বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে
আমাদের জাতিসত্তার একটা সুস্পষ্ট কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নৃতাত্ত্বিক ও আদর্শিক চেতনা
মিশ্র স্বতন্ত্র রূপ ও পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, বাঙালি মুসলমানদের স্বরূপ অন্বেষার ঐকান্তিক আগ্রহ, ভাষা, ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি অর্থনীতিÑ একবাক্য বলা যায় জীবনের পরিপূরক প্রতিটি বিষয় ভিন্ন
ভিন্ন মতবাদের আলোকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে তুলে ধরা হয়েছে। তাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ, অনুভূতি ও বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছে
এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ পে অটল-অবিচল রয়েছে।
কিন্তু
বাস্তবতা হচ্ছে সাংগঠনিক দিক দিয়ে অনিবার্যভাবে এটিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করা
সম্ভব হয়নি। এর জন্য যে মেশিনারির প্রয়োজন-সম্ভব হয়নি তারও বিকাশ ঘটানোর। এ সীমাবদ্ধতাটুকু
স্বীকার করতে হবে নির্দ্বিধায়। আজকের প্রজন্ম বিএনপিকে সেভাবে চেনে না। বিএনপি যে একটি
আদর্শ, একটি চেতনা এটি বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও জানে না। ফলে প্রতিবাদী
কোনো স্পৃহা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে পরিলতি হয় না।
দেশকালের
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে তার নৈতিক ও ধর্মীয়
অনুভূতির পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন মেনে না নেয়া গোঁড়ামি। জিয়াউর রহমান তার বাংলাদেশী
জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
এই অর্থে তিনি একজন সংস্কারবাদী। তার সমাজ ভাবনার মূল প্রতিপাদ্য সমাজসংস্কার।
বাঙালি
মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক মতা লাভের ক্রম পরিবর্তনের কালে জিয়াউর রহমান ঊপস্থাপন
করেছিলেন উদারতন্ত্রের ভাবধারা। তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক
দর্শন। এটি ধর্মান্ধও নয় আবার ধর্মহীনও নয়। সব ধর্ম, ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বীকৃতি
রয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। যার ফলে একটি সুস্পষ্ট চেতনার মাধ্যমে সব ভেদাভেদ ভুলে
সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় সত্যিকারের উন্নয়ন
ও উৎপাদনের রাজনীতি। তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের বদনাম ঘুচিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ পরিণত
হয় সম্ভাবনাময় দেশে।
জাতি অর্থনৈতিক
উন্নয়নের একটি পথ খুঁজে পায় জিয়াউর রহমানের আদর্শিক, উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির মাধ্যমে।
সেই পথ ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। এই পথ থেকে বাংলাদেশকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চলছে
বিরামহীনভাবে। চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে বিএনপিকে ধ্বংস করার। যারা এ
কাজ করছেন, তাদের মনে রাখা উচিত; বিএনপি একটি আদর্শ ও চেতনার নাম।
আর আদর্শ ও চেতনার কোনো ধ্বংস নেই। যারা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আদর্শকে ধ্বংস
করতে চায়, প্রকারান্তরে তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যায়; এর অসংখ্য নজির ইতিহাসে রয়েছে। সুতরাং বিএনপির সব শীর্ষ নেতাকে জেলে বন্দী
করে এবং নেতৃত্ব ধ্বংস করে বিএনপি নামের শব্দটির বিন্দুমাত্র তি করা সম্ভব হবে না।
এটি বেঁচে থাকবে সবার মাঝে।
রাজনীতি
সব সময় এক সমীকরণে চলে না। স্থান-কাল ভেদে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। এ পরিবর্তনের
সাথে খাপখাওয়াতে না পারলে রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়তে হয় নির্দ্বিধায়। বিএনপির এখন প্রয়োজন
রাজপথের সাহসী সংগঠকের, প্রয়োজন নতুন নেতৃত্বের, প্রয়োজন পেশাদার রাজনীতিকের; যারা রাজনীতিতে সার্বণিক সময়
দিতে পারে। কিন্তু গত প্রায় সাত বছর বিরোধী দলে থাকার পরও বিএনপি রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব
তৈরি করতে সমর্থ হয়নি। এটি বিএনপির রাজনীতির জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা।
এর জন্য আন্দোলনে বিএনপি অপূরণীয় তির স্বীকার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তির সম্মুখীন হয়েছেন
মাঠপর্যারের নেতাকর্মীরা। এ তির প্রভাব তাদের প্রতিটি পরিবারে পড়েছে। মামলা-হামলায়
পড়ে ও ব্যবসায়-বাণিজ্য হারিয়ে অনেক পরিবার এখন প্রায় অসহায়। এসবের দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয়
নেতৃত্বের দৃষ্টি দেয়া জরুরি।
চলমান
আন্দোলনে বেশ কিছু টিভি চ্যানেল বিএনপির রাজনীতির অপূরণীয় তি করেছে। তারা পরিকল্পিতভাবে
বিএনপির পিছু নিয়েছে। তাদের টকশো সাজিয়েছে বিএনপির আন্দোলনকে উদ্দেশ করে। এক দিক দিয়ে
টকশো চলেছে, অন্য দিক দিয়ে প্রচার করা হয়েছে জ্বালাও-পোড়াওয়ের দৃশ্য, যেন বার্ন ইউনিট ঢাকা মেডিক্যালে নয়. টিভি সেন্টারগুলোতে; এসব দেখে মনে হয়েছে জ্বালাও-পোড়াও পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে বিএনপির আন্দোলনকে
তিগ্রস্ত করতে। এসবের বিরুদ্ধে বিএনপি তাৎণিক কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
ফলে বিএনপির আন্দোলন হয়ে পড়েছে একপেশে। কাজেই আন্দেলনে সফলতা পেতে হলে মিডিয়ায় প্রাধান্য
থাকা অপরিহার্য। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এখানে কাজ করার মতো লোক বিএনপিকে
তৈরি করতে হবে নিঃসন্দেহে।
আন্দোলন-সংগ্রামে
বিএনপির রয়েছে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস। বিএনপি একটি গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া দল।
জাতীয়তাবাদী আদর্শে বলীয়ান হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
এই আদর্শিক রাজনীতি বিএনপিকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। আদর্শিক চর্চা ছাড়া কোনো রাজনৈতিক
দল টিকে থাকতে পারে না।
বিএনপি
একটি মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী আদর্শিক রাজনৈতিক দল। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও বামপন্থীরা উগ্র রাজনৈতিক দল। এরা রাজনীতির মূল ধারায় চলে আসায় বাংলাদেশের
শান্তি আজ নির্বাসনে। বাংলাদেশ জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুনে। আসছে ধর্ম ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে
আঘাত। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। কাজেই মূল ধারার রাজনীতি থেকে উগ্রপন্থী
দলগুলোকে বিতাড়িত করতে হবে। আর এটি করতে হলে বিএনপিকে আদর্শিক রাজনীতির চর্চা বাড়াতে
হবে।
দৃশ্যত
একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব শক্তিশালী মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি হয়ে যেতে পারেন দুর্বলতম মানুষ। আমাদের
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও অসম্ভবরকম শক্তিশালী মানুষ মনে হয়। তিনি রাজনীতি নিয়ে একতরফা
খেলে যাচ্ছেন অবলীলায়। তার রাজনৈতিক দাপটের কাছে গোটা বিশ্বকে মনে হয়েছে অসহায়। খালেদা
জিয়াকে বালু বোঝাই ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পাইকারি হারে জেলে
নিয়ে তিনি তার মতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীকে। কিন্তু একতরফা নির্বাচন
করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এখন অসহায়। অযাচিত শক্তি প্রয়োগ করে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
আনা তার পে যে অসম্ভব এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হচ্ছে।
দেশে রাজনৈতিক
অচলাবস্থার এখনো চলমান। দলীয় সরকারের অধীনে একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নৈতিক ভিত্তিহীন
তবিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে মতাসীন দল আওয়ামী
লীগ। দেশে-বিদেশে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে আওয়ামী নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা। ফলে অতীতের
যেকোনো সময়ের চেয়ে আওয়ামী রাজনীতির জন্য ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। এটি ভাবলে নিশ্চিত
বোঝা যায়, একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে ফেঁসে গেছে। এখান
থেকে বেরোতে হলে বিএনপির সহযোগিতা আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য। অপরিহার্য নির্দলীয়
সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি পপাতহীন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের। দেশের প্রত্যেকটি নর-নারী যেমন এটি চায়, তেমনি বিশ্ব জনমতও বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প।ে
এ ল্েয
গোটা বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো চায় আগামী
নির্বাচন নিয়ে সব অনিশ্চয়তা দূর হয়ে যাক, সব দলের অংশগ্রহণে একটি পপাতহীন
ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হোক। এ প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে মতাসীন
দলকে। নয়তো গণতন্ত্র তিগ্রস্ত করার দায় নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই।
বাংলাদেশ
তৃতীয় বিশ্বের ুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশ। দেশটি অধিক জনসংখ্যার ভারে ত-বিত। তারপরও
দেশটি দীর্ঘ দুই যুগ গণতন্ত্রের অনুশীলন করছে। এটি বিশ্ববাসীর জন্য একটি অন্যান্য নিদর্শন।
ফলে এ দেশ একটি ‘মডারেট’ গণতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্রেরও খ্যাতি অর্জন করছে।
এসবই সম্ভব হয়েছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত
হওয়ার কারণে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে এটি কোনোভাবেই সম্ভব হতো না, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ দেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলত। যেমনটি
বর্তমান সময়ে হয়েছে। একতরফা নির্বাচনের ফলে বাংলাদেশ এখন সব দিক দিয়ে নিচের দিকে যাচ্ছে।
দেশের
সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা এক কথায় এখন নাজুক। ব্যবসায়-বাণিজ্য বলতে গেলে মুখথুবড়ে পড়েছে।
রাজস্ব ল্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, সরকারের ব্যাংকঋণ বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে। ব্যাংকঋণ বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে
অব্যাহতভাবে। তাতে প্রায় এক যুগ ধরে স্থির থাকা জিডিপি অবধারিত নিচের দিকে নামবে। এটি
দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল হবে না। এটি রোধ করতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছা; যাতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে।
সংসদীয়
গণতন্ত্রের এ দেশে প্রধান বিরোধী দল, যারা কি না দেশের প্রায় অর্ধেক
মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে তারা পার্লামেন্টের বাইরে। তা ছাড়া আরো বহু রাজনৈতিক দল, যারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে, তারাও সংসদের বাইরে। এ অবস্থায়
সংসদ বা সংসদীয় গণতন্ত্র কোনোভাবেই কাজ করতে পারে না। উল্টো গণতন্ত্র মুখথুবড়ে পড়ার
সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই দশম সংসদ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি প্রাসঙ্গিক নয়। যত দ্রুত সম্ভব
এ সংসদ বাতিল করে সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে পপাতহীন নির্বাচনে একাদশ
সংসদ গঠন করাই সমীচীন। তাতে গণতন্ত্র যেমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে, তেমনি এগিয়ে যাবে দেশও; বাংলাদেশের সুনামও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বহির্বিশ্বে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন