গত ০২.০২.১৪ ইং তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বর্ধিত ফি প্রত্যাহার ও বিভিন্ন বিভাগে চালুকৃত সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারীদের নাম জাতীয় সবক’টি দৈনিকে ছবিসহ ছাপানো হয়েছে। এমনকি ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়াতেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হয়। প্রথম আলোর তথ্য মতে, রোববার সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলাকারী অস্ত্রধারী ৬ জনই ছিল রাবি ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল। তারা হচ্ছে- নাসিম আহাম্মেদ (রাবি কমিটির যুগ্ম সম্পাদক), শামসুজ্জামান ও ফয়সাল আহাম্মেদ (সাংগঠনিক সম্পাদক), মুস্তাকিম বিল্লাহ (পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক), সুদীপ্ত সালাম (বিগত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক) ও আনোয়ার ইসলাম ওরফে শুভ্র (উপপ্রচার সম্পাদক)। দেশের অধিকাংশ ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া সমূহে হামলাকারীদের ছবি, নাম, দলীয় পরিচয় ও পদবীসহ প্রকাশিত হওয়ায় কারোর পক্ষে এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে এরা কারা?
ভিসি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর তিনিই জিম্মাদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবপথ রুদ্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা ভিসির কাছে আশ্রয় নেয় সমস্যা সমাধানের জন্য। অথচ রাবি ভিসি কোনো তদন্ত ছাড়াই ঘটনাটি শিবির ঘটিয়েছে বলে ঘোষণা দিলেন তবে অস্ত্রধারী কারা সেই প্রশ্ন যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলেন।
৫.২.১৪ ইং তারিখের প্রথম আলোর তথ্য মতে, রোববারের ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক দায়ের করা ৪টি মামলার কোনোটিতেই অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ নেতাদের কারো নাম না থাকলেও আসামী করা হয়েছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট তথা রাবি ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শনস্বরূপ (!) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৪০-৫০ লাখ টাকার ক্ষতির কারণ দেখিয়ে এবং প্রশাসনিক দৃষ্টান্তহীন শৃঙ্খলা বিধানের নজির স্বরূপ (!) পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক পূর্বোল্লিখিতদের সাথে অজ্ঞাতনামা আরো ৩০০ জনকে আসামী করা হলেও অস্ত্রধারী কাউকে মামলায় রাখা হয়নি। হায় এ কেমন দেশপ্রেম! বরং পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ নেতারাই উল্টো ছাত্রশিবিরের ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৬০-৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। যদিও ঐ ঘটনায় শিবিরের উপস্থিতি কোন পত্রিকা তথ্য দিয়ে প্রকাশ করতে পারেনি। অবশ্য সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ৫.২.১৪ তারিখ বিকেলে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সহ-সভাপতি ও মাদার বকশ হল শাখার সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ডিলসকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু একটি আশংকা থেকেই গেল। হত্যা, সংঘর্ষ, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, অস্ত্র প্রদর্শন, শিক্ষক, সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করার দায়ে গত ৫ বছরে রাবি শাখা ছাত্রলীগের অন্তত ৩০ নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করার পরও কিছুদিনের মধ্যেই যখন অধিকাংশ নেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল তুহিন, সাংগঠনিক সম্পাদক কৌশিক এবং রোববারের ঘটনায় বহিষ্কৃত নাসিম আহাম্মেদ সেতুকে আরো একবার বহিষ্কার করার পর দলে ফিরিয়ে এনে আবার সেই একই অপরাধ করার পর নাটকীয়ভাবে দ্বিতীয়বার বহিষ্কার করা হলো। জাবি মেধাবী ছাত্র জোবায়েরকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্র নামের সন্ত্রাসীরা যখন এখনো চোখের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন দেলোয়ার হোসেন ডিলসকে গ্রেফতারে কী বা আশা করা যায়! যারা প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের কাউকে গ্রেফতার না করে গ্রেফতার করা হলো এমন একজনকে যার হাতে অস্ত্র ছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। হয়ত দেশবাসী আরেকটি ডিজিটাল নাটক দেখতে পাবে।
পত্রিকাগুলো যেখানে তথ্য দিল যে, আন্দোলনকারীরা ছিল সাধারণ শিক্ষার্থী। দাবি আদায়ে খুশি হয়ে বিজয় মিছিল করলে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই করার কথা। কিন্তু তারা তো সন্তুষ্ট হয়নি। তাদের আরো দাবি ছিল। তবে ছাত্রলীগ বিজয় মিছিল করার কে? ওরা তো ওই আন্দোলনে শরিক ছিল না। আর ৪.২.১৪ ইং তারিখে সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই বা কেন দাবি করলেন যে, বর্ধিত ফি বাতিল হওয়ায় ছাত্রলীগ বিজয় মিছিল করছিল? সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক না থাকলে তারা বিজয় মিছিল করলো কার স্বার্থে? তাহলে ছাত্রলীগ কার স্বার্থে রাজনীতি করে? ওদের সাথে কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনোই সম্পর্ক নেই? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অস্ত্রধারীরা সবাই ছাত্রলীগ নয়। অর্থাৎ তিনি স্বীকার করেছেন যে, তাদের কয়েকজন ছাত্রলীগের। যদিও প্রথম আলোসহ অধিকাংশ মিডিয়ার তথ্য মতে, অস্ত্রধারী ৬ জনই ছিল ছাত্রলীগের। যদি প্রথম আলোর তথ্য ভুল হয় তবে সরকারের দাবি মতে ভুল তথ্য পরিবেশনের দায়ে দৈনিক ইনকিলাব বন্ধ হলে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করারও সাহস দেখালেন না কেন? প্রধানমন্ত্রী বিশ্বজিতের খুনিদের বিচার করার উদাহরণ দিয়ে ক্রেডিট কুড়ালেও তিনিই বিশ্বজিতের খুনিদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওরা ছাত্রলীগের কেউই নয়’। কিন্তু সময়ের আবর্তনে প্রমাণিত হয়েছে বিশ্বজিতের খুনিরা ছাত্রলীগেরই ক্যাডার। এবারও হয়তো তাই হবে। সেই আশাই করি।
প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, অস্ত্রধারী ছাত্রলীগদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা হলো- নাসিম আহাম্মেদ ও শামসুজ্জামান। কিন্তু বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক ফারুক ওয়াসিফ আশংকা করে বলেছেন, বৈধভাবে মাত্র ৩ মাস আগে দেশে আসা ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দামের ‘বেরেটা টমক্যাট’ ব্র্যান্ডের ডিজিটাল পিস্তলটি চালাতো ঠনঠনে হওয়ায় তাকে বহিষ্কার করা হতে পারে। রাবি ভিসির দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য, রাবি ও পুলিশ প্রশাসন এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যেন কেমন একটি মিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা না ভেবে ওরা যখন ছাত্রলীগ রক্ষায় মেতে উঠেছেন, তখন সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারে ঐ ঘটনার মূল হোতা ছাত্রলীগ আর তাদের প্রশ্রয়দাতা রাবি ভিসি, পুলিশ প্রশাসন আর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। তাই সাধারণ শিক্ষার্থী ও খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি আহ্বান, সব ঘটনায় কোনো তদন্ত ছাড়াই শুধু শিবিরের উপর দোষ চাপিয়ে যারা নিজেদের কুকর্মকে আড়াল করে চোখের অন্তরালে ডন সেজে বসে আছে এদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সব ঘটনায় শুধু শিবির শিবির আর শুনতে ইচ্ছে করে না। একটি স্বাধীন-গণতান্ত্রিক দেশ এভাবে চলতে পারে না। শিবির হলে তাদেরকে তদন্ত করে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করা হোক। কিন্তু শিবির বলেই দায়িত্ব শেষ করা জনগণ আর মেনে নেবে না। প্রকৃত সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করে তাকে বিচারের মুখোমুখী করতেই হবে। এটি আজ গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। আর কত মায়ের বুক খালি হবে? প্লিজ আর নয়। অনেক হয়েছে। এবার একটু থামুন। নচেৎ জেনে রাখুন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সীমা লঙ্ঘনকারীরা একটু বেশি দিন রাজত্ব করে বটে, তবে নিশ্চিহ্ন হয় চিরতরে। অন্তত নিজেদের স্বার্থে হলেও এবার থামুন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন