রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

প্রকাশ্যেই টাকা চাইলেন তিনি!


অতিক্ষমতা বোধ হয় মানুষকে দাম্ভিক ও বেপরোয়া করে তোলে। অনেক সময় কা-জ্ঞানও হরণ করে নেয়। না হলে গণসংবর্ধনায় প্রদত্ত বক্তব্যে জাতীয় সংসদের চিফ হুইফ আ স ম ফিরোজ কেন বলতে যাবেন, ‘যদি কেউর উপঢৌকন দেয়ার ইচ্ছা থাকে, তবে আর এই ক্রেস্ট না। ক্যাশ (নগদ অর্থ) চাই, ক্যাশ।’ গত শুক্রবার বিকালে তার নির্বাচনী এলাকা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা সদরের পাবলিক মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে চিফ হুইপকে প্রদত্ত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি স্থানীয় ক্যাবল অপারেটরের মাধ্যমে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। কয়েক হাজার জনতার উপস্থিতিতে দেয়া বক্তৃতায় চিফ হুইপের এভাবে টাকা চাওয়ার ঘটনাটি দলের নেতা-কর্মীসহ স্থানীয় মানুষের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
আমরা জানি, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপের পদটি একটি গরুত্বপূর্ণ পদ। তিনি তো জাতীয় সংসদে প্রধান সচেতকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। এমন একজন সচেতক যখন গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তখন তো তিনি সচেতনভাবেই বক্তব্য রাখার কথা। তাই প্রশ্ন জাগে, তিনি কি প্রকাশ্যে জনগণের সামনে সচেতনভাবেই উপঢৌকন হিসেবে ভক্তদের কাছে টাকা চাইলেন? এভাবে কি টাকা চাওয়া যায়? আর ক্ষমতাধরদের যখন ভক্তরা উপঢৌকন হিসেবে অর্থপ্রদান করবে, তার বিনিময়ে তো তারা কিছু চাইবে। এভাবেই আমাদের ক্ষমতাধররা সত্য ও ন্যায়ের বদলে অনুরাগ ও বিরাগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন। আমাদের দেশে দুর্নীতি বিস্তারের এটাও একটা কারণ। টেলিভিশনে চিফ হুইপের টাকা চাওয়ার বক্তব্য শুনে অনেকেই হতবাক হয়ে যান। রাস্তায় তোরণ ও যুবকরা একে অন্যকে দেখলে, ‘ক্যাশ চাই ক্যাশ’ বলে হাস্যরস করছেন। জাকির হোসেন নামে বাউফল পৌরসভার এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এইডাও দেশ। চিফ হুইপেও মাইকে টাহা চায়’। জানি না চিফ হুইপের এমন বক্তব্যে সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের মাথা হেঁট হয়েছে কি না, কিন্তু এতে জাতির মাথা হেঁট হয়েছে। কারণ, যিনি এভাবে প্রকাশ্যে টাকা ভেট চেয়েছেন তিনি আমাদের জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিরোধী দলবিহীন ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আরোহন করে যেন সরকারি দলের কর্তাব্যক্তিরা একটু বেসামাল হয়ে পড়েছেন। তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। অনেকেই যেন সৌজন্যতা ও চক্ষুলজ্জারও মাথা খেয়ে বসে আছেন। তারা যেন বিরোধীদলসহ পুরো জাতিকেই এই বার্তাটি দিতে চাইছেন যে, আইন-আদালত, পুলিশ-প্রশাসন, সংসদ সবাই তো আমাদের হাতের মুঠোয়। এমন কে আছে যে আমাদের গায়ে আঁচড় দেবে। অতএব এখন তারা যা খুশি তাই বলছেন, যা ইচ্ছে তাই করছেন। এ জন্যই হয়তো বিজ্ঞজনরা বলে গেছেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতিকেই ডেকে আনে।
চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজকে যেভাবে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে তাও উল্লেখ করার মতো। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে তৈরি করা হয় দেড় শতাধিক তোরণ। উপজেলার বগা লঞ্চঘাট এলাকা থেকে কালাইয়া বন্দর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার সড়ক সাজানো হয়েছে নানা রঙের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে। এছাড়া তাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় শিক্ষার্থীদের। অথচ আমরা জানি রাস্তায় শিক্ষার্থীদের দাঁড় করিয়ে সংবর্ধনা দেয়ার বিষয়টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মাত্র ক’দিন আগেও ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সংবর্ধনা দেয়ার নিন্দা জানানো হয়েছে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কাউকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করানো যাবে না। এরপরও চিফ হুইপ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সংবর্ধনা গ্রহণ করলেন। তাই প্রশ্ন জাগে, প্রশ্নবিদ্ধ এই সরকার ও সংসদ দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আদৌ কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হবে কি? এবার যেভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে সরকারি দলের কর্তাব্যক্তিদের সংবর্ধনা গ্রহণের ক্ষেত্রে কি কিছুটা লজ্জাবোধ হয় না? এ ক্ষেত্রে নৈতিক চেতনার কথাও উল্লেখ করা যায়, তবে এটা একটু উচ্চতর বিষয়। কিন্তু কোন কা-জ্ঞানে চিফ হুইপকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য দেড় শতাধিক তোরণ নির্মাণ করা হয়? ১৫ কিলোমিটার সড়ক নানা রঙের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে সজ্জিত করা হয়? এত অপচয় কেন? আর এই অর্থ কারা জোগায়, কোত্থেকে আসে? এসব সংবর্ধনার মূলে গেলে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের রহস্যগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এই রহস্য উদঘাটনে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তেমন উৎসাহী নন। অথচ এরাই আবার দুর্নীতি নির্মূলের স্লোগানে উচ্চকণ্ঠ। জানি না, আমাদের দেশে গড়মিলের এই রাজনীতি কখন বন্ধ হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads