ভাষাআন্দোলন আমাদের গৌরবের বিষয়। ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে খুব একটা নেই। ভাষাআন্দোলনের সিঁড়ি বেয়েই আমরা যেমন একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারের স্বীকৃতি অর্জন করেছি, তেমনই একটি সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলা শুধু আমাদের রাষ্ট্রভাষাই নয়, এটি এখন আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবেও গণ্য। বাংলাভাষা আন্দোলনের এ মাসে সাইনবোর্ড, নামফলক, নম্বরপ্লেট ইত্যাদি বাংলায় লিখতে হবেÑ এমন একটি নির্দেশ জারি করেছেন আমাদের হাইকোর্ট।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইনসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও সংস্কৃতিসচিবকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে অগ্রগতি রিপোর্ট ১ এপ্রিল আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের ডিভিশনাল বেঞ্চ থেকে গত সোমবার এ আদেশ দেয়া হয়। এছাড়া সর্বক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলাভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপগ্রহণে সরকারকে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
উল্লেখ্য, বাংলাভাষা প্রচলন আইন প্রণয়নের দীর্ঘ ২৭ বছর পার হয়ে যাবার পরও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। রিটে বলা হয়, ১৯৮৭ সালের মার্চে পাস হওয়া আইনানুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছাড়া অন্য সবক্ষেত্রে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে হবে। নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। উল্লেখিত কোনও কর্মস্থলে যদি কেউ বাংলাভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। যদি কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ আইন অমান্য করেন তাহলে ওই কাজের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিলবিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে ধরা হবে এবং তার বিরুদ্ধে বিধি অনুসারে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। রিটে আরও বলা হয়, আইনটি প্রণয়নের এতদিন পরও সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা তা ঢালাওভাবে অমান্য করে যাচ্ছেন। এমনকি সরকারের মন্ত্রীরাও নথিপত্রে মন্তব্য ও স্বাক্ষর ইংরেজিতে লেখেন। তাই আইনটি বাস্তবায়নে উচ্চ আদালতের আদেশ প্রয়োজন। আদালতে রিটের পক্ষে এডভোকেট ইউনুস আলী আকন্দ এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি এটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায় শুনানি করেন। বাংলাভাষা ব্যবহারের পক্ষে রিটকারী আইনজীবীর মহৎ উদ্যোগ ও মহামান্য আদালতের আদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। এ আদেশ কার্যকর হলে বাংলাভাষার যেমন মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে, তেমনই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ ও আগ্রহ শানিত হবে।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হলেও এর প্রতি আমাদের নানা অবহেলা আর উপেক্ষা বিদ্যমান। বিশেষত বাংলাভাষার ব্যবহার ও চর্চায় আমাদের ঔদাসীন্য খুবই দুঃখজনক। ফলে এর ব্যবহার ও চর্চায় সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান। সাইনবোর্ড, নামফলক প্রভৃতির যেগুলোতে বাংলা ব্যবহার করা হয় তার ভুল যে কত বড় মারাত্মক ও বিভ্রান্তিকর তা চিন্তা করলে দুঃখ এবং মর্মবেদনার অবধি থাকে না। শুধু সাইনবোর্ড বা নামফলকের কথাইবা বলি কেন। অনেক বড় বড় লেখকের বিখ্যাত বিখ্যাত বইপুস্তকেও বাংলা বানান ও ভাষাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি ভাষাপ্রেমিকদের ব্যথিত এবং মর্মাহত করে অহরহ। শুধু এদেশের বাংলাভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর বানানপদ্ধতি ও ভাষার ভুল ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করলে বড় বড় গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন হয়ে পড়বে। শুধু কি তাই? সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাঠ্যপুস্তকেও বহু ভুল চালু আছে, যেগুলো শুধরানো অতীব জরুরি। বিশেষত পাঠ্যপুস্তকে বাংলাভাষার ভুল ব্যবহার তরুণ শিক্ষার্থীদের মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত করে তোলে। বাংলাভাষার ব্যবহার ও চর্চার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে না পারলে মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের যে গৌরব এখনও বিদ্যমান তা অনেকটা অসার হয়ে পড়বে অদূর ভবিষ্যতে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি, শিক্ষাবোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের জরুরি পদপেক্ষ নেয়া প্রয়োজন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন