আবারও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- যেমন ঘটেছে, তেমনি জোর দাবি উঠেছে বিনাবিচারে হত্যাকা- বন্ধ করার এবং সরকারের প্রতি আইনসম্মত পথে ফিরে আসার দাবিও। এমন অবস্থার কারণ হিসেবে প্রাধান্যে এসেছে সর্বশেষ চারটি হত্যাকা- এবং একটি গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট। প্রথম খবর হলো, দেশে-বিদেশে তীব্র নিন্দা-সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখেও গত শনিবার আরও চারটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে। সেদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে প্রকাশ্য দিবালোকে নিহত হয়েছে দু’জন যুবক। পুলিশ যথারীতি তাদের চিহ্নিত আসামী হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, দুই যুবক নাকি পুলিশের গ্রেফতার চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে! ওদিকে সিরাজগঞ্জে জাহাঙ্গীর নামের বিএনপির এক সক্রিয় কর্মীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তার লাশ পাওয়া গেছে কামারখন্দ উপজেলা ঝাঐল ওভারব্রিজের পাশের রাস্তায়। বলা হচ্ছে, এই বিএনপি কর্মীকেও ক্রসফায়ারেই হত্যা করা হয়েছে। কারা করেছে, সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই মানুষের মনে। ওদিকে শনিবারই বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ‘বাংলাদেশ ২০১৩ : সুশাসন প্রবণতা ও ধারণাসমূহ’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে জানানো হয়েছে, বেআইনিভাবে তথা বিনাবিচারে মানুষ হত্যার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, গণধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধই অনেক বেড়ে গেছে। এখনও বেড়ে চলেছে প্রতিদিন। কিন্তু কোনো একটি অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেই সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো সাফল্য দেখাতে পারছে না। আর এই না পারার প্রধান কারণ, র্যাব ও পুলিশের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করছে। বিষয়টি এরই মধ্যে অনেক হত্যাকা-ের মধ্যদিয়ে প্রমাণিতও হয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে সবমিলিয়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন দেশের ভেতরে রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট পর্যন্ত তীব্র নিন্দা জানিয়ে এই হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোও প্রতিদিন হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবারও এক সমাবেশে অভিযোগ করেছেন, সরকার বেছে বেছে বিএনপির সেইসব নেতা-কর্মীকে হত্যা করছে, নিকট অতীতে যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন এবং আগামীতেও যাদের নেতৃত্ব দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। জামায়াতের পক্ষ থেকেও নিয়মিতভাবে একই ধরনের অভিযোগ ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নয়, সাধারণ মানুষও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কারণ হত্যাকা-ের শিকার যারা হচ্ছেন, তারা সাধারণ মানুষেরই কারো না কারো ভাই বা সন্তান। অন্যদিকে কোনো দল বা মহলের প্রতিবাদেই কান দিচ্ছে না সরকার। প্রায় প্রতিদিনই ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ও বন্দুকযুদ্ধ ধরনের নানা নামের আড়ালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চালাচ্ছে র্যাব ও পুলিশ। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে জনগণ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করায় এবং দেশে-বিদেশে এই নির্বাচন ও সরকার গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষমতাসীনরা গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর পন্থা বেছে নিয়েছেন। হত্যাকা-গুলোর পর্যালোচনায়ও এ সত্যই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সব হত্যাকা-ের পর পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে একই ভাষায় জানানো হচ্ছে, আসামী ধরতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল বলেই তারা নাকি ‘বাধ্য হয়ে’ গুলি ছুঁড়েছে এবং এতেই মৃত্যু ঘটেছে ওই নেতা-কর্মীদের! বলা বাহুল্য কাহিনী চমৎকার হলেও সাধারণ মানুষকে মোটেও বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। বাস্তবে জনগণের বরং ১৯৭২-৭৫ সময়কালের তথা মুজিব আমলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। র্যাব ও পুলিশের ব্যাখ্যার চাইতে তারা বেগম খালেদা জিয়ার একটি কথাকেই বেশি বাস্তবসম্মত মনে করছে। উল্লেখ্য, বেগম জিয়া সম্প্রতি বলেছেন, মুজিব আমলের মতো বর্তমান সরকারও দেশপ্রেমিক ছাত্র-যুবকদের নির্মূল করে ফেলার ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। ঘটনাপ্রবাহেও সেটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমে র্যাব, পুলিশ বা সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা বেছে বেছে বিএনপি ও জামায়াতের এমন সব নেতা-কর্মীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে যারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তারপর দু-একদিন পর্যন্ত এসব নেতা-কর্মীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবশেষে পাওয়া যাচ্ছে তাদের লাশ। সব গুম ও হত্যাকা-ের সঙ্গেই পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম জড়িয়ে পড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির রিপোর্টেও একই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, সরকার নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য র্যাব ও পুলিশের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করছে। আমরাও মনে করি, শুনতে অতি কঠোর মনে হলেও গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আসলেও এমন কোনো এলাকার কথা বলা যাবে না, যেখানে বিএনপি-জামায়াত এবং দল দুটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা গুপ্তহত্যার শিকার না হচ্ছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিরোধিতা ও আন্দোলন দমনের জন্য ঢালাও মামলা ও গ্রেফতারের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারেও সরকার সমানতালে এগিয়ে চলেছে। অথচ গণতন্ত্রে তথা সাংবিধানিক শাসনের অধীনে কোনো সরকার এতটা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চালাতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার হত্যাকা- চালাচ্ছে দিনের পর দিন ধরে। শুধু তাই নয়, সরকার পুলিশ ও র্যাবকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যার কাজে ব্যবহার করছে। বিষয়টি এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, মার্কিন সিনেট থেকে শুরু করে দেশের ভেতরে পিপিআরসির মতো বেসরকারি গবেষণা সংস্থাও একই তথ্য তুুলে ধরেছে। সুতরাং সরকারের পক্ষে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। সরকারের উচিত অবিলম্বে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করা এবং আইনসম্মত পথে ফিরে আসা। যত বড় খুনি, সন্ত্রাসী বা অপরাধীই হোক না কেন, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে এবং আইনানুযায়ী বিচারের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন