রাষ্ট্রের জনপ্রশাসন নিয়ে নতুন পর্যায়ে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, পদোন্নতি দেয়া নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চতুর্মুখী চাপে পড়েছে। কারণ, পদ শূন্য না থাকলেও পদোন্নতি পাওয়ার জন্য যোগ্য কর্মকর্তাদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে তাদের চাপও। এতদিন ধরে যে কয়েকশ’জন পদোন্নতি বঞ্চিত রয়েছেন তাদের বাইরেও সম্প্রতি তিনশয়ের বেশি কর্মকর্তা সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এদের বড় অংশ ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ ব্যাচের। ওদিকে দু’বছর আগে থেকেই যুগ্ম-সচিব পদের জন্য যোগ্যতা অর্জন করে অপেক্ষায় রয়েছেন নবম ও দশম ব্যাচের প্রায় তিনশ কর্মকর্তা। পাশাপাশি রয়েছেন বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি বঞ্চিত আরও কয়েকশ কর্মকর্তা। এভাবে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত প্রতিটি পদে পদোন্নতি দেয়া না দেয়া নিয়ে রীতিমতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ওদিকে মাঠ পর্যায়ে সহকারী কমিশনারের অনেক পদও বেশ কিছুদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, পদোন্নতি পেতে পেতে সবাই শুধু ওপরের দিকেই উঠে যাচ্ছেন। নিচের দিকে শূন্য পদ পূরণের জন্য নিয়মিতভাবে বিসিএস পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও একদিকে তা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না অন্যদিকে মাঝেমধ্যে হলেও দলবাজির পাশাপাশি কোটা ধরনের সমস্যার কারণে ফলাফল অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে। কখনো কখনো আবার গোপন আয়োজনে নিযুক্তি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতেও সব শূন্য পদ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আপত্তির অন্য একটি কারণ হলো, বর্তমান সরকারের আমলে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেয়া এক বিচিত্র রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে একজন উপসচিব যুগ্মসচিব হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু পদ না থাকায় হয় তাকে আগের মতো উপসচিবের দায়িত্বই পালন করতে হচ্ছে, না হলে তাকে ওএসডি বানিয়ে বসিয়ে রাখছে সরকার। ওদিকে কাজ উপসচিবের করলেও বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার সবই তাকে যুগ্মসচিবেরই দিতে হচ্ছে। অথচ ২০০২ সালে সংশোধিত চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী পদ না থাকলে বা পদ সৃষ্টি না করা হলে ওই পদের জন্য পদোন্নতি দেয়া যায় না। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করার পর থেকেই আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক দলবাজি শুরু করেছে। একযোগে চলেছে প্রশাসনকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজানোর কর্মকা-ও। সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও নিযুক্তি দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে।
এভাবে নগ্ন দলবাজি করতে গিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার জনপ্রশাসনকে তছনছ করে ফেলেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও নিযুক্তি দিয়ে চলেছে সরকার। বিপরীতভাবে সরকার সমর্থক না হওয়ার কারণে অনেককে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে, এখনো চাকরি হারাচ্ছেন অনেকে। তাদের সংখ্যা দু’ হাজারের ওপরে পৌঁছে গেছে। লজ্জা, দুঃখ ও অপমানে অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকুক না থাকুক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক অফিসাররা পদোন্নতি ও আকর্ষণীয় বিভিন্ন পদে নিযুক্তি পেয়েছেন, এখনো পাচ্ছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর ও বিভাগের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে তাদের। তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকতার দোহাই দিয়ে ধর্মীয় পরিচিতিকেও প্রাধান্য দিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে তো বটেই, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বেছে বেছে বিশেষ ধর্মের লোকজনকেই বসানো হয়েছে। এর ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুসলমান অফিসারদের মধ্যেও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে। দৃঢ়মূল হচ্ছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকড়। এর পাশাপাশি চাকরিচ্যুত ও ওএসডি করার এবং বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ফলেও প্রশাসনে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। কোনো পর্যায়ের কোনো অফিসারের পক্ষেই নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য অবশ্য খুবই স্পষ্ট। তারা এমনভাবে প্রশাসনকে সাজাতে চাচ্ছেন যাতে আগামী দিনের সব জাতীয় নির্বাচনেই ‘কৃতজ্ঞ’ দলীয় আমলাদের সহযোগিতায় তারা সহজে জিতে আসতে পারেন। কিন্তু আপত্তি উঠেছে জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে। জনপ্রশাসনকে ল-ভ- করে ফেলার মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা প্রকৃতপক্ষে দেশকেই সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আমরা প্রশাসন আওয়ামীকরণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই। আমাদের দাবি, পদোন্নতি দিতে হবে মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটির ভিত্তিতে। কোনো দলবিশেষের প্রতি নয়, কর্মকর্তাদের আনুগত্য থাকতে হবে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন