বাংলাদেশের নির্বাচন তো হয়ে গেলো। এবার হবে ভারতের নির্বাচন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী সাম্প্রদায়িক ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি’র নেতা নরেন্দ্র মোদী। একদা যাকে মুসলিম হত্যার জন্য আমেরিকা ভিসা দেয়নি, তার সঙ্গেই এখন মাখামাখির চেষ্টা চলছে। আবারও প্রমাণ হয়েছে একচক্ষুবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক নীতির। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহের আলোকে।
দীর্ঘ ন’বছর পরে আমেরিকা ও নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে চলেছে। ওয়াশিংটনের নির্দেশে খুব শীঘ্রই বিজেপি’র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করতে চলেছেন এদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল। বরফ গলানোর চেষ্টা তলে তলে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল। দিল্লীর মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কাছে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের অনুমতি চাওয়া হয়। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী কোনও দেশের সরকারি প্রতিনিধি কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বিদেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র নেয়া ভারতে বাধ্যতামূলক। পাওয়েল এবং বিদেশ সচিব থাকাকালীন হিলারি ক্লিন্টন যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখনও তাঁদের বিদেশ মন্ত্রকের অনুমতি নিতে হয়েছিল। সম্প্রতি ভারত যুক্তরাষ্ট্রে তাদের দূত দেবযানীর ব্যাপারেও জোরালো ভূমিকা নেয়। আঞ্চলিক শক্তিরূপে নিজের প্রভাব প্রদর্শনে প্রকাশ্য বা গোপনে ভারত পিছপা হয় না। আঞ্চলিক রাজনীতিতে কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রেও ভারতের রাখ-ঢাক নেই।
মিডিয়া সূত্রে প্রকাশ, মোদী-পাওয়েল বৈঠকের ছাড়পত্র মিলেছে। ভোটযুদ্ধে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে মোদীর যতই বিরোধ থাক বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেসের যতই টক্কর থাক বিজেপি’র সঙ্গে, বিদেশ মন্ত্রক এ বিষয়ে রাজনীতিকে কোনও রকম জায়গা দেয়নি। আর বিদেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পেয়েই মার্কিন দূতাবাস গুজরাত সরকারকে জানিয়েছে, তারা এই মাসেই বৈঠকটি করতে চাইছে। যদি মোদীর অসুবিধা না হয়, তা হলে ন্যান্সি পাওয়েল আগামীকাল ১৫ তারিখ গাঁধীনগরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক। এ মাসেরই শেষ সপ্তাহেই নির্বাচন কমিশন ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। তখন নির্বাচনী বিধি কার্যকর হয়ে যাবে। তার আগেই মোদীর সঙ্গে দেখা করতে চান ন্যান্সি। যে আসন্ন সাক্ষাৎকার সব অর্থেই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, মোদীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদ সুবিদিত। গোধরা-পরবর্তী সংঘর্ষ হয়েছিল ২০০২ সালে। এতে প্রচুর মুসলমানকে হত্যা করা হয়। আর এজন্য ২০০৫ সালে আমেরিকা মোদীর ভিসা নাকচ করে। মার্কিন বিদেশ দফতর বারবার বলেছে, তারা মোদীকে ভিসা দিতে তৈরি নয়। এমনকি, তাঁর বিরুদ্ধে গুজরাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও তোলে তারা। এ ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গী হয় ব্রিটেনও। তারপর ৯ বছরে কূটনীতিতে অনেক জল রয়ে গিয়েছে। আমেরিকা যাতে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে, সে জন্য প্রচুর আবেদন জমা পড়েছে। অন্যদিকে, চাপ বেড়েছে মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী ও কূটনৈতিক স্তরেও।
এতদিন মোদীর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর অনুষ্ঠানে জাপান বা ইউরোপের দেশগুলো এলেও আমেরিকার কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি থাকতেন না। জাপান প্রথম থেকেই মোদীকে নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ রাখেনি। তাই এ দেশে তাদের সব বেশ লগ্নি গুজরাতে। মোদীর রাজ্যে তারা চুটিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকার সংস্থাগুলো সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। আর্থিক মন্দার যুগে যা তাদের অস্বস্তির কারণ। তারপর মোদী যদি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তা হলে কী হবে, সেটা নিয়েও জল্পনা কম ছিল না। অনেকেই প্রশ্ন তুলছিলেন, সে ক্ষেত্রে কি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে ইউরোপ-আমেরিকা। তা কি আদৌ সম্ভব!
এই পরিস্থিতিতে কিছুদিন আগে ইউরোপীয় দেশের রাষ্ট্রদূতেরা বৈঠক করেন। ইতালি, গ্রিস, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশগুলির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও সেই বৈঠকে সামিল হয়। তাদের বক্তব্য ছিল ব্রিটেন এবং আমেরিকাকে বিষয়টি বোঝানো উচিত, যাতে মোদীর ব্যাপারে তারা অবস্থান বদল করে। ইউরোপের রাষ্ট্রদূতদের একটি দল এর পরে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করে। যার ফল, সম্প্রতি গাঁধীনগরে মোদীর সঙ্গে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের বৈঠক। এর পর সমবেত চাপ তৈরি হয় আমেরিকার উপরেও। যদিও মাঝে ভারতের ১৫টি দলের সংসদীয় প্রতিনিধিরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন, মোদীকে নিয়ে অবস্থান বদলাবেন না। অন্যদিকে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীও কিন্তু কূটনৈতিক স্তরে এবং বিজেপি’র তরফে চাপ বাড়াতে থাকে। আমেরিকা সফরের সময়ে বিজেপি-সভাপতি রাজনাথ সিংহ জানিয়ে আসেন, মোদীকে ভিসা না-দেয়া অন্যায়। আবার দলের আর এক শীর্ষ নেতা অরুণ জেটলিও বিভিন্ন কূটনৈতিক নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালান। সদ্য বিজেপিতে যোগ দেয়া রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রাক্তন প্রতিনিধি হরদীপ পুরীও এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সম্প্রতি বিজেপি’র পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে দিলীøতে মোদীর জনসভায় আসার জন্য ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বলা হয়, আমেরিকা ভিসা দিক বা না দিক, বিজেপি ন্যান্সিকে জনসভায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। দিল্লীর বিজেপি’র মুখপাত্র বিজেন্দ্র গুপ্ত বলেন, জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, চীনসহ একশোটা দেশের রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। পাওয়েলের ক্ষেত্রেও একই সৌজন্য দেখানো হয়েছে। অভিজ্ঞ মহল জানাচ্ছেন যে, আসল ঘটনা হল, মার্কিন কূটনীতিকরাও ভিতরে ভিতরে বরফ গলাতেই চাইছিলেন। তাঁরা বলছেন, সাম্প্রদায়িকতা বা মানবাধিকারের প্রশ্নে অবস্থান যা-ই হোক না কেন,অন্যকোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানোটা কখনওই আমেরিকার লক্ষ্য নয়। কাজেই ভারতের নির্বাচনে কোন দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে হবেন, তা নিয়ে তাদের কোনও মতামত থাকতে পারে না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যে নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে যা খুশি তা-ই করতে পারে, এমন নজির বিশ্বের দেশে দেশে অসংখ্য। কিন্তু ভারত যে মোদীকে নিয়ে এগুচ্ছে, তার পক্ষে কি জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ বিভেদে আকীর্ণ দেশটির মূলস্রোতের মানুষদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা আদৌ সম্ভব? উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। অরুণাচল প্রদেশ থেকে রাজধানী দিল্লিতে পড়তে আসা প্রথম বর্ষের এক কলেজ ছাত্রকে যে ভাবে লাজপত নগরে পিটিয়ে মারা হয়েছে তা দেখে এই ধারণা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আজও উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগোষ্ঠীর প্রতি তথাকথিত ‘মূলস্রোত’-এর ভারতীয় মানসিকতা বড় তীব্র ভাবেই বিরূপ। (মুসলমান বা অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ভারতের মূলস্রোত তথা হিন্দু সমাজের মনোভাব ও হিংসাত্মক আচরণও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।) ভারতীয় জাতীয়তার চেতনায় উত্তর-পূর্বের মঙ্গোলয়েড জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক আত্তিকরণ হয়নি। প্রান্তিক আঞ্চলিক সত্তাকে তথাকথিত জাতীয়তা উদার মনে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।
আসলে বহু যুগ, বহু বছর ধরে প্রান্তিক্র নি¤œবর্গের মানুষের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করে তার উপর স্টিম রোলার চালিয়ে এক শক্তিশালী ভারত গঠনের কথা বলা হয়েছে। মানুষ বিদ্রোহ করেছে দিল্লির বিরুদ্ধে, আজও যেমন করছে। ১৬৮০-’৮৫ সালে গুজরাতের মাতিয়া নামক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ শুরু হয়। এর পিছনে প্রতিবাদী ধর্র্মের প্রভাব কাজ করলেও এর কারণ কিন্তু ছিল আর্থ-সামাজিক। গুজরাতের কোলি কৃষক সম্প্রদায় থেকে বর্তমান অমেঠী এলাকায় ১৬৭০-’৮০ সালে কুর্মি কৃষক বিদ্রোহ হয়। মথুরায় আঞ্চলিক জমিদার বা জাঠেদের বিদ্রোহ হয়। খটক নামে এক আফগান উপজাতির বিদ্রোহও উল্লেখযোগ্য। এখন উত্তর-পূর্ব ভারতের ভেতরে জ্বলছে অসন্তোষের ধিকি ধিকি আগুন।
ঋারতের রাজ্যে রাজ্যে যেমন, তেমনি অঞ্চলে অঞ্চলেও বিভেদ আর বৈশ্য স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেও উত্তরবঙ্গ নামক এলাকাটি দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামশাসনেও মর্যাদা পায়নি; এখনও পাচ্ছে না। রাজ্যের জনসংখ্যার বিচারে উত্তরবঙ্গে বাস করেন ২০ শতাংশেরও বেশি মানুষ। অথচ এই খ-ের ভাগ্যে জোটে রাজ্যের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র তিন শতাংশ। এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ। স্বাধীনতার পর নেহরুর ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনও উচিত কাজ হয়েছে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। রাজীব গাঁধী পর্যন্ত এক বার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বলে ফেলেছিলেন, এই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য ভাগ করাটাই ঠিক হয় নি। তাহলে কি ধর্মের ভিত্তিতে ঠিক; নাকি সংস্কৃতির ভিত্তিতে? কারণ ভারতের মতো বহুত্ববাদী দেশে নানা ‘সাব কালচার’ বা উপ-সংস্কৃতি আছে আইএমআরবি ইন্টারন্যাশনাল-এর এক বিশেষজ্ঞ ইউনিট গ্রামীণ ভারতের এই উপ-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা চালায় বলা হচ্ছে, উপসংস্কৃতি কাকে বলব? উত্তর: মূল স্রোতের সংস্কৃতিকে কোনও গোষ্ঠীর পরিত্যাগ করা। মোবাইল থেকে প্যাকেট-বন্দি খাবার, এ সবই শহর থেকে গ্রামে ঢুকে উপসংস্কৃতির উপর মূল সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েম করছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা এক দিকে যেমন কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে উপসংস্কৃতিকে যুক্ত করছে, অন্য দিকে তা গ্রামীণ অর্থনীতির স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থাকেও সমস্যায় ফেলেছে। সমন্বয়ের বদলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
আর ঠিক এই পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের মুখে উগ্র হিন্দুত্বকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন এবং একদিন যাকে আমেরিকার পক্ষে নিন্দিত বলা হতো, আমেরিকা এখন তাকেই তোয়াজ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের পর পরই আসন্ন ভারতের নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অঙ্গনে মনে হচ্ছে খেলা জমে উঠেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ছাড়িয়ে হিন্দুত্ববাদীরাও এগিয়ে আসার প্রচেষ্টা নিয়েছে। এই হিন্দু মৌলবাদী প্রচেষ্টার সঙ্গী হতে চেয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নিজের আদর্শিক অবস্থাটাই স্পষ্ট করলো। প্রমাণ করলো, ইসলাম ছাড়া অন্য সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হতে পারে। শুধু বিপদ ইসলাম আর মুসলমানদেরকে নিয়েই তারা দেখেন, হিন্দু বা খ্রিস্টান মৌলবাদীদের মধ্যে দেখেন না। এই হলো বর্তমান বিশ্বের একচক্ষুবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক নীতি!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন