সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মিসরের নতুন সংবিধান ও গণতন্ত্রের কবর


বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিসরের ভূখ- থেকে অত্যাচারী ফেরাউনের প্রেতাত্মা কোনোক্রমেই বের হয়ে আসতে চাচ্ছে না বলে মনে হয়। একটা অভূতপূর্ব গণবিপ্লবের মাধ্যমে হোসনি মোবারকের স্বৈরাচারী শাসন ও অত্যাচার-নির্যাতন এবং হত্যা-গুমের অবসানের পর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী ড. মুরসি ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে মিসরে দুর্র্নীতিগ্রস্ত অত্যাচারী স্বৈরতান্ত্রিক দুঃশাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সামরিক জান্তা নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে সেখানে নব্য ফেরাউনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই জান্তা বৈধভাবে গৃহীত মিসরের সংবিধানকে বাতিল করে গণভোটের নামে প্রহসনের মাধ্যমে জনগণের উপর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি সংবিধান চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে ২০১২ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত মিসরীয় সরকার গণভোটের মাধ্যমে একটি সংবিধান অনুমোদন করেছিলেন। এই গণভোটে মিসরের ৬৪ শতাংশেরও বেশি ভোটার সংবিধানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ড. মুরসির নেতৃত্বাধীন নবনির্বাচিত সরকার একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করার পর মিসরের কিছু কিছু দল এর বিরোধিতা করে। তাদের এই বিরোধিতার পেছনে আদৌ জনসমর্থন আছে কিনা, তা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মিসরীয় জনগণ তার অধীনে তৈরি সংবিধানের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সামরিক জান্তা জেনারেল সিসি এই বৈধ সংবিধানটি বাতিল করে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন এবং গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদনের একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এতে ভয় প্রলোভন দেখানো সত্ত্বে তিনি ও তার সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার ৩৫%-এর বেশি ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত করাতে পারেননি। বলা হয়, এর মধ্যে ৯৮% ভোটার তার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ যদি বর্তমান সামরিক সরকারের কথাই ধরে নেয়া হয় তাহলেও দেখা যায় যে, জেনারেল সিসির সংবিধান পেয়েছে মোট ভোটারের ৩৪ শতাংশের ভোট। পক্ষান্তরে মুরসির সংবিধানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ৬৪ শতাংশ ভোটার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বশেষ গণভোটের প্রয়োজন কি ছিল? ড. মুরসি এক বছরের মতো ক্ষমতায় ছিলেন। একটি শত্রুভাবাপন্ন বিচার বিভাগ এবং আর্মি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রবল হুমকি সত্ত্বেও তার সাফল্যগুলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। দশকের পর দশক ধরে দুর্নীতি করতে অভ্যস্ত আর্মি, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই স্বচ্ছ ও সৎ প্রশাসন পছন্দনীয় ছিল না। তাদের অবৈধ বেআইনি, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক কাজকর্ম এবং দুর্নীতি জুলুম নির্যাতন প্রভৃতিকে বৈধতা দেয়ার জন্যই নতুন সংবিধান এবং গণভোট অনুষ্ঠানের ন্যায় প্রহসনের প্রয়োজন ছিল। সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে এবং আর্মির তরফ থেকে জেনারেল সিসিকে নমিনেশন দেয়ায় তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গত বছর জুলাইয়ে অস্ত্রের মুখে ড. মুরসিকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর থেকে মিসরের জনগণের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে। পাঁচ সহস্রাধিক লোক সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মৌলিক অধিকার ও ইনসাফকে পদদলিত করা হচ্ছে। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র হামলা, ব্যাপক গ্রেফতার, দেখামাত্র গুলী নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামরিক সরকার শত শত স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা, ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দেশটিকে একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। নিরপেক্ষ গণমাধ্যমসমূহ একদিকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে গোয়েবলসীয় কায়দায় ইসলাম, ইসলামী নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক দল এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সারা দেশে ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোট অনুষ্ঠান ক্ষমতা আঁকড়িয়ে থাকার তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী, গণভোটে যারা ‘না’ ভোট দিয়েছেন তাদের নির্মমভাবে প্রহার করে গ্রেফতার করত নির্যাতন সেলে নিয়ে হাত-পা গুঁড়ো করে দেয়া হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মিসরে এখন ভিন্নমত পোষণের আর কোনো স্বাধীনতা নেই। এখানে একটা কথা পরিষ্কার যে, শাসকরা যদি স্বৈরতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক পরিবেশে গণভোট বা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তাহলে তা হারার জন্য করে না। জেতার জন্য যা কিছু দরকার, অত্যাচার, নিপীড়ন, ভয়ভীতি, প্রলোভন, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ক্রয়, ব্যালট বাক্স চুরিÑ সবকিছুই তারা করতে পারে। কুখ্যাত স্বৈরাচারী ও গণহত্যার নায়ক হিটলার, মুসোলিনী, সাদ্দাম হোসেন, বাপবেটা আসাদ, সাদাত, মোবারক এদের সকলেই ‘নব্বই শতাংশ’ মেজরিটি নিয়ে নির্বাচনে অথবা গণভোটে জিতেছিলেন। কেননা অস্ত্রধারী জল্লাদ ও লাঠিয়াল উভয়ই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করুণ পরিণতি থেকে তাদের কেউই রক্ষা পাননি এবং পাবেনও না।
প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১২ সালে ইসলামপন্থী মুরসি সরকার যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন তাতে ঘাটতি কি ছিল যার জন্য নতুন করে সংবিধান প্রণয়ন করে গণভোট দিতে হয়েছে? আমার দৃষ্টিতে এতে কোনো ঘাটতি ছিল না।
নাগরিক অধিকারসহ সকল প্রকার মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের যতগুলো ধারা একটি আধুনিক সংবিধানে থাকা দরকার তার সবগুলোই মুরসির সংবিধানে ছিল। কিন্তু তথাপিও ২০১২ সালের সংবিধান থেকে ইসলামী ধারাসমূহ প্রত্যাহার এবং বেসামরিক সরকার ব্যবস্থাকে বলি দিয়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য নতুন সংবিধানটি তৈরি করা হয়েছে। এখন যারা এই সংবিধানটি প্রণয়ন করেছেন তাদের কথা একটু শুনুন।
এই সংবিধানটি প্রণয়ন করেছেন ৫০ সদস্যের একটি প্যানেল। এদের প্রত্যেকেই গত সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু কেউ জিততে পারেননি। তারা যেসব দলের সদস্য সেসব দল থেকেও পার্লামেন্টের একটি সিটে জয়ী হওয়া কারোর পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। এই প্যানেলটি বস্তুত আর্মির তথা প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল সিসির তল্পিবাহক ভাড়াটিয়া হিসেবে কাজ করছেন। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মিসরে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করা এবং মিসরীয় সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে উচ্ছেদ করা। বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থার সাথে এর একটা বিরাট মিল পাওয়া যায়। তথাকথিত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলো এদের সমর্থন দিচ্ছে এবং অবৈধ অসাংবিধানিকভাবে তাদের ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দিচ্ছে। এর কারণ হয়তো বোঝা যায়। কিন্তু মুসলিম দেশসমূহের নির্লিপ্ততা এবং ইহুদী লবির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামী অনুশাসনের বিরোধিতা করার কারণ আমি খুঁজে পাই না।
এখন সংবিধানের পরিবর্তনসমূহের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
ইসলামী বিধানসমূহের অপসারণ
১. ২০১২ সালের সংবিধানের ভূমিকা এবং এর ১নং অনুচ্ছেদে বিধৃত ইসলামী চরিত্রকে পরিবর্তন করে মিসরকে শুধু গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তথা উবসড়পৎধঃরপ জবঢ়ঁনষরপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
২. ২০১২ সালের সংবিধানে মিসরীয় জনগণের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, তারা ইসলামী উম্মাহ বা জাতির অংশ। সিসির সংবিধানে তা পরিবর্তন করে বলা হয়েছে যে, তারা মুসলিম বিশ্বের অংশ (চধৎঃ ড়ভ গঁংষরস ড়িৎষফ) (অনু : ১)
৩. নতুন সংবিধানে ২০১২ এর সংবিধানের ২১৯ অনুচ্ছেদ বাদ দেয়া হয়েছে। এতে শরীয়াহর বিস্তৃত ব্যাখ্যার বিধান ছিল।
৪. বর্তমানে সংবিধানে শরীয়াহর ব্যাখ্যাকে সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী সংবিধানে যেখানে ইসলামী শরীয়াহর মূলনীতিকে আইন প্রণয়নের প্রাথমিক উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, বর্তমান সংবিধানে তাকে অস্বীকার করে বলা হয়েছে, ‘ঝযধৎরধ রঃংবষভ রং হড়ঃ ঃযব ভঁহফধসবহঃধষ ংড়ঁৎপব’ (অনু : ২)।
৫. ইসলামী শরীয়াহর ব্যাপারে আল আজহারের বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করার একটি বিধান ছিল। এতে আল আজহার সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘অষ-অুযধৎ ধং ধহ বহপড়সঢ়ধংংরহম রহফবঢ়বহফবহঃ ওংষধসরপ রহংঃরঃঁঃরড়হ রিঃয বীপষঁংরাব ধঁঃড়হড়সু ড়াবৎ রঃং ড়হি ধভভধরৎং, ৎবংঢ়ড়হংরনষব ভড়ৎ ঢ়ৎবধপযরহম ওংষধস (ধহফ ঃবধপযরহম) ঃযবড়ষড়মু ধহফ ঃযব অৎধনরপ ষধহমঁধমব রহ ঊমুঢ়ঃ ধহফ ঃযব ড়িৎষফ’ (অনু : ৪)। নতুন সংবিধানে উপরোক্ত বাক্যাংশ বাদ দিয়ে তার স্থলে, ‘ঃযধঃ অষ-অুযধৎ রং ধহ দধপধফবসরপ' নড়ফু (সবধহং হড়ঃ ধহ ধঁঃযড়ৎরঃু রহ ষধি সধশরহম ঢ়ৎড়পবংং)’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
৬. মুরসির সংবিধানের ৪৪ নং অনুচ্ছেদ বাদ দেয়া হয়েছে। এতে নবী-রাসূলদের (সা.) অপমান নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছিল, ‘ওহংঁষঃ ড়ৎ ধনঁংব ড়ভ ধষষ ৎবষরমরড়ঁং সবংংবহমবৎং ধহফ ঢ়ৎড়ঢ়যবঃং রং ঢ়ৎড়যরনরঃবফ’
৭. অনুচ্ছেদ ৫-এ বর্ণিত শূরা কাউন্সিল গঠনের বিধান বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
৮. ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল (অনু : ৭৪) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর প্রধান টার্গেট হচ্ছে মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস এন্ড ফ্রিডম পার্টি (এই দলটি দু’বছরে পাঁচটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল)।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা সংহতকরণ
আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সকলেই প্রায় একমত যে, নতুন সংবিধানে বিধৃত বেশকিছু নীতিমালায় বেসামরিক বা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে সামরিক সরকারের বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে।
সদ্যপাস করা খসড়া সংবিধানের ২০৪ অনুচ্ছেদে বেসামরিক ব্যক্তিদের সামরিক আদালতে বিচারের বিধান রাখা হয়েছে। এই সংবিধানের ২৩৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগের বেলায় সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কাউন্সিলের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে এবং তিনি জনগণের পরিবর্তে সেনাবাহিনীর কাছে জবাবদিহি করবেন।
এই অনুচ্ছেদটিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। এতে নির্বাচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সেনাবাহিনীকে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এভাবে এই গণবিরোধী এবং ইসলামবিরোধী সংবিধান মিসরকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads