সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

উপজেলা নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের হয়রানি


নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত সময়ে ছয় দফায় সারাদেশে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচনের প্রথম পর্বের দিন এগিয়ে এলেও নির্বাচনকে নিয়ে দেশজুড়ে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল তেমন কোনো লক্ষণও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এর একটি প্রধান কারণ সরকারের পাশাপাশি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে আস্থাহীনতা। জনগণ বিশ্বাসই করে না যে, এই কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সরকার যে প্রভাব খাটাবে এবং পুলিশ ও প্রশাসনকে নিজদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ব্যবহার করবে সে বিষয়েও মানুষের মনে সন্দেহ নেই। এমন অবস্থা সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী হলেও পরিস্থিতির কারণে জনগণ অনেক সময় আপত্তি ও প্রতিবাদসহ মেনে নেয়। কিন্তু বর্তমানে চলছে সম্পূর্ণ অন্য রকম কর্মকা-। দৈনিক সংগ্রাম-এর এক রিপোর্টে জানা গেছে, বিরোধী দলের, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা তৎপরতাই চালাতে  পারছেন না। তাদের এমনকি নির্বাচনের মাঠেও থাকতে দেয়া হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের গু-া-সন্ত্রাসীরা তো সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছেই, পাশাপাশি রয়েছে র‌্যাব ও পুলিশসহ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও। বিএনপি ও জামায়াতের সম্ভাবনাময় সব প্রার্থীর বিরুদ্ধেই একের পর এক সাজানো মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সে সব মামলায় গ্রেফতারের জন্য প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়িতে যখন-তখন তল্লাশি চালানো হচ্ছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছেন না। ফলে প্রচারণা চালানো ও জনসভা করার মতো কোনো কার্যক্রমই চালাতে পারছেন না বিরোধী দলের প্রার্থীরা। তাদের পোস্টার পর্যন্ত লাগাতে দেয়া হচ্ছে না। কোনোভাবে লাগাতে পারলেও পোস্টারগুলোকে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এমন ত্রাসের রাজত্বই কায়েম করা হয়েছে যে, নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং জনসংযোগ করা দূরে থাকুক, প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা নিজেদের জীবন বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বাস্তবে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের।
অথচ গণতন্ত্রে এমন অবস্থা কল্পনা করা যায় না। কারণ, সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে কোনো নির্বাচনের একটি প্রধান পূর্বশর্ত। এই সুযোগ প্রত্যেক প্রার্থীরই থাকা দরকার। অন্যদিকে উপজেলা নির্বাচনে দেশের কোনো এলাকাতেই বিরোধী দলের প্রার্থীদের সে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। আমরা এই সন্ত্রাস ও হামলা-মামলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। দাবি জানাই সব দলের প্রার্থীকেই বাধাহীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য। আমরা অবশ্য এটাও মনে করি যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আশা করা যায় না। সরকার সম্পর্কে এমন ধারণার কারণও ক্ষমতাসীনরাই তৈরি করেছেন। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো যাতে নির্বাচনে অংশ না নেয় সেটা নিশ্চিত করতেই ক্ষমতাসীনরা বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। এজন্য তারা এমনভাবেই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার অজুহাত দেখিয়েছেন যাতে বিরোধী দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব না হয়। অথচ বিরোধী দলগুলো আন্তরিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিল। দলগুলো শুধু চেয়েছিল, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ করা হোক এবং সংবিধানে নির্বাচনকালীন ওই সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিধান যুক্ত করা হোক। কিন্তু এটুকু করতেও সম্মত হননি ক্ষমতাসীনরা। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল যে কোনোভাবে বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। সে উদ্দেশ্য তারা অর্জন করেও ছেড়েছেন যদিও পাঁচ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিতে যায়নি। এতে অবশ্য তাদের কিছুই যায়-আসে না। কারণ, তাদের লক্ষ্য ছিল ছলে-বলে-কৌশলে হলেও ক্ষমতায় যাওয়া।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও তারা একই কৌশলের ভিত্তিতে এগিয়ে চলেছেন। পার্থক্য হলো, বিরোধী দলগুলো সংসদ নির্বাচনের মতো এই নির্বাচন বর্জন করেনি বরং ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। দশম সংসদের নামে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটার অনুপস্থিতির কারণে শুধু নয়, মাস কয়েক আগে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের কারণেও ক্ষমতাসীনরা উপজেলা নির্বাচনে ভরাডুবির আশংকা করছেন। এই আশংকা সত্যও বটে। আসলেও তারা জিততে পারবেন না। একই কারণে তারা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন বিরোধী দলগুলো যাতে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে। অংশ নিলেও তাদের প্রার্থীরা যাতে প্রচারণা চালাতে এবং জনগণের কাছে ভোট চাইতে না পারেন। এজন্যই শুরু হয়েছে হামলা ও মামলার মাধ্যমে নতুন পর্যায়ে হয়রানির পালা। ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছেন, বিরোধী দলগুলোকে বাইরে ঠেলে রেখে একতরফা নির্বাচন করতে এবং জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মূলকেন্দ্র উপজেলাগুলোকে নিজেদের দখলে নিতে। আমরা এই হীন এবং সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী উদ্দেশ্য, কৌশল ও কর্মকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই এবং মনে করি, অবিলম্বে সব হামলা ও মামলা বন্ধ করে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা সরকারের সাংবিধানিক কর্তব্য। সরকারকে অবশ্যই বহুল আলোচিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনেরও বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেক প্রার্থী যাতে বাধাহীনভাবে সভা-সমাবেশ করতে ও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধান করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। ক্ষমতাসীনরা যাতে মিথ্যা মামলা দায়ের করে গ্রেফতারের নামে প্রার্থী ও তার কর্মীদের হয়রানি না করতে পারেন সে বিষয়েও কমিশনকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশেষ করে র‌্যাব ও পুলিশসহ সরকারি কোনো বাহিনীকে যাতে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করা হয় সে জন্যও কমিশনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সব মিলিয়েই আমরা চাই, স্থানীয় সরকারের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে উপজেলা নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তার  ব্যবস্থা করা হোক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads