২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজনৈতিক ফ্রন্টে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান কাজ হয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দমন করা, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে দমন করা। পরবর্তী ৫ বছর জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হেন পন্থা নাই যেগুলো আওয়ামী সরকার অবলম্বন করেনি। জামায়াত ও শিবিরের প্রতি আওয়ামী লীগের চ-নীতি সাধারণ মানুষের কাছেও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি করতে গিয়ে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেকে জাহিরকারী আওয়ামী সরকার অতি শীঘ্রই বাংলাদেশকে একটি পুলিশী রাষ্ট্র তথা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ন এবং নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন এমনকি হত্যাকা-েও সাধারণ মানুষের কাছে এর ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। বরং সরকারের দমন ও নির্যাতন যতোই ভয়াবহ হয়েছে ততোই জনগণ সরকারের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং জামায়াত ও শিবিরের প্রতি ক্রমবর্ধমানভাবে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছে। জামায়াত ও শিবিরের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের যতোই কারাগারে নেয়া হয়েছে ততোই এই দুটি সংগঠনে নতুন সদস্যদের সংখ্যা বেড়েছে। সরকারের চ-নীতির ফলে জামায়াত-শিবিরকে যে দমন করা যায় নাই, বরং দিন দিন সংগঠনটি জনপ্রিয় হয়েছে। সেটির প্রমাণ হলো গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ৯৭টি উপজেলার নির্বাচনের ফলাফল। এই ৯৭টির মধ্যে একটি উপজেলা অর্থাৎ উল্লাপাড়া উপজেলায় ব্যালটবাক্স ছিনতাইয়ের কারণে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৯৬টি উপজেলা নির্বাচনের অধিকাংশতে সরকারি দল জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং তাদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। সরকারি হস্তক্ষেপ এবং দলীয় পেশীবাজদের পেশী সঞ্চালনের প্রতিবাদে নির্বাচনের পরদিন ৮টি উপজেলায় বিরোধী দলের ডাকে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়েছে।
গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি বুধবার দেশের ৪৮৭ উপজেলার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৯৬টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাতের মধ্যেই ৯৬টির বেসরকারি ফলাফল প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, চেয়ারম্যান পদে বিএনপি পেয়েছে ৪৩টি আসন, আওয়ামী লীগ ৩৪টি, জামায়েতে ইসলামী ১২টি, জাতীয় পার্টি ১টি এবং অন্যরা পেয়েছে ৬টি আসন।
এই নির্বাচনের সর্বশেষ ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে বিএনপি পেয়েছে ৭২টি আসন, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৪টি, জামায়াতে ইসলামী ২৩টি, জাতীয় পার্টি ১টি এবং অন্যরা ১৯টি আসন। অর্থাৎ জোটগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট পেয়েছে ৭১টি ভাইস চেয়ারম্যানের পদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ৯১টি পদ। অর্থাৎ সরকারি জোট এবং বিরোধী জোটের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রাপ্ত আসনের ব্যবধান ২০টি। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে আরো দেখা যায় যে, এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে মোট ভোটারের ৬২.৪ শতাংশ। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৬ লাখ ভোট। পক্ষান্তরে বিএনপির বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীরা পেয়েছেন ২৪ লাখ ভোট। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি এখানে ৮ লাখ ভোটে এগিয়ে আছে।
দুই
২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত ৯৬টি উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল ৬৬টি উপজেলায়। পক্ষান্তরে বিএনপি বিজয়ী হয়েছিল মাত্র ১৪টি উপজেলায়। ২০১৪ সালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এবার বিএনপি জয় লাভ করে ৪৩টি উপজেলায় আর আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ৩৪টি উপজেলায়। জামায়াতের ফলাফলও অবাক করার মতো। এই দলটির বিরুদ্ধে সরকার অনবরত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা প্রতিনিয়তই রাজরোষে পতিত হচ্ছে। তারপরেও দেখা যায় যে, ২০০৯ সালে জামায়াত যেখানে জয়লাভ করেছিল ৮টি উপজেলায়, সেখানে এবার তারা জয়লাভ করেছে ১২টি উপজেলায়। আওয়ামী লীগের মহাজোটের বড় শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টি ২০০৯ সালে তারা জয়লাভ করেছিল ৩টি উপজেলায়। কিন্তু এবার ৯৬টি উপজেলার মধ্যে তারা জয়লাভ করেছে মাত্র ১টিতে।
সরকারের মন্ত্রীরাই দাবি করছেন যে, বিগত উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে এবং সরকার সেই নির্বাচনে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করে নাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দুই সরব অংশীদার হলো ইনুর জাসদ এবং মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি। এই দুটি দলের ভূমিকা অনেকটা সেই ‘রাজা যাহা বলে/পারিষদ দল বলে তার শত গুণ।’ জাতীয় পার্টি মহাজোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক। বিগত ৫ তারিখের ভোটারবিহীন নির্বাচনে তারা পেয়েছে ৩৪টি আসন। ওয়ার্কার্স পার্টি এবং ইনুর জাসদও পেয়েছে ৩টি করে ভাগবাটোয়ারার আসন। কিন্তু ৯৬টি উপজেলার মধ্যে জাতীয় পার্টি জয়লাভ করেছে মাত্র ১টি উপজেলায়। তবুও তো মন্দের ভালো। কিন্তু মেনন এবং ইনুরাতো একটি আসনও পাননি। অথচ জামায়াত পেয়েছে ১২টি আসন।
সরকারি শিবির এবং বামঘরানা থেকে অনবরত প্রচার করা হচ্ছে যে, বিগত বছর খানেক ধরে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াত-শিবির, সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করে যাচ্ছে। সেই আন্দোলনে বিএনপি এবং জামায়াত ইসলামী নাকি বিপুলভাবে তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। এর কারণ, আন্দোলনের নামে নাকি সহিংসতা হয়েছে, সেই সহিংসতা এবং সন্ত্রাসের ফলে জনগণ নাকি বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর থেকে সম্পূর্ণভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র ১৭ দিন আগে ২ ফেব্রুয়ারি ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছিল যে, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ভোট পাবে ৪১.৫ শতাংশ এবং স্বভাবতই জয়ী হবে। বিএনপি ভোট পাবে ৩৭.৬ শতাংশ এবং পরাজিত হবে।
৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গিয়েছিল যে, নির্বাচনে অংশ নিলে এককভাবে বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রায় দ্বিগুণ ভোট পাবে। ওই জরিপে নাকি প্রশ্ন করা হয় যে, ধরা যাক, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা হলো। তখন কাকে ভোট দিতেন? জরিপে এ প্রশ্নের উত্তরে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগ এবং ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়ার কথা জানান। এখন ভোট হলে কোনো দলকে ভোট দেবেন? উত্তরে ৪১.৫ শতাংশ আওয়ামী লীগ এবং ৩৭.৬ শতাংশ মানুষ বিএনপির পক্ষে ভোট দেয়ার কথা বলেছেন।
তিন
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ওই জরিপ প্রকাশের পর আওয়ামী লীগে উল্লাস দেখা যায়। বিএনপিকে জনগণ ভোট দেবে নাÑ এমন যুক্তি পেয়ে দলটি জোর প্রচারণায় নেমে পড়ে। এ ঘটনার মাত্র ১৭ দিন পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঘটে ঠিক তার উল্টো ঘটনা।
এই উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল সরকার এবং বিদেশী রাষ্ট্র, বিশেষ করে ভারতকে, অনেক বার্তা দিয়েছে। বার্তাটি হলো এই যে, জাতীয় পার্টি প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী এখন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পার্টি। এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। বিএনপির পর আওয়ামী লীগ এবং তারপর জামায়াতে ইসলামী।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এই ফল হয়েছে। এখন যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সেক্ষেত্রে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট, মির্জা ফখরুল ইসলামের দাবি অনুযায়ী ৯৫ শতাংশ আসনে জয়ী না হলেও অন্তত ৮০ শতাংশ আসনে জয় লাভ করতো। দ্বিতীয়ত, সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকা বিএনপিই এখন তৃণমূলে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। ৫ সিটি করপোরেশনের পর ৪০টি জেলার ৯৬টি উপজেলা নির্বাচনেও এটা প্রমাণ হয়েছে যে, সুযোগ পেলে মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে। বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে কমপক্ষে ১০টি জেলায় আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করেছে। নির্বাচনে সরকারি দলের সরকারি ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে আবারও। জালভোট, অস্ত্রবাজি আর কেন্দ্র দখলের ঘটনাও ঘটে। এ কারণে নয়টি উপজেলায় বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেন। শক্তির প্রদর্শনীর ঘটনা না ঘটলে বিএনপি আরও বেশি উপজেলায় জয়ী হতেন বলে মনে করেন। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগ সবসময় দাবি করে এসেছে এবং আওয়ামী ঘরানাও সবসময় তাদের দাবিকে সমর্থন করে এসেছে যে, আওয়ামী লীগই হলো তৃণমূলে সবচেয়ে শক্তিশালী দল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন যেহেতু তৃণমূলেই অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি অনেক বড় জয় পেয়েছে তাই এখন আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিই তৃণমূলে সবচেয়ে শক্তিশালী দল। চতুর্থত, তিন মাস আগে আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওহিরির একটি অডিও বার্তা আপলোড করা হয়েছিল। উপজেলা নির্বাচনের আগে এই বার্তাটি বাজারে ছাড়া হয়। এটি নিয়ে সরকারি মহল পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে সর্বত্র খুব হৈ চৈ করে। টার্গেট হলো বিএনপি এবং জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা। একইভাবে সেই পুরাতন এবং বহুল ব্যবহৃত ইসলামী জঙ্গি কার্ড আবার জোরেশোরে খেলা হয়। আওয়ামী লীগ এটিকে ট্রাম্প কার্ড বা তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও ওই তুরুপের তাসটি খেলা হয়। কিন্তু দেখা গেলো যে তুরুপের তাসটিতে আর জোর নাই। আওয়ামী লীগের হাতে যতগুলো তাস ছিল তার সবগুলো তাস তারা খেলেছে। কিন্তু কোনো তাসই কাজ দেয় নাই।
চার
এই নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে কয়েকটি অমোঘ সত্য বেরিয়ে এসেছে। সেগুলো হলোÑ
(১) বিএনপি দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর বিপরীতে এরশাদ বা রওশন এরশাদ, যার নেতৃত্বেই হোক না কেন, জনগণের নিকট জাতীয় পার্টির আর কোনো আকর্ষণ নাই। এই পার্টিটি এখন অস্তিত্ব হারাবার পথে উঠেছে।
(২) তথাকথিত বাম ঘরানার ইনুর জাসদ, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং তরিকত ফেডারেশন একটি আসনও পায়নি। এরা সকলেই আওয়ামীপন্থী। এর অর্থ হলো এই যে, রাজনৈতিক দল হিসেবে এদের নাম জনগণের কাছে মুছে যাচ্ছে।
(৩) এই নির্বাচন জানিয়ে দিয়েছে যে, যতো বৈরী প্রচারণাই হোক না কেন, জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীকে বিবেচনায় আনতেই হবে। এখন জামায়াত দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। জামায়াতের এই উত্থানের পেছনে অবদান রেখেছে সরকারের অব্যাহত জুলুমের স্টিমরোলার। প্রতিটি ইসলামী সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিত্রিত করার সরকারি প্রবণতা পরিহার করতে হবে। জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী সংগঠন এবং সেই সাথে বিএনপিকে আল-কায়েদা তালেবান এবং পাকিস্তানের সাথে জড়িত করার খাসলত পরিহার করতে হবে।
পাঁচ
বিএনপি ও জামায়াতকে পঙ্গু করার সমস্ত সরকারি কূটচাল ব্যর্থ হয়েছে। জুলুম নির্যাতন করলেও জনগণ বিএনপি ও জামায়াতকে তাদের দল হিসেবে বেছে নিয়েছে। সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে একমাত্র বন্দুকধারী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর জোরে। এই অবস্থা যদি বেশিদিন চলে তাহলে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিপন্ন হবে। তাই আর কালবিলম্ব না করে সরকারকে সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেই সংলাপের মাধ্যমে অবিলম্বে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। আর এটি হলো দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের একমাত্র সমাধান।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন