দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর উন্নয়নশীল অনেক দেশেই এটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। শক্তির অপব্যবহার এবং অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে বাড়ছে মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর এ কারণেই স্বচ্ছতা, আল্লাহভীতি ও জবাবদিহিতামূলক সংস্কৃতি গড়ে ওঠছে না। সৃষ্টির আদিকাল থেকে দুর্নীতি বন্ধের জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু কার্যত কোনো কৌশলই ফলপ্রসূ হয়নি। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আরো বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল অর্জিত হয়নি। তবে কিভাবে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাবে সেটা এখন বিশ্বব্যাপী একটি জিজ্ঞাসা। এ লক্ষ্যে আলোচ্য প্রবন্ধে দুর্নীতির পরিচয়, উৎপত্তি ও বিস্তার, পরিধি, উৎস, কারণ, দমন করার উপায় ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম কি ধরনের বিধান প্রণয়ন করেছে, সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
দুর্নীতির পরিচয় : দুর্নীতি কী? প্রথমেই আমাদেরকে এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করতে হবে। দুর্নীতি একটি নেতিবাচক শব্দ। সহজ ভাষায় বুঝি কু-নীতি, কু-রীতি। নীতি বহির্ভূত কর্মকা-। ‘‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, কলকাতা : সাহিত্য সংসদ, ১৯৮৭, পৃ. ৩৩৯।’’ আরবী ভাষায় একে ফাসাদ বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘‘যেসব লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে : তাদেরকে হত্যা করতে হবে কিংবা শূলিবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের নির্বাসিত করা হবে।’’ (আল-কুরআন, ৫ : ৩৩) আরবী জারীমা শব্দকেও এর সমার্থক শব্দ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জারীমা অর্থ অপরাধ, পাপ বা আইন বিরোধী শব্দ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জারীমা অর্থ অপরাধ, পাপ বা আইন বিরোধী কাজ। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো crime, offense তাছাড়া Moral degeneration; a malpractice, a corruption, perversion(বদমায়িশি),wickedness, Improbity, dishonesty(অসততা), a diversion from the true path (সৎ পথ থেকে বিপথে গমন)। ÔÔSamsad Bangali-English Dictionary, Calcatta : Sahitya Samsad, 1988, P. 443.’’ যার বিপরীত হলো Moral, Morality or relating to the conduct of men; The doctrine or practice of the duties of life. Oxford Dictionary, Edited by Oxford University Press. Oxford Learner’s Favorite Dictionary’ Edited by Prof. Raihan Kawsar & Khairul Alam Monir, Published by Chowdhury & Son’s, Dhaka: Banglabazar, 2006.’’
* * Oxford English Dictionaryতে বলা হয়েছে, Dishonest, illegal behabior, especially of people in authority, elegations of bribery. A. S Hornby, Oxford Advanced Learner’s of Current English, Oxford University Press, 2000, P-201’’
অর্থাৎ ‘‘দুর্নীতি হলো অসততা, অবৈধ আচরণ, বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে আসীন ব্যক্তিবর্গের আইন বহির্ভূত আচরণ, ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ইত্যাদি।’’
* দুর্নীতি হলো সমাজে প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ। ‘‘ড. মুহাম্মদ জাকির হোসাইন, আর্থ সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪, পৃ. ৪০৭।’’
* সাধারণত ঘুষ বলপ্রয়োগ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যক্তি বিশেষকে সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণপ্রশাসনের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা অর্জনের নাম দুর্নীতি। ‘‘প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৭-৪০৮।’’
* রমনাথ শর্মার মতে, In corruption a person willfully neglected his specified duty in order to have an undue advantage.. ‘‘প্রাগুক্ত’’ অর্থাৎ ‘‘অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলার নাম দুর্নীতি।’’
*World Bank কর্তৃক প্রদত্ত দুর্নীতির সংজ্ঞা হলো : Corruption is the abuse of public power for private benefit. ÔÔVito TanziÕÕ ÒCorruption around the world causes, consequences scope and cures in Governance, corruption & economics performance’’ edited by George T. Abed & Sanjeev Gupta Washington International monetary Fund, 2002, P. 25 অর্থাৎ ‘‘দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার।’’
* * Transparency International (TI) Ges Corruption Perception Index (CPI)) প্রতিবেদনে দুর্নীতি বলতে সরকারি ক্ষমতা ও সুবিধাকে বেসরকারি বা ব্যক্তিস্বার্থে অপব্যবহার এবং সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিকে বুঝানো হয়েছে। ‘‘আবদুন নূর, ‘আদর্শ, উন্নয়ন ও দুর্নীতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ” তা. বি. পৃ. ১৭-১৮।
* * Transparency International এর সংজ্ঞা হলো: Corruption is the abuse of public office for private gain.. অর্থাৎ “সরকারি দফতরকে ব্যক্তি স্বার্থে কাজে লাগানো, যেখানে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।” মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন, দুর্নীতি ও উন্নয়ন : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, ঢাকা: মাসিক ইতিহাস অন্বেষা, মার্চ-২০০৬, পৃ. ৪৩।
* * M. Johne এর মতে, ‘‘Corruption is missuse of public property, public rank and status for private interest.” Political Conference of corruption Comparative Politics, P.460
দুর্নীতি কেবল সরকারি কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত নয়; বরং সরকারি, বেসরকারি, এনজিও বিভিন্ন পেশা, শ্রেণী, পরিবার, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থেও হতে পারে। যেমন, একজন সরকারি কর্মকর্তা অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে ব্যক্তিগত কার্যাবলী সম্পন্ন করতে পারেন, যা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হবে অথবা সরকারি বাজেটের টাকা দিয়ে টেন্ডার ছাড়াই কোনো কাজ নিজের বা দলীয় লোকদের মাধ্যমে করানো অথবা টেন্ডার দিলেও কাজের মান যথাযথভাবে ঠিক না রেখে কিছু টাকা খরচ করে বাকি টাকা নিজের পকেটস্থ করাও দুর্নীতি হিসেবে গণ্য হবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, দুর্নীতি হলো প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, আইনকানুন এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে উদ্ভুত এমন এক পরিস্থিতি যা সঠিকভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত করে। অন্য কথায় দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অবৈধ স্বার্থ হাসিল করাকে দুর্নীতি বলে।
দুর্নীতির উৎপত্তি ও বিস্তার : সভ্যতার প্রথম থেকেই প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রচলন কমবেশি বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত প্রশাসনের উৎপত্তির সাথে সাথেই এর প্রচলন ও বিস্তার ঘটতে থাকে। এটি মানুষের ‘ফিতরাত’ তথা স্বভাবের একটি মন্দ দিক। আসমানী কিতাব তাওরাত (Old Testament) এর বিকৃতি ছিলো ইতিহাস বিখ্যাত একটি জঘন্য দুর্নীতি। “প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮” প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে ভারতীয় রাজতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য (Kautilya) তাঁর প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্র (Arthashastra) গ্রন্থে দুর্নীতির বিষয়টি আলোকপাত করেছেন। | ÒVito Tanzi, Corruption around the world” P. 25. প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে দান্তে (উহঃব) ঘোষণা করেন, আইন বহির্ভূত কর্মসম্পাদন কিংবা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কাউকে প্রভাবিত করার জন্য ঘুষ-উৎকোচ প্রদানকারীর অবস্থান হলো নরকের সর্বনিম্ন স্তরে। “আবদুন নূর, প্রাগুক্ত পৃ. ১৯” বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর কোনো একটি নাটকে দুর্নীতিকে বিখ্যাত চরিত্রে রূপায়ন করেছেন। “প্রাগুক্ত পৃ. ১৯-২০” আমেরিকার সংবিধানে ঘুষ উৎকোচ এবং প্রতারণামূলক কর্মকা-কে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যে অপরাধ সম্পাদনের কারণে সেখানকার প্রেসিডেন্ট ইম্পিচম্যান্টের যোগ্য হতে পারেন। ÒNooman John T, Bribes, New Yourk, 1984”, ১৯৮৪” ১৭৭৫ সালে ভারতবর্ষের ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং মীরজাফরের পতœীকে দেড় লক্ষ টাকা উৎকোচ দেয়ার বিনিময়ে মুর্শিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণকার্যে নিযুক্তি লাভ করেন। অবশ্য এজন্য বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট তাকে গভর্নরের পদ থেকে ইম্পিচ করেন। সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ভারতের গবর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক ১৮২৮ সালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা যাচাইয়ের জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (অঈজ) গ্রহণের নিয়ম প্রচলন করেন। “আবদুর নূর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬” ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৫৭ সালে এদেশে দুর্নীতি দমন ব্যুরো গঠন করে দুর্নীতি প্রতিরোধের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধানের অধীনস্থ দফতরে পরিণত হওয়ায় এ ব্যুরো তার কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। ফলে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকে এ দেশের প্রায় সকল সরকারের ক্ষেত্রেই কমবেশি দুর্নীতির অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগ কোনো নতুন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপে বর্তমানে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতিবছর যে অপচয় হয় তা হচ্ছে ১১,২৫৬ কোটি টাকা। “Transparency International, সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০০২” ফলে সকল স্তরে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও ভারতের চেয়ে প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাচ্ছে। ২০১১ সালে GDP বিনিয়োগের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ। ADB--এর কান্ট্রি ডিরেক্টর তেরেসাখো বলেন, WEF--এর ২০১১-১২ রিপোর্টে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অবকাঠামোর দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ দুর্নীতি। “দৈনিক আমার দেশ, ২৩ মে- ২০১২”
দুর্নীতির পরিধি : আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায়, সারা পৃথিবীকেই দুর্নীতি গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু নীতি বহির্ভূত সকল প্রকার কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার ও কথা-বার্তা সবই এর আওতাভূক্ত। যেহেতু আয়-উপার্জন জীবনের বিশাল অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে যৌক্তিক কারণেই বড় করে দেখা হয়। দুর্নীতি ব্যাপক বিস্তৃত একটি পরিভাষা। নীতি হিসেবে আমরা যদি ইসলামকে বেছে নেই তবে দুর্নীতিরও একটি সংজ্ঞা প্রয়োজন। ইসলামের সংজ্ঞা যদি এই হয়, ‘আল্লাহর বিধান ও দীনের সামনে আত্মসমর্পন’ অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা, দ্বারা আল্লাহ সকল বিধানের পরিপূর্ণতা ঘটিয়েছেন সেগুলো মনে প্রাণে মেনে নেয়া। যিনি মেনে নিবেন তার মধ্যে কতগুলো গুণ-বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হবে; যথা : তিনি নীতিবান হবেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সদাতৎপর থাকবেন, তার মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পাবে ইত্যাদি। বিপরীত দিকে ইসলামী শরীয়তে অপরাধ (জারীমা) বলেও একটি পরিভাষা রয়েছে। দুর্নীতি একটি অপরাধ। যে সম্পর্কে আল্লাহ হদ্দ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) অথবা তাজীর (দ-বিধি) দ্বারা হুমকি প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।” ড. মোহাম্মদ মোস্তাফা কামাল, মৌলিক সমস্যা সমাধানে ইসলামী আইন, গবেষণা বিভাগ, ইসলামিক ফাউ-েশন বাংলাদেশ, জানুয়ারী-২০০৬।
মানুষের ইচ্ছা শক্তির দ্বারা সংঘটিত নৈতিক কর্মসমূহের বিপরীতে দুনিয়া ও পরকালে পুরস্কৃত করা হবে এবং অনৈতিক বা পাপাচারের পরিণামে শাস্তি প্রদান করা হবে। মানুষের ইচ্ছা শক্তি হচ্ছে বিনিময়ের মাপকাঠি। ইচ্ছাশক্তি যখন অপরাধ কাজের অবয়বে প্রকাশিত হয়, তখন সেটাই দুর্নীতি এবং সেটাই দ-যোগ্য। এ অপরাধ মানুষের মধ্যে মন্দ চর্চার দ্বারা বিকশিত হয়। মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা চারটি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। তা হলো- প্রভুত্বের গুণাবলী, শয়তানী গুণাবলী, পশুত্বের গুণাবলী ও হিংস্রতার গুণাবলী। ‘‘প্রাগুক্ত’’ প্রভুত্বের গুণাবলী দুশ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটায়। যেমন : অহংকার, গর্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রশংসা ও গৌরবের মোহ, বিরোধিতা ও চিরস্থায়িত্বের মোহ, সবার উপরে বড়ত্বের অনুসন্ধান ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্র বিধ্বংসী গুণ। এগুলোই দুর্নীতির জন্ম দেয়। শয়তানী গুণাবলী থেকেও অংসখ্য শাখা-প্রশাখা জন্মে। পক্ষান্তরে এ দু’জন যদি বিকৃত স্বভাব ও কুরুচিপূর্ণ মনের অধিকারী হন এবং আধুনিক ও প্রগতিবাদী সাজার অভিপ্রায় নিয়ে উচ্ছৃংখল আচার-আচরণ, কথা-বার্তা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিসরে চালু করেন, তবে তাদের পরিবারটি নৈতিকতা বিবর্জিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে শ্রদ্ধাবোধ, লজ্জা-শরম, স্নেহ-মমতা ও ভালবাসার পরিবর্তে বেয়াদবি, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও উচ্ছৃংখলতা ব্যাপকহারে চালু হবে। আমাদের সমাজে উচ্ছৃংখল কিছু মাতা-পিতা এমনও রয়েছেন যে, নিজেদের কোমলমতি ও নিষ্পাপ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একই সাথে দেশী-বিদেশী টিভি পর্দায় নর্তক-নর্তকীদের উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ নাচ, অশ্লীল অঙ্গভক্তি ও বিকৃত যৌনাচারমূলক দৃশ্য তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করেন। একটি শিশু দুশ্চরিত্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যতগুলো উপকরণ প্রয়োজন সবগুলোর যোগান এ পিতা-মাতাই দিয়ে থাকে। আবাদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, রসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। বর্ণনাকারী বলেন, নবী করীম স. অশ্লীলভাষীও ছিলেন না এবং অশ্লীলতার ভানও করতেন না।’’ ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-বিরর ওয়াস সিলাহ, অনুচ্ছেদ : মা জাআ ফিল কুহশ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫০। নবী করীম স. বলেন, ‘‘প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অত:পর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বা খৃস্টান বানায় অথবা অগ্নি-উপাসক বানায়।’’ ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-কাদার, অনুচ্ছেদ : মা জাআ কুল্লু মাওলুদিন আলাল-ফিতরাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬৬।
পিতামাতাই যদি নিজ হাতে নিজের সন্তানদেরকে ধ্বংসের পথে তুলে দেন তবে সে সমস্ত পিতা-মাতাকে মূলত : দেশ ও জাতির শত্রু বলেই আখ্যায়িত করা যায়। কারণ অপরিণামদর্শী এসব পিতা-মাতাই জাতীয় দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, গডফাদার, আন্তর্জাতিক চোরাচালানি, চোর-ডাকাত বানাবার সবগুলো উপাদান চেতন বা অবচেতনে পারিবারিক পরিবেশে ছোট কচি মনের শিশুটির জন্য প্রধান যোগানদাতার ভূমিকা পালন করেন। তাই সকল পিতামাতার উচিত নিজের প্রাণপ্রিয় শিশুটিকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলার নিমিত্তে পারিবারিক পরিবেশে আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলুল্লাহ স. প্রদর্শিত পন্থায় সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা চালু করা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : পরিবারের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো একটি শিশুর জীবন গড়ার দ্বিতীয় প্রধান পাঠশালা। এ পাঠশালার পাঠ্য তালিকাও একটি শিশুর জীবনের ভীত রচনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে জাতিসত্তা ও সভ্যতার অবকাঠামো। জাতীয় চরিত্র গঠন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী সৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অবাধ ভোগবাদী সিলেবাস চালু আছে, যা আলোকিত লোক তৈরিতে সম্পূর্ণ অক্ষম। সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যায়, দুর্নীতিবাজদের একটা বিরাট অংশ বর্তমান প্রচলিত শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত। যারা কলমের খোঁচায় ও ফাইল আটকিয়ে রেখে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, অথচ এ শিক্ষাকেই বলা হয় ‘শিক্ষাই আলো’। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমস্ত উচ্চশিক্ষিত লোক কেন আজ অন্ধকার জগতের বাসিন্দা? প্রকৃতপক্ষে উচ্চশিক্ষিত হওয়া আর সৎ লোক হওয়া এক কথা নয়। সৎ ও আধুনিক যোগ্য লোক গঠনের জন্য অবশ্যই আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। কোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি অপরাধের প্রতি ঘৃণা এবং অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার মনোভাব সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন, তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান ও মূখ্য ভূমিকা রাষ্ট্রকেই পালন করতে হবে।
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ গড়ার কারিগর মুহাম্মদ স. দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত একটি সমাজকে উদ্ধারের নিমিত্তে কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তা লক্ষণীয়। সে শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস ছিল আল-কুরআন ও আল-হাদীস। এ শিক্ষা গ্রহণ করে গড়ে উঠেছিলেন আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী রা.-এর মতো মানবেতিহাস খ্যাত শাসক ও মনীষী। এ ব্যবস্থা আত্মস্থ করে এমন একদল মানুষ তৈরি হলেন, যারা অপরাধের পর বিবেকের কশাঘাতে টিকতে না পেরে নিজেদের অপরাধের বিচার প্রার্থনার জন্য রসূলের বিচারালয়ে হাজির হতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অভুক্তকে নিজের খাদ্য বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠলো। এতে এমন এক দল চরিত্রবান নেতৃত্ব গড়ে ওঠলো, যারা এক সময় মানুষের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর জন্য হুমকি ছিলো, পরবর্তীতে তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রাতে-দিনে সুন্দরী, মূল্যবান সব অলঙ্কার পরিহিতা মহিলা একাকি পথ চলেছে কিন্তু কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করেনি, কেউ তার দিকে চোখ তুলে দৃষ্টিপাতও করেনি। প্রত্যেকটি মানুষ পরস্পরের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর বিশ্বস্ত আমানতদার বনে গেল। আল-কুরআন এমন সোনার মানুষ তৈরি করল যে, অর্ধেকটা পৃথিবীর বাদশাহী হাতের মুঠোয় পেয়েও দায়িত্বের ভার তাকে এমনভাবে তাড়া করে ফিরতো যে, আরামের ঘুম দূরে ঠেলে দিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়তো অভুক্ত মানুষের সন্ধানে। কোথাও কি অসহায় মানবতা জুলুমের শিকার হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করছে? কেউ কি তাঁর শাসন কাজে অসন্তুষ্ট? এ সমস্ত প্রশ্ন তাকে সদা অস্থির করে তুললো। প্রয়োজন পূরণে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দু’টি কাপড় নয় বরং অন্যান্য নাগরিকদের ন্যায় একটিই গ্রহণ করলো। কিন্তু এক টুকরা কাপড় দিয়ে তার জামা হওয়ার কথা নয়; ছেলের ভাগের কাপড় দিয়ে নিজের জামা তৈরি করে নিল।
সুতরাং দুর্নীতির সব ব্যবস্থা উন্মুক্ত রেখে দুর্নীতি দমন অসম্ভব। এ জন্য রসূল স.-এর পন্থায় আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য আমাদের সেই কুরআন-যা আজো অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেটিকে আমাদের সকল কাজের মূলনীতিরূপে গ্রহণ করতে হবে।
প্রচার মাধ্যম : দেশের প্রচার মাধ্যমগুলো দুর্নীতি উচ্ছেদে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকার মিডিয়াগুলোকে নৈতিকতাসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য বাধ্য করতে পারে। এতে মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে না। কারণ দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য এ ধরনের বাধ্যবাধকতা কারো স্বাধীনতাকে ক্ষুণœ করে না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ মিডিয়া এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দখলে যারা নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না। যারা অবাধ স্বাধীনতার নাম করে কখনো কখনো সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করতে কসুর করে না। অনেক সময় মনে হয়, এদের কাছে সরকার অসহায়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। কিছুসংখ্যক মিডিয়া আজ ভয়ঙ্কর স্বেচ্ছাচারিতার রূপ ধারণ করেছে। কখনো কখনো দেশের মানুষের চরিত্র হননের সাথে সাথে সমাজ ভাঙনে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। তারা তারা এমনসব তথ্য প্রচার করে, যা আণবিক বোমার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর। বোমা একটা নির্দিষ্ট আওতায় কিছু লোকের জান-মালের ক্ষতি করে থাকে কিন্তু একটি বিকৃত মিথ্যা তথ্য সমাজ ভাঙ্গনের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে থাকে। ইথারে ভেসে ভেসে তার আওতার বিস্তৃতি ঘটায়। সমাজকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করায়। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধের স্থান দখল করে নেয় হিংসা-হানাহানি, বিদ্বেষ আর অমানবিকতা। ফলে মানুষ চরম দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়। সুতরাং সরকারের দায়িত্ব এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রচারমাধ্যমকে নৈতিকতা বিকাশে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাধ্য করা।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন