বর্তমান বিশ্বের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষা করাকে। দারিদ্র্যবিমোচন, জনসংখ্যার আধিক্য রোধ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জাতীয় অগ্রগতি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, অস্ত্র তথা পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ, সম্পদের সুসম বণ্টন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক রাজনীতির উল্লেখযোগ্য এজেন্ডা। মূলত ঠা-া যুদ্ধের অবসান হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যদিয়ে। ঠা-া যুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বে আমেরিকা অনেকটা একক মোড়লের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এখন মুসলিম বিশ্বকে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি। এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও মানবতার জন্য বড় হুমকি। এমন কথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, ঠা-া যুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বে যুদ্ধ সংঘাতের সম্ভাবনা একেবারে কমে গেছে। বরং মহাপরাক্রমশালী আমেরিকা ও তার সা¤্রাজ্যবাদী দোসররা একযোগে মুসলমানদের কল্পিত প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করেছে। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নাম করে দুনিয়া থেকে ইসলামকে চিরতরে উৎখাত করার একটা মহাসমরে সা¤্রাজ্যবাদীরা লিপ্ত হয়েছে। ইসলামী জঙ্গিবাদের ধুয়ো তুলে তারা প্রতিটি মুসলিম দেশের অভ্যন্তরে আত্মঘাতী গোলযোগ সৃষ্টি করছে। মুসলিম নামধারী কিছু অমুসলিম শুধুমাত্র সামান্য কিছু মাসোহারার বিনিময়ে ইহুদিদের পা-চাটা গোলামে পরিণত হয়েছে। অজ্ঞ এই শয়তানরা কখনো ধর্মের নামে দেশে দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাচ্ছে আবার কখনো বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সেজে মিডিয়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বোমা ফাটাচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি। আর এরই সুযোগ নিয়ে আমেরিকা ও সা¤্রাজ্যবাদের দোসররা মোড়লের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। ফলে মুসলিম দেশসমূহের ওপর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে।
ইসলাম দুনিয়ায় আসার পর থেকেই বিরুদ্ধবাদীরা ছিল খড়গহস্ত। ঐতিহাসিকভাবে সত্য যুগে যুগে যত নবী-রাসূল এসছেন প্রায় তাদের সবার ওপরই হয়েছে অত্যাচার, নিপীড়ন। আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন সবাই। কম বেশি সব নবীর উম্মতই ছিলেন নির্যাতিত। শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরও সহ্য করতে হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। অতএব, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হবে এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্মের নাম নয়। নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ঈদ, কুরবানী ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠানের নাম ইসলাম নয়। ইসলামের সামগ্রিক ব্যবস্থা শুধু বিভিন্ন উৎসব আর আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুসের জীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান বিষয় সম্পর্কেই ইসলামের যুগোপযোগী পরিপূর্ণ দিক-নির্দেশনা রয়েছে। আর সেজন্যই ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। অর্থাৎ মানুষের জীবন সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মহান আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে যে বিশেষ নিয়ম-পদ্ধতি বলে দিয়েছেন এবং মহানবী মুহম্মদ (সাঃ) যা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন, তাই হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম কোনো বিশেষ দেশের জন্য বা বিশেষ কোনো অঞ্চলের জন্য আসেনি। এমনকি ইসলাম কোনো বিশেষ জাতি-গোষ্ঠী, কোনো বিশেষ বর্ণ-গোত্রের জন্য আসেনি। ইসলাম শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যও নয়। এটা কারো একক সম্পত্তি নয়। তবে যারা ইসলাম মেনে চলে তাদের মুসলমান বলা হয়। ইসলাম নীতিগতভাবে আরব বা অনারব কারো পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। এটা পূর্ব-পশ্চিমের কোন বিষয় নয়। ইসলাম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কারো বিরোধী নয়। শিরক ও ধর্মহীনতা ইসলাম বরদাস্ত করে না। ইসলাম অসত্য, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার, অনাচার, শোষণ, বঞ্চনা, নীতিহীনতা, আদর্শহীনতা, অশ্লীলতা, ব্যক্তিবাদ, বস্তুবাদ, ব্যক্তিপূজা, বস্তুপূজা, অমানবিকতা, বৈষম্য ইত্যাদির বিরোধী। আর এগুলো প্রাচ্যে হোক বা পাশ্চাত্যে হোক ইসলাম সবসময় তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। অতএব, নীতিগতভাবে ইসলাম কখনোই কোনো বিশেষ অঞ্চল বা জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষ নয়। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ইসলাম সবসময় সোচ্চার। অন্যায়, অবিচার যেখানে যে দেশেই হোক ইসলাম তার বিরুদ্ধে। ইসলাম কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রকে কখনো ঘৃণা করে না। যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ, ইসলামকে একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা এবং মুহম্মদ (সাঃ)কে একমাত্র আদর্শ নেতা হিসেবে মেনে নেয়, কেবলমাত্র তখনই সে মুসলমান হয়। হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ঈমানের স্বাদ পেয়েছে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে ইলাহ, ইসলামকে দ্বীন ও মুহম্মদ (সাঃ)কে রাসূল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে। (সহী মুসলিম)
জীবন বিধান সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের একটি ঘোষণা, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত পশু, রক্ত, শূকরের গোশত, ঐসব পাশু যা আল্লাহর নাম ছাড়া আর কারো নামে যবেহ করা হয়েছে, যা গলা টিপে মারা হয়েছে, যা আঘাতের কারণে মরেছে, যা উপর থেকে পড়ে মরেছে, যা শিংয়ের আঘাতে মরেছে এবং যা হিং¯্র জানোয়ার ধরে মেরেছে, তবে জীবিত অবস্থায় যদি তা যবেহ করা হয়ে থাকে তা হারাম নয়। যে পশু পূঁজারবেদীতে যবেহ করা হয়েছে এবং যা জুয়ার তীর দিয়ে হত্যা করে ভাগ করা হয়। এসবই গোনাহের কাজ। আজ কাফিররা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে গেছে। তাই তোমরা তাদের ভয় করো না, আমাকে ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করে দিলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (তাই হালাল ও হারামের বিধি-নিষেধ মেনে চলো)। তবে কেউ যদি গোনাহের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে কিছু খেয়ে ফেলে তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা আল মায়িদা : ৩)
সম্প্রতি অমুসলিম দেশের মতো আমাদের দেশেও আল্লাহ সুবহানুতায়ালা, নবী মুহম্মদ (সাঃ), মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও শরীয়তের বিধি-বিধান সর্বোপরি ইসলামকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ, অবজ্ঞা ও কটাক্ষ করার মাত্রা বেড়ে গেছে। প্রায়ই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অধ্যাপকরা ক্লাসে ইসলামের ফরজ বিধান হিজাব নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করছেন। অনেক অমুসলিম শিক্ষক এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। এসব করে তারা শুধু নিজেদের অজ্ঞতারই প্রমাণ পেশ করছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব কাজ নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মানুষ ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায় যেসব কথা ও কাজের মাধ্যমে, ইসলামের বিধি-বিধানকে বিদ্রƒপ ও কটাক্ষ করা তার মধ্যে অন্যতম। আল্লাহ-রাসূল, কুরআন-হাদিস নিয়ে মশকরা করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করা বা ঠাট্টা-কটাক্ষ করা সরাসরি কুফরি করার নামান্তর। মুনাফিকদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো ইসলামকে কটাক্ষ করা। মহান আল্লাহ মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আর আপনি যদি তাদের প্রশ্ন করেন, তোমরা কি এসব কথা বলছিলে, তখন অবশ্যই চট করে তারা বলে দেবে যে, আমরা তো হাসি-তামাশ ও খেলাচ্ছলে কথাগুলো বলছিলাম। তাদের জিজ্ঞেস করুন, তোমাদের হাসি-তামাশা, বিদ্রƒপ কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলের সাথে করছিলে?’ (সূরা তাওবা-৬৫)। (চলবে)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন