যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে যে আমাদের রাজনীতিতে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ দ্রুত বিদায় নিচ্ছে। মানুষের হৃদয়ে দয়া মায়া যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটিও যেন ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে। একটি সময় ছিল যখন আইন শৃঙ্খলা বাহীনির গুলীবর্ষণে একজন কি দুইজন ব্যক্তি নিহত হতেন। সে মৃত্যু নিয়ে সে কি তোলপাড় ! পুলিশের গুলীবর্ষণ সঠিক হয়েছে কি বেঠিক হয়েছে, সে বিচার বিবেচনায় কেউ যেতেন না। একজন দুইজন কি তিনজন মানুষ মারা গেছেন, সেটিই হয়েছে তখন সবচেয়ে বড় ইস্যু। পুলিশের গুলীবর্ষণের পক্ষে কথা বলার সাহস কোনো বাপের বেটার ছিল না। কেউ যদি ঠারেঠুরে ওই ইস্যুতে সরকারকে সমর্থন করার চেষ্টাও করতো তাহলে মুহূর্তের মধ্যে শত শত নয়, হাজার হাজার মানুষ সরকারের দালাল বলে তাকে দুয়ো দিতো। দালাল আখ্যা পেয়ে সেই লোকটি অথবা সেই মহলটি লজ্জা ও গ্লানিতে জনসমক্ষে আসা তো দূরের কথা, নিজের পরিবারের কাছে মুখ দেখাতে পারতো না। আর সেই একটি ঘটনায় গুলীবর্ষণই সরকারের ১২টা বাজানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো।
অথচ সেইদিন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন অবস্থাটা যেন সেই ‘চোরের মার ডাঙ্গর গলা’। এখন অসংখ্য মানুষ হত্যা করার পরেও সরকারের চাপাবাজি থামে না। তারা বরং সেই হত্যাকা-কে ডিফেন্ড করার মতো নির্লজ্জ প্রগলভতা দেখাচ্ছে। আরো অবাক লাগে এক শ্রেণীর মিডিয়া এবং পত্রিকার সম্পাদকের আচরণে। এদের মধ্যে দুই চারজন সাংবাদিক শিরোমনি প্রশ্ন তুলেছেন যে বেগম জিয়া তার সাংবাদিক সম্মেলনে ৩০২ ব্যক্তি যে গুম এবং খুন হওয়ার পরিসংখ্যান দিয়েছেন সেটি সঠিক কিনা। দুঃখের বিষয় হলো এই যে ওইসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী পরিসংখ্যান ঠিক কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং মাথা ঘামাচ্ছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে, গুম এবং খুনের মতো নির্মম বর্বর এবং হিটলারী ভূমিকার নিন্দা না করে তারা শহীদদের সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। বেগম জিয়া বলেছেন যে, খুন হয়েছেন ২৪২ জন। আর গুম হয়েছেন ৬০ জন। এখন যদি বিএনপির এই সংখ্যাটি ২০/২৫ জন কম হয় বা বেশি হয় তাহলে সেটি নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলার কোনো অবকাশ থাকে না। বরং সেটি করলে যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার প্রতি অবমাননা করা হয়।
৩০০ এর জায়গায় যদি ২০০ জনও মারা গিয়ে থাকেন তাহলে ওই ২০০ জন কি মানুষ ছিলেন না? টকশোতে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলছেন যে, বেগম জিয়া যে ৩০২ জনের লিস্ট দিয়েছেন সেখানে ওই ৩০২ জনের নামধাম ও ঠিকানা থাকা উচিত ছিলো। তা না হলে নাকি বেগম জিয়ার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই সব কথা যখন তারা বলেন তখন তারা ভুলে যান যে তারা আসলে কি বলছেন। আসলে ওরা জানেন না যে, ওরা ওদের অজান্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করার মতো কাজ করছেন। গ্রীক উপাখ্যানে আছে প্যান্ডোরার বাক্সের কথা। প্যান্ডোরার বাক্সের মুখ খুললে নাকি সেখান থেকে অনেক ভয়ংকর পোকা মাকড় এবং রোগ-জীবাণু বেরিয়ে আসে। বিগত ৪০/৪৫ বছরে অনেক কিছু ঘটেছে যার নেপথ্য কাহিনী প্রকাশিত হয়নি। অথচ অনেকেই সেসব কথা জানেন, কিন্তু প্রকাশ্যে বলেন না। বললে অনেক কিছুর ভিত্তি নড়ে যায়। অনেক পরিসংখ্যান দেয়া হয় যেগুলোর পেছনে বাস্তবতার সমর্থন নাই। সেই সব পরিসংখ্যান চ্যালেঞ্জ করা যায়। কিন্তু সেখানেও অনেক কিছুর ভিত্তি নড়ে যায়।
আমাদের কথা অত্যন্ত সহজ সরল এবং পরিষ্কার। গত আন্দোলনে নিহত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন। তারা পুলিশ হতে পারেন, কিন্তু তারপরেও তারা মানুষ। সুতারাং পুলিশ ভাইদের মৃত্যুতেও রয়েছে আমাদের আন্তরিক সমবেদনা এবং গভীর দুঃখ। যারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন তারাও মানুষ। তাদের মৃত্যুতেও আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। অনুরূপভাবে পুলিশের গুলীবর্ষণে মারা গেছেন প্রায় ৩ শতাধিক আদম সন্তান। এদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা ও কর্মী, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা ও কর্মী এবং সাধারণ জনগণ। বিএনপি, জামায়াত এবং তাদের অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও মানুষ। প্রায় ৩ শত নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষ মারা গেলেন। তাদের জন্য রয়েছে আমাদের গভীর সমবেদনা। তাদের রূহের মাগফেরাত কমনা করছি। কিন্তু আমাদের দেশে একটি বিশেষ মহল রয়েছে যারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী শিবিরে অবস্থান করছেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তারা একই ঘরানার লোক। এদের কাছে বিএনপি ও জামায়াত এবং অঙ্গ-সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীরা মানুষ নয়। তারা হলো বিএনপি এবং জামায়াত। এরা মনুষ্য পদবাচ্য নয়। তাই তারা মরলে কোনো আপসোস নাই। ওরা মরুক, শত শত, হাজার হাজার। কুচ পরোয়া নাই।
দুই
তবে আমার অবাক লাগে, জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল এবং ঘরানার নিষ্ক্রিয়তা দেখে। আওয়ামী লীগের প্রচার শক্তির কাছে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী ঘরানা সব সময় ম্লান থাকছে। নির্বাচনের নামে যত বড় তামাশা এবং পুকুর চুরি আওয়ামী লীগ করল সেটা যদি বিএনপি ক্ষমতায় থেকে করতো আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতো, তাহলে এতদিন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বুকে কেয়ামত নাযিল করতো। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু যখন আওয়ামী লীগ হাতে নেয় তখন সেটি সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা ছিলো না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী এমন উথাল-পাতাল শুরু করে যে তৎকালীন বিএনপি সরকার পদত্যাগ করতে এবং তত্ত্বাবধায়ক মেনে নিতে বাধ্য হয়। অথচ বিএনপি এমন একটি জনপ্রিয় ইস্যু ক্যাশ করতে পারলো না। তথাকথিত নির্বাচনের আগে প্রায় বছর খানেক ধরে চার পাঁচটি জনমত জরিপ হয়। সেই জরিপে দেখা যায় যে, মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে, টেলিভিশনের প্রতিটি টকশোতে এবং পত্র পত্রিকার লেখালেখিতে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠেছিলো। সেই জনমতকে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামাতে পারলে পরিস্থিতি উল্টে যেতো। অথচ বিএনপি সাংগঠনিক পরিপক্কতার অভাবে এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অনুপস্থিতিতে সেই সুযোগটি হারিয়েছে।
তিন
বিগত আন্দোলন সফল হয়েছে কি ব্যর্থ হয়েছে তার সরাসরি জবাব দেয়া মুশকিল। যদি ভোট প্রদানের সংখ্যা ধরা যায়, তাহলে বলতেই হবে যে ওই আন্দোলন পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছে। কারণ ইলেকশনে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি এত কম, তারপরেও ৩০০ জন এমপির মধ্যে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং বিনা ভোটে এমপি বনে গেছেন। সুতরাং বলা যায় যে ১৯ দলের আন্দোলন সম্পূর্ণ সফল। কিন্তু আবার অন্যভাবে বিচার করলে আন্দোলনটি পূর্ণ সফলতা পায়নি। কারণ আন্দোলনের জোরালো লক্ষ্য ছিলো এই সরকারের অপসারণ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। অনেক রক্ত গেছে। তারপরও নির্বাচনে সেই কাংখিত ফল আসেনি।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, কেন সরকারের পতন ঘটলো না সেটি নিরাসক্ত মনে আমাদের বড় বড় নেতাদের এই ব্যাপারটির কারণ খুঁজে বের করা উচিত। এটি খুব জরুরী। এবার অনেক প্রাণ গেছে কিন্তু বাঞ্ছিত ফল লাভ হয়নি। কর্মীরা এবার মাঠে নামার আগে একবার হলেও ভাববে যে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বো কিন্তু সাফল্য আসবে তো?
একটি সরকারের পতন ঘটাতে গেলে তিন চারটি পথে সেটি ঘটে। প্রথমটি হলো, পার্লামেন্টারী পথে। বিএনপি পার্লামেন্টে নাই। সুতরাং সেই পথে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত সামরিক অভ্যুত্থান। আমারা সেই পথের ঘোরতর বিরোধী। তৃতীয়ত, গণঅভ্যুত্থান। আমরা সাম্প্রতিককালে দেশে বিদেশে কয়েকটি গণঅভ্যুত্থান দেখতে পাই। অনেক আগে রাশিয়া এবং চীনে যে কমিউনিস্ট বিপ্লব দেখেছি সেটাকে ঠিক গণভ্যুত্থান বলা যায় না। তাই সেটি আমাদের পথ নয়। আরো একটি কথা খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই। সেটি হলো, আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম বা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী নই। কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো বা বলিভিয়ার চেগুয়েভরার পথ আমাদের নয়। আমাদের পথ হতে পারে ১৯৮৯ সালে সংঘটিত চেকোস্লোভাকিয়ার ভেলভেট রেভ্যুলিউশন বা মখমল বিপ্লব। অথবা ২০০৪ থেকে ২০০৫ সালে সংঘটিত ইউক্রেনের অরেঞ্জ রেভ্যুলিউশন বা কমলা বিপ্লব। অথবা ২০১১ সালে সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে জেসমিন রেভ্যুলিউশন বা জেসমিন বিপ্লব। জেসমিন বিপ্লবের উৎপত্তি এবং বিকাশ আফ্রিকার তিউনিশিয়ায়।
এদেশের ইসলামী এবং জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের আন্দোলনে নেবেনা কোনো সামরিক বাহিনীর সাহায্য, নেবে না কোনো বিদেশী শক্তির সাহায্য। তাই তাদেরকে শুধুমাত্র জনগণের সাহায্য এবং শক্তির ওপরে নির্ভর করতে হবে। বিগত আন্দোলনে কূটনৈতিক নির্ভরতার একটি ক্ষতিকর প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। বিদেশীরা আমাদের বন্ধু, কিন্তু তাই বলে প্রভু নয়। আমাদেরকে ইউরোপে যেতে হবে না। আমাদের মুসলিম ভাইদের দেশে গণবিপ্লবের বেশ কয়েকটি নজির রয়েছে। জেসমিন বিপ্লবকে ‘আরব বসন্ত’ও বলা হয়। সকলের আশা ছিলো এই যে বাংলাদেশেও হয়তো ওই আরব বসন্তের পরিবর্তে ‘বাংলা বসন্ত’ আসবে। আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্যের যেসব মুসলিম দেশকে নাড়া দিয়েছিলো তাদের মধ্যে সামনের সারিতে রয়েছে তিউনিশিয়া, ইয়েমেন এবং মিশর। লিবিয়ার বিপ্লবকে আমি জনগণের বিপ্লব বলি না। কারণ সেখানে ন্যাটো বাহিনীর প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছিল। বাংলাদেশেও জেসমিন বিপ্লব ঘটবে বলে ধারণা করা হয়েছিলো। কিন্তু তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিশ, ইয়েমেনের রাজধানী সানা অথবা মিশরের রাজধানী কায়রো যেভাবে লাখ লাখ জনতার পদভারে প্রকম্পিত হয়েছিলো তেমনিভাবে লাখ লাখ জনতার পদভারে ঢাকা প্রকম্পিত হয়নি। মফস্বল জেলাগুলো কেঁপে উঠেছিলো। কিন্তু ঢাকা কেঁপে ওঠেনি। সেই জন্যই সরকারের পতন ঘটেনি। কথায় বলে, ঈধঢ়রঃধষ রং ঃযব ংবধঃ ড়ভ চড়বিৎ. অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হলো রাজধানী। সেই রাজধানী ঢাকাই কেঁপে উঠলো না। তাহলে সরকার নড়ে যাবে কিভাবে? এবারের আন্দোলনের প্লাস এবং মাইনাস পয়েন্ট বাইরে থেকে আমরা জেনেছি। এখন নেতারা, যারা ভেতরে আছেন, তারা কি জানতে পেরেছেন? অথবা এই বিষয়ে ভাবছেন?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন