খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের এক জনসমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং বিভিন্ন সময়ে মুসলিম হত্যাকা-ের শিরোমণি নরেন্দ্রনাথ মোদি। এর ক’দিন আগেই চরম হিন্দুত্ববাদী প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিল। মঞ্চে একের পর এক বিভিন্ন ধর্ম ও পেশার প্রতিনিধিরা নিজেদের প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে নরেন্দ্রনাথ মোদিকে পাগড়ি ও গেরুয়া রঙের উত্তরীয় ধরনের কিছু না কিছু পরিয়ে দিচ্ছিলেন। হাতে ফুলও তুলে দিচ্ছিলেন অনেকে। মিস্টার মোদিও হাসিমুখে সেগুলো পরছিলেন, নিচ্ছিলেন এবং মাথা নত করে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটল একজন মুসলমান নেতার বেলায়। তিনি গিয়েছিলেন একটি টুপি পরিয়ে দেয়ার জন্য। মিস্টার মোদি সোজা অস্বীকার করে বসলেন। মাথায় পরা দূরে থাকুক এমনকি তিনি টুপিটি ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখলেন না। আগেই হাত নেড়ে না করে দিলেন। এসবই ঘটছিল এক প্রকাশ্য জনসমাবেশে। মুসলমানদের ব্যাপারে এভাবেই ঘটে আসছে ভারতে। সে একই নরেন্দ্রনাথ মোদি সম্প্রতি আসামের শিলচরে এক সমাবেশে ঘোষণা করেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ থেকে ‘শরণার্থী’ হিসেবে ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা তো করবেনই, চাকরি-ব্যবসা দেয়ার পাশাপাশি তাদের ভোটার হওয়ারও সুযোগ দেবেন। এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। বলেছেন, হিন্দুদের প্রতি ভারত ও বিজেপির বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। লক্ষণীয় যে, মিস্টার মোদি কিন্তু মুসলমানদের ব্যাপারে তেমন কিছুই বলেননি। শুধু তা-ই নয়, বিজেপির এই প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী আরো ঘোষণা করেছেন, তার দল ক্ষমতায় এলে আগামী ৬০ মাসের মধ্যে ভারত ‘রামরাজ্য’ হবে। অর্থাৎ বিজেপি ভারতকে হিন্দুদের ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করবে।
বর্তমান পর্যায়ে কথা উঠেছে ভারতের আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে। আগামী মে’তে দেশটিতে লোকসভার নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। লোকসভা ভারতের পার্লামেন্ট বলে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে একই সঙ্গে ক্ষমতায়ও পরিবর্তন ঘটতে পারে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন ইউপিএ জোটের প্রধান দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এরই মধ্যে দলের নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সামনে এনেছে। অন্যদিকে চরম হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি এনেছে নরেন্দনাথ মোদিকে। লোকসভার এই নির্বাচন নিয়ে ভারতে শুধু নয়, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশেও এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আমরা অবশ্য এখনই সে আলোচনায় অংশ নিতে চাই না। এখানে আমরা বরং কিছু তথ্য ও ঘটনার উল্লেখের মাধ্যমে মুসলমানদের প্রশ্নে ভারতীয়দের রাজনীতিকদের মনোভাব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া, যাতে অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার হবে। সে বিষয়টি হলো, মুসলমানদের প্রতি ভারতীয় হিন্দুদের মনোভাব সেই বৃটিশ আমলের মতোই রয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘টু নেশন থিওরি’তে কোনো ভুল বা অতিরঞ্জন ছিল না। মিস্টার জিন্নাহ আসলেও একশ ভাগ সত্যই বলেছিলেন।
প্রথমে ‘ওপার বাংলা’র কথাই বলা যাক। শুনলে আমাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সুশীলজনরা রা-রা করে উঠতে পারেন, কিন্তু ভারত এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র যে, কলকাতার মুসলিম প্রধান পার্ক সার্কাস এলাকায় মুসলমানরা এখনো জুমার নামাজ পড়তে যান টুপি পকেটে নিয়ে। অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়ে যেন কোনো মহাঅপরাধ করতে যাচ্ছেন! ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কমিউনিস্টদের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিমবঙ্গে তথা এদেশের অনেকের অতি প্রিয় ‘ওপার বাংলা’য় মাইকে আযান দেয়া আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নয়াদিল্লী¬র তথা ভারতের রাজধানীর দিকে লক্ষ্য করুন। ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর মতো বিদেশিনী খ্রিস্টান রমণীকেও নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার আগে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে, হাঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে এবং ঢাকঢোল বাজিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। মন্দিরে গিয়ে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে হিন্দুদের দেবীকে পেন্নাম করতে হয়। অথচ সোনিয়া গান্ধী হিন্দু নন। এসবই ভারতের রাজনীতিতে অবশ্য পালনীয়Ñ সোনিয়া গান্ধী থেকে নরেন্দ্রনাথ মোদি পর্যন্ত রাজনীতিকদের প্রত্যেককে হিন্দু ধর্ম এবং ধর্মের বিধিবিধান মানতে হয়। না হলে ভোট পাবেন না তারা। কথাগুলো জানানোর উদ্দেশ্য এ কথা স্পষ্ট করা যে, যতই ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সেø¬¬াগান দেয়া হোক না কেন, ভারত এখনো সর্বতোভাবেই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র রয়ে গেছে। দেশটিতে মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের বিপদও বাড়ছে পাল্ল¬¬া দিয়ে।
উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রসঙ্গক্রমে ২০০২ সালের সংঘটিত গুজরাট হত্যাকা-ের উল্লেখ করা দরকার। গোধরায় একটি ট্রেনে অগ্নিসংযোগের মিথ্যা অভিযোগে দিনের পর দিন ধরে সেবার শত শত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী মুসলমানদের স্বার্থে কোনো পদক্ষেপ নেননি। শুধু তা-ই নয়, হত্যাকা- নিয়ে লোকসভায় বিতর্ক শুরু হওয়ার প্রাক্কালে গোয়ায় অনুষ্ঠিত বিজেপির সম্মেলনে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গুজরাট হত্যাকা-ের জন্য উল্টো মুসলমানদেরই দায়ী করেছিলেন। তার কথাগুলোও ছিল উস্কানিমূলক। তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানেই মুসলমান সেখানেই সন্ত্রাস। তাদের ধর্ম সন্ত্রাস শেখায় এবং পৃথিবীর কোথাও তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে না।’ বাজপেয়ী গুজরাট পরিস্থিতির জন্য তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের এবং গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদির কোনো দায়-দায়িত্ব নেই বলেও ঘোষণা করেছিলেন। এককালের সমাজতন্ত্রী ও বাজপেয়ীর প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বক্তব্যও স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘রেপ বা ধর্ষণ এমন কোনো বিষয় নয়। এটা অতীতেও বহুবার ঘটেছে। গর্ভবতী মায়ের পেট কেটে শিশু হত্যার যে কথা বলা হচ্ছে, তা কি এক গুজরাটেই ঘটেছে? ১৯৪৭ সাল থেকে এমন ঘটনা কতবার ঘটেছে তার হিসাব কষে দেখুন।’ প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বক্তব্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দুজনই প্রকারান্তরে মুসলিম হত্যাকা-ে নিজেদের সমর্থন ও অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছিলেন। তাদের কথায় ঘাতকদের প্রতিও সমর্থন ও উস্কানি ছিল যার অর্থ হলো, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে হত্যার অভিযান চালানো যেতে পারে! এতে দোষের কিছু নেই এবং এটাই ভারতীয় মুসলমানদের প্রাপ্য!
‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ ধ্বজাধারী ন্যাশনাল কংগ্রেস ও বামপন্থীসহ বিজেপির বিরোধিতাকারী দলগুলোও কখনো মুসলমানদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনি। গুজরাট হত্যাকা-ের দিনগুলোতে দেখা গেছে, রাজ্যের রাজধানী আহমেদাবাদে যাওয়ার কিংবা মুসলমানদের বাঁচানোর লক্ষ্যে ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে সোনিয়া গান্ধী শুধু লোকসভার অধিবেশন আহ্বান জানানোর দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। এর ফলেও ঘাতকরা যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। এদেশের কারো কারো ‘কাকাবাবু’ জ্যোতি বসু তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাকেও শুধু কলকাতা আর দিল্লী¬তেই দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। এভাবেই এক মাসের বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছিলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের রাজনৈতিক নেতারা। লোকসভার অধিবেশনে দেয়া ভাষণেও সোনিয়া গান্ধী গুজরাট হত্যাকা-ের তদন্ত ও বিচারের এবং মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তেমন জোরালোভাবে জানাননি। তিনি প্রধানত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দনাথ মোদিকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছিলেনÑ যেন ওই একজন মাত্র ব্যক্তিকে সরানো হলেই মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে! যেন হত্যার অভিযানে বাজপেয়ীসহ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো ভূমিকা বা অংশগ্রহণই ছিল না! প্রাসঙ্গিক অন্য একটি তথ্যও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী তখন গুজরাটের রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সোনিয়া গান্ধী সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ গুজরাটে তখন নির্বাচন হলে মুসলমান নিধনে নেতৃত্ব দেয়ার ‘পুরস্কার’ হিসেবে বিজেপি জোটই জয়ী হতো এবং নরেন্দ্রনাথ মোদিই আবারও মুখ্যমন্ত্রী হতেন। ভারত এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশ! এর মধ্যদিয়েও প্রমাণিত হয়েছিল, ভারতে এখনো ‘টু নেশন থিওরি’ই একশ ভাগ সত্য। উল্লেখ্য, বিজেপি এখনো গুজরাটের ক্ষমতায় রয়েছে এবং মোদিই আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।
এখানে কংগ্রসের ভূমিকাও লক্ষ্য করা দরকার। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিরোধিতা ও প্রতিবাদের নামে কংগ্রেস তখন যেটুকু করেছিল তার সবই করেছিল নিজের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচিতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কংগ্রেসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের অন্যান্য রাজ্যে ‘ভোট ব্যাংক’ মুসলমানদের সন্তুষ্ট করা। অর্থাৎ কংগ্রেসের উদ্দেশ্যের মধ্যে মুসলমানদের জানমাল হেফাজতের কোনো উপাদান ছিল না। সবই ছিল নিতান্ত রাজনৈতিক কৌশল। বলা দরকার, কংগ্রেসই সবচেয়ে বেশি সময় ভারতের ক্ষমতায় থেকেছে এবং কংগ্রেসের সময়ও মুসলমানরা একইভাবে হত্যা ও দাঙ্গার শিকার হয়েছেন। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ যখন ভেঙে ফেলা হয়, তখনও কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। কিন্তু কংগ্রেস সরকার বাবরী মসজিদ ভাঙা যেমন প্রতিহত করেনি, তেমনি ব্যবস্থা নেয়নি মুসলমানদের হত্যার অভিযান থামানোর জন্যও। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং বলেছেন এবং পরবর্তীকালে এ কথা প্রমাণিতও হয়েছে যে, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানী বাবরী মসজিদ ভাঙার কর্মকা-ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস সরকার এই দুজনসহ কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সত্যিকার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কোনো রাষ্ট্রে এমনটা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাটসহ সারা ভারতে মুসলমানদের হত্যাকা- সম্ভব হওয়ার কারণ হচ্ছে, সংবিধানে লেখা থাকলেও এবং প্রকাশ্যে প্রচারণা চালানো হলেও ভারত এখনো উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি, মনোভাব ও কৌশল নিয়েই এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে মুসলমানদের হত্যা করা, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালানো এবং মুসলমানদের পদানত রাখার ব্যাপারে গোপনে গোপনে সব দলের মধ্যেই রয়েছে বিচিত্র সমঝোতা। পার্থক্য হলো, বিজেপি যেখানে হিন্দুত্ববাদী পরিচিতিকে প্রকাশ্যে আনে, কংগ্রেস সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সাইনবোর্ডকে সামনে রাখে।
এখানে কমিউনিস্ট ও বাম নামধারীদের প্রসঙ্গেও বলা দরকার। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ এবং ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানবিরোধী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে অন্য ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও সে সময় পাল্ল¬¬¬া দিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আগের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে এই বিরোধিতায় তেমন কমতি ছিল কিনা? উত্তর হলো, সর্বতোভাবে ভারতের স্বার্থ উদ্ধারে নিয়োজিত থাকলেও জ্যোতি বসু এদেশে অনেকেরই ‘কাকাবাবু’ হওয়ার চাতুরিপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ‘কমরেড’ জ্যোতি বসু যেখানে অভিনয় করার কৌশল নিয়েছিলেন, ‘কমরেড’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেখানে কূটনৈতিক শালীনতা ও শিষ্টাচার পর্যন্ত মানেননি। এই নেতার কথাবার্তা শুনে বরং মনে হয়েছে, প্রকাশ্য পরিচিতিতে একজন ‘কমিউনিস্ট’ হলেও তার আবির্ভাব ঘটেছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি, আরএসএস ও সংঘ পরিবার থেকে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেগে থাকার জন্যই যেন তাকে মুখ্যমন্ত্রী বানানো হয়েছিল! উদাহরণ দেয়ার জন্য এখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কিছু মন্তব্যের উল্লেখ করা যায়। ২০০৪ সালের ১৭ আগস্টের বোমাবাজি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যখন ভীতসন্ত্রস্ত ও চরমভাবে ক্ষুব্ধ, পশ্চিমবঙ্গের এই ‘কমরেড’ মুখ্যমন্ত্রী তখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ‘সেকেন্ড ফ্রন্ট’ আবিষ্কার করে বসেছিলেন। বোমাবাজির ঠিক পরদিন উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও চরম বাংলাদেশবিরোধী হিসেবে পরিচিত কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখন একটা থ্রেট’। এ শুধু কথার কথা ছিল না। কারণ অত্যন্ত ক্ষোভ ও বিরক্তির সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ যে একটা ‘থ্রেট’ এবং পাকিস্তান যে বাংলাদেশে তার ‘সেকেন্ড ফ্রন্ট’ খুলেছে এই কথাটি তিনি দিল্লী¬¬কে তথা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ততবার’ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ‘যতবার’ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু ‘আফসোসের’ বিষয়, কেউই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথাকে তেমন ‘পাত্তা’ দেননি। তা সত্ত্বেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার নিজের মনের মতো করে ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন। আনন্দবাজারকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে ‘কমরেড’ মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘মৌলবাদীরা’ এমনভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছে, যার ফলে ‘ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম’ নাকি একটি ‘জটিল জায়গায়’ চলে গেছে! তিনি আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, কথিত ‘মৌলবাদীদের’ প্রতিফলন নাকি সরকারে এবং সেনাবাহিনীতেও হচ্ছে! এজন্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাংলাদেশকে একটা ‘থ্রেট’ মনে করেছিলেন। বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে তিনি যে পাকিস্তানের পাশাপাশি সার্বিকভাবে মুসলমানদেরই টেনে এনেছিলেন সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ ভারতের তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেরও কারো কাছে মুসলমানদের আশা করার বা পাওয়ার কিছু নেই তা তিনি মুখ্যমন্ত্রী বা রাজুৈনতিক নেতা, কূটনীতিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বা নোবেল বিজয়ী যা-ই হোন না কেন। এ ব্যাপারে সর্বশেষ খেল তো বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও কম দেখাননি যাকে এদেশের বিশিষ্টজনরা নিজেদের ‘দিদিমণি’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন!
উদ্বেগের কারণ হলো, ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মুসলিমবিরোধী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠনেরও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। দেশটিতে হিন্দু ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন শুধু গড়েই ওঠেনি, সেগুলো দশকের পর দশক ধরে তৎপরতাও চালিয়ে আসছে। এসব সংগঠনের সঙ্গে ভারতের সেনাবাহিনীও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। তাদের লক্ষ্য ভারতকে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। তারা ভারতের সেনাবাহিনীতে হিন্দুত্ববাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। পেছনে রয়েছে শিব সেনা, বজরঙ্গ দল, আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা ভিএসপির মতো কয়েকটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল। দলগুলো সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের অফিসার ও সৈনিকদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে ভেড়াচ্ছে। পুলিশ অনেক উপলক্ষেই প্রমাণ পেয়েছে, ভারতের সেনাবাহিনী ও হিন্দু সন্ত্রাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা মুসলমানদের হত্যাসহ নানা রকমের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। কারণ নির্দেশ আসে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কাছ থেকে। সব প্রধানমন্ত্রীর আমলেই ‘র’ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ ভারতের রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, ‘র’ এবং সন্ত্রাসীদের সমন্বিত নেটওয়ার্ক একযোগে কাজ করছে। বাবরী মসজিদ ধ্বংস ও মুসলমান হত্যা, গোধরায় ট্রেনে অগ্নিসংযোগ, গুজরাট গণহত্যা, মালেগাঁওয়ের বোমা বিস্ফোরণ, সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগ এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব অপরাধেই রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, ‘র’ এবং সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিটি হত্যাকা-ের সময় তো বটেই, আগে-পরে সব উপলক্ষেও প্রমাণিত হয়েছে, ভারতীয় মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো দল ভারতে নেই। অদূর ভবিষ্যতেও তেমন কোনো দলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হিসেবে যত প্রচারণাই চালানো হোক না কেন, ভারত এখনো হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। বিশ্লে¬ষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ভারতের সব রাজনৈতিক নেতাই ভারতীয় হিন্দু হিসেবে তাদের জাতীয় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন!
বর্তমান পর্যায়ে এত কথা বলার একটি কারণ হলো, অমন এক ভয়ঙ্কর দেশ ভারতের চামচামো করার মতো লোকজনের সংখ্যা এদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তো বটেই, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্য সব ক্ষেত্রেও তারা দাপটের সঙ্গে তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব লোকজনই কথায় কথায় বাংলাদেশকে ‘এপার বাংলা’ বানিয়ে ছাড়ছে যেন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ ‘ওপার বাংলা’ পশ্চিমবঙ্গের মতো ভারতের একটি রাজ্য মাত্র! বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, সবকিছুর পেছনে রয়েছে একই সুচিন্তিত পরিকল্পনা। বাংলাদেশের জনগণকে তারা ধীরে ধীরে ভারত নামের ট্যাবলেট গেলানোর কৌশল নিয়েছেন। ভারতীয়রা এমন কিছু করতেই পারেন, কিন্তু উদ্বেগ বেড়ে চলেছে আসলে বাংলাদেশের ওই গোষ্ঠীর কর্মকা-ে। বিষয়টি নিয়ে এখনই গভীরভাবে চিন্তা না করা হলে বিপদ শুধু মুসলমানদের বাড়বে না, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বও বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে।
আহমদ আশিকুল হামিদ