সৈয়দ আবদাল আহমদ
সংসদ সদস্য থেকেও পদত্যাগ করেছেন সোহেল তাজ। তার এবারের পদত্যাগও সর্বত্র আলোড়ন তুলেছে। শাবাশ সোহেল তাজ, শাবাশ। অন্যায়ের প্রতিবাদ আপনি সঠিকভাবেই করেছেন। আপনার সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী ও আইনসম্মত। অন্যরা আইন এবং সংবিধানকে তোয়াক্কা না করলেও আপনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এটা করা ভুল। আপনার বাবা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দিন আহমদের কথাও দেশবাসীর স্মরণে আছে। তিনিও সত্য কথা বলতে দ্বিধা করেননি, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি এবং সেজন্য মফন্ত্রত্ব থেকে পদত্যাগ করতেও পিছপা হননি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সোহেল তাজ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হলে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর পাঁচ মাসের মাথায় ২০০৯ সালে ৩১ মে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন এবং পরদিন ১ জুন পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি তার এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। সংবিধানের ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে পাঠান যমুনায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর ২০০৯ সালের ৪-৮ জুন সোহেল তাজ আবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অফিস করেন। কিন্তু ৯ জুন ২০০৯ হঠাত্ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়নি, তিনি ছুটি নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর সোহেল তাজ স্পষ্ট জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সঠিক নিয়ম অনুযায়ী তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। এ ঘটনার পর উচিত ছিল সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী পদত্যাগপত্রটি গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠিয়ে দেয়া। কিন্তু সরকার থেকে প্রচার করা হয়, সোহেল তাজ ছুটি নিয়েছেন। সোহেল তাজ যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই সাংবাদিকদের আবারও জানিয়ে দেন, তিনি সরকারে নেই। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। এ পদে তিনি আর ফিরবেন না। এ ঘটনার পর সরকার থেকে আর কিছুই বলা হয়নি। সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে কি হয়নি, কিছুই বলেনি সরকার। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি সোহেল তাজ আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে সরকারের পক্ষ থেকে তার জন্য প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার সব প্রটোকলের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বিমান থেকে নেমে তিনি সরকারের প্রটোকল নেননি; সরকারের গাড়িতেও ওঠেননি। বোনের গাড়িতে করে সোজা চলে যান বাসায়। ওই দফায় ২০ দিনের মতো দেশে অবস্থান করে আবার চলে যান আমেরিকায়। প্রায় ৬ মাস পর আবার তিনি দেশে ফেরেন। সেবারও তিনি বিমানবন্দরে কোনো প্রটোকল নেননি। ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট দেখা যায়, সোহেল তাজকে ‘দফতরবিহীন প্রতিমন্ত্রী’ হিসেবে নতুন নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ ওয়েবসাইটেও তাকে ‘দফরতবিহীন প্রতিমন্ত্রী’ হিসেবে দেখানো হয়। পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলে আবারও সোহেল তাজ জানিয়ে দেন, প্রতিমন্ত্রিত্বের পদে তিনি নেই এবং এ পদে তিনি আর ফিরে আসবেন না। তবুও বিষয়টি সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সুরাহা করা হয়নি। এরপর এ নিয়ে আর কোনো আলোচনা দেখা যায়নি। সম্প্রতি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলে তার পদত্যাগ নিয়েও ঘটে একই ধরনের ঘটনা। পরদিন হঠাত্ সরকার থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, সুরঞ্জিত দফতরবিহীন মন্ত্রী। অথচ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করে গাড়ির পতাকা নামিয়ে রেল ভবন থেকে সোজা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। অবশ্য সরকারের ঘোষণার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সোহেল তাজের মতো বলেননি, তিনি আর এ পদে নেই; বরং তিনি খুশিই হন। এ ঘোষণায় অনেকটা যেন প্রাণ ফিরে পান সুরঞ্জিত। বিবিসিকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এ ব্যাপারে তার বলার কিছু নেই।
পদত্যাগ নিয়ে এ ঘটনার পর বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও ডক্টর শাহদীন মালিক সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর মন্ত্রী নেই। দফতরবিহীন মন্ত্রীর পদে তার থাকা এখন অবৈধ। নতুনভাবে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করতে হলে আবার শপথ লাগবে। তারা সোহেল তাজের পদত্যাগ নিয়েও একই কথা বলেন। অর্থাত্ তার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পদটিও শূন্য হয়ে গেছে।
সুরঞ্জিতের মন্ত্রিত্ব নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, ঠিক এ সময় কৃষক দলের মুজিবনগর দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেননি। আরও বললেন, সোহেল তাজের পদত্যাগপত্রও তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাননি। অর্থাত্ প্রায় ৩ বছর পার হয়ে গেল। সোহেল তাজের পদত্যাগপত্রটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাছেই রেখে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এ তথ্য বের হলে এ নিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী এভাবে কি পদত্যাগপত্র আটকে রাখতে পারেন কিংবা গায়েব করে দিতে পারেন? কোনো মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ না চান, সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে আলোচনা করে বা তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পদে রেখে দেবেন। পদত্যাগের ব্যাপারে সিরিয়াস থাকলে সাংবিধানিকভাবে তিনি তো আর তাকে জোর করে আটকে রাখতে পারেন না।
দেশের বিশিষ্ট সংবিধানবিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা স্পষ্টভাবে বলেছেন, সোহেল তাজের পদত্যাগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা করছেন, তা সংবিধান ও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তারা বলেছেন সুরঞ্জিত ও সোহেল তাজের দফতরবিহীন মন্ত্রিত্ব অবৈধ। সংবিধানের ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের পদ শূন্য হয়ে গেছে। তাদের দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় রাখার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, গাড়িতে-বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন—সবকিছুই অবৈধ। সংবিধান অনুযায়ী তাদের পদত্যাগপত্র নাকচ করার কোনো সুযোগ নেই প্রধানমন্ত্রীর। আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী এক অর্থে অবৈধ কাজই করেছেন। অন্যায়ের এখানেই শেষ নয়। দেখা গেছে, সোহেল তাজ চাচ্ছেন না অথচ তার অজান্তে তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে বেতনের টাকা জমা হচ্ছে। বিষয়টি জানার পর ১৭ এপ্রিল সোহেল তাজ আমেরিকা থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি চিঠি পাঠিয়ে তার পদত্যাগের গেজেট কেন জারি হয়নি, জানতে চান। একই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতনের টাকা জমা দেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ৩৩ মাসের টাকা ফেরত নেয়ার অনুরোধ করেন।
কিন্তু এই চিঠির পরও সরকারের টনক নড়েনি। ফলে গতকাল সংসদ সদস্যের পদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেছেন। শুধু পদত্যাগই নয়, স্পিকারের কাছে সংবিধান অনুসরণ করে পদত্যাগপত্র পাঠানোর পর তিনি তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের উদ্দেশেও একটি খোলা চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি বলেন, সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগের এ সিদ্ধান্ত তিনি অনেক চিন্তাভাবনা করেই নিয়েছেন। তবে এর কারণ তিনি খুলে বলতে পারছেন না। তার মতে, সবকিছু খুলে বলা যায় না। তিনি শুধু বলেছেন, ‘বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কাপাশিয়ার মানুষের সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কথার পেছনে অনেক কথা থাকে। অনেক লুক্কায়িত সত্য থাকে—যা দেশ, জনগণ ও দলের স্বার্থে জনসম্মুখে বলা উচিত নয় এবং বলা সম্ভবও নয়। তবে সঙ্গত কারণেই আমি এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করেছি।’
সোহেল তাজ সাধারণ কোনো পরিবারের কেউ নন, তিনি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান তিনি। তাজউদ্দীন আহমদের সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছে। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৫ মার্চ রাত ১২টায় তাজউদ্দীন আহমদ সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তাকে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সঙ্গে একটি টেপ রেকর্ডারও নিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করেননি। তিনি তাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে গেলে পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিচার করবে।’ এই ঐতিহাসিক তথ্যটি স্থান পেয়েছে দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর বইয়ে।
স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সরকার পরিচালনা নিয়ে কিছু মতভেদও হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী মরহুম ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে এর বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, ১৯৭৪ সালের ১৩ অক্টোবর অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ইউরোপ সফর করে দেশে ফিরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ভ্রান্ত নীতি নেয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি রসাতলে গেছে।’ তার এই বক্তব্য পরদিন সব পত্রিকায় ছাপা হয়। এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার মন্তব্য সম্পর্কে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ দলের নেতারা পত্রপত্রিকায় তার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। সৃষ্টি হয় তীব্র মতভেদ। এ অবস্থায় ২৬ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মন্ত্রিত্ব থেকে তিনি ইস্তফা দেন।
ড. ওয়াজেদ মিয়া বইয়ে এ সম্পর্কে আরও লেখেন, ‘এই দুঃখজনক ঘটনার পর থেকে তাজউদ্দিন আহমদ রাজনীতি থেকে বেশ নিষ্ক্রিয় থাকেন। তার রাজনৈতিক সহকর্মী বা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মীর সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করেছেন বলেও শোনা যায়নি। শুধু মাঝে মধ্যে ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আবাহনী মাঠে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে।’ তার পদত্যাগ সম্পর্কে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের দফতর থেকে তার পদত্যাগপত্র টাইপ করে তাজউদ্দিন আহমদের কাছে সই করে দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল।
পঁচাত্তরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার নেতার হত্যাকাণ্ডে তিনিও হত্যার শিকার হন। সেই তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান সোহেল তাজ অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। তার রক্তে তাজউদ্দীন আহমদের রক্ত প্রবাহিত। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি এক প্রতিবাদী যুবক। পদত্যাগ করে বাবার মতো এবং চাচা আফসার উদ্দিন আহমদের মতো সাহসী সিদ্ধান্তই নিয়েছেন সোহেল তাজ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সোহেল তাজ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হলে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর পাঁচ মাসের মাথায় ২০০৯ সালে ৩১ মে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন এবং পরদিন ১ জুন পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি তার এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। সংবিধানের ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে পাঠান যমুনায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর ২০০৯ সালের ৪-৮ জুন সোহেল তাজ আবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অফিস করেন। কিন্তু ৯ জুন ২০০৯ হঠাত্ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়নি, তিনি ছুটি নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর সোহেল তাজ স্পষ্ট জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সঠিক নিয়ম অনুযায়ী তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। এ ঘটনার পর উচিত ছিল সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী পদত্যাগপত্রটি গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠিয়ে দেয়া। কিন্তু সরকার থেকে প্রচার করা হয়, সোহেল তাজ ছুটি নিয়েছেন। সোহেল তাজ যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই সাংবাদিকদের আবারও জানিয়ে দেন, তিনি সরকারে নেই। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। এ পদে তিনি আর ফিরবেন না। এ ঘটনার পর সরকার থেকে আর কিছুই বলা হয়নি। সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে কি হয়নি, কিছুই বলেনি সরকার। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি সোহেল তাজ আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে সরকারের পক্ষ থেকে তার জন্য প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার সব প্রটোকলের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বিমান থেকে নেমে তিনি সরকারের প্রটোকল নেননি; সরকারের গাড়িতেও ওঠেননি। বোনের গাড়িতে করে সোজা চলে যান বাসায়। ওই দফায় ২০ দিনের মতো দেশে অবস্থান করে আবার চলে যান আমেরিকায়। প্রায় ৬ মাস পর আবার তিনি দেশে ফেরেন। সেবারও তিনি বিমানবন্দরে কোনো প্রটোকল নেননি। ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট দেখা যায়, সোহেল তাজকে ‘দফতরবিহীন প্রতিমন্ত্রী’ হিসেবে নতুন নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ ওয়েবসাইটেও তাকে ‘দফরতবিহীন প্রতিমন্ত্রী’ হিসেবে দেখানো হয়। পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলে আবারও সোহেল তাজ জানিয়ে দেন, প্রতিমন্ত্রিত্বের পদে তিনি নেই এবং এ পদে তিনি আর ফিরে আসবেন না। তবুও বিষয়টি সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সুরাহা করা হয়নি। এরপর এ নিয়ে আর কোনো আলোচনা দেখা যায়নি। সম্প্রতি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলে তার পদত্যাগ নিয়েও ঘটে একই ধরনের ঘটনা। পরদিন হঠাত্ সরকার থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, সুরঞ্জিত দফতরবিহীন মন্ত্রী। অথচ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করে গাড়ির পতাকা নামিয়ে রেল ভবন থেকে সোজা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। অবশ্য সরকারের ঘোষণার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সোহেল তাজের মতো বলেননি, তিনি আর এ পদে নেই; বরং তিনি খুশিই হন। এ ঘোষণায় অনেকটা যেন প্রাণ ফিরে পান সুরঞ্জিত। বিবিসিকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এ ব্যাপারে তার বলার কিছু নেই।
পদত্যাগ নিয়ে এ ঘটনার পর বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও ডক্টর শাহদীন মালিক সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর মন্ত্রী নেই। দফতরবিহীন মন্ত্রীর পদে তার থাকা এখন অবৈধ। নতুনভাবে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করতে হলে আবার শপথ লাগবে। তারা সোহেল তাজের পদত্যাগ নিয়েও একই কথা বলেন। অর্থাত্ তার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পদটিও শূন্য হয়ে গেছে।
সুরঞ্জিতের মন্ত্রিত্ব নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, ঠিক এ সময় কৃষক দলের মুজিবনগর দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেননি। আরও বললেন, সোহেল তাজের পদত্যাগপত্রও তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাননি। অর্থাত্ প্রায় ৩ বছর পার হয়ে গেল। সোহেল তাজের পদত্যাগপত্রটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাছেই রেখে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এ তথ্য বের হলে এ নিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী এভাবে কি পদত্যাগপত্র আটকে রাখতে পারেন কিংবা গায়েব করে দিতে পারেন? কোনো মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ না চান, সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে আলোচনা করে বা তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পদে রেখে দেবেন। পদত্যাগের ব্যাপারে সিরিয়াস থাকলে সাংবিধানিকভাবে তিনি তো আর তাকে জোর করে আটকে রাখতে পারেন না।
দেশের বিশিষ্ট সংবিধানবিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা স্পষ্টভাবে বলেছেন, সোহেল তাজের পদত্যাগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা করছেন, তা সংবিধান ও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তারা বলেছেন সুরঞ্জিত ও সোহেল তাজের দফতরবিহীন মন্ত্রিত্ব অবৈধ। সংবিধানের ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের পদ শূন্য হয়ে গেছে। তাদের দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় রাখার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, গাড়িতে-বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন—সবকিছুই অবৈধ। সংবিধান অনুযায়ী তাদের পদত্যাগপত্র নাকচ করার কোনো সুযোগ নেই প্রধানমন্ত্রীর। আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী এক অর্থে অবৈধ কাজই করেছেন। অন্যায়ের এখানেই শেষ নয়। দেখা গেছে, সোহেল তাজ চাচ্ছেন না অথচ তার অজান্তে তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে বেতনের টাকা জমা হচ্ছে। বিষয়টি জানার পর ১৭ এপ্রিল সোহেল তাজ আমেরিকা থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি চিঠি পাঠিয়ে তার পদত্যাগের গেজেট কেন জারি হয়নি, জানতে চান। একই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতনের টাকা জমা দেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ৩৩ মাসের টাকা ফেরত নেয়ার অনুরোধ করেন।
কিন্তু এই চিঠির পরও সরকারের টনক নড়েনি। ফলে গতকাল সংসদ সদস্যের পদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেছেন। শুধু পদত্যাগই নয়, স্পিকারের কাছে সংবিধান অনুসরণ করে পদত্যাগপত্র পাঠানোর পর তিনি তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের উদ্দেশেও একটি খোলা চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি বলেন, সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগের এ সিদ্ধান্ত তিনি অনেক চিন্তাভাবনা করেই নিয়েছেন। তবে এর কারণ তিনি খুলে বলতে পারছেন না। তার মতে, সবকিছু খুলে বলা যায় না। তিনি শুধু বলেছেন, ‘বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কাপাশিয়ার মানুষের সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কথার পেছনে অনেক কথা থাকে। অনেক লুক্কায়িত সত্য থাকে—যা দেশ, জনগণ ও দলের স্বার্থে জনসম্মুখে বলা উচিত নয় এবং বলা সম্ভবও নয়। তবে সঙ্গত কারণেই আমি এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করেছি।’
সোহেল তাজ সাধারণ কোনো পরিবারের কেউ নন, তিনি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান তিনি। তাজউদ্দীন আহমদের সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছে। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৫ মার্চ রাত ১২টায় তাজউদ্দীন আহমদ সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তাকে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সঙ্গে একটি টেপ রেকর্ডারও নিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করেননি। তিনি তাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে গেলে পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিচার করবে।’ এই ঐতিহাসিক তথ্যটি স্থান পেয়েছে দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর বইয়ে।
স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সরকার পরিচালনা নিয়ে কিছু মতভেদও হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী মরহুম ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে এর বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, ১৯৭৪ সালের ১৩ অক্টোবর অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ইউরোপ সফর করে দেশে ফিরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ভ্রান্ত নীতি নেয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি রসাতলে গেছে।’ তার এই বক্তব্য পরদিন সব পত্রিকায় ছাপা হয়। এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার মন্তব্য সম্পর্কে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ দলের নেতারা পত্রপত্রিকায় তার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। সৃষ্টি হয় তীব্র মতভেদ। এ অবস্থায় ২৬ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মন্ত্রিত্ব থেকে তিনি ইস্তফা দেন।
ড. ওয়াজেদ মিয়া বইয়ে এ সম্পর্কে আরও লেখেন, ‘এই দুঃখজনক ঘটনার পর থেকে তাজউদ্দিন আহমদ রাজনীতি থেকে বেশ নিষ্ক্রিয় থাকেন। তার রাজনৈতিক সহকর্মী বা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মীর সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করেছেন বলেও শোনা যায়নি। শুধু মাঝে মধ্যে ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আবাহনী মাঠে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে।’ তার পদত্যাগ সম্পর্কে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের দফতর থেকে তার পদত্যাগপত্র টাইপ করে তাজউদ্দিন আহমদের কাছে সই করে দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল।
পঁচাত্তরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার নেতার হত্যাকাণ্ডে তিনিও হত্যার শিকার হন। সেই তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান সোহেল তাজ অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। তার রক্তে তাজউদ্দীন আহমদের রক্ত প্রবাহিত। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি এক প্রতিবাদী যুবক। পদত্যাগ করে বাবার মতো এবং চাচা আফসার উদ্দিন আহমদের মতো সাহসী সিদ্ধান্তই নিয়েছেন সোহেল তাজ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন