আলাউদ্দিন আরিফ
গুম, অপহরণ ও গুপ্ত হত্যা বন্ধে সরকারকে চাপ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। তারা বলেছে, বাংলাদেশে গুমের ঘটনা ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে এবং এটা উদ্বেগজনক। বিশেষ করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনা বাড়ছে এবং এ ধরনের সর্বশেষ ঘটনায় গত ১৭ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। তারা এসব গুমের ঘটনা অবিলম্বে নিরপেক্ষভাবে তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান যোসেফ
ক্রাউলি, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ, পলবার, লিবডেম ও রেসপেক্ট দলীয় কয়েকজন এমপি, ব্রিটেনের অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ও অ্যামেনেস্ট্রি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। দ্য গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, দ্য হিন্দু, আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, এএফপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশে গুম, অপহরণ এবং গুপ্তহত্যার ভয়াহতা তুলে ধরে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এ সব প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার এর দায় এড়াতে পারবে না।
গুমের ঘটনা দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল তাদের পৃথক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, ইলিয়াস আলী সর্বশেষ গুম হন। তাকে পাওয়া না গেলে বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে এবং এর দায় অবশ্যই বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে। যদিও ইলিয়াস আলীর উদ্ধারের বিষয়ে ১১ দিনেও কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি সরকারের অধীনস্থ সংস্থাগুলো।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্র কেবল চলতি বছরই ইলিয়াস আলীসহ ২২ জন নিখোঁজ বা গুম হয়েছেন বলে তাদের এক রিপোর্টে বলেছে। তাছাড়া সংস্থাটির হিসাবে ২০১১ সালে গুম হয়েছেন ৭০ জন এবং ২০১০ সালে ৩০ জন। অর্থাত্ গত ২৭ মাসে ১২২ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন গুম হয়েছেন যারা পরে হত্যারও শিকার হন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব ঘটনার স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, গুম হওয়ার এসব ঘটনা বিশেষ করে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত দরকার। সরকার এখনও পর্যন্ত এসব ঘটনা তদন্তে বা এরকম ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে র্যাব গুম এবং হত্যার মতো ঘটনায় জড়িত বলে হিউম্যান রাইটস এর আগে তাদের তদন্তে দেখতে পেয়েছে। এ সম্পর্কে সংস্থাটি বলেছে, আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে র্যাবের হাতে এ ধরনের হত্যার ঘটনা কমে এলেও এর বিপরীতে গুমের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। যারা গুম হচ্ছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সর্বশেষ নিরাপত্তাবাহিনীর হেফাজতেই দেখা গেছে। এতে করে এমন আশঙ্কাই জোরালো হচ্ছে যে, নিরাপত্তাবাহিনী আগের পথ ছেড়ে নির্যাতনের একটা ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানী ঢাকার বনানী থেকে গুম হয়েছেন বিএনপির জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলী। বিগত ১১ দিনেও তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি বা তার কোনো হদিস করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর ইতোমধ্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মতো আন্তর্জাতিক মহলও।
রবার্ট ব্লেক : ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী মতের নেতাকর্মীরা গুম, গুপ্তহত্যা, নিখোঁজ এবং দমন-নিপীড়নের শিকার হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর এ বিষয়ে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকের কাছে লেখা এক চিঠিতে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তিনি। চিঠিতে রবার্ট ব্লেক বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এটাকে ‘ডিস্টার্বিং’ বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসকে পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়ার কথও উল্লেখ করেছেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন : ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউ দেশগুলোর প্রতিনিধিদের দেয়া এক বিবৃতিতে ইলিয়াস আলীসহ গুমের অন্যান্য ঘটনার সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর পক্ষে ঢাকায় ইইউ দূতাবাস থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়ি চালকসহ অন্যদের গুম হওয়ার খবরে ইইউ প্রতিনিধিরা উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ইলিয়াস আলীসহ অন্যান্য গুমের ঘটনার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে পাঠানো ই-মেইলের জবাবে ফরাসি দূতাবাসের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তাকে উদ্ধারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ : বাংলাদেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীরা গুম হওয়ার ঘটনা অবিলম্বে নিরপেক্ষভাবে তদন্তের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ। গতকাল এইচআরডব্লিউ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনা বাড়ছে এবং এ ধরনের ঘটনায় গত ১৭ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। এইচআরডব্লিউ বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব ঘটনার স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা। সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এডামস বলেন, গুম হওয়ার এসব ঘটনা, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত দরকার। সরকার এখনও পর্যন্ত এসব ঘটনা তদন্তে বা এরকম ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের একটি বিশেষ বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব অপহরণ এবং হত্যার মতো ঘটনায় জড়িত বলে এইচআরডব্লিউ আগে তাদের তদন্তে দেখতে পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ব্যাবের হাতে এধরনের হত্যার ঘটনা কমে আসলেও এর বিপরীতে গুম হওয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এইচআরডব্লিউ আরো বলছে, যারা নিখোঁজ হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে সর্বশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতেই দেখা গেছে। এতে করে এমন আশঙ্কাই জোরালো হচ্ছে যে, নিরাপত্তা বাহিনী আগের পথ ছেড়ে নির্যাতনের একটা ভিন্নপথ বেছে নিয়েছে।
যোসেফ ক্রাউলি : যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান যোসেফ ক্রাউলি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। গত ২৩ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদ এবং নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন আই-বিএনপি’র নির্বাহী পরিচালক ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু জোসেফ ক্রাউলির সঙ্গে তার অফিসে সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি এই মন্তব্য করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ-আমেরিকান ডেমোক্রাটিক ককাসের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মইন চৌধুরী। যোশেফ ক্রাউলি দ্রুততার সঙ্গে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার ও গুম এবং গুপ্তহত্যার মতো মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিরা : বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা ও অপহরণের ঘটনায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ, পলবার, লিবডেম ও রেসপেক্ট দলীয় এমপিরাও এ ঘটনাকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছেন বলে মন্তব্য করেন। বিষয়টি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নজরেও রয়েছে বলে জানান তারা। ব্রিটিশ এমপি রিচার্ড ফুলারসহ আরো অনেক এমপি এ বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে অবহিত করছেন। বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়েছে। ফরেন অফিস বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশনকেও এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গুম হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়েছিল ব্রিটিশ এমপি রিচার্ড ফুলারের। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই ইলিয়াস আলীকে ধরে নিয়েছে বলে ডেভিড ক্যামেরনকে অবহিত করেছেন রিচার্ড ফুলার। হাউস অব কমন্স-এ এই বিষয়টিই তিনিই প্রথম তুলে ধরেন।
রেসপেক্ট পার্টির চেয়ারম্যান ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অন্যতম প্রভাবশালী এমপি জর্জ গ্যালাওয়েও ইলিয়াস আলীকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের এই বিষয়টি নিয়ে আমি ব্রিটিশ ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। ফরেন অফিসের সাউথ এশিয়ান ডেস্ক প্রধানের সঙ্গে তিনি এই বিষয়ে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তিনি সশরীরে বাংলাদেশে আশার কথাও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার বহুবার দেখা-সাক্ষাত্ হয়েছে। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীকে পাওয়া না গেলে বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে এবং এর দায় অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম বাংলাদেশী এমপি রুশনারা আলীও ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার জন বার্কো, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ, জিম ফিটজ ফ্যাট্রিক এমপি, চার্লস টেনক এমপি, কিথ ভাজ এমপি, ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের বুরোক্রাট ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টর পামেলা গর্ডনসহ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ বিভাগের জুনিয়র মন্ত্রী জেরিমি ব্রাউন ও অ্যালেস্টার বাটও ইলিয়াস আলী গুম হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অ্যান মেইন এমপি : ব্রিটেনে সরকারদলীয় প্রভাবশালী পার্লামেন্ট মেম্বার ও অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা এম. ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় সিলেটে এম. ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে তার নিখোঁজের ঘটনাকে গণতন্ত্রের জন্য চরম হুমকি বলে মনে করেন। তিনি ইলিয়াস আলীর মতো বিরোধী দলের একজন প্রথম সারির জনপ্রিয় নেতাকে খুঁজে বের করতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
অ্যান মেইন এমপি এম. ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক এমপির সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে শিগগিরই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আর্লিডে মোশন আনতে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা বলেছেন। তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আর্লিডে মোশন আনতে নিজ নিজ এলাকার এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি লিখিতভাবে জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
ড্যান মজীনা : রবার্ট ব্লেকের চিঠির পর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনায় উদ্বেগ এবং নিন্দা জানিয়ে তাকে খুঁজে বের করতে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, গুমের ঘটনায় অন্য সবার উদ্বেগের প্রতি আমি একান্ত সমর্থন জ্ঞাপন করছি। এ ঘটনা নিন্দনীয় এবং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে সব পক্ষকে সংযত আচরণের মাধ্যমে একে অন্যকে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, যিনি গুম হয়েছেন এটা শুধু তার জন্যই নয়, তার পরিবারের জন্যও এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন : এম ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) বাংলাদেশে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যা উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে বলে অভিযোগ করে সরকারকে অবিলম্বে এসব তত্পরতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। গত বুধবার এক বিবৃতিতে হংকংভিত্তিক এই মানবাধিকার সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা এখন সর্বপর্যায়ে মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাদা পোশাকধারী সশস্ত্র ব্যক্তিরা আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজনকে রাস্তা, মার্কেট এমনকি তাদের অফিস বা বাড়ি থেকে অপহরণ করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপহরণকারীরা নিজেদের আইন প্রয়োগকারী ও নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তুলে নেয়ার কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর বিভিন্ন স্থানে লাশ পাওয়ার সংবাদ শুনে স্বজনরা আরও উত্কণ্ঠিত হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে, হয়তো তাদের প্রিয়জনের লাশই পাওয়া গেছে। স্বজনদের জন্য আরও হতাশাজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যখন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুুলো তাদের প্রিয়জনদের গুম-গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে বা নীরব থাকে।
হিউম্যান রাইটস কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনো দেশে বসবাসকারী রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, জাতীয় পরিচয় নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা থাকে সরকারের ওপর। অধিকন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে আইনের চোখে সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে সবার জীবন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এবং ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) সদস্য হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে দেশেরই জনগণকে রক্ষায় আরও বেশি বাধ্যবাধকতা রয়েছ। এতে ব্যর্থ হলে তাকে নাগরিকদের রক্ষায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণ, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মহলকে অবহিত করতে হবে। অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলমান অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার জন্য ‘দুর্বৃত্তচক্র’ কিংবা ‘বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে’ দায়ী করে আসছে। গুম ও গুপ্তহত্যার দায়দায়িত্ব অস্বীকার বা সে বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করে কর্তৃপক্ষ দৃশ্যত তাদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করে ফেলেছে বলে মনে করছে। কিন্তু কমিশনের মতে, এটা খুবই হতাশাজনক ব্যাপার এবং সম্ভবত অত্যন্ত ভুল পদক্ষেপ।
হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গ্রেফতরের কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করা বা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই অহরহ লোকজনকে আটক করছে। আটকের সময়ে কোনো আইনি নথিপত্র প্রদর্শন করা হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা অপহরণ হিসেবে দেখা হয়। রাষ্ট্রীয় এজেন্টরা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া লোকজনকে গ্রেফতার করতে থাকলে এবং আটক ব্যক্তি বা তার স্বজনদের যথাযথ ব্যাখ্যা না দিয়ে ও আটকের পর দ্রুত পছন্দমত আইনজীবীর পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকলে ‘দুর্বৃত্তচক্র’ বা সরকারি নয়, এমন গ্রুপগুলোও একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। মানবাধিকার সংস্থাটি জানায়, নাগরিকদের রক্ষার দায়িত্ব পালন না করে সরকার অন্যদের ওপর দোষ চাপালে বা নীরবতা অবলম্বন করতে থাকলে তাতে সরকারের অক্ষমতাই ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ সরকার স্রেফ একটি ফালতু রাজনৈতিক সত্তা না হয়ে থাকলে তাকে অবশ্যই গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে এবং কেউ চায় না বাগাড়ম্বরের পুনরাবৃত্তির মধ্যেই সরকার তার সব তত্পরতা সীমাবদ্ধ রাখুক বা তার দায়দায়িত্ব যাক।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার না করা এবং পুলিশ বা র্যাব যৌক্তিক কারণ ছাড়া সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার না করে, সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা নিশ্চিত করতে হবে। একবার যদি জনমনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়, পরোয়ানা ছাড়া বা সাদা পোশাকে পুলিশ বা র্যাব কাউকে গ্রেফতার করে না, তখন অন্য কেউ ওই ধরনের কাজ করতে সাহস পাবে না। সংস্থাটি বলেছে, অপহরণ ও গুপ্তহত্যার সব ঘটনা দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে; আর এই তদন্ত উপযুক্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে হলে ভালো হয়। কারণ, পুলিশ ও র্যাব এরই মধ্যে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। কমিশনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির খাতিরে তদন্ত প্রতিবেদন তালাবদ্ধ করে রাখলে চলবে না, যেমনটি বরাবর বাংলাদেশে হয়ে আসছে। অপরাধীদের অবশ্যই নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে।
বিবৃতিতে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন গুম ও গুপ্তহত্যা সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী মোকাবিলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশের সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে যা প্রয়োজন তা হলো ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মৌলিক ধারণার আলোকে সরকারি কর্তৃপক্ষ কাজ করা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল : যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে মানুষ ‘গুম’ হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা গত বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সিলেটের দু’জন ছাত্রদল নেতা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের দু’জন নেতাসহ চলতি বছর ২০ জনেরও বেশি গুম হয়েছেন। এদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমিনুল ইসলাম গত ৪ এপ্রিল গুম হওয়ার পরদিন টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অনেকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের অনুসন্ধান শেষে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে। তাদের পায়ে বুট পরা থাকায় ধারণা করা হয় তারা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। আর তাদের চুলও ছোট করে ছাঁটা। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পর পুলিশকে তদন্ত করতে বলার পর আবার একে ‘নাটক’ বলে মন্তব্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছে অ্যামনেস্টি।
প্রতিষ্ঠানটি তাদের বিবৃতিতে ইলিয়াস আলী গুমের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা নিরপেক্ষ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে। তারা বলেছে, গুমের পর প্রতিবাদ কর্মসূচি চলাকালে যে মানুষগুলো নিহত হলো, কারা গুলি ছুড়ল তা বের করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই স্বাধীন তদন্ত করতে হবে। এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন : রাজনীতিবিদ গুম হওয়ার কঠোর সমালোচনা করে ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এসব ঘটনায় বাংলাদেশে উত্তেজনা বাড়ছে। গত রোববার পত্রিকার অনলাইন সংখ্যায় বলা হয়েছে, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মিলে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে জয় নিয়ে ক্ষময়তা যাওয়া সরকারের জনপ্রিয়তা বেশ কমেছে। পত্রিকাটি সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে জানিয়েছে, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটিতে নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নির্বাহী পরিচালক ইফতিখারুজ্জামানের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি ‘গণতান্ত্রিক জবাবদিহি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমবর্ধমান দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবকে’ দায়ী করেন। তিনি বলেন, এতে ‘তাদের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা কমে যায় এবং এর ফলে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, সাম্য ও জনগণের মৌলিক মানবাধিকার বিকাশে তাদের সামর্থ্য ধ্বংস হয়। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইলিয়াস আলী ছাড়াও সম্প্রতি গুম হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির তিন ছাত্রনেতা ও এক শ্রমিক নেতা।
আল জাজিরার প্রতিবেদন : ‘পলিটিক্যাল ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস প্লেগ বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশ রাজনৈতিক গুমের মহামারীতে আক্রান্ত’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন করেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ১০০ মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তার মধ্যে সিলেট অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য ইলিয়াস আলী রয়েছেন। তাকে বিরোধী রাজনীতিতে উদীয়মান এক নেতা হিসেবে দেখা হয়। তার স্ত্রী নিশ্চিত, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। তার আতঙ্ক একেবারে ভিত্তিহীন নয়। নিকোলাস হকের লেখা ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী আদিলুর রহমান বিশ্বাস করেন, এসব নিখোঁজের ঘটনায় বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন : ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুর অনলাইন সংস্করণে ‘ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস, কিলিংস ট্রিগার কনসার্ন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েয়ে, গুমের ঘটনা ও রহস্যময় হত্যার ঘটনা সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। এতে বাংলাদেশে আতঙ্ক ও রাজনীতিতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সাংবাদিক হারুন হাবীবের লেখা এ রিপোর্টে আরও বলা হয়, ক্রমবর্ধমান গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে এরই মধ্যে উচ্চ আদালত গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার গ্রুপগুলো দাবি করছে, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২১ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়েছে। তবে গত সপ্তাহে ঢাকায় গাড়িচালকসহ সাবেক এমপি ও বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর রহস্যময় নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এমন ঘটনায় সিনিয়র মন্ত্রীরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও ইলিয়াস আলী কোথায় আছেন তা চিহ্নিত করতে পারেনি। গত ১৭ এপ্রিল রাতে কি কারণে রাজধানী থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের এই প্রভাবশালী নেতা গুম হয়ে গেছেন তারও কোনো তথ্য দিতে পারছেন না তারা। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ২০১০ সালের জুলাই মাসে বিএনপির আরেক নেতা চৌধুরী আলম কোথায় আছেন সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পুলিশ কর্মকর্তা ও র্যাবকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন আদালত।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চাপ : এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপক সমালোচনা করছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর থেকেই নানা ধরনের খবর প্রকাশ করেছে তারা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার ভয়াবহতা তুলে ধরে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে খ্যাতনামা সংবাদ সংস্থা বিবিসি। এছাড়া আল জাজিরা, রয়টার্স, এএফপি, সিনহুয়া, পিটিআইসহ অন্যান্য সংস্থাও বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রচারিত নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজে। নিউইয়র্ক টাইমসের লেখক ব্লগেও বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল জয় পায়। কিন্তু নানা অভিযোগে তার সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ লিখেছে, ‘২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে বিএনপির আরেক নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন। গত দুই বছরেও তিনি কোথায় আছেন বা তার কী পরিণতি হয়েছে, সে সম্পর্কে পুলিশ কোনো হদিস দিতে পারেনি। অনলাইন রেডিফ ‘এনফোর্সড ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস অন দ্য রাইজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে লিখেছে, ‘ইলিয়াস গুমের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ কড়া ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে গুম হওয়ার ঘটনা বাড়ছেই। বার্তা সংস্থা পিটিআই বলছে, ‘ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে অভিযানের নির্দেশ দেয়া হলেও এর প্রতি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কোনো আস্থা নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এএফপি ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার প্রতিবাদে সার্বক্ষণিক হরতাল ও আন্দোলন-সংগ্রামের আপডেট সংবাদ প্রচার করছে। রয়টার্স জানিয়েছে, ‘ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের প্রতিবাদে সিলেটসহ সারাদেশ উত্তাল।’ এএফপি জানিয়েছে, ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এতো সংবাদ প্রকাশ ও নানা ধরনের চাপের পরও টনক নড়ছে না বাংলাদেশ সরকারের। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুমের ১১ দিনেও এ বিষয়ে এক বিন্দুও সফলতা দেখাতে পারেনি। গত বৃহস্পতিবার সরকারি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহাসচিব সৈয়দ আশরাফও বলেছেন তারা ইলিয়াস আলীকে জীবিত উদ্ধার করবেন। গতকালও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ইলিয়াস আলীকে জীবিত উদ্ধার করা হবে। ইলিয়াস আলীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের প্রতীক্ষায় যেভাবে প্রহর গুনছে সারাদেশের মানুষ, তেমনি প্রতীক্ষায় আছে আন্তর্জাতিক মহল ও মিডিয়া।
এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান যোসেফ
ক্রাউলি, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ, পলবার, লিবডেম ও রেসপেক্ট দলীয় কয়েকজন এমপি, ব্রিটেনের অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ও অ্যামেনেস্ট্রি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। দ্য গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, দ্য হিন্দু, আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, এএফপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশে গুম, অপহরণ এবং গুপ্তহত্যার ভয়াহতা তুলে ধরে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এ সব প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার এর দায় এড়াতে পারবে না।
গুমের ঘটনা দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল তাদের পৃথক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, ইলিয়াস আলী সর্বশেষ গুম হন। তাকে পাওয়া না গেলে বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে এবং এর দায় অবশ্যই বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে। যদিও ইলিয়াস আলীর উদ্ধারের বিষয়ে ১১ দিনেও কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি সরকারের অধীনস্থ সংস্থাগুলো।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্র কেবল চলতি বছরই ইলিয়াস আলীসহ ২২ জন নিখোঁজ বা গুম হয়েছেন বলে তাদের এক রিপোর্টে বলেছে। তাছাড়া সংস্থাটির হিসাবে ২০১১ সালে গুম হয়েছেন ৭০ জন এবং ২০১০ সালে ৩০ জন। অর্থাত্ গত ২৭ মাসে ১২২ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন গুম হয়েছেন যারা পরে হত্যারও শিকার হন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব ঘটনার স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, গুম হওয়ার এসব ঘটনা বিশেষ করে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত দরকার। সরকার এখনও পর্যন্ত এসব ঘটনা তদন্তে বা এরকম ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে র্যাব গুম এবং হত্যার মতো ঘটনায় জড়িত বলে হিউম্যান রাইটস এর আগে তাদের তদন্তে দেখতে পেয়েছে। এ সম্পর্কে সংস্থাটি বলেছে, আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে র্যাবের হাতে এ ধরনের হত্যার ঘটনা কমে এলেও এর বিপরীতে গুমের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। যারা গুম হচ্ছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সর্বশেষ নিরাপত্তাবাহিনীর হেফাজতেই দেখা গেছে। এতে করে এমন আশঙ্কাই জোরালো হচ্ছে যে, নিরাপত্তাবাহিনী আগের পথ ছেড়ে নির্যাতনের একটা ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানী ঢাকার বনানী থেকে গুম হয়েছেন বিএনপির জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলী। বিগত ১১ দিনেও তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি বা তার কোনো হদিস করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর ইতোমধ্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মতো আন্তর্জাতিক মহলও।
রবার্ট ব্লেক : ইলিয়াস আলীসহ বিরোধী মতের নেতাকর্মীরা গুম, গুপ্তহত্যা, নিখোঁজ এবং দমন-নিপীড়নের শিকার হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর এ বিষয়ে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকের কাছে লেখা এক চিঠিতে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তিনি। চিঠিতে রবার্ট ব্লেক বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এটাকে ‘ডিস্টার্বিং’ বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসকে পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়ার কথও উল্লেখ করেছেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন : ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউ দেশগুলোর প্রতিনিধিদের দেয়া এক বিবৃতিতে ইলিয়াস আলীসহ গুমের অন্যান্য ঘটনার সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর পক্ষে ঢাকায় ইইউ দূতাবাস থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়ি চালকসহ অন্যদের গুম হওয়ার খবরে ইইউ প্রতিনিধিরা উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ইলিয়াস আলীসহ অন্যান্য গুমের ঘটনার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে পাঠানো ই-মেইলের জবাবে ফরাসি দূতাবাসের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তাকে উদ্ধারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ : বাংলাদেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীরা গুম হওয়ার ঘটনা অবিলম্বে নিরপেক্ষভাবে তদন্তের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ। গতকাল এইচআরডব্লিউ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনা বাড়ছে এবং এ ধরনের ঘটনায় গত ১৭ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। এইচআরডব্লিউ বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব ঘটনার স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা। সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এডামস বলেন, গুম হওয়ার এসব ঘটনা, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত দরকার। সরকার এখনও পর্যন্ত এসব ঘটনা তদন্তে বা এরকম ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের একটি বিশেষ বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব অপহরণ এবং হত্যার মতো ঘটনায় জড়িত বলে এইচআরডব্লিউ আগে তাদের তদন্তে দেখতে পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ব্যাবের হাতে এধরনের হত্যার ঘটনা কমে আসলেও এর বিপরীতে গুম হওয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এইচআরডব্লিউ আরো বলছে, যারা নিখোঁজ হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে সর্বশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতেই দেখা গেছে। এতে করে এমন আশঙ্কাই জোরালো হচ্ছে যে, নিরাপত্তা বাহিনী আগের পথ ছেড়ে নির্যাতনের একটা ভিন্নপথ বেছে নিয়েছে।
যোসেফ ক্রাউলি : যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান যোসেফ ক্রাউলি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। গত ২৩ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদ এবং নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন আই-বিএনপি’র নির্বাহী পরিচালক ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু জোসেফ ক্রাউলির সঙ্গে তার অফিসে সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি এই মন্তব্য করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ-আমেরিকান ডেমোক্রাটিক ককাসের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মইন চৌধুরী। যোশেফ ক্রাউলি দ্রুততার সঙ্গে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার ও গুম এবং গুপ্তহত্যার মতো মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিরা : বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা ও অপহরণের ঘটনায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ, পলবার, লিবডেম ও রেসপেক্ট দলীয় এমপিরাও এ ঘটনাকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছেন বলে মন্তব্য করেন। বিষয়টি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নজরেও রয়েছে বলে জানান তারা। ব্রিটিশ এমপি রিচার্ড ফুলারসহ আরো অনেক এমপি এ বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে অবহিত করছেন। বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়েছে। ফরেন অফিস বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশনকেও এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গুম হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়েছিল ব্রিটিশ এমপি রিচার্ড ফুলারের। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই ইলিয়াস আলীকে ধরে নিয়েছে বলে ডেভিড ক্যামেরনকে অবহিত করেছেন রিচার্ড ফুলার। হাউস অব কমন্স-এ এই বিষয়টিই তিনিই প্রথম তুলে ধরেন।
রেসপেক্ট পার্টির চেয়ারম্যান ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অন্যতম প্রভাবশালী এমপি জর্জ গ্যালাওয়েও ইলিয়াস আলীকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের এই বিষয়টি নিয়ে আমি ব্রিটিশ ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। ফরেন অফিসের সাউথ এশিয়ান ডেস্ক প্রধানের সঙ্গে তিনি এই বিষয়ে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তিনি সশরীরে বাংলাদেশে আশার কথাও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার বহুবার দেখা-সাক্ষাত্ হয়েছে। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীকে পাওয়া না গেলে বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে এবং এর দায় অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম বাংলাদেশী এমপি রুশনারা আলীও ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার জন বার্কো, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ, জিম ফিটজ ফ্যাট্রিক এমপি, চার্লস টেনক এমপি, কিথ ভাজ এমপি, ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের বুরোক্রাট ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টর পামেলা গর্ডনসহ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ বিভাগের জুনিয়র মন্ত্রী জেরিমি ব্রাউন ও অ্যালেস্টার বাটও ইলিয়াস আলী গুম হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অ্যান মেইন এমপি : ব্রিটেনে সরকারদলীয় প্রভাবশালী পার্লামেন্ট মেম্বার ও অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন এমপি বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা এম. ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় সিলেটে এম. ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে তার নিখোঁজের ঘটনাকে গণতন্ত্রের জন্য চরম হুমকি বলে মনে করেন। তিনি ইলিয়াস আলীর মতো বিরোধী দলের একজন প্রথম সারির জনপ্রিয় নেতাকে খুঁজে বের করতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
অ্যান মেইন এমপি এম. ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক এমপির সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে শিগগিরই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আর্লিডে মোশন আনতে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা বলেছেন। তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আর্লিডে মোশন আনতে নিজ নিজ এলাকার এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি লিখিতভাবে জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
ড্যান মজীনা : রবার্ট ব্লেকের চিঠির পর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনায় উদ্বেগ এবং নিন্দা জানিয়ে তাকে খুঁজে বের করতে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, গুমের ঘটনায় অন্য সবার উদ্বেগের প্রতি আমি একান্ত সমর্থন জ্ঞাপন করছি। এ ঘটনা নিন্দনীয় এবং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে সব পক্ষকে সংযত আচরণের মাধ্যমে একে অন্যকে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, যিনি গুম হয়েছেন এটা শুধু তার জন্যই নয়, তার পরিবারের জন্যও এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন : এম ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) বাংলাদেশে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যা উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে বলে অভিযোগ করে সরকারকে অবিলম্বে এসব তত্পরতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। গত বুধবার এক বিবৃতিতে হংকংভিত্তিক এই মানবাধিকার সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা এখন সর্বপর্যায়ে মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাদা পোশাকধারী সশস্ত্র ব্যক্তিরা আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজনকে রাস্তা, মার্কেট এমনকি তাদের অফিস বা বাড়ি থেকে অপহরণ করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপহরণকারীরা নিজেদের আইন প্রয়োগকারী ও নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তুলে নেয়ার কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর বিভিন্ন স্থানে লাশ পাওয়ার সংবাদ শুনে স্বজনরা আরও উত্কণ্ঠিত হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে, হয়তো তাদের প্রিয়জনের লাশই পাওয়া গেছে। স্বজনদের জন্য আরও হতাশাজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যখন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুুলো তাদের প্রিয়জনদের গুম-গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে বা নীরব থাকে।
হিউম্যান রাইটস কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনো দেশে বসবাসকারী রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, জাতীয় পরিচয় নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা থাকে সরকারের ওপর। অধিকন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে আইনের চোখে সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে সবার জীবন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এবং ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) সদস্য হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে দেশেরই জনগণকে রক্ষায় আরও বেশি বাধ্যবাধকতা রয়েছ। এতে ব্যর্থ হলে তাকে নাগরিকদের রক্ষায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণ, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মহলকে অবহিত করতে হবে। অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলমান অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার জন্য ‘দুর্বৃত্তচক্র’ কিংবা ‘বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে’ দায়ী করে আসছে। গুম ও গুপ্তহত্যার দায়দায়িত্ব অস্বীকার বা সে বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করে কর্তৃপক্ষ দৃশ্যত তাদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করে ফেলেছে বলে মনে করছে। কিন্তু কমিশনের মতে, এটা খুবই হতাশাজনক ব্যাপার এবং সম্ভবত অত্যন্ত ভুল পদক্ষেপ।
হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গ্রেফতরের কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করা বা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই অহরহ লোকজনকে আটক করছে। আটকের সময়ে কোনো আইনি নথিপত্র প্রদর্শন করা হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা অপহরণ হিসেবে দেখা হয়। রাষ্ট্রীয় এজেন্টরা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া লোকজনকে গ্রেফতার করতে থাকলে এবং আটক ব্যক্তি বা তার স্বজনদের যথাযথ ব্যাখ্যা না দিয়ে ও আটকের পর দ্রুত পছন্দমত আইনজীবীর পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকলে ‘দুর্বৃত্তচক্র’ বা সরকারি নয়, এমন গ্রুপগুলোও একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। মানবাধিকার সংস্থাটি জানায়, নাগরিকদের রক্ষার দায়িত্ব পালন না করে সরকার অন্যদের ওপর দোষ চাপালে বা নীরবতা অবলম্বন করতে থাকলে তাতে সরকারের অক্ষমতাই ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ সরকার স্রেফ একটি ফালতু রাজনৈতিক সত্তা না হয়ে থাকলে তাকে অবশ্যই গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ঘটনাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে এবং কেউ চায় না বাগাড়ম্বরের পুনরাবৃত্তির মধ্যেই সরকার তার সব তত্পরতা সীমাবদ্ধ রাখুক বা তার দায়দায়িত্ব যাক।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার না করা এবং পুলিশ বা র্যাব যৌক্তিক কারণ ছাড়া সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার না করে, সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা নিশ্চিত করতে হবে। একবার যদি জনমনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়, পরোয়ানা ছাড়া বা সাদা পোশাকে পুলিশ বা র্যাব কাউকে গ্রেফতার করে না, তখন অন্য কেউ ওই ধরনের কাজ করতে সাহস পাবে না। সংস্থাটি বলেছে, অপহরণ ও গুপ্তহত্যার সব ঘটনা দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে; আর এই তদন্ত উপযুক্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে হলে ভালো হয়। কারণ, পুলিশ ও র্যাব এরই মধ্যে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। কমিশনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির খাতিরে তদন্ত প্রতিবেদন তালাবদ্ধ করে রাখলে চলবে না, যেমনটি বরাবর বাংলাদেশে হয়ে আসছে। অপরাধীদের অবশ্যই নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে।
বিবৃতিতে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন গুম ও গুপ্তহত্যা সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী মোকাবিলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশের সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে যা প্রয়োজন তা হলো ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মৌলিক ধারণার আলোকে সরকারি কর্তৃপক্ষ কাজ করা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল : যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে মানুষ ‘গুম’ হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা গত বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সিলেটের দু’জন ছাত্রদল নেতা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের দু’জন নেতাসহ চলতি বছর ২০ জনেরও বেশি গুম হয়েছেন। এদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আমিনুল ইসলাম গত ৪ এপ্রিল গুম হওয়ার পরদিন টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অনেকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের অনুসন্ধান শেষে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে। তাদের পায়ে বুট পরা থাকায় ধারণা করা হয় তারা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। আর তাদের চুলও ছোট করে ছাঁটা। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পর পুলিশকে তদন্ত করতে বলার পর আবার একে ‘নাটক’ বলে মন্তব্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছে অ্যামনেস্টি।
প্রতিষ্ঠানটি তাদের বিবৃতিতে ইলিয়াস আলী গুমের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা নিরপেক্ষ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে। তারা বলেছে, গুমের পর প্রতিবাদ কর্মসূচি চলাকালে যে মানুষগুলো নিহত হলো, কারা গুলি ছুড়ল তা বের করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই স্বাধীন তদন্ত করতে হবে। এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন : রাজনীতিবিদ গুম হওয়ার কঠোর সমালোচনা করে ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এসব ঘটনায় বাংলাদেশে উত্তেজনা বাড়ছে। গত রোববার পত্রিকার অনলাইন সংখ্যায় বলা হয়েছে, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মিলে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে জয় নিয়ে ক্ষময়তা যাওয়া সরকারের জনপ্রিয়তা বেশ কমেছে। পত্রিকাটি সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে জানিয়েছে, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটিতে নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নির্বাহী পরিচালক ইফতিখারুজ্জামানের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি ‘গণতান্ত্রিক জবাবদিহি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমবর্ধমান দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবকে’ দায়ী করেন। তিনি বলেন, এতে ‘তাদের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা কমে যায় এবং এর ফলে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, সাম্য ও জনগণের মৌলিক মানবাধিকার বিকাশে তাদের সামর্থ্য ধ্বংস হয়। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইলিয়াস আলী ছাড়াও সম্প্রতি গুম হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির তিন ছাত্রনেতা ও এক শ্রমিক নেতা।
আল জাজিরার প্রতিবেদন : ‘পলিটিক্যাল ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস প্লেগ বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশ রাজনৈতিক গুমের মহামারীতে আক্রান্ত’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন করেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ১০০ মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তার মধ্যে সিলেট অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য ইলিয়াস আলী রয়েছেন। তাকে বিরোধী রাজনীতিতে উদীয়মান এক নেতা হিসেবে দেখা হয়। তার স্ত্রী নিশ্চিত, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। তার আতঙ্ক একেবারে ভিত্তিহীন নয়। নিকোলাস হকের লেখা ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী আদিলুর রহমান বিশ্বাস করেন, এসব নিখোঁজের ঘটনায় বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন : ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুর অনলাইন সংস্করণে ‘ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস, কিলিংস ট্রিগার কনসার্ন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েয়ে, গুমের ঘটনা ও রহস্যময় হত্যার ঘটনা সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। এতে বাংলাদেশে আতঙ্ক ও রাজনীতিতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সাংবাদিক হারুন হাবীবের লেখা এ রিপোর্টে আরও বলা হয়, ক্রমবর্ধমান গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে এরই মধ্যে উচ্চ আদালত গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার গ্রুপগুলো দাবি করছে, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২১ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়েছে। তবে গত সপ্তাহে ঢাকায় গাড়িচালকসহ সাবেক এমপি ও বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর রহস্যময় নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এমন ঘটনায় সিনিয়র মন্ত্রীরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও ইলিয়াস আলী কোথায় আছেন তা চিহ্নিত করতে পারেনি। গত ১৭ এপ্রিল রাতে কি কারণে রাজধানী থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের এই প্রভাবশালী নেতা গুম হয়ে গেছেন তারও কোনো তথ্য দিতে পারছেন না তারা। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ২০১০ সালের জুলাই মাসে বিএনপির আরেক নেতা চৌধুরী আলম কোথায় আছেন সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পুলিশ কর্মকর্তা ও র্যাবকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন আদালত।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চাপ : এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপক সমালোচনা করছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর থেকেই নানা ধরনের খবর প্রকাশ করেছে তারা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার ভয়াবহতা তুলে ধরে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে খ্যাতনামা সংবাদ সংস্থা বিবিসি। এছাড়া আল জাজিরা, রয়টার্স, এএফপি, সিনহুয়া, পিটিআইসহ অন্যান্য সংস্থাও বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রচারিত নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজে। নিউইয়র্ক টাইমসের লেখক ব্লগেও বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল জয় পায়। কিন্তু নানা অভিযোগে তার সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ লিখেছে, ‘২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে বিএনপির আরেক নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন। গত দুই বছরেও তিনি কোথায় আছেন বা তার কী পরিণতি হয়েছে, সে সম্পর্কে পুলিশ কোনো হদিস দিতে পারেনি। অনলাইন রেডিফ ‘এনফোর্সড ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস অন দ্য রাইজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে লিখেছে, ‘ইলিয়াস গুমের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ কড়া ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে গুম হওয়ার ঘটনা বাড়ছেই। বার্তা সংস্থা পিটিআই বলছে, ‘ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে অভিযানের নির্দেশ দেয়া হলেও এর প্রতি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কোনো আস্থা নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এএফপি ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার প্রতিবাদে সার্বক্ষণিক হরতাল ও আন্দোলন-সংগ্রামের আপডেট সংবাদ প্রচার করছে। রয়টার্স জানিয়েছে, ‘ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের প্রতিবাদে সিলেটসহ সারাদেশ উত্তাল।’ এএফপি জানিয়েছে, ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এতো সংবাদ প্রকাশ ও নানা ধরনের চাপের পরও টনক নড়ছে না বাংলাদেশ সরকারের। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুমের ১১ দিনেও এ বিষয়ে এক বিন্দুও সফলতা দেখাতে পারেনি। গত বৃহস্পতিবার সরকারি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহাসচিব সৈয়দ আশরাফও বলেছেন তারা ইলিয়াস আলীকে জীবিত উদ্ধার করবেন। গতকালও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ইলিয়াস আলীকে জীবিত উদ্ধার করা হবে। ইলিয়াস আলীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের প্রতীক্ষায় যেভাবে প্রহর গুনছে সারাদেশের মানুষ, তেমনি প্রতীক্ষায় আছে আন্তর্জাতিক মহল ও মিডিয়া।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন