সৈয়দ আবদাল আহমদ
স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। ১৯৫৯ সালে মুজিববাদী ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি যতবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, ততবারই বিজয় লাভ করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে তিনি প্রথম নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। বর্তমান সংসদে সম্ভবত তিনিই একমাত্র রাজনীতিক, যিনি সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নবম সংসদের স্পিকার হওয়ার আগেও তিনি ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার এবং বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেছেন।
এমন একজন রাজনীতিক ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানকে নিঃসন্দেহে যে কোনো মানুষই দেশের সম্পদ হিসেবে মনে করে থাকে। একই সঙ্গে এমন মানুষের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা থাকে, তার দ্বারা দেশের ভালো কিছু হবে। তিনি দেশের রাজনীতি আলোকিত করবেন, গণতন্ত্রকে আরও বিকশিত, আরও সুন্দর এবং মজবুত করবেন। কিন্তু গত ২৯ মার্চ নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের শেষদিনে স্পিকারের সমাপনী বক্তব্য শুনে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত, দুঃখ পেয়েছেন এবং একইসঙ্গে ক্ষুব্ধও। টেলিভিশনে অনেকে দেখেছেন স্পিকার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, ক্রোধ প্রকাশ করছেন। স্পিকারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজও খুব আপত্তিকর মনে হয়েছে। না, মাননীয় স্পিকার, আপনার কাছ থেকে আমরা এভাবে বক্তব্য আশা করি না। আপনি কথায় কথায় বলেন, অন্য যে কোনো দেশের স্পিকারের চেয়ে আপনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কি সেই নিরপেক্ষতার নমুনা?
যে কোনো সংসদের সফলতা নির্ভর করে স্পিকারের নিরপেক্ষ ভূমিকার ওপর। স্পিকার নিরপেক্ষ না হলে সংসদের অঙ্গহানি ঘটে এবং তা সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সংসদের স্পিকারের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পিকার হচ্ছেন সংসদের অভিভাবক। তাকে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাকে ননপার্টিজান হতে হয়। এজন্যই স্পিকার পদের মর্যাদা অন্যরকম। সবাই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে বলা হয় ‘মাদার অব অল পার্লামেন্ট’। ব্রিটেনে দেখা গেছে, স্পিকার যে এলাকায় নির্বাচনে প্রার্থী হন, সেখানে তার প্রতিপক্ষ দল কোনো প্রার্থীই দেয় না। ফলে বিভিন্ন মেয়াদে বারবার স্পিকার তার পদে বহাল থাকতে পারেন। জাপানে কেউ স্পিকার হলে তাকে সংশ্লিষ্ট দল থেকে পদত্যাগ করতে হয়। আমরা হয়তো এতটা আশা করি না। কিন্তু স্পিকার হিসেবে নিরপেক্ষতা কিছুটা হলেও বজায় রাখতে ন্যূনতম যা করার, সেটা তো স্পিকারের করা উচিত। সেটা না করে স্পিকার যদি দলের অন্যসব নেতাকর্মীর মতোই আচরণ করেন, তাহলে কি সেটা ভালো দেখায়?
২৯ মার্চ সংসদে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় এমপিদের একহাত নিয়েছেন। তিনি বেগম খালেদা জিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর সংসদে যোগ দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি তোলেননি। তিনি কোনটা মানেন? কোন ধরনের, কোন পদ্ধতির তত্ত্বাবধায়ক, কী রূপরেখার তত্ত্বাবধায়ক চান, তা ওনার বলা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে বিরোধীদলীয় নেতা জাতিকে ধূম্রজালের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ইউ শুড স্পিক ইন পার্লামেন্ট।’ স্পিকার আরও অভিযোগ করেন, বিরোধীদলীয় নেতা যখন বক্তব্য দিয়েছেন, তখন সংসদ নেতা সংসদে থেকে বক্তব্য শুনেছেন। কিন্তু সংসদ নেতার বক্তব্যের সময় বিরোধীদলীয় নেতা চলে গেলেন। এটা তো কোনো অবস্থায় হতে পারে না। এটা মোটেও ঠিক হয়নি।
নিজেকে শতভাগ নিরপেক্ষ দাবি করে স্পিকার বলেন, আমাকে অনেকে ‘ওয়ান সাইডেড’ বলেন। তবে আমি ‘ওয়ান সাইডেড’ নই। আমি আমার বিবেকের কাছে মুক্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত স্পিকার এসেছে, তার মধ্যে আমি নিজেকে নিরপেক্ষ বলতে পারব। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের স্পিকারের তুলনায় আমি কোনো অংশে কম ধৈর্য-সহ্য দেখাইনি। আমার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে শুধু বলব, আমি দুঃখিত। বিরোধীদলীয় এমপিদের অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগের বিষয় উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, রেহানা আক্তার যে কথা বলেছেন তাতে তার কথা বন্ধ করা যেত। কিন্তু সেটা করলে সংসদ বর্জনের উছিলা হতো। স্পিকার আরও বলেন, ‘অন্তরে জ্বালা থাকলেও বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি না। কারণ আমাকে স্পিকারের দায়িত্ব দিয়েছেন। শপথ নিয়েছি নিরপেক্ষতার।’
স্পিকার আরও বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অষ্টম পার্লামেন্টে আমি যখন বিরোধী দলের উপনেতা ছিলাম, আমাদের সঙ্গে কী করেছে আপনারাও দেখেছেন, দেশবাসী দেখেছে। বিরোধীদলীয় নেতাকে দীর্ঘ বক্তব্যের সুযোগ দেয়ার কথা উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, আমি তাকে শুধু বলেছিলাম বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা আছে, সে জন্য যেন কথা সংক্ষেপ করা হয়। তখন বিরোধীদলীয় নেতা বললেন, আমি যেন তাকে বাধা না দিই।
গত ২৯ মার্চ স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলের ওপর কেন এত রাগ ঝাড়লেন, তা বোধগম্য নয়। দীর্ঘদিন বর্জনের পর সংসদে যোগদান করেছে বিরোধী দল। সংসদীয় কার্যক্রমে বিরোধী দলকে কীভাবে ধরে রাখা যায়, স্পিকারের ভূমিকা হবে সেটাই। কিন্তু উল্টো তিনিই ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিরোধী দলের ওপর। বিরোধীদলীয় নেতা তো তার মতো করেই বক্তব্য দেবেন। স্পিকার যেভাবে চান, সেভাবে তো তিনি বক্তব্য দেবেন না। বিরোধীদলীয় নেতার একটি রাজনৈতিক দল আছে, তার একটা রাজনীতি আছে এবং সেই রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ আছে। সেটাকে সামনে রেখেই তিনি বক্তব্য দেবেন এবং দিয়েছেনও। কিন্তু স্পিকার তার কাছে অনেকটা কৈফিয়ত চাওয়ার মতো করেই বললেন, খালেদা জিয়া কেন সংসদে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবি তুললেন না, তিনি তত্ত্বাবধায়ক চান কি চান না, কোনটা মানেন আর কোনটা মানেন না, সেটা নাকি বলা উচিত ছিল। খালেদা জিয়ার বক্তব্য পর্যালোচনা করলে আমরা কী দেখতে পাই? সংসদে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে না এবং নির্বাচন হতে দেবে না। তার এই বক্তব্যে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি পরিষ্কার নয়? এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারটা কী ধরনের হবে, সেটা সংসদে খালেদা জিয়া ফর্মুলা উপস্থাপন করলেই যদি তা হয়ে যেত, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়াই তো শ্রেয় ছিল। সংসদে বিরোধী দল বিএনপির যে সংখ্যক এমপি রয়েছেন, তারা ইচ্ছা করলেই তো প্রস্তাব পাস করাতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ফর্মুলা উপস্থাপনের কী যৌক্তিকতা আছে? বিরোধী দল থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, নির্বাচনকালীন সরকারটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার হতে হবে। সেটা যে কোনো নামে হতে পারে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে আন্তরিক হলে তারা আলাপ-আলোচনা করে সহজেই সমস্যার সুরাহা করে দিতে পারেন। এজন্য স্পিকারের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে দোষারোপ করে তো লাভ নেই। বরং এ ব্যাপারে স্পিকারের পক্ষে একটা উদ্যোগ নিয়ে সরকারি দলকে বুঝিয়ে সমস্যার সমাধান করাটা সহজ ছিল। বিরোধীদলীয় নেতা ‘ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন’ কিংবা ‘ইউ শুড স্পিক ইন পার্লামেন্ট’ মন্তব্যগুলো অযথা নয় কি? বিরোধীদলীয় নেতা কোথায় ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন? তিনি যা ভালো মনে করেছেন, সেই বক্তব্য পার্লামেন্টেই তো দিয়েছেন।
স্পিকার বললেন, অষ্টম সংসদে তার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি তখন সংসদ উপনেতা ছিলেন। তার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছিল দেশবাসী দেখেছে। বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কী আচরণ করতে পারে, কতটা করতে পারে সেটা এদেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে তো আর কেউ ভালো বলতে পারে না। তবে তাই বলে স্পিকার যদি তার অন্তরের জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ঘটান খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে, সেটা কি ভালো দেখায়?
‘বাংলাদেশের ইতিহাসে যত স্পিকার এসেছেন, তার মধ্যে আমি নিরপেক্ষ’ বলে দাবি করেছেন অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। এটা কতটা সত্য? বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা স্পিকার হিসেবে দেখেছি আবদুল মালেক উকিল, মির্জা গোলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, আবদুর রহমান বিশ্বাস, শেখ রাজ্জাক আলী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এবং বর্তমান স্পিকারকে দ্বিতীয়বার। তাদের প্রত্যেকের কাজই তো আমাদের চোখের সামনে। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় পার্লামেন্টকে দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণবন্ত বা লাইভলি পার্লামেন্ট হিসেবে ধরা হয়। সেই সংসদে বিরোধী দলের (আওয়ামী লীগের) সংসদ সদস্য ছিলেন ৩৮ জন। স্পিকার ছিলেন মির্জা গোলাম হাফিজ। সেই সংসদের কার্যক্রমের ধারে-কাছেও কি পরের সংসদগুলো যেতে পেরেছে? ১৯৮৬ সালের পার্লামেন্টে বিএনপি ছিল না। স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ছিল। সেই সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরীর হিউমারের কথাও সবার মুখে মুখে এখনও আছে। পঞ্চম সংসদের স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী অত্যন্ত দক্ষ স্পিকার হিসেবে সংসদ চালিয়েছিলেন। অথচ সপ্তম জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সেই সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। পরে তিনি স্পিকারও হন। সেই সংসদে ইতিহাসের বৃহত্তর বিরোধী দল (১১৬ আসনের) ছিল বিএনপি। বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন খালেদা জিয়া। সেই সংসদের কার্যক্রমও আছে আমাদের চোখের সামনে। সেই সংসদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে সংসদটা মৃতপ্রায় একটি অকার্যকর সংসদে পরিণত হয়েছিল। সংসদ একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। সরকারি দল আওয়ামী লীগের ‘রাবার স্ট্যাম্প’ পার্লামেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিল সপ্তম সংসদ। লাগামহীনভাবে সংবিধান লঙ্ঘন, সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি লঙ্ঘন, বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেয়া, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের একপেশে ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সংসদ পরিচালনা, স্পিকারের স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনি রুলিংয়ের কারণে ওই সংসদটি সংসদীয় ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় রচনা করেছিল। সেই সংসদের প্রথমে ডেপুটি স্পিকার ছিলেন আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, পরে তিনি স্পিকার হন। বর্তমান নবম সংসদেও তিনি স্পিকার। এই সংসদ কতটা নিরপেক্ষ, স্পিকার কতটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সংসদ চালাচ্ছেন—সেটা তো দেশবাসী দেখছেনই। কথায় কথায় স্পিকারের মুখ থেকে নিরপেক্ষতার বুলি বের হলেই কি বলা যাবে স্পিকার নিরপেক্ষভাবে সংসদ চালাচ্ছেন। স্পিকার নিজেই বলেছেন, আমাকে অনেকেই ‘ওয়ান সাইডেড’ বলছেন; কিন্তু আমি ‘ওয়ান সাইডেড’ নই। সবার প্রশ্ন—‘ওয়ান সাইডেড’ না হলে আপনাকে মানুষ ‘ওয়ান সাইডেড’ বলবে কেন? নিরপেক্ষভাবে সংসদ চালালে সেটা আপনার বলা লাগবে না। এর সুফল সবাই পাবে এবং এমনিতেই আপনার নিরপেক্ষতার কথা ছড়িয়ে পড়বে।
চলতি নবম সংসদ কতটা নিরপেক্ষভাবে চলছে কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট। সংসদের ১২টি অধিবেশনে বিরোধীদল ৭১৬টি মুলতবি প্রস্তাব জমা দেয়। কিন্তু অনুপস্থিতির অজুহাতে স্পিকার বিরোধী দলের একটি মুলতবি প্রস্তাবও গ্রহণ করেননি। বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেননি স্পিকার। অথচ এসব মুলতবি প্রস্তাব ছিল জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রস্তাব হচ্ছে— নির্বাচনোত্তর সহিংসতা, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি, ভারতের একতরফা অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার, বিডিআর অসন্তোষ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ, বিষাক্ত ওষুধ, সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে অনিয়ম, নতুন আবাসনে গ্যাস ও বিদ্যুত্ সংযোগ না দেয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সেনানিবাস বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ, ভারতের সঙ্গে সর্বশেষ সম্পাদিত তিনটি চুক্তি, বিমানে লোকসান, গুপ্তহত্যা, গার্মেন্টে শ্রমিক অসন্তোষ, ওয়ারিদ টেলিকমের শেয়ার হস্তান্তর, গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া, পৌর নির্বাচনে ভোট কারচুপি, বিরোধীদলের সমাবেশে বাধা, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ইত্যাদি।
অষ্টম সংসদের বিদায়ী স্পিকারের বিরোধী দল বিএনপিকে দেয়া সামনের সারির ৯টি আসনের মধ্যে ৫টি কেড়ে নেয়া হয় স্পিকার আবদুল হামিদ দায়িত্ব নেয়ার পরপরই। এ কারণে সংসদ বর্জন করে বিরোধী দল। পরে অবশ্য বাদ-প্রতিবাদের পর মাত্র একটি আসন বাড়ানো হয়। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংসদে বিরোধী দলকে সংখ্যার বিচারে দেখা হবে না। বিগত কয়েকটি সংসদের রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম দিনই সংসদে যোগ দিলেও বিরোধী দল বিএনপিকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। সংসদে একাধারে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য দেয়া হলেও স্পিকার নিজে উদ্যোগী হয়ে এক্সপাঞ্জ করেননি বা এসব বক্তব্যে বাধা দেননি। অথচ বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অসংসদীয় ভাষায় কথা হলে নিজ থেকেই তা এক্সপাঞ্জ করে দিয়েছেন স্পিকার।
স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদকে মাছের বাজার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই সংসদের সিটিং এমপি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেফতার করা হলেও সংসদের অভিভাবক হিসেবে কোনো উদ্যোগ নেননি স্পিকার।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করলেও স্পিকার নীরব ভূমিকা পালন করেন। এমনকি সংসদে মহাজোটের সিনিয়র এমপিরা পুলিশের পক্ষ হয়ে ফারুকের সমালোচনা করলেও স্পিকার ছিলেন নিশ্চুপ।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
এমন একজন রাজনীতিক ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানকে নিঃসন্দেহে যে কোনো মানুষই দেশের সম্পদ হিসেবে মনে করে থাকে। একই সঙ্গে এমন মানুষের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা থাকে, তার দ্বারা দেশের ভালো কিছু হবে। তিনি দেশের রাজনীতি আলোকিত করবেন, গণতন্ত্রকে আরও বিকশিত, আরও সুন্দর এবং মজবুত করবেন। কিন্তু গত ২৯ মার্চ নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের শেষদিনে স্পিকারের সমাপনী বক্তব্য শুনে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত, দুঃখ পেয়েছেন এবং একইসঙ্গে ক্ষুব্ধও। টেলিভিশনে অনেকে দেখেছেন স্পিকার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, ক্রোধ প্রকাশ করছেন। স্পিকারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজও খুব আপত্তিকর মনে হয়েছে। না, মাননীয় স্পিকার, আপনার কাছ থেকে আমরা এভাবে বক্তব্য আশা করি না। আপনি কথায় কথায় বলেন, অন্য যে কোনো দেশের স্পিকারের চেয়ে আপনি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কি সেই নিরপেক্ষতার নমুনা?
যে কোনো সংসদের সফলতা নির্ভর করে স্পিকারের নিরপেক্ষ ভূমিকার ওপর। স্পিকার নিরপেক্ষ না হলে সংসদের অঙ্গহানি ঘটে এবং তা সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সংসদের স্পিকারের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পিকার হচ্ছেন সংসদের অভিভাবক। তাকে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাকে ননপার্টিজান হতে হয়। এজন্যই স্পিকার পদের মর্যাদা অন্যরকম। সবাই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে বলা হয় ‘মাদার অব অল পার্লামেন্ট’। ব্রিটেনে দেখা গেছে, স্পিকার যে এলাকায় নির্বাচনে প্রার্থী হন, সেখানে তার প্রতিপক্ষ দল কোনো প্রার্থীই দেয় না। ফলে বিভিন্ন মেয়াদে বারবার স্পিকার তার পদে বহাল থাকতে পারেন। জাপানে কেউ স্পিকার হলে তাকে সংশ্লিষ্ট দল থেকে পদত্যাগ করতে হয়। আমরা হয়তো এতটা আশা করি না। কিন্তু স্পিকার হিসেবে নিরপেক্ষতা কিছুটা হলেও বজায় রাখতে ন্যূনতম যা করার, সেটা তো স্পিকারের করা উচিত। সেটা না করে স্পিকার যদি দলের অন্যসব নেতাকর্মীর মতোই আচরণ করেন, তাহলে কি সেটা ভালো দেখায়?
২৯ মার্চ সংসদে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় এমপিদের একহাত নিয়েছেন। তিনি বেগম খালেদা জিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর সংসদে যোগ দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি তোলেননি। তিনি কোনটা মানেন? কোন ধরনের, কোন পদ্ধতির তত্ত্বাবধায়ক, কী রূপরেখার তত্ত্বাবধায়ক চান, তা ওনার বলা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে বিরোধীদলীয় নেতা জাতিকে ধূম্রজালের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ইউ শুড স্পিক ইন পার্লামেন্ট।’ স্পিকার আরও অভিযোগ করেন, বিরোধীদলীয় নেতা যখন বক্তব্য দিয়েছেন, তখন সংসদ নেতা সংসদে থেকে বক্তব্য শুনেছেন। কিন্তু সংসদ নেতার বক্তব্যের সময় বিরোধীদলীয় নেতা চলে গেলেন। এটা তো কোনো অবস্থায় হতে পারে না। এটা মোটেও ঠিক হয়নি।
নিজেকে শতভাগ নিরপেক্ষ দাবি করে স্পিকার বলেন, আমাকে অনেকে ‘ওয়ান সাইডেড’ বলেন। তবে আমি ‘ওয়ান সাইডেড’ নই। আমি আমার বিবেকের কাছে মুক্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত স্পিকার এসেছে, তার মধ্যে আমি নিজেকে নিরপেক্ষ বলতে পারব। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের স্পিকারের তুলনায় আমি কোনো অংশে কম ধৈর্য-সহ্য দেখাইনি। আমার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে শুধু বলব, আমি দুঃখিত। বিরোধীদলীয় এমপিদের অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগের বিষয় উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, রেহানা আক্তার যে কথা বলেছেন তাতে তার কথা বন্ধ করা যেত। কিন্তু সেটা করলে সংসদ বর্জনের উছিলা হতো। স্পিকার আরও বলেন, ‘অন্তরে জ্বালা থাকলেও বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি না। কারণ আমাকে স্পিকারের দায়িত্ব দিয়েছেন। শপথ নিয়েছি নিরপেক্ষতার।’
স্পিকার আরও বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অষ্টম পার্লামেন্টে আমি যখন বিরোধী দলের উপনেতা ছিলাম, আমাদের সঙ্গে কী করেছে আপনারাও দেখেছেন, দেশবাসী দেখেছে। বিরোধীদলীয় নেতাকে দীর্ঘ বক্তব্যের সুযোগ দেয়ার কথা উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, আমি তাকে শুধু বলেছিলাম বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা আছে, সে জন্য যেন কথা সংক্ষেপ করা হয়। তখন বিরোধীদলীয় নেতা বললেন, আমি যেন তাকে বাধা না দিই।
গত ২৯ মার্চ স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলের ওপর কেন এত রাগ ঝাড়লেন, তা বোধগম্য নয়। দীর্ঘদিন বর্জনের পর সংসদে যোগদান করেছে বিরোধী দল। সংসদীয় কার্যক্রমে বিরোধী দলকে কীভাবে ধরে রাখা যায়, স্পিকারের ভূমিকা হবে সেটাই। কিন্তু উল্টো তিনিই ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিরোধী দলের ওপর। বিরোধীদলীয় নেতা তো তার মতো করেই বক্তব্য দেবেন। স্পিকার যেভাবে চান, সেভাবে তো তিনি বক্তব্য দেবেন না। বিরোধীদলীয় নেতার একটি রাজনৈতিক দল আছে, তার একটা রাজনীতি আছে এবং সেই রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ আছে। সেটাকে সামনে রেখেই তিনি বক্তব্য দেবেন এবং দিয়েছেনও। কিন্তু স্পিকার তার কাছে অনেকটা কৈফিয়ত চাওয়ার মতো করেই বললেন, খালেদা জিয়া কেন সংসদে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালের দাবি তুললেন না, তিনি তত্ত্বাবধায়ক চান কি চান না, কোনটা মানেন আর কোনটা মানেন না, সেটা নাকি বলা উচিত ছিল। খালেদা জিয়ার বক্তব্য পর্যালোচনা করলে আমরা কী দেখতে পাই? সংসদে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে না এবং নির্বাচন হতে দেবে না। তার এই বক্তব্যে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি পরিষ্কার নয়? এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারটা কী ধরনের হবে, সেটা সংসদে খালেদা জিয়া ফর্মুলা উপস্থাপন করলেই যদি তা হয়ে যেত, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়াই তো শ্রেয় ছিল। সংসদে বিরোধী দল বিএনপির যে সংখ্যক এমপি রয়েছেন, তারা ইচ্ছা করলেই তো প্রস্তাব পাস করাতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ফর্মুলা উপস্থাপনের কী যৌক্তিকতা আছে? বিরোধী দল থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, নির্বাচনকালীন সরকারটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার হতে হবে। সেটা যে কোনো নামে হতে পারে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে আন্তরিক হলে তারা আলাপ-আলোচনা করে সহজেই সমস্যার সুরাহা করে দিতে পারেন। এজন্য স্পিকারের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে দোষারোপ করে তো লাভ নেই। বরং এ ব্যাপারে স্পিকারের পক্ষে একটা উদ্যোগ নিয়ে সরকারি দলকে বুঝিয়ে সমস্যার সমাধান করাটা সহজ ছিল। বিরোধীদলীয় নেতা ‘ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন’ কিংবা ‘ইউ শুড স্পিক ইন পার্লামেন্ট’ মন্তব্যগুলো অযথা নয় কি? বিরোধীদলীয় নেতা কোথায় ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন? তিনি যা ভালো মনে করেছেন, সেই বক্তব্য পার্লামেন্টেই তো দিয়েছেন।
স্পিকার বললেন, অষ্টম সংসদে তার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি তখন সংসদ উপনেতা ছিলেন। তার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছিল দেশবাসী দেখেছে। বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কী আচরণ করতে পারে, কতটা করতে পারে সেটা এদেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে তো আর কেউ ভালো বলতে পারে না। তবে তাই বলে স্পিকার যদি তার অন্তরের জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ঘটান খালেদা জিয়াকে আক্রমণ করে, সেটা কি ভালো দেখায়?
‘বাংলাদেশের ইতিহাসে যত স্পিকার এসেছেন, তার মধ্যে আমি নিরপেক্ষ’ বলে দাবি করেছেন অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। এটা কতটা সত্য? বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা স্পিকার হিসেবে দেখেছি আবদুল মালেক উকিল, মির্জা গোলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, আবদুর রহমান বিশ্বাস, শেখ রাজ্জাক আলী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এবং বর্তমান স্পিকারকে দ্বিতীয়বার। তাদের প্রত্যেকের কাজই তো আমাদের চোখের সামনে। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় পার্লামেন্টকে দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণবন্ত বা লাইভলি পার্লামেন্ট হিসেবে ধরা হয়। সেই সংসদে বিরোধী দলের (আওয়ামী লীগের) সংসদ সদস্য ছিলেন ৩৮ জন। স্পিকার ছিলেন মির্জা গোলাম হাফিজ। সেই সংসদের কার্যক্রমের ধারে-কাছেও কি পরের সংসদগুলো যেতে পেরেছে? ১৯৮৬ সালের পার্লামেন্টে বিএনপি ছিল না। স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ছিল। সেই সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরীর হিউমারের কথাও সবার মুখে মুখে এখনও আছে। পঞ্চম সংসদের স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী অত্যন্ত দক্ষ স্পিকার হিসেবে সংসদ চালিয়েছিলেন। অথচ সপ্তম জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সেই সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। পরে তিনি স্পিকারও হন। সেই সংসদে ইতিহাসের বৃহত্তর বিরোধী দল (১১৬ আসনের) ছিল বিএনপি। বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন খালেদা জিয়া। সেই সংসদের কার্যক্রমও আছে আমাদের চোখের সামনে। সেই সংসদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে সংসদটা মৃতপ্রায় একটি অকার্যকর সংসদে পরিণত হয়েছিল। সংসদ একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। সরকারি দল আওয়ামী লীগের ‘রাবার স্ট্যাম্প’ পার্লামেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিল সপ্তম সংসদ। লাগামহীনভাবে সংবিধান লঙ্ঘন, সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি লঙ্ঘন, বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেয়া, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের একপেশে ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সংসদ পরিচালনা, স্পিকারের স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনি রুলিংয়ের কারণে ওই সংসদটি সংসদীয় ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় রচনা করেছিল। সেই সংসদের প্রথমে ডেপুটি স্পিকার ছিলেন আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, পরে তিনি স্পিকার হন। বর্তমান নবম সংসদেও তিনি স্পিকার। এই সংসদ কতটা নিরপেক্ষ, স্পিকার কতটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সংসদ চালাচ্ছেন—সেটা তো দেশবাসী দেখছেনই। কথায় কথায় স্পিকারের মুখ থেকে নিরপেক্ষতার বুলি বের হলেই কি বলা যাবে স্পিকার নিরপেক্ষভাবে সংসদ চালাচ্ছেন। স্পিকার নিজেই বলেছেন, আমাকে অনেকেই ‘ওয়ান সাইডেড’ বলছেন; কিন্তু আমি ‘ওয়ান সাইডেড’ নই। সবার প্রশ্ন—‘ওয়ান সাইডেড’ না হলে আপনাকে মানুষ ‘ওয়ান সাইডেড’ বলবে কেন? নিরপেক্ষভাবে সংসদ চালালে সেটা আপনার বলা লাগবে না। এর সুফল সবাই পাবে এবং এমনিতেই আপনার নিরপেক্ষতার কথা ছড়িয়ে পড়বে।
চলতি নবম সংসদ কতটা নিরপেক্ষভাবে চলছে কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট। সংসদের ১২টি অধিবেশনে বিরোধীদল ৭১৬টি মুলতবি প্রস্তাব জমা দেয়। কিন্তু অনুপস্থিতির অজুহাতে স্পিকার বিরোধী দলের একটি মুলতবি প্রস্তাবও গ্রহণ করেননি। বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেননি স্পিকার। অথচ এসব মুলতবি প্রস্তাব ছিল জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রস্তাব হচ্ছে— নির্বাচনোত্তর সহিংসতা, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি, ভারতের একতরফা অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার, বিডিআর অসন্তোষ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ, বিষাক্ত ওষুধ, সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে অনিয়ম, নতুন আবাসনে গ্যাস ও বিদ্যুত্ সংযোগ না দেয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সেনানিবাস বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ, ভারতের সঙ্গে সর্বশেষ সম্পাদিত তিনটি চুক্তি, বিমানে লোকসান, গুপ্তহত্যা, গার্মেন্টে শ্রমিক অসন্তোষ, ওয়ারিদ টেলিকমের শেয়ার হস্তান্তর, গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া, পৌর নির্বাচনে ভোট কারচুপি, বিরোধীদলের সমাবেশে বাধা, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ইত্যাদি।
অষ্টম সংসদের বিদায়ী স্পিকারের বিরোধী দল বিএনপিকে দেয়া সামনের সারির ৯টি আসনের মধ্যে ৫টি কেড়ে নেয়া হয় স্পিকার আবদুল হামিদ দায়িত্ব নেয়ার পরপরই। এ কারণে সংসদ বর্জন করে বিরোধী দল। পরে অবশ্য বাদ-প্রতিবাদের পর মাত্র একটি আসন বাড়ানো হয়। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংসদে বিরোধী দলকে সংখ্যার বিচারে দেখা হবে না। বিগত কয়েকটি সংসদের রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রথম দিনই সংসদে যোগ দিলেও বিরোধী দল বিএনপিকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। সংসদে একাধারে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য দেয়া হলেও স্পিকার নিজে উদ্যোগী হয়ে এক্সপাঞ্জ করেননি বা এসব বক্তব্যে বাধা দেননি। অথচ বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অসংসদীয় ভাষায় কথা হলে নিজ থেকেই তা এক্সপাঞ্জ করে দিয়েছেন স্পিকার।
স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদকে মাছের বাজার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই সংসদের সিটিং এমপি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেফতার করা হলেও সংসদের অভিভাবক হিসেবে কোনো উদ্যোগ নেননি স্পিকার।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করলেও স্পিকার নীরব ভূমিকা পালন করেন। এমনকি সংসদে মহাজোটের সিনিয়র এমপিরা পুলিশের পক্ষ হয়ে ফারুকের সমালোচনা করলেও স্পিকার ছিলেন নিশ্চুপ।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন