সৈয়দ আবদাল আহমদ
ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার রহস্যের এখনও কোনো কূল-কিনারা হয়নি। দু’দিন পার হয়ে গেলেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন, না গুম-খুনের শিকার হয়ে লাশে পরিণত হয়েছেন কেউ কিছু বলতে পারছে না। ছেলে গুম হওয়ার খবরে সিলেটে বৃদ্ধ মা বাকরুদ্ধ। স্বামীর খোঁজে স্ত্রী লুনা হন্যে হয়ে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। কিশোর ছেলেমেয়েদের কান্না থামছে না। কিন্তু কেউই তাদের ইলিয়াস আলীর খোঁজ দিতে পারছে না। পুলিশ, র্যাব, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—সর্বত্রই ধরনা দিয়েছেন ইলিয়াস আলীর স্বজন ও বিএনপির নেতারা। সবার জবাব, আমরা কিছু জানি না।
তাহলে কি ইলিয়াস আলীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না? তার ভাগ্যও কি চৌধুরী আলমের মতো হবে? না, এটা হতে পারে না। না, বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া যায় না।
ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনায় সারাদেশের মানুষ আজ স্তম্ভিত, আতঙ্কিত। ইলিয়াস আলী সাধারণ কোনো নাগরিক নন। অতি সাধারণ নেতাও তিনি নন। এক সময়ের আলোচিত ছাত্রনেতা তিনি। বর্তমানে ইলিয়াস আলী দেশের বড় দুটি দলের একটি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। সাবেক এমপি। বৃহত্তর সিলেটের মানুষের কাছে ইলিয়াস আলী অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর এখন সিলেট বিএনপির কাণ্ডারিই বলা যায় ইলিয়াস আলীকে। সিলেটে তার এই জনপ্রিয়তা এমনিতেই হয়নি। সিলেটের জন্য রাত-দিন তিনি শ্রম দিচ্ছেন। সিলেটের প্রতিটি এলাকায় তিনি ঘুরছেন, মানুষের সান্নিধ্যে আসছেন। সিলেটের মানুষও তাকে নিয়ে আশাবাদী। তার মধ্যে ভবিষ্যত্ নেতৃত্বের এক বড় সম্ভাবনা দেখেছে তারা। ফলে সিলেটের মানুষ ইলিয়াস আলীর দিকে ঝুঁকেছে। এরই মধ্যে সিলেট সংগঠিত করে তুলছেন ইলিয়াস আলী। এর ছাপ বুধবার দেখা গেছে। ইলিয়াস আলীর গুমের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারেনি। তারা নেমে এসেছে রাজপথে। বিক্ষোভ করেছে, ভাংচুর করেছে, সড়ক অবরোধ করেছে। বৃহস্পতিবার সর্বাত্মক হরতাল পালন করে সিলেটবাসী সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনা তারা মেনে নেবে না। ইলিয়াস আলীকে তাদের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। তাকে নিয়ে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র সিলেটবাসী বরদাশত করবে না।
ইলিয়াস আলী বিএনপির একজন সাহসী নেতা। না, তিনি শুধু সাহসী নেতাই নন, একজন পরীক্ষিত নেতাও। ছাত্রদল থেকে যারা মূল দলে আসে, তাদের সাধারণত ‘অরিজিনাল বিএনপি’ বলা হয়। ইলিয়াস আলী ছাত্রদলকে নেতৃত্ব দিয়ে মূল দলে এসেছেন তো বটেই, তার চেয়ে বড় কথা তিনি আপসকামীদের কোনো গ্রুপে ছিলেন না, সুবিধাবাদকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তার রয়েছে সুস্পষ্ট চিন্তাধারা। তিনি একজন স্পষ্টবাদী রাজনীতিক। মুখে যা বলেন অন্তরে তা বিশ্বাস করেন। অর্থাত্ তিনি বিএনপি করেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শ বিশ্বাস করেন এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব আপাদমস্তক মানেন—এর বাইরে রাজনীতি তিনি বোঝেন না । তাই দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিককালে সিলেটে বিএনপির পক্ষে জনসমর্থন ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সিলেটে রোডমার্চ নিয়ে গেলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য জনজোয়ার। এর জন্য ইলিয়াস আলীর অবদান কম নয়। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধেও সিলেটের মানুষকে সংগঠিত করেছেন ইলিয়াস আলী। সিলেটের স্বার্থ এবং সেখানকার মানুষের প্রতিটি স্বার্থের সঙ্গে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে মানুষের মন জয় করেছেন। তা হলে এটাই কি কাল হয়ে দাঁড়াল? ইলিয়াসের জীবন কি এ জন্যেই শঙ্কায় পড়েছে?
ইলিয়াস আলীকে কেন গুম করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তর সরকারি কর্তাব্যক্তিদের কেউই দিতে পারছেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তার উত্তর ইলিয়াস আলীকে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তুলে নিয়ে যায়নি। তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার খোঁজ দিতে পারছে না কেন? এটা কি তাদের দায়িত্বে পড়ে না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুধবার রাতে ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়েছেন এবং ইলিয়াস আলীর স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, র্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসের ২৪ ঘণ্টা পার হয়েছে। আর ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পার হয়েছে। কিন্তু জানা যায়নি ইলিয়াস আলীর কোনো খবর। গতকাল সকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে স্মারকলিপি দিয়েছে। স্মারকলিপিতে অবিলম্বে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করে সবার মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। বিএনপি জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিকে এই গুমের ঘটনা জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ঢাকায় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ডেকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এতবড় ঘটনার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বিকার। তার যখন কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দিয়ে সহযোগী একটি দলের গুম হওয়া জনপ্রিয় একজন রাজনৈতিক নেতাকে উদ্ধার করা, সেটা না করে উল্টো তিনি গতকাল কৃষক লীগের সমাবেশে বলেছেন, ‘বিরোধী দলের নেত্রীই হয়তো তাকে লুকিয়ে রেখেছেন। বিএনপি নিজেরাই মানুষ হত্যা ও গুম করে।’ এই দায়িত্বহীনতাকে কি বলা যায়?
কেন ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। জন মনে ব্যাপক সন্দেহ—সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্নীতি চাপা দিতেই ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, ইলিয়াস আলীকে সরকারের কোনো বাহিনীই গুম করেছে। ইলিয়াস আলীর মতো সাহসী নেতাকে সাধারণ কোনো মহল থেকে গুম করার কেউ সাহস দেখাবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারকে ধসিয়ে দিয়েছে। সর্বত্রই এ নিয়ে আলোচনা। ‘আমি নির্দোষ’ বলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যতই চেঁচামেচি করেন না কেন, তিনি যে এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন কেউ তা বিশ্বাস করছে না। তার অবস্থাটা হয়েছে এমন যে, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদের মতো। নিজের জড়িত থাকার কথা নিজের অজান্তেই বলে ফেলছেন। অপরাধীরা অপরাধ করে চিহ্ন রেখে যায়—এ ধারণা স্বতঃসিদ্ধ। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। গভীর রাতে এপিএস ও মন্ত্রণালয়ের জিএম ৭০ লাখ টাকার বস্তা নিয়ে গাড়িতে জাতীয় সংসদের স্টিকার লাগিয়ে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছেন। পথে বিজিবি সদর দফতরে টাকাটা ধরা পড়ার পর পরই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আগ বাড়িয়ে বলছেন, এ টাকা এপিএসের ব্যক্তিগত। তিনি কীভাবে জানেন এ টাকা এপিএসের ব্যক্তিগত? এ টাকা তো তার বাড়িতে যাচ্ছিল। তাছাড়া এপিএস হঠাত্ একসঙ্গে এত টাকা কোথায় পাবে? এপিএসের বেতন তো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি নয়? ধরা পড়ার দিন এপিএস ফারুক বলেছে, ৭০ লাখ নয়, টাকা ছিল ২৫ লাখ। এ টাকা তাকে দিয়েছে তার শ্যালক। আবার দুদকে গিয়ে এপিএস বলেছে, টাকা ৭০ লাখই ছিল, তবে এ টাকা তার নিজের। আমেরিকা থেকে তার ভাই এ টাকা দিয়েছে। আগে বলেছে শ্যালক, এখন বলছে ভাই। আগে বলেছে ২৫ লাখ, এখন স্বীকার করছে ৭০ লাখই। তার কত বড় ধনী ভাই আমেরিকায় থাকে যে, তাকে একসঙ্গে ৭০ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে? রাতের বেলায় তিনি টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন। রাতে কি ব্যাংক খোলা থাকে? কোন ব্যাংক থেকে তিনি টাকা তুলেছেন কিংবা কার কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন? এর প্রমাণপত্র কোথায়? এপিএস আরও বলেছেন, ‘এটা আমার টাকা, দাদার টাকা নয়। দাদা একজন নক্ষত্র। তিনি নির্দোষ, তিনি নির্দোষ, তিনি নির্দোষ।’ এপিএস এটা বারবার বলার অর্থ কী? সেটা কি এপিএসকে শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য নয়? অর্থাত্ আগে তুমি আমাকে নির্দোষ কর, পরে তোমাকে বাঁচাব। অনেকেই বলছেন, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যদি জড়িত না-ই থাকতেন, তাহলে তিনি নিজেই এপিএসকে ধরে এনে মিডিয়ার সামনে হাজির করাতেন। তার উপস্থিতিতে মিডিয়ার সামনে তাকে বলতেন—বল, এই টাকা কোথায় পেলে? এই টাকার উত্স কি, প্রমাণ দেখা? সুরঞ্জিত সেন আরও করতে পারতেন। তিনি পুলিশ ডেকে জিএম ও এপিএসকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বলতে পারতেন, গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে এরা ধরা পড়েছে। এই টাকা এরা কোথায় পেল—রহস্য বের করুন। কিন্তু সুরঞ্জিত সেটা না করে বলেছেন, এ টাকা এপিএসের। এপিএসের এ টাকার উত্স কী তা এনবিআর দেখবে। এটা বলে কি তিনি বিষয়টি ধামাচাপা দেননি। কেন তিনি ধামাচাপা দিয়েছেন? কারণ একটিই—থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে।
আরেকটা বিষয় মানুষের চোখে পড়েছে। মন্ত্রিত্ব রাখার জন্য তিনি ছিলেন মরিয়া। দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার ঘোষণার আগেই পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার জন্য লবিং করছেন। নইলে প্রধানমন্ত্রীকে তো তিনি বলতে পারতেন এখন আমার মন্ত্রী থাকার প্রয়োজন নেই। তদন্ত হোক। তদন্তের পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে ৬ মাস পর আমি মন্ত্রী হব। সেটা তো তিনি করেননি; বরং একদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন, সুরঞ্জিত দফতরবিহীন মন্ত্রী। এ কথাও মানুষের মুখে মুখে যে, প্রতিবেশী একটি দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নীতি-নির্ধারককে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুরঞ্জিতের ব্যাপারে তদবির করানো হয়েছে। কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ভেতরের ঘটনা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর সে কারণেই বড় ধরনের ধস ঠেকাতে গুম করা হয়েছে ইলিয়াস আলীকে। আর ইলিয়াস আলীকে একাই গুম করা হয়নি। কোনো সাক্ষী যেন না থাকে সে জন্য সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসারকেও গুম করা হয়েছে। তারও কোনো খোঁজ নেই। কারণ ইলিয়াস আলীর গুম ছোটখাটো ঘটনা নয়। জনগণের চোখ সুরঞ্জিত কেলেঙ্কারি থেকে চলে আসবে ইলিয়াস আলীর গুমের দিকে। এসেছেও। গত দু’দিন ধরে সর্বত্র ইলিয়াসের গুমই আলোচনায়। এভাবে একের পর এক ইস্যু বদল করার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। দেখা গেছে, একটি বড় ঘটনা নিয়ে জনমত সংগঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেছে অন্য আরেকটি ঘটনা। ফলে আগের ইস্যু ছেড়ে নতুন ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানেও সুরঞ্জিত কেলেঙ্কারি ইস্যু থেকে এখন নজর ইলিয়াস আলীর গুম। তবে নেপথ্যের ঘটনা যাই হোক, আমরা ইলিয়াস আলীকে আমাদের মাঝে ফিরে পেতে চাই। সম্ভাবনাময় এই নেতৃত্বকে আমরা কোনোভাবেই হারাতে চাই না। ইলিয়াস আলী শুধু বিএনপির সম্পদই নন, দেশের সম্পদ। ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দাও। ইলিয়াস আলী ফিরেছেন—এ সুখবর সহসাই পাব প্রত্যাশা করে ইতি টানছি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
তাহলে কি ইলিয়াস আলীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না? তার ভাগ্যও কি চৌধুরী আলমের মতো হবে? না, এটা হতে পারে না। না, বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া যায় না।
ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনায় সারাদেশের মানুষ আজ স্তম্ভিত, আতঙ্কিত। ইলিয়াস আলী সাধারণ কোনো নাগরিক নন। অতি সাধারণ নেতাও তিনি নন। এক সময়ের আলোচিত ছাত্রনেতা তিনি। বর্তমানে ইলিয়াস আলী দেশের বড় দুটি দলের একটি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। সাবেক এমপি। বৃহত্তর সিলেটের মানুষের কাছে ইলিয়াস আলী অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর এখন সিলেট বিএনপির কাণ্ডারিই বলা যায় ইলিয়াস আলীকে। সিলেটে তার এই জনপ্রিয়তা এমনিতেই হয়নি। সিলেটের জন্য রাত-দিন তিনি শ্রম দিচ্ছেন। সিলেটের প্রতিটি এলাকায় তিনি ঘুরছেন, মানুষের সান্নিধ্যে আসছেন। সিলেটের মানুষও তাকে নিয়ে আশাবাদী। তার মধ্যে ভবিষ্যত্ নেতৃত্বের এক বড় সম্ভাবনা দেখেছে তারা। ফলে সিলেটের মানুষ ইলিয়াস আলীর দিকে ঝুঁকেছে। এরই মধ্যে সিলেট সংগঠিত করে তুলছেন ইলিয়াস আলী। এর ছাপ বুধবার দেখা গেছে। ইলিয়াস আলীর গুমের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারেনি। তারা নেমে এসেছে রাজপথে। বিক্ষোভ করেছে, ভাংচুর করেছে, সড়ক অবরোধ করেছে। বৃহস্পতিবার সর্বাত্মক হরতাল পালন করে সিলেটবাসী সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনা তারা মেনে নেবে না। ইলিয়াস আলীকে তাদের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। তাকে নিয়ে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র সিলেটবাসী বরদাশত করবে না।
ইলিয়াস আলী বিএনপির একজন সাহসী নেতা। না, তিনি শুধু সাহসী নেতাই নন, একজন পরীক্ষিত নেতাও। ছাত্রদল থেকে যারা মূল দলে আসে, তাদের সাধারণত ‘অরিজিনাল বিএনপি’ বলা হয়। ইলিয়াস আলী ছাত্রদলকে নেতৃত্ব দিয়ে মূল দলে এসেছেন তো বটেই, তার চেয়ে বড় কথা তিনি আপসকামীদের কোনো গ্রুপে ছিলেন না, সুবিধাবাদকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তার রয়েছে সুস্পষ্ট চিন্তাধারা। তিনি একজন স্পষ্টবাদী রাজনীতিক। মুখে যা বলেন অন্তরে তা বিশ্বাস করেন। অর্থাত্ তিনি বিএনপি করেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শ বিশ্বাস করেন এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব আপাদমস্তক মানেন—এর বাইরে রাজনীতি তিনি বোঝেন না । তাই দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিককালে সিলেটে বিএনপির পক্ষে জনসমর্থন ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সিলেটে রোডমার্চ নিয়ে গেলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য জনজোয়ার। এর জন্য ইলিয়াস আলীর অবদান কম নয়। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধেও সিলেটের মানুষকে সংগঠিত করেছেন ইলিয়াস আলী। সিলেটের স্বার্থ এবং সেখানকার মানুষের প্রতিটি স্বার্থের সঙ্গে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে মানুষের মন জয় করেছেন। তা হলে এটাই কি কাল হয়ে দাঁড়াল? ইলিয়াসের জীবন কি এ জন্যেই শঙ্কায় পড়েছে?
ইলিয়াস আলীকে কেন গুম করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তর সরকারি কর্তাব্যক্তিদের কেউই দিতে পারছেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তার উত্তর ইলিয়াস আলীকে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তুলে নিয়ে যায়নি। তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার খোঁজ দিতে পারছে না কেন? এটা কি তাদের দায়িত্বে পড়ে না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুধবার রাতে ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়েছেন এবং ইলিয়াস আলীর স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, র্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসের ২৪ ঘণ্টা পার হয়েছে। আর ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পার হয়েছে। কিন্তু জানা যায়নি ইলিয়াস আলীর কোনো খবর। গতকাল সকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে স্মারকলিপি দিয়েছে। স্মারকলিপিতে অবিলম্বে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করে সবার মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। বিএনপি জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিকে এই গুমের ঘটনা জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ঢাকায় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ডেকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এতবড় ঘটনার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বিকার। তার যখন কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দিয়ে সহযোগী একটি দলের গুম হওয়া জনপ্রিয় একজন রাজনৈতিক নেতাকে উদ্ধার করা, সেটা না করে উল্টো তিনি গতকাল কৃষক লীগের সমাবেশে বলেছেন, ‘বিরোধী দলের নেত্রীই হয়তো তাকে লুকিয়ে রেখেছেন। বিএনপি নিজেরাই মানুষ হত্যা ও গুম করে।’ এই দায়িত্বহীনতাকে কি বলা যায়?
কেন ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। জন মনে ব্যাপক সন্দেহ—সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্নীতি চাপা দিতেই ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, ইলিয়াস আলীকে সরকারের কোনো বাহিনীই গুম করেছে। ইলিয়াস আলীর মতো সাহসী নেতাকে সাধারণ কোনো মহল থেকে গুম করার কেউ সাহস দেখাবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারকে ধসিয়ে দিয়েছে। সর্বত্রই এ নিয়ে আলোচনা। ‘আমি নির্দোষ’ বলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যতই চেঁচামেচি করেন না কেন, তিনি যে এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন কেউ তা বিশ্বাস করছে না। তার অবস্থাটা হয়েছে এমন যে, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদের মতো। নিজের জড়িত থাকার কথা নিজের অজান্তেই বলে ফেলছেন। অপরাধীরা অপরাধ করে চিহ্ন রেখে যায়—এ ধারণা স্বতঃসিদ্ধ। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। গভীর রাতে এপিএস ও মন্ত্রণালয়ের জিএম ৭০ লাখ টাকার বস্তা নিয়ে গাড়িতে জাতীয় সংসদের স্টিকার লাগিয়ে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছেন। পথে বিজিবি সদর দফতরে টাকাটা ধরা পড়ার পর পরই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আগ বাড়িয়ে বলছেন, এ টাকা এপিএসের ব্যক্তিগত। তিনি কীভাবে জানেন এ টাকা এপিএসের ব্যক্তিগত? এ টাকা তো তার বাড়িতে যাচ্ছিল। তাছাড়া এপিএস হঠাত্ একসঙ্গে এত টাকা কোথায় পাবে? এপিএসের বেতন তো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি নয়? ধরা পড়ার দিন এপিএস ফারুক বলেছে, ৭০ লাখ নয়, টাকা ছিল ২৫ লাখ। এ টাকা তাকে দিয়েছে তার শ্যালক। আবার দুদকে গিয়ে এপিএস বলেছে, টাকা ৭০ লাখই ছিল, তবে এ টাকা তার নিজের। আমেরিকা থেকে তার ভাই এ টাকা দিয়েছে। আগে বলেছে শ্যালক, এখন বলছে ভাই। আগে বলেছে ২৫ লাখ, এখন স্বীকার করছে ৭০ লাখই। তার কত বড় ধনী ভাই আমেরিকায় থাকে যে, তাকে একসঙ্গে ৭০ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে? রাতের বেলায় তিনি টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন। রাতে কি ব্যাংক খোলা থাকে? কোন ব্যাংক থেকে তিনি টাকা তুলেছেন কিংবা কার কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন? এর প্রমাণপত্র কোথায়? এপিএস আরও বলেছেন, ‘এটা আমার টাকা, দাদার টাকা নয়। দাদা একজন নক্ষত্র। তিনি নির্দোষ, তিনি নির্দোষ, তিনি নির্দোষ।’ এপিএস এটা বারবার বলার অর্থ কী? সেটা কি এপিএসকে শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য নয়? অর্থাত্ আগে তুমি আমাকে নির্দোষ কর, পরে তোমাকে বাঁচাব। অনেকেই বলছেন, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যদি জড়িত না-ই থাকতেন, তাহলে তিনি নিজেই এপিএসকে ধরে এনে মিডিয়ার সামনে হাজির করাতেন। তার উপস্থিতিতে মিডিয়ার সামনে তাকে বলতেন—বল, এই টাকা কোথায় পেলে? এই টাকার উত্স কি, প্রমাণ দেখা? সুরঞ্জিত সেন আরও করতে পারতেন। তিনি পুলিশ ডেকে জিএম ও এপিএসকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বলতে পারতেন, গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে এরা ধরা পড়েছে। এই টাকা এরা কোথায় পেল—রহস্য বের করুন। কিন্তু সুরঞ্জিত সেটা না করে বলেছেন, এ টাকা এপিএসের। এপিএসের এ টাকার উত্স কী তা এনবিআর দেখবে। এটা বলে কি তিনি বিষয়টি ধামাচাপা দেননি। কেন তিনি ধামাচাপা দিয়েছেন? কারণ একটিই—থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে।
আরেকটা বিষয় মানুষের চোখে পড়েছে। মন্ত্রিত্ব রাখার জন্য তিনি ছিলেন মরিয়া। দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার ঘোষণার আগেই পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার জন্য লবিং করছেন। নইলে প্রধানমন্ত্রীকে তো তিনি বলতে পারতেন এখন আমার মন্ত্রী থাকার প্রয়োজন নেই। তদন্ত হোক। তদন্তের পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে ৬ মাস পর আমি মন্ত্রী হব। সেটা তো তিনি করেননি; বরং একদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন, সুরঞ্জিত দফতরবিহীন মন্ত্রী। এ কথাও মানুষের মুখে মুখে যে, প্রতিবেশী একটি দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নীতি-নির্ধারককে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুরঞ্জিতের ব্যাপারে তদবির করানো হয়েছে। কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ভেতরের ঘটনা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর সে কারণেই বড় ধরনের ধস ঠেকাতে গুম করা হয়েছে ইলিয়াস আলীকে। আর ইলিয়াস আলীকে একাই গুম করা হয়নি। কোনো সাক্ষী যেন না থাকে সে জন্য সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসারকেও গুম করা হয়েছে। তারও কোনো খোঁজ নেই। কারণ ইলিয়াস আলীর গুম ছোটখাটো ঘটনা নয়। জনগণের চোখ সুরঞ্জিত কেলেঙ্কারি থেকে চলে আসবে ইলিয়াস আলীর গুমের দিকে। এসেছেও। গত দু’দিন ধরে সর্বত্র ইলিয়াসের গুমই আলোচনায়। এভাবে একের পর এক ইস্যু বদল করার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। দেখা গেছে, একটি বড় ঘটনা নিয়ে জনমত সংগঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেছে অন্য আরেকটি ঘটনা। ফলে আগের ইস্যু ছেড়ে নতুন ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানেও সুরঞ্জিত কেলেঙ্কারি ইস্যু থেকে এখন নজর ইলিয়াস আলীর গুম। তবে নেপথ্যের ঘটনা যাই হোক, আমরা ইলিয়াস আলীকে আমাদের মাঝে ফিরে পেতে চাই। সম্ভাবনাময় এই নেতৃত্বকে আমরা কোনোভাবেই হারাতে চাই না। ইলিয়াস আলী শুধু বিএনপির সম্পদই নন, দেশের সম্পদ। ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দাও। ইলিয়াস আলী ফিরেছেন—এ সুখবর সহসাই পাব প্রত্যাশা করে ইতি টানছি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন