ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে বিএনপির অনীহা ছিল। এই অনীহায় খুশি ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানার ও ডিজিটাল হোডিংয়ে শোভা পাচ্ছিল ঢাকার চারদিক। কিন্তু হঠাত্ তাদের উত্সাহে ভাটা পড়েছে। বিএনপি নির্বাচন করবে—এ খবরে এখন আওয়ামী লীগ সিটি নির্বাচন বন্ধ রাখার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের সেই আইনজীবী মনজিল মোরশেদ সক্রিয়। এরই মধ্যে তিনি উকিল নোটিশ ইস্যু করেছেন। এরপর রিটের দিকে এগিয়ে যাবেন।
তবে নগরবাসীর এখনও আশাবাদ, নির্বাচনটি হবে। দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হোক, সাধারণ ভোটাররা সেটাই চান। কিন্তু একদিকে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা এবং অন্যদিকে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের গভীর রাতে বস্তাভরা ৭০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আওয়ামী লীগকে ভাবিয়ে তুলছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হলেও দুই বড় দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির লোকদের অংশগ্রহণে হোক—সেটাই সবাই চাচ্ছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, এ নির্বাচনে চমক দেখাবে তার দল। দুই সিটিতে নতুন মুখ মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। তবে প্রার্থী মনোনয়নে দুই দলই ধীরগতিতে চলছে। এক পক্ষের কৌশল দেখে অপর পক্ষ ‘চমক’ প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনের ফসল ঘরে তুলতে চায়।
প্রায় ১০ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন বানচাল করতে একটি চক্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, রেলমন্ত্রীর ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকার ও মন্ত্রীদের ইমেজ ক্ষুণ্ন হওয়া, রাজধানীতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, গ্যাস-পানি-বিদ্যুত্ সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিসহ নাজুক পরিস্থিতিতে ঢাকার সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীদের হারিয়ে এর জবাব দিতে পারেন রাজধানীবাসী। এর প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এ আশঙ্কা থেকেই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে হাইকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ এ নির্বাচন বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। ইসি এ নির্বাচন বন্ধ না করলে আইনি পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে ডিসিসি নির্বাচন ঘিরে রাজধানীতে উত্সবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে প্রায় দেড় হাজার সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে নেমেছেন। ইসি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত আট শতাধিক মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। এ নির্বাচনে অন্তত দুই হাজার মনোনয়নপত্র বিক্রি হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া যেসব প্রার্থী অনুরোধ সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে ব্যানার-বিলবোর্ডসহ নির্বাচনী সামগ্রী অপসারণ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সে বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বড় দুই দল : বিতর্কিত বিগত কমিশনের আমলে আলোচিত-সমালোচিত ইভিএম ব্যবহার ও আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সেনা মোতায়েন না করায় নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বয়কট করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তবে বর্তমান কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন তারা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ খোলাসা করে বলেছেন, এ নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। একটি বেসরকরি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, নেতাকর্মীদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দলীয়ভাবে প্রার্থী সমর্থন দেয়া হবে। দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, এ নির্বাচনে যেভাবেই হোক জয় নিজেদের ঘরে নিতে চায় বিএনপি। এজন্য দেখে-শুনে-বুঝে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার পরিকল্পনা করছে দলীয় হাইকমান্ড। বিএনপি নেতাদের মতে, সরকারের শোষণ ও নির্যাতনের ভয়ানক এ পরিস্থিতিতে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূল মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি পাওয়া যাবে। এতে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। তবে তালিকায় বিএনপি নেতা শিল্পপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম, সাবেক ছাত্রনেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন পিন্টু ও সাবেক কমিশনার এমএ কাইয়ুমের নাম রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত কাউকে শেষ পর্যন্ত দলে ভিড়িয়ে বা পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে চমক দেখানোর পরিকল্পনা নেই বিএনপির। প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আবদুল আউয়াল মিন্টু গতকাল আমার দেশকে বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে এ বিষয়ে ইতিবাচক আলাপ হয়েছে। আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে সবকিছু চূড়ান্ত হবে। সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ডিসিসি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের খবরে নড়েচড়ে বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অতীতে দেখা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন যে রাজনৈতিক দলের দখলে ছিল, সেই দলই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফল করে। আর যেহেতু জাতীয় নির্বাচনের সময়ও ঘনিয়ে আসছে, তাই আওয়ামী লীগ নতুন কৌশলে মাঠে নেমেছে। দলীয় সূত্র জানায়, এ নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তা অনেকাংশে বিএনপির কৌশলের ওপর নির্ভর করছে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার মতো বড় ভুল ঢাকার ক্ষেত্রে করতে চায় না ক্ষমতাসীনরা। তাই বিএনপির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেই প্রার্থী মনোনয়নে চমক দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরো রশীদকে ঢাকা দক্ষিণ ও জাসদ নেত্রী শিরীন আকতারকে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে সমর্থন দিতে পারে আওয়ামী লীগ। এ দু’জনই অনেক আগে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, প্রয়াত সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে আলহাজ সাঈদ খোকন, সাবেক সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর লবিং করছেন। তবে দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির কৌশল দেখে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ক সফর শেষে আগামী শনিবার দেশে ফেরার পর দলের নীতিনির্ধারক এবং জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে।
মনোনয়নপত্র কিনলেন যারা : নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই সিটিতে আট শতাধিক মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। ঢাকা উত্তরে মেয়র পদের মনোনয়নপত্র কেনার তালিকায় রয়েছেন—আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এখলাস মোল্লা, এসএ খালেক, চৌধুরী ইরাদ আহম্মেদ সিদ্দিকী ও জাসদ নেত্রী শিরীন আকতারসহ মোট ৮ জন। ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র কেনার তালিকায় রয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু, প্রয়াত সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে আলহাজ সাঈদ খোকনসহ ৬ জন। ঢাকা উত্তরে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৪২ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৮৬ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা দক্ষিণে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৫৫ জন ও সাধারণ ওয়ার্ডে ৪১২ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। উত্তরে মেয়র প্রার্থীসহ সর্বমোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ৩৩৬ জন এবং দক্ষিণে মেয়র প্রার্থীসহ ৪৭৪ জন। সব মিলিয়ে দুই ঢাকা সিটি করপোরেশনে এ পর্যন্ত ৮ শতাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের সময় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেলে ‘নাগরিক কমিটি’র পক্ষ থেকে নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, আমি তো ঘর ভাঙিনি। এখনও ঘরেই আছি। যেভাবে আছি সেভাবেই নির্বাচন করব। ডিসিসিতে অনেক কিছুই করার আছে। সাঈদ খোকন বলেন, বাবার মতো ঢাকাবাসীর সেবা করে যেতে চাই। আশা করি ঢাকাবাসী ও দলের সমর্থন পাব। শিরীন আখতার বলেন, দলের পক্ষে নয়, ব্যক্তিগতভাবে মনোনয়ন ফরম নিয়েছি। ভোটাররা আমার পক্ষে আছেন। এদিকে ব্যক্তিগতভাবে ফরম নেয়ার কথা বলেছেন বিএনপি নেতা এখলাস মোল্লাও।
ডিসিসি নির্বাচনের তথ্য : সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ৯ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৪ মে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে একযোগে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ আগামী ১৯ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ২২ ও ২৩ এপ্রিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২ মে।
সর্বশেষ ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ডিসিসির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালের ১৪ মে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। গত ৫ বছরে একাধিকবার ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারের অনিচ্ছার কারণে সম্ভব হয়নি। পরে সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে। ডিসিসির ৯২টি ওয়ার্ডের গেজেট প্রকাশ করা হয় ৫ ডিসেম্বর। আইন অনুসারে আগামী ২৯ মে অর্থাত্ ১৮০ দিনের মধ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা উত্তর ও ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গঠিত। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটার ২১ লাখ ৭২ হাজার ৬৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৮০৯ জন ও মহিলা ভোটার ১০ লাখ ২৭ হাজার ৮৭৩ জন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ১৬ লাখ ৮০ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ১৬ হাজার ২৩০ জন ও মহিলা ভোটার সাত লাখ ৬৪ হাজার ৪২৪ জন। গত ৯ নভেম্বর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন পুনর্গঠনের পর ৯ এপ্রিল ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।
তবে নগরবাসীর এখনও আশাবাদ, নির্বাচনটি হবে। দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হোক, সাধারণ ভোটাররা সেটাই চান। কিন্তু একদিকে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা এবং অন্যদিকে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের গভীর রাতে বস্তাভরা ৭০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আওয়ামী লীগকে ভাবিয়ে তুলছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হলেও দুই বড় দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির লোকদের অংশগ্রহণে হোক—সেটাই সবাই চাচ্ছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, এ নির্বাচনে চমক দেখাবে তার দল। দুই সিটিতে নতুন মুখ মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। তবে প্রার্থী মনোনয়নে দুই দলই ধীরগতিতে চলছে। এক পক্ষের কৌশল দেখে অপর পক্ষ ‘চমক’ প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনের ফসল ঘরে তুলতে চায়।
প্রায় ১০ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন বানচাল করতে একটি চক্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, রেলমন্ত্রীর ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকার ও মন্ত্রীদের ইমেজ ক্ষুণ্ন হওয়া, রাজধানীতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, গ্যাস-পানি-বিদ্যুত্ সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিসহ নাজুক পরিস্থিতিতে ঢাকার সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীদের হারিয়ে এর জবাব দিতে পারেন রাজধানীবাসী। এর প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এ আশঙ্কা থেকেই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে হাইকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ এ নির্বাচন বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। ইসি এ নির্বাচন বন্ধ না করলে আইনি পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে ডিসিসি নির্বাচন ঘিরে রাজধানীতে উত্সবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে প্রায় দেড় হাজার সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে নেমেছেন। ইসি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত আট শতাধিক মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। এ নির্বাচনে অন্তত দুই হাজার মনোনয়নপত্র বিক্রি হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া যেসব প্রার্থী অনুরোধ সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে ব্যানার-বিলবোর্ডসহ নির্বাচনী সামগ্রী অপসারণ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সে বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বড় দুই দল : বিতর্কিত বিগত কমিশনের আমলে আলোচিত-সমালোচিত ইভিএম ব্যবহার ও আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সেনা মোতায়েন না করায় নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বয়কট করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তবে বর্তমান কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন তারা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ খোলাসা করে বলেছেন, এ নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। একটি বেসরকরি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, নেতাকর্মীদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দলীয়ভাবে প্রার্থী সমর্থন দেয়া হবে। দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, এ নির্বাচনে যেভাবেই হোক জয় নিজেদের ঘরে নিতে চায় বিএনপি। এজন্য দেখে-শুনে-বুঝে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার পরিকল্পনা করছে দলীয় হাইকমান্ড। বিএনপি নেতাদের মতে, সরকারের শোষণ ও নির্যাতনের ভয়ানক এ পরিস্থিতিতে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূল মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি পাওয়া যাবে। এতে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। তবে তালিকায় বিএনপি নেতা শিল্পপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম, সাবেক ছাত্রনেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন পিন্টু ও সাবেক কমিশনার এমএ কাইয়ুমের নাম রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত কাউকে শেষ পর্যন্ত দলে ভিড়িয়ে বা পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে চমক দেখানোর পরিকল্পনা নেই বিএনপির। প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আবদুল আউয়াল মিন্টু গতকাল আমার দেশকে বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে এ বিষয়ে ইতিবাচক আলাপ হয়েছে। আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে সবকিছু চূড়ান্ত হবে। সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ডিসিসি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের খবরে নড়েচড়ে বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অতীতে দেখা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন যে রাজনৈতিক দলের দখলে ছিল, সেই দলই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফল করে। আর যেহেতু জাতীয় নির্বাচনের সময়ও ঘনিয়ে আসছে, তাই আওয়ামী লীগ নতুন কৌশলে মাঠে নেমেছে। দলীয় সূত্র জানায়, এ নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তা অনেকাংশে বিএনপির কৌশলের ওপর নির্ভর করছে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার মতো বড় ভুল ঢাকার ক্ষেত্রে করতে চায় না ক্ষমতাসীনরা। তাই বিএনপির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেই প্রার্থী মনোনয়নে চমক দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরো রশীদকে ঢাকা দক্ষিণ ও জাসদ নেত্রী শিরীন আকতারকে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে সমর্থন দিতে পারে আওয়ামী লীগ। এ দু’জনই অনেক আগে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, প্রয়াত সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে আলহাজ সাঈদ খোকন, সাবেক সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর লবিং করছেন। তবে দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির কৌশল দেখে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেবে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ক সফর শেষে আগামী শনিবার দেশে ফেরার পর দলের নীতিনির্ধারক এবং জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে।
মনোনয়নপত্র কিনলেন যারা : নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই সিটিতে আট শতাধিক মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। ঢাকা উত্তরে মেয়র পদের মনোনয়নপত্র কেনার তালিকায় রয়েছেন—আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এখলাস মোল্লা, এসএ খালেক, চৌধুরী ইরাদ আহম্মেদ সিদ্দিকী ও জাসদ নেত্রী শিরীন আকতারসহ মোট ৮ জন। ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র কেনার তালিকায় রয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু, প্রয়াত সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে আলহাজ সাঈদ খোকনসহ ৬ জন। ঢাকা উত্তরে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৪২ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৮৬ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা দক্ষিণে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৫৫ জন ও সাধারণ ওয়ার্ডে ৪১২ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। উত্তরে মেয়র প্রার্থীসহ সর্বমোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন ৩৩৬ জন এবং দক্ষিণে মেয়র প্রার্থীসহ ৪৭৪ জন। সব মিলিয়ে দুই ঢাকা সিটি করপোরেশনে এ পর্যন্ত ৮ শতাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের সময় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেলে ‘নাগরিক কমিটি’র পক্ষ থেকে নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, আমি তো ঘর ভাঙিনি। এখনও ঘরেই আছি। যেভাবে আছি সেভাবেই নির্বাচন করব। ডিসিসিতে অনেক কিছুই করার আছে। সাঈদ খোকন বলেন, বাবার মতো ঢাকাবাসীর সেবা করে যেতে চাই। আশা করি ঢাকাবাসী ও দলের সমর্থন পাব। শিরীন আখতার বলেন, দলের পক্ষে নয়, ব্যক্তিগতভাবে মনোনয়ন ফরম নিয়েছি। ভোটাররা আমার পক্ষে আছেন। এদিকে ব্যক্তিগতভাবে ফরম নেয়ার কথা বলেছেন বিএনপি নেতা এখলাস মোল্লাও।
ডিসিসি নির্বাচনের তথ্য : সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ৯ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৪ মে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে একযোগে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ আগামী ১৯ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ২২ ও ২৩ এপ্রিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২ মে।
সর্বশেষ ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ডিসিসির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালের ১৪ মে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। গত ৫ বছরে একাধিকবার ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারের অনিচ্ছার কারণে সম্ভব হয়নি। পরে সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে। ডিসিসির ৯২টি ওয়ার্ডের গেজেট প্রকাশ করা হয় ৫ ডিসেম্বর। আইন অনুসারে আগামী ২৯ মে অর্থাত্ ১৮০ দিনের মধ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা উত্তর ও ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গঠিত। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটার ২১ লাখ ৭২ হাজার ৬৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৮০৯ জন ও মহিলা ভোটার ১০ লাখ ২৭ হাজার ৮৭৩ জন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ১৬ লাখ ৮০ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ১৬ হাজার ২৩০ জন ও মহিলা ভোটার সাত লাখ ৬৪ হাজার ৪২৪ জন। গত ৯ নভেম্বর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন পুনর্গঠনের পর ৯ এপ্রিল ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন