শনিবার, ২১ এপ্রিল ২০১২
নূরুজ্জামান: হঠাৎ মধ্যরাতে শুনতে পাই বিকট একটা শব্দ। মনে হলো একটি গাড়ি অপর গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে। এর পরই কানে ভেসে আসে ধস্তাধস্তির শব্দ। কেউ একজন চিৎকার করে বলছিলেন- বাঁচাও, বাঁচাও, এরপর নীরব হয়ে যায় এলাকা। পুরো ঘটনাটি ঘটে ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে। গতকাল বনানী থানাধীন ২ নম্বর সড়কে অবস্থিত সাউথ পয়েন্ট স্কুল ও নূরানী টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড এবং একাধিক নির্মাণ শ্রমিক এ বর্ণনা দেন।কি ঘটেছিল সে রাতে। কিভাবে ইলিয়াস আলীকে তুলে নেয়া হলো? এ বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এ ঘটনা। সিকিউরিটি গার্ড লুৎফর রহমান বলেন, মঙ্গলবার রাতে আমি তখন চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। হঠাৎ দুটি গাড়ির টক্করের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। শুনতে পাই লোকজনের ধস্তাধস্তি। কানে আসে বাঁচাও, বাঁচাও শব্দ। নূরানী টাওয়ারের নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, আর্তচিৎকার ও ধস্তাধস্তির কারণে মনে হয়েছিল রাস্তায় ছিনতাই হচ্ছে। তাই শুনেও না শোনার ভান করে শুয়েছিলাম। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ওই রাতে স্কুল মাঠের পাশে হট্টগোলের আওয়াজ পেয়েছি। মনে হয়েছে, পুলিশ কোন অপরাধীকে পাকড়াও করছে। কারণ ওই গলি দিয়ে ১০ মিনিট পরপরই পুলিশ ও র্যাবের টহল টিম আসা-যাওয়া করে। চেকপোস্ট থাকে মহাখালী আমতলী পয়েন্টে। সে সময় আমি একটু এগুই। দেখি একটি প্রাইভেট কার আর পেছনে কালো একটি মাইক্রোবাস। কয়েকজন লোক একজনকে টেনে তুলছে মাইক্রোবাসে। পরে মাইক্রোবাসটি চলে যায়। সে সময় ভয়ে আমি এগুইনি। অনেকক্ষণ পর পুলিশ এলে ঘটনাস্থলে যাই। দেখি প্রাইভেট কারের পেছনে ধাক্কা দেয়া। মনে হলো মাইক্রোবাসটি এটিকে ধাক্কা দিয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসারকে মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সাউথ পয়েন্ট স্কুল সংলগ্ন বনানী ২ নম্বর সড়ক থেকেই তাদের অপহরণ করা হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সর্বশেষ মোবাইল ফোন কলের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তারা। তদন্ত সূত্র জানায়, রাত ১২টা ২ মিনিটে ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোনে সর্বশেষ কল আসে। ওই কল করা হয়েছিল সিলেট জেলা থেকে। তাদের মধ্যে প্রায় ৭ মিনিটি কথা হয়। এর কয়েক মিনিট পরই ইলিয়াস সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা- অপহরণকারীরা ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যেই দু’জনকে অপহরণ করে ওই এলাকা ত্যাগ করেছে। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের বিপরীত পাশে অবস্থিত পোশাক কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, রাস্তায় গাড়ি নিয়ে কিছু লোকজনের হৈচৈ শোনা গেছে। কিন্তু তারা রাস্তায় যেতে সাহস পাননি। এর পরেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পান। নূরানী টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ড লুৎফর আরও বলেন, আমার কাছ থেকে তথ্য জানার জন্য বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ থানায় ডেকে নিয়েছিল। ওই রাতে কি শুনেছি ও কি দেখেছি সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তবে তারা খারাপ ব্যবহার করেননি। প্রথমে থানায় ও পরে আরও এক জায়গায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এরপর আমার এক স্বজন গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছেন। লুৎফর আরও বলেন, ওই রাতে রাস্তার মধ্যে লোকজনের আর্তচিৎকারে আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। তাই ওদিকে উঁকি মেরে কিছু দেখার সাহস পাইনি। নিজের চেয়ারেই বসে বসে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকি। এর ঘণ্টাখানেক পরে সাধারণ লোকজনের শব্দ শুনি। কৌতূহলবশত উঁকি দিয়ে দেখি রাস্তায় তিনটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। নিখোঁজ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ও বনানী থানার ওসি (তদন্ত) কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতির কোন খবর নেই। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অপহরণের ঘটনাটি কোনভাবেই যাতে সাবোটাজ না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। পুলিশের সব গোয়েন্দা শাখার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সূত্রমতে, ইলিয়াস আলীর ফোন বন্ধ হওয়ার আগে বাংলামোটর, ইস্কাটন ও রূপসী বাংলা হোটেল এলাকার টাওয়ার ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে। ওই দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনানীর ২/১ নম্বর সড়কে অবস্থিত সিলেট হাউজ থেকে দু’জন ব্যক্তির সঙ্গে বাসার বাইরে বের হয়েছিলেন ইলিয়াস। তখন গাড়ি চালাচ্ছিলেন চালক আনসার। দু’জন সঙ্গীসহ গিয়েছিলেন হোটেল রূপসী বাংলায়। সেখানে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। ফেরার পথে গাড়িতে ইলিয়াস ও তার চালক আনসার ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনা বলেন, ওই দুই ব্যক্তি কারা ছিলেন তা জানেন না। তিনি অভিযোগ করেন, যে লোকেশন থেকে ইলিয়াসকে অপহরণ করা হয়েছে, সেই লোকেশনে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল। এ ছাড়া ওই পয়েন্টের অদূরেই সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুরক্ষিত ওই রাস্তা থেকে কিভাবে কারা অপহরণ করেছে, তা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমার ধারণা- সরকারের কোন সংস্থা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে বনানীর ২ নম্বর গলির মুখে ইলিয়াস আলীর গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ইলিয়াস নিখোঁজ হওয়ার আগে চালক আনসার ও তাজুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছিলেন। তাজুল বলেছেন, রাত সাড়ে ১১টায় স্যার আমাকে ফোন করেছিলেন। গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলেন হোটেল রূপসী বাংলায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই শুনি তিনি রওনা দিয়েছেন। র্যাব জানায়, ওই রাতে বাংলামোটর, ইস্কাটন, শেরাটন হোটেল এলাকায় ইলিয়াস আলীর মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে কোন কোন ব্যক্তির সঙ্গে কি ধরনের কথা হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। তদন্তসূত্র জানায়, ওই রাতে রূপসী বাংলা হোটেলে ইলিয়াস আলী গিয়েছিলেন এবং এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা ছাড়াও ইলিয়াস নিখোঁজের নেপথ্যে সিলেট বা ঢাকায় রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, পারিবারিক কোন দ্বন্দ্ব ছিল কি না তাও তদন্ত করছেন তারা। |
শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১২
যেভাবে ইলিয়াসকে তুলে নেয়া হয়
Posted on ১২:৩৮ PM by Abul Bashar Manik
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন