বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

রেলওয়ের ১৫০ কোটি টাকা নিয়োগবাণিজ্য ফাঁস : এপিএস সাময়িক বরখাস্ত



কাজী জেবেল
রেলওয়েতে অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকা নিয়োগবাণিজ্য সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন পদে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার লোক নিয়োগ দিতে গিয়ে গত ক’মাস যাবত্ এ বিশাল অঙ্কের টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদ থেকে মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের অনেকেই এ টাকার ভাগ পেয়েছেন। অনেক চাকরিপ্রার্থী মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়েও চাকরি পাননি। অনেক কর্মকর্তা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই অসন্তোষ বিরাজ করছিল। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত সোমবার রাতে। ওই সময় রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িচালক আলী আজম বস্তাভর্তি ঘুষের টাকা বিজিবির হাতে ধরিয়ে দেন। এ ঘটনায় থলের কালো বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার জালিয়াতিসহ রেল-ওয়ের বিভিন্ন অনিয়মের ভয়াবহ তথ্য এখন ওপেন সিক্রেট।
এদিকে ‘ঘুষ কেলেঙ্কারি’র ঘটনার পর গতকাল রেলওয়ে ভবন ও সচিবালয়ের অফিসে যাননি মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং সদ্য বরখাস্ত হওয়া এপিএস ওমর ফারুক। ওই ঘটনায় জড়িত রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (পূর্বাঞ্চল) আবু ইউসুফ মৃধাও চট্টগ্রামের অফিসে যাননি। ওই গাড়ির চালক আলী আজমকে গতকালও থানায় হস্তান্তর করা হয়নি। তাকে কোথায় রাখা হয়েছে—তা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনার আদ্যোপান্ত সব তথ্য গাড়িচালক আলী আজমই জানেন। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় গতকাল দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। সচিবালয় থেকে শুরু করে সারাদেশে এ ঘটনা ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ ছিল। অনেকে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। তবে গতকাল সন্ধ্যায় রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করবে বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।
দেড়শ’ কোটি টাকার নিয়োগবাণিজ্য : রেলওয়ে সূত্র জানায়, সারাদেশে ৬৫ ক্যাটাগরিতে ৭ হাজার ২৭৫ শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে এক হাজার ৭৭৬ জনকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার প্রথম দফায় এক হাজার ৩৩৮ জন ও দ্বিতীয় দফায় ৪৩৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। বাকি সাড়ে ৪ হাজার পদে নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। সব নিয়োগ দেয়া হয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে। প্রথম দফা নিয়োগে পূর্বাঞ্চল বিভাগের ৪১ ক্যাটাগরির মধ্যে ১১ ক্যাটাগরিতে ৯৯৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। একই সময় পশ্চিমাঞ্চলে ২১ ক্যাটাগরির মধ্যে ১১ ক্যাটাগরিতে ৩৪০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে নিয়োগের সর্বশেষ তথ্য দিতে পারেনি রেলওয়ে বিভাগ। জানা গেছে, এসব নিয়োগ ও ঘুষবাণিজ্যের সবকিছুই রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার বিজিবির হাতে আটক হওয়া ইউসুফ আলী মৃধা ও পশ্চিমাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার তোফাজ্জেল হোসেন নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের অন্যতম সহযোগী মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক, রেলওয়ের ক’জন কর্মকর্তা ও সরকারি দলের একাধিক নেতা। সূত্র জানায়, প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়। তবে দলীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৭ হাজার পদের বিপরীতে অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। পুরো টাকা দুই জোনের জেনারেল ম্যানেজার নিয়ে তার ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ঘুষবাণিজ্যের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক মামলাও হয়েছে। এ কারণে ওয়েম্যান, বুকিং ক্লার্ক, অফিস সহকারীসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। ঘুষবাণিজ্যের হোতা দুই জেনারেল ম্যানেজার এতই ক্ষমতাবান যে, তারা নিয়োগ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য রেলওয়ে সদর দফতরকে জানাননি। এ নিয়ে রেলওয়ে সদর দফতর থেকে দুই জোনকে চিঠি দেয়া হলে তারা তা আমলে নেয়নি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল জেনারেল ম্যানেজার (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধাকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পশ্চিমাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমি ফেব্রুয়ারি মাসে এ পদে যোগ দিয়েছি। আমার আমলে কোনো নিয়োগ হয়নি। চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আপনার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ আছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।
চালকের ভাগ্যে কী ঘটেছে : টাকাসহ আটক এপিএসের গাড়িচালক আলী আজম কোথায় আছেন—তা জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে, তাও অজানা। গত সোমবার চালক আজমের সত্সাহসিকতার কারণে বস্তাভর্তি ঘুষের টাকাসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়েন এপিএস ওমর ফারুক ও রেল কর্মকর্তা ইউসুফ আলী মৃধা। মঙ্গলবার দু’জনকে ছাড়া হলেও আলী আজমকে ছাড়া হয়নি। চালক আজমই এ ঘটনার আদ্যোপান্ত সব জানেন। কিন্তু তাকে মিডিয়ার সামনে আনা হয়নি। কোথায় রাখা হয়েছে, তাও জানা যায়নি। বিজিবি সূত্র জানায়, গতকাল তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মহসিনের সঙ্গে আমার দেশ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তারা ফোন রিসিভ করেননি। র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান গতকাল রাতে আমার দেশকে বলেন, গাড়িচালক আলী আজমকে র্যাব গ্রেফতার বা হেফাজতে নেয়নি।
পুলিশের দায় এড়ানোর চেষ্টা : চালকের বিষয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি রাজধানীর তিন থানার কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে নিউমার্কেট, ধানমন্ডি ও লালবাগ থানা রশি টানাটানি করছে। নিউমার্কেট থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। এ ঘটনায় কেউ থানায় অভিযোগ নিয়ে আসেনি। ওই থানার এসআই শফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, আসলে ঘটনাটি আমাদের থানা এলাকায় পড়েনি। এ ব্যাপারে ধানমন্ডি থানায় যোগাযোগ করতে পারেন। তার মতে, ঘটনার সূত্রপাত ধানমন্ডি থেকে; তাই ওখানে মামলা হতে পারে। যোগাযোগ করা হলে ধামন্ডি থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, বিজিবির প্রধান গেট এলাকাটি পড়ছে নিউমার্কেট অথবা লালবাগ থানা এলাকায়। ধানমন্ডি থানায় গতকাল পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি। ধানমন্ডি থানার ডিউটি অফিসার এএসআই আবু জাফর বলেন, আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানি না। বিজিবি থেকে কোনো ব্যক্তিকে থানায় সোপর্দ করেনি কিংবা থানায় মামলাও করেনি। এ ব্যাপারে লালবাগ থানার ওসি নুরুল আলমও একই কথা বলেন, বিজিবির টাকা আটকের ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি। কোনো ব্যক্তিকে থানায় হস্তান্তরও করা হয়নি। লালবাগ থানার এসআই আজিজুল হক বলেন, থানায় মামলা হলে অথবা কাউকে সোপর্দ করা হলে আমরা অবশ্যই আপনাদের (সাংবাদিকদের) জানাতাম। তিনি বলেন, বিজিবি প্রধান গেট লালবাগ থানা এলাকাতেই পড়েছে। এসআই আজিজুল বলেন, বুধবার সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তিনি একটানা ডিউটিতে রয়েছেন। তবে এ সময়ের মধ্যে বিজিবি অথবা কোনো পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো মামলা, অভিযোগ কিংবা আটক ব্যক্তিকে থানায় স্থানান্তর করেনি।
এপিএস সাময়িক বরখাস্ত : আগের অবস্থান থেকে সরে এসে এপিএস ওমর ফারুককে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। গত মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত শাস্তি দেয়া ঠিক নয় মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, তারা নিয়মিত অফিস করবেন। কিন্তু গতকাল তিনি নিজেই এপিএসকে বরখাস্ত করেন এবং সাংবাদিকদের নিজেই জানান। সূত্র জানায়, শীর্ষস্থানীয় রেল কর্মকর্তা আবু ইউসুফ মৃধাকে অফিস না করার জন্য মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আজ তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে। এদিকে গতকাল রেল ভবন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা গেছে ওমর ফারুকের দরজা বন্ধ। আশপাশের কর্মকর্তারা জানান, গতকাল তিনি অফিসে আসেননি। আবু ইউসুফ মৃধাও গতকাল চট্টগ্রামে তার অফিসে যাননি।
৭০ লাখ টাকাসহ রেলমন্ত্রীর এপিএস আটকের খবর গতকাল টক অব দ্য কান্ট্রি ছিল। এ ঘটনায় সারাদেশে হৈচৈ পড়ে যায়। সচিবালয়, রেল ভবন থেকে শুরু করে সারাদেশে এ খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ক’দফা ভূমিকম্প আতঙ্কের মধ্যেও এ নিয়ে রসালো আলাপ ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক, ব্লগসহ সামাজিক ওয়েবসাইটে রেলমন্ত্রীর দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুষ গ্রহণ সম্পর্কে নানা মন্তব্য করতে দেখা গেছে। অনেকে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন।
সচিবালয় ও রেল বিভাগের অবস্থা : সরেজমিনে দেখা গেছে, যোগাযোগ ও রেল ভবনে নীরবতা বিরাজ করছে। গতকাল সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অংশ নিতে রেল ভবনের বেশিরভাগ কর্মকর্তা সংসদে গেছেন বলে তাদের সহকারীরা জানান। গতকাল বিকালে তারা রেল ভবনে ফেরেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেছেন। কর্মকর্তাদের রুমে প্রবেশ করলেই তারা বলেন, ভাই প্লিজ, আজ আসবেন না। আমরা আতঙ্কে আছি। কখন কার চাকরি যায়—তা বলা মুশকিল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads