শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১২

সুরঞ্জিতপুত্র সৌমেনের হঠাৎ উদ্যোক্তা হওয়ার রহস্য



নয়াদিগিন্ত,১৪,০৪,২০১২ 
কানাডা থেকে প্রযুক্তি বিদ্যায় পড়ে এসেছেন সৌমেন। বাবা রাজনীতিক। বছরে আয় মাত্র সাত লাখ টাকা। তবুও তিনি পুত্রকে বিদেশে পড়াতে পেরেছেন। দেশে এসে মাত্র বছর দেড়েক চাকরি করে এবার নিজেই হয়ে উঠেছেন টেলিযোগাযোগ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা। 
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি গণহারে টেলিকম ব্যবসায়ের লাইসেন্স দিচ্ছে। নিয়মনীতি কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। এমন সুযোগ তো মন্ত্রী-এমপি ও তাদের সহযোগী এবং পরিবারের সদস্যরা নেবেনই। সুরঞ্জিতপুত্র সৌমেনও নিয়েছেন। তিনি ২০১০ সাল থেকে নেক্সটজেন নেটওয়ার্কে চাকরি করেছেন। সেখান থেকে অগ্নি সিস্টেমসে। মাস ছয়েক আগে সেখানকার চাকরিও ছেড়েছেন। 
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অল্প সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশমান টেলিযোগাযোগ ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করার ভাবনা থেকে লাইসেন্সের আবেদন করেন বিটিআরসিতে। 
বিটিআরসি সূত্র বলেছে, সেনগুপ্ত টেলিকম নামে সৌমেনের প্রতিষ্ঠান আইসিএক্স লাইসেন্সের আবেদন করে এবং বিটিআরসি প্রথম দিকে যে অল্প কয়েকটি লাইসেন্স ইস্যু করার পক্ষে ছিল, সেখানেও সৌমেনের প্রতিষ্ঠান ছিল। বিটিআরসি সূত্র মতে, সেনগুপ্ত টেলিকম প্রাথমিক বাছাইয়ে টপ টেনে ছিল। পরে অবশ্য মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত তালিকায় আইসিএক্সের জন্য ২২টি প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করে। তবে লাইসেন্স নেয় ২১টি প্রতিষ্ঠান। গত বৃহস্পতিবার বিটিআরসি কার্যালয় থেকে এসব লাইসেন্স বিতরণ করা হয়। তাদের মধ্যে সেনগুপ্ত টেলিকমও লাইসেন্স বুঝে নিয়েছে। সৌমেন কেবল লাইসেন্স পেয়েছেন তা নয়, তার আগের কর্মস্থল, যেখান থেকে ছয় মাস আগে চাকরি ছেড়েছেন সে প্রতিষ্ঠান অগ্নি সিস্টেমসও আইসিএক্সের লাইসেন্স পেয়েছে। 
একটি সূত্র দাবি করেছে, সৌমেন কেবল নিজে লাইসেন্স নেননি, তিনি অন্য দুটো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স নিয়ে দেয়ার জন্য তদবির করেছেন। সেখান থেকে পাওয়া টাকা এবং তার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাঁচ কোটি টাকা দামের ওই লাইসেন্স নিয়েছেন তিনি। তার তদবির করা অগ্নি সিস্টেমসও আইসিএক্সের লাইসেন্স পেয়েছে। 
আইসিএক্স আইজিডব্লিউর সাথে লোকাল কল বিতরণ করা প্রতিষ্ঠানের কল আদান প্রদানের সমন্বয় করে থাকে। 
বিটিআরসি সূত্র খেকে পাওয়া খবর হলো, সৌমেন যে দুটো প্রতিষ্ঠানের জন্য তদবির করেছেন, সে দুটো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ার জন্য চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। তবে সৌমেনের প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে বিটিআরসির আগ্রহ ছিল। সে মতে, তিনি লাইসেন্স পেয়েছেন। 
২০১০ সালে সংশোধিত টেলিযোগাযোগ আইন অনুসারে বিটিআরসি লাইসেন্স প্রদানের জন্য নাম প্রস্তাব করে, তবে তা চূড়ান্ত করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ওই চূড়ান্ত তালিকা ধরে বিটিআরসি ওই লাইসেন্স বিতরণ করে মাত্র। এবারো তাই করেছিল। তবে গণ লাইসেন্স দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান ছিল বিটিআরসির। বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জিয়া আহমেদ বলেছিলেন, এত বেশি লাইসেন্স বাজারের ভারসাম্য নষ্ট করবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সচিব সুনীল কান্তি বোস তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন এবং সর্বশেষ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ৮২টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্সের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। 
ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে-আইজিডব্লিউ, ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ-আইসিএক্স এবং ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে-আইআইজি এ তিনটি ক্যাটাগরিতে বৃহস্পতিবার ৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়। 
সৌমেনের টাকার উৎস সম্পর্কে বিটিআরসি কিছু বলতে পারেনি। বিটিআরসি থেকে বলা হয়েছে যথাযথ নিয়ম মেনেই তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সৌমেনের প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সপ্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করে বিটিআরসি চেয়ারম্যান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘যথাযথ নিয়ম মেনেই তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি।’ 
সৌমেন টাকা কোথায় পেয়েছেন এ সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। তবে তার বাবা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি রেলে কালো বিড়াল তাড়া করে ফিরছিলেন, তিনি গত রাতে বলেছেন, ‘তার ছেলে বৈধ টাকায় এ লাইসেন্স নিয়েছে।’ 
তিনি এর বেশি কিছু বলতে চাননি। ১০ এপ্রিল তার এপিএস ফারুকের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া নিয়ে বর্তমানে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। গাড়িতে থাকা তিন ব্যক্তিÑ তার এপিএস, রেলওয়ের ডিজি (পূর্ব) এবং নিরাপত্তারক্ষী বলেছেন, গাড়ির টাকা নিয়ে তারা সুরঞ্জিত সেনের বাড়ি যাচ্ছিলেন। 
২০০৮ সালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদ সদস্য হওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনে বলেছিলেন তার বছরে আয় সাত লাখ টাকা। এসব টাকা আসে বাড়িভাড়া, মৎস্য চাষ ও কৃষি থেকে। সেখান থেকে হঠাৎ করে তিনি বা তার ছেলে কিভাবে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে লাইসেন্স নিচ্ছেন, টেলিযোগাযোগ ব্যবসায় করছেন এ বিষয়ে কোনো খোলামেলা উত্তর মেলেনি। সৌমেনের গ্রামীণফোনের ব্যবহৃত একটি নম্বরে বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। 
টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো সেবাদাতা একটি প্রতিষ্ঠানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গত রাতে নয়া দিগন্তকে বলেন, লাইসেন্স নেয়ার জন্য পাঁচ কোটি টাকা খরচ করলেও এ ব্যবসায়ের জন্য যে পরিমাণ টেকনিক্যাল ও নন-টেকনক্যিাল ইকুইপমেন্ট লাগবে তার জন্য কমপক্ষে ৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। তার সাথে অফিস ও লোকজন নেয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ের খরচ তো আছেই। 
খবর নিয়ে জানা গেছে, সৌমেন যেখানে সর্বশেষ চাকরি করেছেন সেই অগ্নি সিস্টেমসে তিনি বেতন হিসেবে পেতেন ৫০ হাজার টাকার মতো। এর আগে তিনি নেক্সটজেন নেটওয়ার্কে চাকরি করতেন। ওই আইটি ফার্মে তার বেতন ছিল ৪০ হাজার টাকার মতো। ২০১০ থেকে মে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেছেন। পরে তিনি অগ্নিতে যোগ দেন। এটি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। 
সুরঞ্জিতপুত্রের যদি এত ভালো ব্যবসায় করার সামর্থ্যই থাকবে তাহলে তিনি চাকরি করতে গেলেন কেনÑ এমন প্রশ্ন রেখে একজন টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, টেলিযোগাযোগ খাতে লাইসেন্স নিয়ে যে লুটপাট চলছে এটা হলো তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads