শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দেশের উন্নয়নের জন্য দরকার স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার


ষোল কোটি জনগণের দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার আধিক্যে ক্ষুদ্রায়তন এ ভূ-খ-ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু নেই। বলা যায়, স্বাধীনতাপরবর্তী এদেশের উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব একটি দেশের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের একটি অপরিহার্য শর্তকেই মৌলিক প্রেরণা জোগায় বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় সার্বভৌমত্বের ভিত্তি বলে মনে করে। সমাজ, দেশ, সংস্কৃতি বলে যে, সামাজিক আচার-আচরণ এবং নিত্যনৈমিত্তিক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের যে শর্তাবলীগুলো রাষ্ট্রের দায়িত্বের অংশ হিসেবে পরিগণিত তা যদি কোন ভঙ্গুর সামাজিক অবকাঠামোর অর্থনৈতিক ঘূণে ধরা আওতাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা বজায় থাকে, তবে তাতে সুশাসন এবং সামাজিক শৃঙ্খলার কোন প্রশাসনিক মজবুত ব্যবস্থা কায়েম থাকতে পারে না। বোধকরি তা রাষ্ট্র পরিচালকদের কারো অজানা নয়। সে দিক থেকে জনপ্রশান্তি এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মৌলিকভাবে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের দিকটিই মুখ্য বলে বিবেচিত। নতুবা উন্নয়ন এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও সুখ-শান্তির সমাজ ব্যবস্থা কখনো কামনা করা যায় না। যেহেতু বাংলাদেশ জনভারে জর্জরিত সেহেতু তার সমস্যা এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও ব্যাপক। তাই এখানকার জনগণের সুখ-দুঃখের ভাগাভাগিতে বিত্তবানদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হয় একথা বলাই বাহুল্য। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এদেশটিতে সম্পদের কোন ঘাটতি নেই। যা আছে তা সৎ প্রশাসন এবং আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির অভাব।
বর্তমান ডিজিটাল যুগের চাহিদা মেটাতে যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার অপ্রতুলতায় কাক্সিক্ষতমানের তেমন কোন উন্নয়ন আমরা ঘটাতে পারছি না। এটাও একটা সংকট এবং বাধা। এতোসব বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মজবুত উন্নয়ন ঘটাতে হলে প্রথমেই দরকার একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার। যার দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার অনুভূতি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় আন্তরিকভাবে আত্মনিয়োগ করা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং স্বার্থহাসিলের দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরতরে নির্বাসিত করতে না পারলে কোন সরকারের পক্ষেই আধুনিক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দেয়া সম্ভবপর নয় বলেই সবার ধারণা এবং এটাই বাস্তব। এর বাইরে গিয়ে যে সরকারই প্রতিষ্ঠিত থাকবে সেটা ফ্যাসিবাদী গভ:মেন্ট এর রূপ পরিগ্রহ করে। যার সাথে মিশ্রণ ঘটে বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের চিন্তা-চেতনা এবং অনাদর্শিক নিপীড়ন। প্রকারান্তরে যাদের যুপকাষ্ঠে বলি হতে থাকে সাধারণ জনগণ। আর সেই সমাজেই তখন সুখ-শান্তি তিরোহিত হয় চিরতরে। পাশাপাশি জুলুমের বিস্তার ঘটে ব্যাপকভাবে। যাকে আমরা স্বৈরতন্ত্র বা জুলুমতন্ত্রের সরকার বলেই আখ্যায়িত করতে পারি।
এ ব্যাপারে বিগত শতাব্দীর রাজনীতির ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তবে একথাগুলো অবশ্যই আমরা বুঝতে পারব যে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশে দেশে কি পরিমাণ গজব নাযিল হয়। আমরা যদি মধ্য এশিয়ার বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক হালচাল পর্যবেক্ষণ করি তাতে ভুরি ভুরি নজির পেশ করা যাবে যে, একেকটি দেশের কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ এবং বিপর্যয়কর অবস্থা ঘটেছিল। মধ্য এশিয়ার চেঙ্গিস-হালাকু খানদের বীভৎস রাজনৈতিক ধ্বংসকা- কে না জানে। একটি দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সমুদ্রের অতলগর্ভে নিক্ষিপ্ত করেছিল ভয়ঙ্কর রূপে। ইতিহাস সাক্ষী নীলনদের পানি কালো রূপ ধারণ করেছিল জ্ঞানীগুণীদের লেখনী কালির বই পুস্তকের ডুবিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এ সমস্ত ইতিহাস জ্বল জ্বল করছে এবং এখনও বেদনার সমুদ্রে হতাশায় হাবুডুব খাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তারপর জার শাসিত রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলগুলোর করুণ আর্তনাদ এবং পরবর্তীতে গোটা রাশিয়ার লেনিন এবং স্ট্যালিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পরিচালিত কমিউনিজম শাসনের সময় আড়াই থেকে পাঁচ লাখ মানুষের নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে প্রায় সিকি শতাব্দীর কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গোটা জাতিকে দিয়েছিল বিভীষিকাময় অন্ধকার এবং দুঃসহ যন্ত্রণাময় জীবন। প্রশাসনের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ে টুঁ-শব্দ করাই ছিল নির্ঘাত মৃত্যুদ-। আমাদের নিকট অতীতেও যদি ঔপনিবেশিক আমলের কথাই ধরি, তবে তাতেও লিখা আছে হাজারো অশ্রুঝরা দুঃখ-যন্ত্রণার প্রশাসনিক ইতিহাস। আমাদের এ উপমহাদেশেও কতো রচিত হয়ে গেলো সাম্রাজ্যবাদীদের নখর থাবায় রক্তাক্ত ইতিহাস। মানুষ আজো ভোলেনি রক্ত পিপাসুদের স্বার্থ হাসিলের নিকৃষ্ট শাসনের। অতএব যে কোন দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং জনগণের মতামতের মূল্যায়ন করা। কেননা, সমাজে মানুষের সুখ-দুঃখ এবং সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রেখেই জনকল্যাণের ছক আঁকতে হবে প্রশাসক নেতৃবৃন্দের এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা আবর্তিত হতে হবে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ভূমিকায় এবং কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশ গঠনের পরিকল্পনা। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা তখনই সৃষ্টি হবে যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার গঠনের বিধিব্যবস্থা কার্যকর থাকে। আর যদি কোন একপেশে মনোভাবের শুধু ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যেই সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে যেনতেনভাবে পরিচালনার মাধ্যমে নির্বাচন এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েম হয় তবে তাতে অবশ্যই স্বার্থ হাসিল এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবকে দৃঢ়তর করে। এ সমস্ত সরকার গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনকল্যাণের বিষয়টি আর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মৌলিক কাজ বলে গণ্য হয় না।
বর্তমানে আমাদের দেশের অবস্থাটাও অনেকটা সেরকম সরকার গঠনের প্রক্রিয়া গোটা দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন এবং বুথ সেন্টারগুলোতে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই ভোটগ্রহণ (প্রহসনের নির্বাচন) শেষ হয়ে সরকার গঠন প্রক্রিয়াও প্রায় সমাপ্ত। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কোন পর্যবেক্ষক ছাড়াই নির্বাচনপরবর্তী সরকার দম্ভভরেই বলেছিলেন সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। এমন ঘোষণায় সম্ভবত তাদের বিবেকবোধও লজ্জায় অধোবোদন হয়েছে! তবুও তাদের দাবি যথেষ্ট ভোট পড়েছে। এমনকি শেখ হাসিনা পর্যন্ত বললেন, উন্নত দেশগুলোতে এতো ভোট পড়ে না। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে চাপা ফোটালেন। যাক, বিশ্ব মিডিয়ার বদৌলতে সবাই প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশের দশম সংসদের প্রহসনের নির্বাচন! জনগণের মতামতকে পদদলিত করে ফ্যাসিবাদী আচরণের মধ্যদিয়ে যে সরকার গঠিত হলো, সেটাকে আর যাই বলা হোক, গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায় না। সুতরাং দেশ জাতির কথা চিন্তা করে সমৃদ্ধ দেশ গঠনের লক্ষ্যে যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে অবাধ-নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ কায়েমের কোন বিকল্প নেই। আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয়ের মাধ্যমে জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবেন। বর্তমানে জনগণের এটিই একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। আর যদি সে পথে না গিয়ে সরকার অন্য কোন টালবাহানার পথ বেছে নেয়, তবে জাতি ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে জনগণ যদি আবারো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতার মসনদে বসায় তবে কারো কোন মন্তব্য করার অবকাশ থাকবে না। কারণ, জনগণের মতামত নিয়েই সরকারের ক্ষমতায় আসা উচিত। বর্তমান দুনিয়ায় যে ধরনের গণতান্ত্রিক ফর্মুলা বিদ্যমান আছে, ন্যূনতম পক্ষে সে ব্যবস্থাটাই কায়েম হোক, আজকের জনগণ সে প্রত্যাশাই করে। আর এ ব্যবস্থাটুকুও যদি নির্বাসিত হয় তবে এ দেশ আর গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে না, তখন তা হয়ে যাবে এক ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়া আর ক্ষমতা লিপ্সার কাছে বন্দী এবং সেটা হবে আরেকটি ‘রাজতান্ত্রিক ফর্মুলার নয়া সংস্করণ’। তাই আসুন, দেশকে বাঁচাতে আমরা গণতন্ত্রের পথে শান্তি শৃঙ্খলাভাবে নতুন বাংলাদেশকে গড়তে বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলি এবং সেই প্রত্যাশায় ভবিষ্যতের পথ রচনা করি।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সরকারের ‘বিশাল অর্জন’ এবং ‘দশম’ সংসদের প্রথম অধিবেশন


দশম নামের সংসদের ‘নির্বাচন’ করার এবং পাঁচ শতাংশেরও কম মানুষের ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে সরকার গঠনের পরপর ওই সংসদের অধিবেশনও শুরু করেছেন ক্ষমতাসীনরা। গত ২৯ জানুয়ারি দশম নামে বর্ণিত জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী তথা প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন করার এবং সদস্যদের আসন বণ্টনের বাইরে এ অধিবেশনে উল্লে¬খযোগ্য আর কিছুই করতে দেখা যায়নি। ‘সেঞ্চুরি’ হাঁকানো সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতো স্পীকার পদে ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পীকার পদে এডভোকেট ফজলে রাব্বি চৌধুরীও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন। এর মাত্র একদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর ছেড়ে দেয়া রংপুর-৬ আসন থেকে ‘নির্বাচিত’ হয়ে এসেছিলেন মাননীয় স্পীকার। সেটাও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই! তাকে নিয়ে এবারের সংসদে তাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’দের সংখ্যা ১৬০-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সব মহলে ব্যাপকভাবে নিন্দিত-সমালোচিত এত বড় একটি লজ্জাকর বিষয়েও সংসদে উপস্থিত কাউকে সামান্য লজ্জিত বোধ করতে দেখা যায়নি। প্রত্যেকে বরং মাথা উঁচিয়ে এবং বুক ফুলিয়ে থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নতুন নেত্রী রওশন এরশাদসহ যে কয়েকজন মাত্র বক্তব্য রেখেছেন তারাও গর্বিতভাবেই বলেছেন। অহঙ্কারেরও স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন তারাÑ যেন হাজার নয়, লাখ লাখ ভোটের বিশাল ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে সংসদে এসেছেন প্রত্যেকে!
সংসদের প্রচলিত রীতি ও রেওয়াজও যথেচ্ছভাবে ভেঙেছেন তারা।  যেমন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রেওয়াজ হলো, নতুন স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচনের পর প্রথমে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যসহ দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের উদ্দেশে সম্মান জানিয়ে শোক প্রকাশ ও শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে এবারের প্রথম অধিবেশনে গুণকীর্তন করা হয়েছে স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর। বিস্ময়করভাবে স্পীকার নিজেও সরকারি দলের চিফ হুইপের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। এই সুযোগে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বুঝিয়ে দিয়েছেন, চাটুকারিতা কাকে বলে। সবাইকে হতবাক করে চিফ হুইপ বলেছেন, এতদিনকার ‘অনভিজ্ঞ’ স্পীকার নাকি প্রমাণ করেছেন, যারা বিজ্ঞ স্পীকার তিনি তাদের চেয়েও ‘বিজ্ঞ’! প্রশ্ন উঠেছে, মাত্র কয়েক মিনিট আগে নির্বাচিত হয়েই শিরিন শারমিন চৌধুরী কিভাবে ‘প্রমাণ’ করলেন যে, তিনি আসলেও অতীতের সব বিজ্ঞ স্পীকারের চেয়ে বিজ্ঞ স্পীকার? তেমন কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগই তো তখন পর্যন্ত তিনি পাননি। তিনি তো বরং রেওয়াজ ভেঙে ‘প্রমাণ’ করেছেন, স্পীকার পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতাই তার ছিল না। তাছাড়া সত্যিকারের যোগ্য ও বিজ্ঞ স্পীকাররা সাধারত চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেন না যেটা সবচেয়ে ‘বিজ্ঞ’ বলে বর্ণিত স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী প্রথম অধিবেশনের প্রথম উপলক্ষেই দিয়েছেন। দায়িত্ব যেখানে ছিল অতি সম্প্রতি মৃত্যুবরণকারী টাঙ্গাইল আসনের সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহানের জন্য শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা স্পীকার সেখানে সরকারি দলের চিফ হুইপকে নিজের গুণকীর্তনের জন্য সুযোগ দিয়েছেন।
দশম নামের সংসদের প্রথম অধিবেশনে অন্য দু’-একজনও কম দেখাননি। বিশেষ করে ‘নবনির্বাচিত’ বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের কথা বলতেই হবে। কারণ একদিকে তিনি নিজের স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বাঁ পাশে নীরবে বসিয়ে রেখে নিজে বসেছেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের স্টাইলে ধোয়ামোছা করেছেন বিএনপি এবং বেগম খালেদা জিয়াকে। একই নিঃশ্বাসে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি ভক্তি উজাড় করে দিয়েও অবাক করেছেন তিনি। সবশেষে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে এরশাদের নেতৃত্বে উন্নয়নের যে সূচনা হয়েছিল সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পূর্ণতা পাবে’ এবং এ ব্যাপারে তারা সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবেন। মন্ত্রিত্ব নিয়েও কিভাবে বিরোধী দল হওয়া যায় সে প্রশ্নের উত্তরে রওশন বলছেন, এটা নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই নতুন একটি ‘কনসেপ্ট’! উল্লেখ্য, রওশনের পাশে বসে থাকা এরশাদকে সেদিন নিতান্ত এক বেচারা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়ানি। একটি কথাও বলেননি তিনি। তাকে এমনকি নিজের দল জাতীয় পার্টির এমপি ও নেতাদের সঙ্গেও হেসে কথা বলতে বা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে দেখা যায়নি। ওদিকে প্রথম অধিবেশনে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট। রীতি ও প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদের প্রথম অধিবেশনে তাকে ভাষণ দিতে হয়েছে। মূলত আওয়ামী লীগের নেতা এবং ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি বলে অন্যরকম সম্ভাবনা ছিল না সত্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও ধারণা করা হয়েছিল, তিনি অন্তত কথায় সংযমী হবেন। বক্তব্য রাখবেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত মহামান্য ব্যক্তি এবং জাতির অভিভাবকের মতো। অন্যদিকে ঠিক একজন অওয়ামী লীগের মেঠো নেতার মতো ভাষণ দিয়েছেন আবদুল হামিদ এডভোকেট। এমন একজন নেতার মতো, নেত্রীর সন্তুষ্টি, প্রশংসা এবং অনুগ্রহ অর্জনই যার প্রধান উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রপতির এই ভাষণ নিয়ে আলোচনার আগে অন্য কিছু কথা সেরে নেয়া যাক।
ভাষণসহ নানা নাটকীয়তার মাধ্যমে চমক দেখানোর চেষ্টা করা হলেও প্রথম অধিবেশনের কোনো কার্যক্রমই জনগণকে সামান্য আকর্ষণ করতে পারেনি। তাদের সমর্থন পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আসল কারণ হলো, গলদ রয়েছে গোড়াতেই। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে হাস্যকর মহড়া করা হয়েছে সে মহড়ায় দু’-তিনটি মাত্র নামসর্বস্ব দলকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ একাই শুধু অংশ নিয়েছে। এজন্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। একটি ‘ফুল’ এবং একটি ‘হাফ’ সেঞ্চুরিও হাঁকানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫৩ জন নির্বাচন না করেই ‘নির্বাচিত’ হয়ে গেছেন। এর ফলে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭টি আসনের নির্বাচনও হাস্য-কৌতুকের সৃষ্টি করেছিল। কারণ, যে ৩৯০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের। কয়েকজন ছিলেন আওয়ামী মহাজোটের। যারা দলের মনোনয়ন পাননি তারা দাঁড়িয়েছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে। জিতে যাওয়ার পর বিদ্রোহীদের কয়েকজনকে ঘরের ছেলের মতো দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। তারাও নেত্রীর কাছে ফিরে যেতে পেরে ধন্য ও কৃতার্থ হয়ে গেছেন। এভাবে সংসদে আওয়ামী লীগ আবারও দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি, ২৩৫টি আসন দখল করেছে।
এত কিছুর মধ্যেও লক্ষণীয় প্রধান বিষয় ছিল জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ভোটার ভোট দিয়েছে বলে দাবি করা হলেও মাঠ পর্যায়ের কোনো রিপোর্টেই পাঁচ শতংশের বেশি ভোট দেয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক কিছু কথা বলেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। নির্বাচন পরবর্তী এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, পরীক্ষায় মাত্র পাঁচ মার্ক পেলে যেখানে ফেল করার কথা সেখানে ফেল করা ব্যক্তিরা শুধু পাসই করেননি, ক্ষমতায়ও বসেছেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অধ্যাপক চৌধুরী বলেছেন, প্রায় নয় কোটি ভোটারের মধ্যে খুব বেশি হলে ভোট দিয়েছেন মাত্র ২০ লাখের মতো ভোটার। এদের শতকরা হার পাঁচ ভাগের বেশি নয়। কিন্তু এই ভোট পেয়েই ফেল করা ব্যক্তিরা সরকার গঠন করেছেন। এটা সম্ভব হওয়ার কারণ, তারা নিজেরাই খেলোয়াড়, রেফারি এবং লাইনসম্যান ছিলেন। একই ধরনের কথা বলেছেন আরো অনেকে। ক্ষমতাসীনরা তাই বলে পিছিয়ে যাননি, লজ্জিতও বোধ করেননি। প্রধানমন্ত্রী উল্টো বরং ৪০ শতাংশের এক উদ্ভট তত্ত্ব হাজির করেছেন। বলেছেন, দেশের ৪০ শতাংশ ভোটার নাকি তাদের ভোট দিয়েছে! কথাটা বলার সময় আহামরি ধরনের সাফল্যের পুলক অনুভব করলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু লক্ষ্যই করেননি যে, ৪০ শতাংশ ভোটার যদি ভোট দিয়েও থাকে তারপরও সত্য হলো, ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়নি। আর ৬০ শতাংশ নিশ্চয়ই ৪০ শতাংশের চাইতে অনেক বেশি! প্রকৃতপক্ষে জনগণ ক্ষমতাসীনদের সোজা ‘না’ বলে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের আসলে পরাজয়ই ঘটেছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটও প্রধানমন্ত্রীর সুরে ও ভাষায় কথা বলেছেন। প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলে বসেছেন, বর্তমান সরকারকে দ্বিতীয়বার ‘নির্বাচিত’ করে জনগণ নাকি ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছে! রাষ্ট্রপতির কথাটাকে সত্য বলতে হলে বাস্তবে ‘ম্যান্ডেট’ শব্দের অর্থই কিন্তু পাল্টে ফেলতে হবে। কারণ, এরই মধ্যে প্রমাণিত সত্য হলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পাঁচ শতাংশের বেশি মানুষ ভোটই দেয়নি! তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি দিব্যি বলেছেন, নির্বাচন নাকি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে! অনেকাংশে অনুগ্রহ করে ‘বিভিন্ন প্রতিকূলতা’র কথা উল্লে¬খ করলেও তিনি এই সত্যের ধারেকাছেই যাননি যে, ওই নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলই অংশ নেয়নি। রাষ্ট্রপতির লক্ষ্য রাখা উচিত ছিল যে, তার নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্বীকার করেছেন, ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ। যার অর্থ, বেশির ভাগ তথা ৬০ শতাংশ ভোটারই ভোট দিতে যাননি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর হিসাবকেও সচেতন সকল মহল প্রথম উপলক্ষেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। সে কারণে রাষ্ট্রপতির অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি শুধু ‘ম্যান্ডেট’ পাওয়ার কথাই শোনাননি, একথা পর্যন্ত বলে বসেছেন যে, এক নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে আরেক নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নাকি এক ‘বিশাল অর্জন’! যেহেতু ‘বিশাল অর্জন’ করেই ফেলেছেন সেহেতু এরপর নির্বাচন নিয়ে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
এ পর্যন্ত এসেও অবশ্য থেমে পড়েননি রাষ্ট্রপতি। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা থেকে কথিত সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং পঞ্চদশ সংশোধনী ও কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ‘নিরপেক্ষ’ বিচার প্রক্রিয়া পর্যন্ত এমন প্রতিটি বিষয়েও তিনি বলেছেন, যেগুলো প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব সময় বলে থাকেন। শুধু বলেননি, বলেছেনও আবার ক্ষমতাসীনদের সুরে ও ভাষাতেই। একটি বিষয়ে তিনি এমনকি তার নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকেও ছাড়িয়ে গেছেন। বিগত পাঁচ বছরে তারা নাকি শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে হেঁটেছেন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি নিজেদের দৃষ্টিকে ২০২১ সাল ছাড়িয়ে ২০৫০ সালের দিকে প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। লক্ষণীয় যে, এতদিন নিজের সব স্বপ্নকে ২০২১ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে আসার পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাত্র ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ২০৪১ সাল পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির তার প্রথম ভাষণেই ‘হাফ সেঞ্চুরির’ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেনÑ দৃষ্টি প্রসারিত করতে বলেছেন ২০৫০ সাল পর্যন্ত। মানতেই হবে, জাতি অতি যোগ্য একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টাকে পেয়েছে বটে!
রাষ্ট্রপতি আহ্বান জানালেও জনগণের অবশ্য এত বেশি দূর পর্যন্ত দেখার সাধ্য নেই, ইচ্ছাও নেই। এর কারণ, আবারও ‘নির্বাচিত’ হয়ে আসার পর মুহূর্ত থেকেই সরকার গণতন্ত্রের যে ‘নমুনা’ দেখাতে শুরু করেছে, যে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও কণ্ঠ চেপে ধরতে শুরু করেছে এবং যেভাবে প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও নেতা-কর্মীদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে তারপর কোনো মানুষের পক্ষেই গণতন্ত্র বা সাংবিধানিক তথা আইনের শাসনের জন্য আশায় হা করে থাকা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। একই কারণে গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সংলাপ করার জন্য ‘নির্বাচন বর্জনকারী’ দলগুলোর প্রতি যে আহ্বান রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন সে আহ্বান অনুযায়ী সুফল পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে না। এমন বিশ্লে-ষণের ভিত্তিতেই বলা দরকার, রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাত অবসানের মাধ্যমে ‘সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান আসলে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জানালেই তিনি ভালো করতেন। এর মধ্য দিয়ে তার সদিচ্ছারও পরীক্ষা হয়ে যেতো। কিন্তু সেদিকে যাননি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট। এই না যাওয়ার কারণ, তাকে সব সময় মনে রাখতে হয়, তিনি কোন দল থেকে এসেছেন এবং ঠিক কোনজনার শুভেচ্ছা রয়েছে তার ‘বিশাল অর্জনের’ পেছনে!
সবশেষে বলা দরকার, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটও জনগণকে নিরাশই করেছেন এবং মূলত ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাবের কারণেই জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকা অনেক গভীর হয়েছে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের যে কর্মকা- চালানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে জনগণ। জনগণ একদলীয় এ নির্বাচনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন করা দরকার এজন্য যে, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরাও একবাক্যে বলেছেন, ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার এবং পাঁচ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক সরকারের নামে ক্ষমতায় বসেছে স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী। নির্বাচনটিকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কলঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করে তারা আরো বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠূকে দিয়েছে। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, দেশের ভেতরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা নির্বাচনটিকে গ্রহণ করেনি। এমন প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য শুধু নয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্যও মোটেই শুভ নয়। কথাটা ক্ষমতাসীনরাও যে বোঝেননি তা নয়। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদ পূরণের উদ্দেশ্যেই তারা ভোটারবিহীন এ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। জেদও প্রধানমন্ত্রী বুঝে-শুনেই করেছিলেন। কারণ, সব জরিপ ও অনুসন্ধানেই জানা গিয়েছিল, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্যই তারা সুচিন্তিভাবে উস্কানি দেয়ার মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পাশাপাশি তাদের পক্ষে দায়িত্ব পালন করেছে অথর্ব, মেরুদ-হীন ও সেবাদাস হিসেবে চিহ্নিত নির্বাচন কমিশন।
একই কারণে কথিত দশম সংসদ এবং নতুন সরকারও জনগণের চোখে কখনো বৈধতা অর্জন করতে পারবে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনসহ ঘটনাপ্রবাহে বরং আবারও প্রমাণিত হয়েছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। কথাটা ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্যরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই তাদের জন্য শুধু নয়, দেশের জন্যও মঙ্গল। মিষ্টি কথার আড়ালে চাটুকারিতাসহ সব কাজ ফেলে তাদের তাই সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার সংক্রান্ত একটি মাত্র বিধান যুক্ত করেই সরে পড়া উচিত। না হলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রচ- আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এ সংসদকে বিদায় করবে। মহামান্য কোনো রাষ্ট্রপতি কিংবা সবচেয়ে বিজ্ঞ কোনো স্পীকারও তখন কোনো কাজে আসতে পারবেন না।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্রের নতুন মডেল!


নয়া এক গণতন্ত্র আমরা পেয়েছি বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর। বিশ্বের কোথাও এ ধরনের গণতন্ত্র এ মুহূর্তে চালু নেই। পশ্চিমা গণতন্ত্রের জন্মদাতারা বেঁচে থাকলে হয়তো তারা বড্ড বেশি লজ্জা পেতেন। কারণ, প্রচলিত ধারার গণতন্ত্রের সংজ্ঞার সাথে বাংলাদেশী গণতন্ত্রের  মিল নেই। অদ্ভুত কিসিমের এই গণতন্ত্রে কোনো ভোটের প্রয়োজন হয় না। সংসদেও দরকার হয় না বিরোধী দলের। বিরোধী নেত্রী আছেন। আছেন তার দলের মন্ত্রীরা। সে দলের প্রধান সরকারের বিশেষ দূতও। সরকার আর বিরোধী দলকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কথা হচ্ছে জটিল এক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা এটা অর্জন করেছি। পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের অবিচল আনুগত্য আর নেই। কারণ, আমরা নিজেরা নয়া এক মডেল তৈরি করেছি। এখন সংবিধান সংশোধন করে নিলেই সব মামলা চুকে যায়। বুদ্ধিজীবীরা সমানেই টিভির টকশোতে নয়া সব তত্ত্ব হাজির করছেন। বলছেন এটাই গণতন্ত্র। কে ভোট দিতে গেল আর না গেল, তা দেখার সুযোগ বা সময় কোথায়? ভোটের বাক্স ছিল। দাওয়াতও দেয়া হয়েছিল ভোটারদের। নিরাপত্তাও ছিল। কেউ যায়নি, তাতে কী?

শাসন কায়েম হয়ে গেছে। বিদেশ থেকে স্বীকৃতিও এসে গেছে। তাই আসুন, আমরা সবাই যোগ দিই গার্ডেন উৎসবে। যদিও সবার জন্য দরজা খোলা নয় এই উৎসবের। যারা সহযাত্রী তারাই যোগ দেবেন বা দিয়েছেন। আগে ব্যতিক্রম থাকতেন নিরাপত্তা বসরা।এবার তারাও কোরাসে যোগ দিয়েছেন। খানাপিনায় অংশ নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। বলেছেন, বাড়তি মজা দেখছি। আগে আমাদের কেন দূরে ঠেলে রাখা হতো। এটাইতো ভালো। সবাই মিলেমিশে এক পতাকাতলে যোগ দিলে দেশে শান্তি আসবে। ভিন্ন মতের কী প্রয়োজন? ওরা তো গাড়ি পোড়ায়, রাস্তা অবরোধ করে। কথায় কথায় হরতাল ডাকে। জ্বালাও পোড়াও ছাড়া ওদের যেন আর কাজ নেই। একদা আমজনতার আওয়াজ অন্য স্রোতে বেশি ছিল। এখন ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ওদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার ওষুধ পেয়ে গেছি। দেখছেন না জেলায় জেলায় থানায় থানায় কিভাবে নতুন শব্দে ঘুম ভাঙে। কেউ জাগে, কেউ চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যায়।

নয়া মডেল দরকার। আসাদরা গাদ্দাফিরা কোনো মডেল দিতে পারেনি। তারা বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় টিকে ছিল বা আছে। এখানে তো সংসদ বহাল। বিরোধী দলও থাকছে। একটু অন্যরকম আর কি। সরকার আর বিরোধী দল একযোগে কাজ করবে। বিরোধী মতের কী প্রয়োজন। অযথা বাড়তি টেনশন। কথার যুদ্ধ। জনগণকে উসকে দিয়ে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা। বাংলাদেশী  নতুন মডেলে এর জায়গা নেই। ধীরে ধীরে এই জঞ্জাল সাফ করতে হবে। বিরোধী মতের আপাতত কোনো দরকার নেই। ভবিষ্যতে দেখা যাবে। পশ্চিমা দুনিয়ার কয়েকজন চেঁচামেচি করবে। পরে ঠিক হয়ে যাবে। ওরা কী চায়। ব্যবসা, সুযোগ সুবিধা। সবই তারা পাবে। দেখলেন না চীন কিভাবে রাতারাতি পাল্টে গেল। আরো বড় শক্তি? অপেক্ষা করছে। দেখবেন, সেটাও ম্যানেজ হয়ে গেছে। বিরোধীরা যে কেন ভোটে এলো না, তা বুঝতে পারি না। তারা এলেই অনেক কিছু পেত। সবাইকেই দিয়েছি। গোলমালটা হচ্ছে ইউরোপীয় একটি শক্তিকে নিয়ে। তারা ওয়েস্ট মিনস্টার ধারণার অন্য ব্যাখ্যা মানতে চায় না। তাই তারা আপত্তি করেছে। সংসদে প্রস্তাবও পাস করেছে। আপাতত বৈরী। পরশু সকালে দেখবেন বিলকুল ঠিক। বিরোধীরাও চুপ হয়ে যাবে। সামনে কত যে খেলা অপেক্ষা করছে। উপজেলা যাক নাÑ দেখবেন হিসাব মেলাতে পারছে না। রাজনীতি চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি হয়ে যাবে। মিডিয়া তো কাবু হয়েই গেছে। আমাদের কিছু করতে হয়নি। নিজেরাই ম্যানেজ হয়ে গেছে। নতুন আইন করতে যাচ্ছি তাতে ওয়েব দুনিয়াও ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কজনের সাহস আছে আইন অমান্য করে আন্দোলনে যোগ দেয়ার। তার মানে কী? মানে খুবই সোজা। এক নেতা, এক দেশ,’ স্লোগানটি একসময় শুনতে ভালো লাগত। মাঝখানে অরুচি ছিল। এখন নয়া মোড়কে মোড়ানো হচ্ছে। ভালো লাগতেও পারে। না লাগলে চলে যান অন্য দেশে। কার কী আপত্তি। কেউ আপত্তি জানাবে না। নিরাপত্তার জন্য, সুশাসনের জন্য প্রজারা নানা সময় নানা কিছু করেছেন। এই ভূখণ্ডেও তাই দেখা গেছে। প্রজারা রাজাকে বসান। আবার হটিয়েও দেন। রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মিল খুঁজতে গিয়ে অযথা বাড়তি চিন্তা করছেন কেন? সময় শেষ হয়ে যায়নি। অপেক্ষা করুন, দেখুন। নয়া কিছুর জন্য কষ্ট করতে হয়। রূপকথার গল্প শেষে সব সময় বলা হয়, এরপর তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। এটা রূপকথা কি না, তা নিয়ে আপনি বিতর্ক করতে পারেন। আমি অন্তত করছি না।


 

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্রের চিরায়ত ও শাশ্বত পথ


বাংলাদেশে এখন  রাজনীতির  দৃশ্য মঞ্চায়িত হচ্ছে। এ রকম মনে করার কারণ রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণে অভিনবত্বে ভরপুর দশম জাতীয় সংসদ প্রথম অধিবেশনে মিলিত হয় গত বুধবার। একটি বা দুটি নয়, বহু অভিনব বিষয় দেখা যাচ্ছে অন্য রকমের সংসদে। গণতন্ত্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য, তত্ত্ব ও প্রয়োগের দিক থেকে কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী অভিনব উদাহরণ সৃষ্টি করল আমাদের দশম জাতীয় সংসদ। 
দশম জাতীয় সংসদ অভিনব এজন্য যে, এতে অংশগ্রহণকারী সদস্যগণের অর্ধেকেরও বেশি প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন নি। দশম সংসদ গঠনের জন্য যে নির্বাচন হয়েছে, সেটি দেশ-বিদেশের মিডিয়া ও বিশেষজ্ঞদের দ্বারা চরমভাবে ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত’। দেশের অর্ধেকেরও বেশি ভোটার এতে ভোট দিতে পারেন নি। অন্যত্র ভোট বর্জন করা হয়। পরিশেষে ভোটারদের যে উপস্থিতি হয়েছিল, সেটাও হাস্যকর রকমের কম। আবার সে ‘কম ভোট’ বেশি বানিয়েছে, দলের পা-ারা। ফলে এ সংসদের পেছনে জনসমর্থনের স্তম্ভটি আইনগতভাবে দেখতে সুন্দর হলেও ভেতরে ফাঁপা, জনঅংশগ্রহণ ও জনসমর্থনহীন।
দশম জাতীয় সংসদের অভিনবত্ব আরও প্রকট হয় সুস্পষ্ট-বিরোধী দল না থাকা এবং বিরোধী দলের দ্বৈত আনুগত্যের কারণে। যে দলের প্রধান ব্যক্তি সরকারের অধীনে বেতন, ভাতা নিয়ে কাজ করেন, তার দলকে বিরোধী দল বলা যায় না। পার্টি প্রধান সাবেক প্রেসিডেন্টকে বসে থাকতে দেখা গেলো তার স্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর পাশের আসনে। রেওয়াজ অনুযায়ী দলনেতাকেই সংসদীয় দলের নেতা করা হয়। তাকে করা হয়েছে মন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ দূত। একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের জন্য [স্বৈরাচারী বা গণতান্ত্রিক, যা-ই হোক না কেন] পদটি নিঃসন্দেহে অধঃস্তন এবং তিনি সেটা সানন্দে গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। উপরন্তু তিনি মঞ্জুর হত্যা মামলাসহ অনেক মামলার অভিযুক্ত আসামী। সরকারে তার অংশ নেয়ায় বিচার প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন যা-ই উঠুক বা নাটক যতই হোক,  ব্যক্তিগতভাবে তিনি গণতন্ত্র নয়, নিজের স্বার্থ দেখছেন, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমন কি, এরশাদের পাশে সরকারের আরেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ উপবিষ্ট। অতএব দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দলের আসনে বসে আছেন সরকারের নানা পদ ও পদবীধারীরাই। পরিস্থিতির প্রকৃত চেহারাটি এমনই হ-য-ব-র-ল।
সংসদীয় রীতি মেনে বিরোধী দলীয় সদস্যরা তাদের জন্য একজন সংসদ নেতা নির্বাচন করেছেন বটে এবং তাকে বিরোধী দলের নেতা বলা হচ্ছে। নীতিগতভাবে তার দলের সংসদ সদস্যরা সংসদীয় কার্যক্রমে তাকেই মানতে বাধ্য। তারা বসেছেনও তাদের দলীয় ও সংসদীয় নেত্রীর পাশেই। কিন্তু তাদের অনেকেই আবার সরকারের মন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কাজ করছেন। এসব সদস্য কাকে মান্য করবেন? প্রধানমন্ত্রীকে? নাকি তাদের দলনেত্রী তথা বিরোধী দলীয় প্রধানকে? সংসদের বিধিতে ফ্লোর ক্রস করাই (এক দলের পক্ষে নির্বাচিত হয়ে অন্য দলে চলে যাওয়া) যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে একই সঙ্গে নিজের দলের জন্য এবং ক্ষমতাসীন দলের জন্য কাজ করতে গেলে আনুগত্যের সীমানা তো লঙ্ঘিত হতে বাধ্য। কোন ইস্যুতে ভোটাভুটি হলে কে কখন কোন দিকে থাকবেন, সেটা বলা মুস্কিল হয়ে গেছে। এক হাত সরকারের পক্ষে আর আরেক হাত বিরোধী দলের পক্ষে রেখে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা দুটি ভোট দিতে পারবেন না। তাদেরকে একটি ভোটই দিতে হবে। সে ভোটের চরিত্র কি সরকারি ভোট, নাকি বিরোধী ভোট হবে, সেটাই দেখার বিষয়। তখন আইনগত বৈধতার নানা সমস্যা ও জটিলতা যে তৈরি হবে, সেটা চোখ বন্ধ করেও বলা যায়। অন্যদিকে,  বিরোধী দলের সদস্য হিসাবে মূল দায়িত্ব সরকারকে জবাবদিহি করা। খোদ সরকারে বসে থেকে তারা আর কাকে জবাবদিহি করবেন! বিভিন্ন সময়, যেমন নবম সংসদে কিছু দল সরকারে অংশ নেয়। তাদের কেউ কেউ মন্ত্রীও হন। তারা স্বভাবতই বিরোধী আসনে বসেন নি। সরকারের সঙ্গে বসেছেন। বর্তমান দশম সংসদেও জাতীয় পার্টির একটি অংশের নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সরকারে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি তার সাবেক দলপতি এরশাদের চেয়ে বরং প্রধানমন্ত্রীর অধিক নিকটবর্তী। তিনি নিজেকে বিরোধী দল দাবি করছেন না। কিন্তু  দশম সংসদের প্রধান বিরোধী দলটি সরকারেও থাকছে, বিরোধী দলের আসনগুলোও দখল করেছে। কার্যত যারা সরকারের অংশে পরিণত হয়েছে, তারা বিরোধী দলের চরিত্র বজায় রাখবে কিভাবে? বিরোধী দলের দায়িত্বও তাদের পক্ষে কিভাবে পালন করা সম্ভব? এসব অকল্পনীয় বিষয় যদি দশম জাতীয় সংসদে সম্ভব হয়, তাহলে ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ পাওয়া যাবে বলতে হয়। আসলে বাস্তবে, কার্যক্ষেত্রে ও পুরো অবয়বে একটি সরকারি জাতীয় সংসদই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নানামুখী কণ্ঠস্বরও উচ্চকিত হওয়ার বাস্তব অবস্থা নেই। প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে সবাই যখন সরকারের অংশে পরিণত হয়, তখন বহুদলীয় আর একদলীয়ের ফারাকটি বেশ বড় হয়ে সকলের চোখের সামনে চলে আসে। কোনভাবেই এটিকে আড়াল করা সম্ভব হয় না।  
অথচ সংসদীয় ব্যবস্থার প্রাণই সরকারি ও বিরোধী দলের সাংবিধানিক প্রতিযোগিতার মধ্যে নিহিত। বিরোধী দলের উপস্থিতির কারণেই সংসদীয় গণতন্ত্র একদলীয় হতে পারে না। সরকার জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার মধ্যে থেকে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সংসদীয় গণতন্ত্রের উদ্ভব থেকে সর্বাধুনিক বিকাশ পর্যন্ত সরকারি ও বিরোধী দলের পার্থক্যপূর্ণ অবস্থান একটি সুস্পষ্ট এবং সুনির্ধারিত বিষয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সরকারে অংশ নেয়া বিরোধী দলের কারণে তাবৎ সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যে সংসদ ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন, প্রার্থীদের প্রতিযোগিতাহীনতা ও জনগণের অংশগ্রহণ বিহীনতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিরোধী দলীয় রীতি-নীতির অবক্ষয় সাধন করে সরকারে বিলীয়মান হয়ে যায়, সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা ছোটভাবে দেখার উপায় নেই। বহুদলীয় গণতন্ত্রের ইমেজ তালাশ করাও বাতুলতায় পরিণত হয়। স্বৈরাচারের আমলে মুখে গণতন্ত্রের মুখোশ লাগানোর জন্য ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ সৃষ্টি করে প্রকাশ্যে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষার মাধ্যমে দেখানো হয়েছিল যে, আমরা গণতন্ত্রে আছি, কারণ এখানে বিরোধী দল আছে। এখন সরকারে অংশ নেয়া বিরোধী দলকে সামনে রেখে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার ভিত্তিতে বিদ্যমান বাস্তব-পরিস্থিতিকে কি বলা হবে? সমালোচকদের কেউ কেউ অবশ্য এখনই একদলীয় সংসদ উপমাটি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।
সন্দেহ নেই, এবার উদ্ভবগত দিক থেকেই সংসদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা। কার্যক্রমের সূচনাতেই প্রকট হচ্ছে আরও নানা কার্য প্রণালীগত সমস্যা ও সঙ্কট। সামনের দিনগুলোতে কাজ চালাতে গেলে এ সংসদকে গণতন্ত্রের বিধিবদ্ধ মানদ-ের বাইরে গিয়ে এমন অনেক অভিনব, আপত্তিকর, অগ্রাহ্য কাজ হয়ত করতে হবে, যা পুরো পরিস্থিতিকেই সঙ্কট-সমস্যার অক্টোপাশে আবদ্ধ করতে পারে; বৈধতা ও আইনগত সিদ্ধতার নানা আপত্তি সামনে নিয়ে আসতে পারে। এমন একটি সংসদীয় কার্যক্রমকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার চিরায়ত পথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করাও আদৌ সম্ভব হবে না। বরং, এমন নাজুক ব্যবস্থাকে নিয়ে পাঁচ বছর কার্যক্রম চালাতে গেলে গণতান্ত্রিকতার অধঃপতনের সমূহ ঝুঁকি ও বিপদই ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। ফলে যারা ক্ষমতার রথকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে একচক্ষু হরিণের মতো আশেপাশের বিপদ ও সমস্যাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন বা দেখছেন না, তারা অচীরেই ভুল ব্যবস্থার নানা ধরনের অভিনব ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়ে বিপদে পড়তে পারেন। অতএব, দেশ ও বিদেশ থেকে যে গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা মানা হলে বৈধতা ও শক্তিমত্তা দুটিই নৈতিক বল পাবে। বিদ্যমান অভিনব পরিস্থিতিকে সাময়িক ও আপৎকালীন বিশেষ পরিস্থিতিরূপে গণ্য করে গণতন্ত্রের চিরায়ত ও শাশ্বত পথে অতি দ্রুত প্রত্যাবর্তন করাই হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক এবং এতেই নিশ্চিত হবে সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক সফলতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাধারণভাবে সেরা রাজনীতিবিদ আমরা সাধারণত কাকে বলি বা কাদের বলি এবং সেটা কেন বলি? যাঁর উদ্ভাবিত কৌশলের সামনে এসে বিপক্ষ দলের কৌশল নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। যাঁর কৌশল যত বেশি, যিনি যত বেশি নির্বাচনী বা রাজনৈতিক বাজি জিততে পারেন, তিনি তত বড় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন। এটাই এখনকার দস্তুররেস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানত, কৌশলের বিপক্ষে আর একটি তুখোড় কৌশলÑÑএইভাবেই রাজনীতিবিদদের ক্রিয়াকলাপকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা। মূলত কৌশল-প্রতিকৌশলের প্যাঁচ-মারামারি দেখতেই আমাদের কৌতূহল আজ রাজনীতির মল্লভূমির দিকে এগিয়ে যায়। রাজনীতির মানবকল্যাণমুখী স্রোতটি, গণতন্ত্রের চিরায়ত ও শাশ্বত পথ  চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ছোট আয়তন হলেও কিন্তু বিরাট জনসংখ্যার বিশাল এই দেশ বাংলাদেশ। ন্যায় ও মুক্তির সংগ্রাম-সঞ্জাত সুমহান ও সুউচ্চ এদেশের চিরায়ত ঐতিহ্য। সকল মত-পথ-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-অঞ্চলের মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে চায় যে-দেশ, সে-দেশের উত্তরাধিকারের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ত্যাগ, মহানুভবতা, শিষ্টতা, পরহিত ও আত্মনিবেদনের আদর্শিক পরাকাষ্ঠা। শতাব্দীর পর শতাব্দী সে কথাগুলোই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন এদেশের বরেণ্য পুরুষেরা স্বাধীনতার সৈনিকেরা জনমুখী রাজনীতিবিদেরা। এমন একটি কথাই আমরা শুনতে পাই উইলিয়াম এফ. বাকলে-এর কণ্ঠে: “সংখ্যাগরিষ্ঠের তোষামোদ করতে আমরা এতই ব্যস্ত থাকি যে, আমাদের আর খেয়ালই থাকে না, একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা দূরে থাকুক, সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও মাঝেমাঝেই সংখ্যাগরিষ্ঠকে নমিত করা প্রয়োজন।” সেইসব আদর্শ আজকের রাজনীতিবিদদের অনেকের কাছেই প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে এসেছে। মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ক্ষমতার মোহ। কূট, কৌশল, ইস্যু, চতুরতার মোহ। মূল্যবোধ, আত্মসম্মান আর মানবিকতাকে বিতাড়িত করেছে রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে। রাজনীতি এখন কেবলই ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, বৈভব, দাপট ও দখলদারিত্বের এক হিংসা ও রক্ত-প্লাবিত রণাঙ্গন ছাড়া আর কিছু নয়।
তত্ত্বকথায় আছে হিংসা, হিংসার জন্ম দেয়। সন্ত্রাস, সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। বলপ্রয়োগ, আরো বলপ্রয়োগকে ডেকে আনে। অনাচার-অনিয়ম, বিপদ তৈরি করে। কথাগুলো তত্ত্বগত হলেও বাস্তব-বিবর্জিত নয়। বাস্তবের মাঠ থেকেই এগুলো উঠে এসেছে তত্ত্বের পাতায়। রাজনীতি করার সময় তত্ত্ব আর বাস্তবের বিষয়গুলো নতুন করে তুলনা করা দরকার। খানিকটা মূল্যায়নও হওয়া দরকার রাজনীতির। কেবল কূট, কৌশল আর চতুরতাই যে রাজনীতির শেষ কথা নয় মূল্যবোধ, আত্মসম্মান, ত্যাগ, পরহিত, পরমতসহিষ্ণুতা আর সহনশীলতারও যে গুরুত্ব আছে বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ কথাগুলোও পুনরুচ্চারিত হওয়া দরকার। কেননা, শাশ্বত-অর্থে রাজনীতি হলো রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কিত বিজ্ঞান। হিংসা, কূটচাল, কৌশল, চতুরতা দিয়ে আপাত বিজয় লভ্য হলেও রাষ্ট্র ও নাগরিকগণের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়গুলো সুস্থ ও কাম্য স্তরে নেয়া যাবে না। উন্নয়ন প্রচেষ্টাতেও জনঐক্য নিশ্চিত হবে না। ক্ষমতার প্রতিযোগিতাই প্রলম্বিত হবে মাত্র।
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গণতন্ত্রের চাদরে মোড়ানো এক নব্য স্বৈরতন্ত্র


বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতা বদলের যতগুলো পন্থা আছে তার মধ্যে সর্ব উত্তম পন্থা হলো গণতন্ত্র। বিভিন্ন কারণে গণতন্ত্র জনগণের মাঝে প্রিয় হয়ে উঠছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো এই ব্যবস্থায় দেশের প্রতিটি নাগরিক নিজের স্বাধীন মতামত পেশ করতে পারেন। তবে এই গণতন্ত্র নিয়েও অনেক কথা আছে। অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য এটাকে একটা খারাপ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। কারণ বেশি মানুষ এক দিকে মতামত দিলেই সেটা ভাল নাও হতে পারে আবার অভিজ্ঞতা ও বাস্তব সম্মত চৌকষ ব্যক্তি সংখ্যায় কম হলেও সেই মতটাই ভাল হতে পারে। অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ শত অশিক্ষিত মানুষের চেয়ে ভাল হওয়ার কথা, কিন্তু গণতন্ত্র এটাকে সমর্থন করে না। এজন্যই কেউ কেউ বলে থাকেন যে গণতন্ত্র হলো অশিক্ষিত শাসন ব্যবস্থা। তবে অশিক্ষিত মানে মূর্খ নয়। সে যাই হোক আর যে যাই বলুক বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা সম্ভবত আর একটি নেই।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা লক্ষণীয়। বাংলাদেশের মানুষের কাছেও গণতন্ত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মূলত বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে গণতন্ত্রের বিকাশ সাধনের জন্য। সেই হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও তরুণ পর্যায়েই রয়ে গেছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই অবস্থাতেই তরুণ গণতন্ত্রের টু’টি চেপে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা খুব সুন্দর করে ব্যক্ত করেছি ঠিক কিন্তু তা অনেকটা সংবিধান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, সেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।”
এই অনুচ্ছেদে মূলত চারটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে (১) মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা (২) মৌলিক স্বাধীনতা (৩) মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করণ (৪) প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এর সবগুলিই আজ চরমভাবে ভূলুন্ঠিত। আজকে মানবাধিকার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। যদি আমার মতের পক্ষে হয় তবেই সেটা মানবাধিকার আর যদি আমার মতের বিরুদ্ধে যায় তাহলে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। সমগ্র বিশ্বে প্রায় একই অবস্থা। আজকে যদি আমরা ফিলিস্তিনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব-সেখানকার অসহায় আর নির্যাতিত মানুষেরা যখন জালিমশাহী ই¯্রাইলের সৈন্যবাহিনীর দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারছে তখন সেটা হয় মানবাধিকার লঙ্ঘন বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কিন্তু ইস্রাইলী সৈন্যরা যখন ফিলিস্তিনিদের দিকে গুলী ছুঁড়ে তখন নাকি সেটা হয় আত্মরক্ষা! বর্তমান বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা। বিরোধীদলের নেতা কর্মীরা যখন মজলুম অবস্থায় নিরুপায় হয়ে ঢিল ছুঁড়ে তখন সরকার কর্তৃক লেলিয়ে দেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকার পন্থিরা সেটার জবাব দেয় বন্দুকের নল দিয়ে। আর এভাবে তারা শত শত বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে হত্যা করেই চলছে। বিরোধী দল যেটা করছে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন আর সরকারি দল যেটা করছে সেটা মানবাধিকার সংরক্ষণ! মানুষের মানবিক মর্যাদা আজকে ধুলোর সাথে মিশে গেছে। স্বাধীনতা আজকে সোনার হরিণ। আশঙ্কা নিয়েই মানুষ ঘর থেকে বের হয় আর আশঙ্কাসহই ঘরে ফেরে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভাবে হয়তো জীবিত আর ঘরে ফেরা নাও হতে পারে। অন্যদিকে ঘরে থাকলে যে কোন সময় খুন বা অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার হওয়া লাগতে পারে। সব মিলিয়ে কোথাও তিনি স্বাধীনতা অনুভব করেন না। অথচ গণতন্ত্রের অন্যতম বিষয়ই হলো মৌলিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।
অজ্ঞাত কোন কারণে এক একজন গ্রেফতার হচ্ছে, তারপর তার কাছে বড় মাপের একটা টাকার অংক চাওয়া হচ্ছে যদি তা দিতে পারে তাহলে হয়তো মুক্তি নয়তো তথাকথিত ক্রসফায়ার বা অমানবিক নির্যাতন অথবা জেল। আজকে কাউকে গ্রেফতার করতে কোন প্রমাণ বা মামলা অথবা সময় লাগে না। যে কোন সময় যে কোন কাউকে ইচ্ছে হলেই গ্রেফতার করা যায়। এক আজব অবস্থা আর গ্রেফতার করার পর শুধু দিনের পর দিন নয়, মাসের পর মাসও কোর্টে না তুলে বন্দিকে নিয়ে তথাকথিত অভিযান চালানো হয় যা সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী। কারণ আমাদের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের (১) এ বলা আছে “গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।” অথচ বর্তমানে এর কোন পরোয়াই করা হয় না।
আবার অনুচ্ছেদ ৩৩ এর (২) এ বলা হয়েছে “গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।” অথচ এর কোনটাই সঠিকভাবে করা হচ্ছে না, এটা কি কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায়?
বলা হলো নির্বাচন করতেই হবে নয়তো সংবিধান অমান্য করা হবে, আর এই নির্বাচন হবে বর্তমান সরকারের অধীনেই। অথচ জনগণ বললো ভিন্ন কথা। জনগণ বললো যে, না ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নয় নির্বাচন করতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এ নিয়ে অনেক মিডিয়া জরিপ চালালো, সেই জরিপের মাধ্যমে উঠে আসলো প্রকৃত চিত্র। বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো জরিপ চালালো যে কত ভাগ মানুষ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় আর কত ভাগ চায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় (প্রথম আলো ৫ নভেম্বর’১৩)। কিন্তু শাসক গোষ্ঠী সেই জনগণের কথা মানলেন না।
যেহেতেু তাদের হাতে শক্তি আছে সেহেতু অন্য যে যাই বলুন তাতে কিছু যায় আসে না, নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে জনগণকে ঠ্যাঙ্গানোর মধ্য দিয়ে হলেও নির্বাচন করতেই হবে, এ বিষয়ে সংবিধানে কি বলা আছে বা হলো তাতে কোন যায় আসে না। সহজভাবে বললে বলা যায় নিজের মতকে দাঁড় করানোর জন্য সংবিধানকে যদি ছিঁড়তে হয়- ছেঁড়া হবে, কাটতে হয় কাটা হবে, ল্যাঙ মারতে হয় তবে তাই করা হবে এরপরও নিজের অসুবিধা হবে এমন কাজ করা যাবে না! তাহলে এমন সংবিধানের দরকারটা কি। যখন যেই গোষ্ঠী শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন তাদের কথায় আমরা চললাম। শাসকরা উঠতে বললে আমরা উঠবো আর বসতে বললে বসবো এমনটা করাই তো মনে হয় ভাল।
অবশ্য এটা শুধু বাংলাদেশে নয় বরং অনেক দেশেই লক্ষ্য করা যায়। আমরা দেখলাম মিসরে এককভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড ৫১ ভাগের বেশি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর বহির্বিশ্বের ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছিনিয়ে নিল আর এখন পর্যন্তও সেটা কুক্ষিগত করেই রেখেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এখন পর্যন্তও কোন গণতান্ত্রিক দেশ এর বিরুদ্ধে শক্ত কথা বলে নাই। অথচ মিসরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই ক্ষমতার পালা বদল ঘটেছিল। আর মজার বিষয় হলো গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা আমেরিকা মিসরের এই অবস্থা দেখেও নিলর্জ্জভাবে বললো যে, মিসর গণতন্ত্রের দিকেই এগুচ্ছে! যেখানে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হলো সেই অবস্থা দেখেও তারা এমন বাজে কথা বলতে পারলো! যেহেতু সেখানে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায় সেহেতু তারা গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় গেলেও সেটা গণতন্ত্র নয় আর সেনা কর্মকর্তারা যেহেতু আমেরিকার পা চাটা গোলাম সেহেতু তারা যাই করুক না কেন সেটাই গণতন্ত্র যদিওবা সেনাবাহিনী ব্রাদারহুড পন্থি হাজার হাজার নেতা কর্মীকে নির্মমভাবে গুলী করে হত্যা করছে! হায়রে গণতন্ত্র!
বাংলাদেশের অবস্থাও আজ এর চেয়ে কম নয়! বিরোধী দলকে ঠ্যাঙ্গানোর জন্য যত রকম পন্থা অবলম্বন করা দরকার বর্তমান সরকার সেটাই করতে প্রস্তুত। যদি কাউকে মারতে হয় মারবে, গুম করতে হয় গুম করবে, হুমকি-ধমকি বা ভয় ভীতি দেখাতে হয় তবে তাই করবে, মামলা দিয়ে বাড়ি ছাড়া বা জেলে দিতে হয় তবে তাই করা হবে অর্থাৎ যখন যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে এরপরও ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে।
বিরোধী দলকে ভালভাবে কোন কর্মসূচী পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। সভা-সমাবেশতো দুরের কথা একটা মানববন্ধন পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি দলীয় অফিসগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অফিসের ভিতরে বসেও যদি কোন বৈঠক করা হয় তাহলে সেটাও নাকি নাশকতার পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আর এই অবস্থায় এমনকি অফিস ভেঙ্গে হলেও সেখান থেকে বিরোধী দলের নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
অথচ আমাদের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে “জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”
এসব বিষয় থেকে এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার আমাদের সংবিধানের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। আর এই কথাগুলো বলতে গেলেই হয় জেলে যেতে হবে নয়তো আপনার বাড়ি-ঘর গুড়িয়ে দেয়া হবে। আমি বুঝি না আসামী ধরার সাথে বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দেয়ার সম্পর্কটা কি?
তাহলে যেখানে জনগণ বা বিরোধী দলকে সহ্যই করা হচ্ছে না আর সংবিধানকে করা হচ্ছে থোরাই কেয়ার তাহলে সেখানে গণতন্ত্র আছে বলে যদি কেউ দাবী করে তাহলে সেটা কিভাবে মানা সম্ভব? এটা হলো “মুখে গণতন্ত্র আর মনে স্বৈরাচার” অবস্থা। স্বৈরতন্ত্রের যতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে বর্তমান সময়ে তার প্রত্যেকটিই মিলে যায়।
উইকিপিডিয়ায় স্বৈরতন্ত্রের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা এমন “স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে একজনের শাসন। স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে কোন বিশেষ ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতা যিনি সে দেশের জনগণ, সংবিধান আইনের রীতি-নীতি অগ্রাহ্য করে এককভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তার একক নির্দেশনায় দেশকে শাসন করে তাকে স্বৈরচারিতা বলা হয়। যখন রাষ্ট্রে এক ব্যক্তির ক্ষমতার মাধ্যমে সকল কাজ সম্পন্ন হয় তাই স্বৈরশাসন। যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা নেতা অগণতান্ত্রিক বা জোর করে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তার অধীনস্থ করে রাখে।”
এই সবগুলো বিষয় ধারাবাহিকভাবে সাজালে এটাই প্রতীয়মান হয় যে বর্তমানে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের তেমন বালাই নেই বরং এখানে চলছে গণতন্ত্রের আবরনে বা চাদরে মোড়ানো এক নব্য স্বৈরতন্ত্র। আমরা যদি সচেতন হয়ে এই স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করতে না পারি তাহলে নির্ঘাত আগামী দিনে এর জন্য আমাদেরকে অনেক বড় মাশুল দিতে হতে পারে। 
0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জিয়ার জনপ্রিয়তার কারণ

শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের অতীব জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বিশ্লেষণ করলে তার জনপ্রিয়তার জন্য নিচের কারণগুলো পাওয়া যায়। প্রথম কারণ, জিয়া হলেন একজন শহীদ। কুরআন মজিদ বলে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বিশ্বাস করে তারাই তাদের প্রতিপালকের দৃষ্টিতে সিদ্দিক (সত্যনিষ্ঠ) ও শহীদের মতো। তাদের জন্য রয়েছে প্রাপ্য পুরস্কার ও জ্যোতি।’ (সূরা হাদিদ, ১৯ আয়াত) জিয়া শাসনতন্ত্রে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত করেন। আর যারা তা সহ্য করতে পারেনি, তারাই তাকে শহীদ করে। দ্বিতীয় কারণ, তিনি নিহত হয়েছিলেন; কিন্তু ব্যর্থ হননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি একটি বৃহৎ ধারার প্রবর্তক, যা গণতন্ত্রায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তৃতীয় কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নামাজে জানাজা তিনিই পেয়েছিলেন। চতুর্থ কারণ, তিনি ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা। বউ-ছেলেকে বিপদের মুখে রেখে তিনি ইয়াহিয়ার হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হন। পঞ্চম কারণ, তার কণ্ঠ থেকে বাঙালিরা তখন স্বাধীনতার ঘোষণা শোনে, যা প্রথমে সবাইকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মতো ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিয়ে শৃঙ্খলার পরিচয় রাখেন। ছয় নম্বর কারণ, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও এবং সব ক্ষমতা ভাগ্যক্রমে তার হাতে আসা সত্ত্বেও তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেন। সাত নম্বর হলো, তিনি ছিলেন মধ্যপন্থী চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক। তিনি বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। আট নম্বর কারণ, প্রথম জীবনে কিছুটা বামের প্রভাবে এলেও তিনি সে লাইন ছেড়ে দেন। তার বন্ধুদের অনেকেই বাম ঘরানার ছিলেন। তার সামনে ছিল ন্যাপ ও জাসদের বাম আদর্শ। তাদের ব্যর্থতায় তিনি তাদের সাথে যেতে চাননি। তার এ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রনায়কোচিত ছিল, যা ব্যর্থ ন্যাপ ও জাসদের চেয়ে তাকে বেশি সফলতা এনে দেয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ধর্মীয় চেতনাবিহীন বাম রাজনীতি তেমন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নয় নম্বর হলো, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা তিনি। বাঙালি ও বাংলাদেশীতে খুব একটা ফারাক নেই, তবে যেহেতু সমগ্র বাংলা মুলুক আমরা পাইনি, তাই বাংলাদেশ সমগ্র বাঙালি কমিউনিটির রাষ্ট্র হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও পশ্চিম বাংলার ভাইরা মূলত কাশী, বৃন্দাবন, মথুরা ছাড়তে পারবেন না বলে আমাদেরই ছেড়ে গেলেন। স্বাধীন বাংলা তখন হতে পারল না। আমাদের অবস্থা এখন ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের মতো। দুই দেশেই ফরাসি ভাষা চলে, তবে আলাদা দুই দেশ। বাংলা ও বাঙালিÑ এ শব্দগুলো মুসলিম সুলতানি আমল থেকে প্রচলিত এবং মুসলমানদেরই দেয়া। এখন যেহেতু বাংলাদেশের বাইরেও বাঙালি আছে (এখানে ১৬ কোটি, আর সেখানে ৯ কোটি), আর আমাদের বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও আরো নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাই রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সঠিক সিদ্ধান্ত; আমরা সংখ্যাগুরুরা বাঙালি, আর সবাই মিলে বাংলাদেশী। বাঙালি ও বাংলাদেশী ধারণার সমন্বয় সহজ। দশ নম্বর হলো, রাজনীতিতে জিয়া ইনকুসিভ’ (অন্তর্ভুক্তকরণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ) চরিত্র আনয়ন করেছেন, যা সবাইকে নিয়ে কাজ করা, এর আগে বঙ্গবন্ধু এটা অনেকটাই শুরু করেছিলেন; তবে শেষ করার সময় পাননি। বঙ্গবন্ধু যেমন অতীতকে পেছনে ফেলে সবাইকে নিয়ে এগোতে চাচ্ছিলেন, শহীদ জিয়া তা আরো বিস্তৃত করলেন। জিয়াকে বাংলাদেশের নেলসন ম্যান্ডেলা বলা যেতে পারে। এগারো নম্বর হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে জিয়া ইসলামি আদর্শকে সঠিক স্থান দেন। এর আগে অবশ্য বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। তিনি বলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান।তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করলেন, মাদরাসা বোর্ড করলেন, ঘোড়দৌড় ও মদপান নিষিদ্ধ করলেন, তাবলিগ জামাতকে ইজতেমার জন্য জমি দান করলেন; সর্বোপরি ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন। সময়ের দাবিতে জিয়া ধর্মের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। বারো নম্বর হলো, জিয়ার আমলে তার শাসনে প্রকৃতই মনে হলো যে, দেশ এখন সত্যিকারভাবে সার্বভৌম। তেরো নম্বর হলো, পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি বহুমুখিতা আনেন। ইন্ডিয়া ছাড়াও চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্ব প্রসারিত করেছিলেন। এর আগে অবশ্য বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে, সেই সাথে চীনের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নের প্রাথমিক চেষ্টা নিয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বে জিয়া খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। চৌদ্দ নম্বর হলো, জিয়ার আমলকে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া সম্পর্কের সমমর্যাদার যুগ বলা যেতে পারে। ইন্ডিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বাংলাদেশকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। তখন দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার পানিচুক্তি হয়েছিল, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করেছিল। পনের নম্বর হলো, জনগণের সাথে জিয়ার যোগাযোগ ছিল সরাসরি। খালকাটা কার্যক্রম তাকে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। ষোল নম্বর, তার জীবনযাত্রা ছিল খুব সাদাসিধে আড়ম্বরহীন। সতের নম্বর, তিনি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন। আঠারো নম্বর, তিনি অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা আনেন। সমাজতন্ত্র করতে গিয়ে শিল্প তথা অর্থনীতির যে সমূহ ক্ষতি হয় তা তিনি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য, আমরা দেখেছি, পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনও অর্থনীতির ক্ষেত্রে আগের অবস্থানে না থেকে অর্থনীতিতে সংস্কার এনেছিল। জিয়া তা আগেই করেছিলেন। উনিশ নম্বর কারণ, তিনি সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
তার সময়ে সামরিক বাহিনীতে অনেক শৃঙ্খলাবিরোধী ঘটনা ঘটে এবং শেষবার তিনি নিহতই হলেন। তবে এটিও ঠিক যে, তিনিই পেরেছিলেন সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা আনতে, যার পরিণতিতে তার বিরুদ্ধে শেষ ক্যুব্যর্থ হয়। অন্য কোনো জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা তার মতো সফল হতে পারতেন কি না সন্দেহ। বিশ নম্বর কারণ, জিয়ার অমর কীর্তি সার্ক। দেশের বাইরেও সবাইকে নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন ছিল তার। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে এই আঞ্চলিক সংস্থা। এর মাধ্যমে তিনি ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের মতো পরস্পর পারমাণবিক শত্রুকেও এক টেবিলে নিয়ে আসতে সফল হন, যা আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটা ধাপ। আজ পর্যন্ত সার্ক পূর্ণতা না পেলেও এর সম্ভাবনা প্রচুর। একদিন না একদিন সার্ক সফল হবেই। তখন সার্কের গুরুত্ব আরো বোধগম্য হবে।


 

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সরকারের গন্তব্য ও শ্রীনিবাসনের প্রেসক্রিপশন


বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত ইস্যু। এ নির্বাচনে প্রত্যক্ষদর্শী পর্যবেক্ষকদের মতে, ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে গিয়ে থাকতে পারেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত দেখা যায়। ভারতীয় শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতেও নির্বাচনে ভোট দেয়ার হার এরচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়নি। এই নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন এক নির্বাচন যেখানে ১৫৩টি আসনে ভোট ছাড়াই সরকার সমর্থকেরা জয়ী হওয়ার রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে। এই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং সিনিয়র মন্ত্রীরাও রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে স্পষ্টত দুটি শিবির দেখা যায়। যার একটিতে ছিল বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত আর বাকি সব দেশ ছিল অন্য পক্ষে। প্রথম পক্ষ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতায় আসতে পারবে এমন একটি নির্বাচন চেয়েছিল। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান সরকারের অধীনে নির্বাচনকে তারা সর্বান্তকরণে সমর্থন করে। দ্বিতীয় পক্ষ মনে করে বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে সেটি এ দেশকে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার পথে রাখতে পারবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রতিবেশী দেশটির তার অবস্থানের পক্ষে বাংলাদেশে প্রকাশ্য তৎপরতা চালানোর বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের আকম্মিক বাংলাদেশ সফরে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের সাথে বৈঠকের পর সাবেক এই প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। সে সময় ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথেও কথা বলেছিলেন।
এ সময় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে মেনে নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ে সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশ্বাস দেন তিনি। সেই আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশ আন্দোলনের কার্যসূচি বাস্তবায়ন থেকে কার্যত নিজেদের সরিয়ে রাখেন। এতে ২৯ ডিসেম্বরের রোড টু ডেমোক্র্যাসি সাফল্য পায়নি। তবে জনগণের অনাগ্রহ ও প্রতিরোধের মুখে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটারের অংশ গ্রহণে। এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ফলে এটি সংবিধানে জনগণের সম্মতিতে সরকার গঠনের শর্ত পূরণ করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এ নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যকে অবশ্য আমলেই নেয়নি সরকার। এমনকি আগের সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আরেকটি সংসদের সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান এবং সে সংসদের ভিত্তিতে সরকার গঠন বৈধ কি না, এর কোনোটার ব্যাপারেই সাংবিধানিক প্রশ্নগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সরকার গঠন করা হয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরপরই সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য পাল্টে যায়। সিনিয়র মন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, সৈয়দ আশরাফসহ একাধিক ব্যক্তি বর্তমান সরকার আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে বলে মন্তব্য করেন। সরকার গঠনের পর কূটনীতিকদের আনুষ্ঠানিক এক সভায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা আগামী মে-জুনের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এটিকে উচ্চাভিলাষী চাওয়া বলে উল্লেখ করে মেয়াদপূর্তি বা মধ্যবর্তী সময়ে নির্বাচনের বিষয় ভাবতে বলেন। সরকারি দলের সিনিয়র নেতা মুহাম্মদ নাসিম আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, বিএনপিকে রাজনীতি করতে হলে আর কোনো ভুলকরবে না বলে দাসখত দিতে হবে।
বাংলাদেশে সরকারের কর্মকৌশল কী হবে, এ ব্যাপারে গত পাঁচ বছর ধরে এখানকার সরকারি নীতিনির্ধারকদের চেয়ে ভারতের কিছু সাবেক নীতিনির্ধারকের বক্তব্যে আভাস অনেক বেশি সুস্পষ্টরূপে পাওয়া যায়। যাদের লেখায় এ ধরনের আভাস বেশি স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় তাদের একজন হলেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন। তিনি বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ভারতীয় হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ অক্সফোর্ডে অধ্যয়নকারী এই ভারতীয় কূটনীতিক তার পেশাজীবনের শেষ পর্যায়ে কমনওয়েলথের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কয়েকদিন আগে তিনি ভারতীয় টেলিগ্রাফ পত্রিকায় অন দি রাইট সাইড অব দি হিস্টরিনামে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন লিখেন। তার এ লেখাটি একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পরামর্শের সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। শ্রীনিবাসন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ২০ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ২৫ শতাংশের বেশি ভোটার অংশ নেয় না; কিন্তু তিনি এটি বলেননি যে ইইউ গঠন হওয়ার পর থেকে এটি হলো ইইউ সংসদের ভোট দেয়ার সাধারণ অনুপাত। অথচ বাংলাদেশে এর আগের বারে (২০০৮) সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল। আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও এর কাছাকাছি হারে ভোট পড়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো ৫ শতাংশের পরিবর্তে শ্রীনিবাসনের দাবি অনুসারে ২০ শতাংশ ভোটারেরও যদি ভোট দেয়া হয়ে থাকে সেটি কিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে।
লেখাটিতে শ্রীনিবাসন শেখ হাসিনার যুক্তি সমর্থন করে বলেন, পৃথিবীর কোনো গণতন্ত্রেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় না। বেগম জিয়ার এ ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি যৌক্তিক ছিল না। কিন্তু তিনি এটি ভুলে যেতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজে। গত চার বছরের আন্দোলনে বেগম জিয়া যেসব কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বলেছেন ঠিক এ কথাই শোনা গিয়েছিল ২০০৬ সালের পূর্ববর্তী সময়ে শেখ হাসিনার মুখে।
সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ব্যাপারে শেখ হাসিনার সাথে সুর মিলিয়েছেন শ্রীনিবাসন। তিনি বলেছেন, সেই নিক্সন-কিসিঞ্জারের আমল থেকেই আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে তারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন না করার মহাভুল করেছিল। এখন তারা নোবেল জয়ী ড. ইউনূসের মর্যাদার ব্যাপারে শেখ হাসিনার দ্বিমতে এবং মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার ইস্যুতে একই ধরনের বৈরিতা দেখাচ্ছেন। কিন্তু কি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অস্বীকার করবে যে উগ্র ইসলামিস্ট হিসেবে পরিচিত জামায়াত হলো বিএনপির প্রধান সহযোগী। গণতন্ত্রের নীতি ও চেতনাকে উচ্চকিত করার চেয়েও পাকিস্তানপন্থীদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোই হলো তাদের প্রধান এজেন্ডা।
 
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, জামায়াতের ব্যাপারে জুজুর ভয় দেখানোর কৌশলটি প্রতিবেশীদের বেশ পুরনো। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তাদের ব্যাপারে এই প্রচারণাই চালানো হয়েছে দলটি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে অচিরেই তারা ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াত ও ইসলামিস্টদের সমর্থক বলে উল্লেখ করেছিলেন। অথচ জামায়াত নিকট অতীতের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেনি। দলটি এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তির রেকর্ড ১১ শতাংশের কোঠায়। দলটি বাংলাদেশে সক্রিয় হওয়ার পর থেকে সব কটি নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে একাধিক সময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করেছে। আসলে জামায়াতের যুক্তি দেখিয়ে ১৯৭৫ সালের পরবর্তী যে রাজনীতি বাংলাদেশে প্রধান হয়ে উঠেছিল সেটির নির্মূল কামনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কর্মসূচি নেয়ার জন্য পরামর্শও দেয়া হচ্ছে।
শ্রীনিবাসন তার লেখার শেষ পর্যায়ে একতরফা নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ভারত ইতিহাসের সঠিক প্রান্তেই থাকবে। এখন শেখ হাসিনার উচিত হবে খালেদা জিয়ার সাথে অর্থহীন সমঝোতার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার সরকার ও ক্ষমতাকে সুসংহত করা। যারা সহিংসতার সাথে যুক্ত ছিল তাদের গ্রেফতার ও দমন করা। ১৯৭১ সালের রাজাকারদের দণ্ড কার্যকর করা। আর সেই সাথে উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতি নজর দেয়া।
 
শ্রীনিবাসন উল্লেখ করেছেন, খালেদা জিয়ার নির্বাচন বয়কট অথবা তাকে সুযোগ দিতে আশু অরেকটি নির্বাচনের দাবির বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মতো আধাসামরিক বাহিনী এর মধ্যে অনেক কিছু করেছে, তাদের সমর্থন অব্যাহত থাকলে শেখ হাসিনার পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বেগম জিয়া এবং জামায়াতের সহিংসতাকেন্দ্রিক অসহযোগ আন্দোলনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিএনপিকে সামনে ভাঙনের মুখে পড়তে হবে। দলটির অনেক নেতাই জনমত জরিপে জেতার সম্ভাবনা থাকার পরও নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিল না। আন্তর্জাতিক চাপও বেশি কিছু করতে পারবে না।
ক্ষমতাকে সংহত করতে কি কি করতে হবে এ ব্যাপারে শ্রীনিবাসনের বক্তব্যে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। তবে নির্বাচনোত্তর সময়ে সারা দেশে যৌথবাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারের নামে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে তার সাথে সরকারকে সংহত করার কর্মসূচির সম্পর্ক থাকতে পারে। শ্রীনিবাসন তার লেখায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত সমর্থনের কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে আগামী দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিবারগুলো থেকে কর্মকর্র্তা ও জওয়ান পর্যায়ে ৭৩ হাজার সদস্য নিয়োগ করার একটি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব বাহিনীকে এমনভাবে বিন্যাস করতে হবে যাতে তাদের সর্বোচ্চ  সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে; কিন্তু সরকারের ইচ্ছার বাইরে কিছু করার ক্ষমতা তাদের থাকবে না। সব কিছুর মূল লক্ষ্য হবে ১৯৭৫ পরবর্তী ধারার রাজনীতির সুযোগ না থাকার স্থায়ী ব্যবস্থা করা। নির্বাচনের আগে মতলববাজ মানবাধিকার নেত্রী হিসেবে বিতর্কিত সুলতানা কামাল বলেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহির্ভূত কোনো দলের রাজনীতি করতে দেয়া উচিত নয়। সরকারি দলের নেতারা মহাজোটের বাইরের সব দলকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরের দল হিসেবে চিহ্নিহ্নত করে থাকে। সুলতানা কামালের দাবি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে আবার ৭৫ পূর্ববর্তী সময় ফিরে আসতে কোনো বাধা হয়ত আর থাকবে না। এ দেশ স্থায়ীভাবে পরিচালিত হবে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছায়। 


 

বুধবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

স্বৈরশাসকদের শেষ পরিণতি : প্রেক্ষিত হাল আমলের স্বৈরশাসন


দুনিয়ার ক্ষণকালের ক্ষমতা বা অক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করে কিছু মানুষকে মানবতার কল্যাণে বাছাই করতে চান। সে বাছাই পরীক্ষায় অনেকে অঙ্কুরে ঝরে যায়। ক্ষমতান্ধ হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অবিবেচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশ, জাতি, সমাজ, পরিবারের উপর নিজের নিষ্ঠুরতাকে চাপিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। আর যারা অক্ষম তারা শাসকবর্গের আশ্রয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়, তাদেরকেও আল্লাহ ক্ষমতা না দিয়ে তাদের মনের অবস্থা নিরীক্ষণ করতে চান। যুগে যুগে অনেকে ক্ষমতাসীন হওয়ার সুবাদে দেশ-জাতিকে নিজের মতো ভালবেসে জনগণের মনের মানুষ হিসেবে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। আর স্বৈরাচারী শাসকরা ধরার বুকে অসাম্য ও অন্যায়ের দাবানলে দ্বগ্ধ করে বণী আদমকে পদপিষ্ট করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে চরম নিষ্ঠুরতম পথ বাছাই করে নেয়। ফেরাউন ছিলেন প্রাচীন দুনিয়ার নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসক। তিনি নিজেকে পুরো দুনিয়ার মালিক বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন-“আনা রাব্বুকুমুল আলা”। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে নমরুদসহ অনেকে। ক্ষমতার উত্তাপ সবাই সহ্য করতে পারে না। তাই ক্ষমতার উত্তাপে সবাইকে জ্বালিয়ে ছারখার করে ফেলতে চায়। তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে খুব কম মানুষ।
আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় নতুন করে অ্যাডলফ হিটলার স্বৈরতন্ত্রের সূচনা করেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নানা দেশ নানা ভাবে স্বৈরতন্ত্রের শিকলে আবদ্ধ করে দুনিয়াকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে নব্য স্বৈরশাসকরা। কেউ ঘোষিত স্বৈরশাসক আবার কেউ বা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরশাসক। স্বৈরশাসকদের শাসনে মানবতার অপমৃত্যু ঘটে। মুক্তিকামী মানুষ ফুঁসে উঠে। শুরু হয় শাসক ও শোষিতের লড়াই। কোথাও সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসক কোথাও বা তথাকথিত নির্বাচিত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। যার শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ। শুরু হয় জনগণের রাষ্ট্রব্যবস্থা। শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে নির্বাচনে জালিয়াতি, নির্যাতন-নিপীড়নের পথকেই বাছাই করে নেয়। এক সময় প্রতিবাদী মানুষের লাশ, আন্দোলন ও বিদ্রোহে কেঁপে উঠে স্বৈরতন্ত্রের সালতানাত, নেংটি ইঁদুরের মত লেজ গুঁটিয়ে পালানোর পথ খুঁজে। স্বৈরশাসক মহারাজা-নবাব-বাদশাহগণ বিদায় নিতে বাধ্য হন। তাদের লাঞ্ছনা, অপমান, অপদস্থতা হয় জীবনের শেষ উপহার। দুনিয়ার স্বৈরশাসক হিসেবে যারা পরিচিত তারা বঞ্চিত-শোষিত মানবতার ঘৃণার পাত্র। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও এর থেকে মুক্তি পায়নি। সহজ সরল মানুষগুলোকে দাবার গুঁটি বানিয়ে ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট করেছে শেখ মুজিব ও জেনারেল এরশাদ। এখন একই পথে হাঁটছেন শেখ হাসিনা! লোকে বলে শেখ হাসিনা হিটলারকেও হার মানিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী! আসলে কি তাই? তাহলে শেষ গন্তব্য কোথায়?
দার্শনিক এ্যারিস্টটল বলেছেন, রাষ্ট্র মানুষের একটি স্বভাবগত কার্যক্রম। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক। মানুষের প্রকৃতিই তাকে রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি আরও বলেছেন, যে মানুষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রয়োজনবোধ করেনা, সে হয়ত মানবেতর জীব, না হয় মানব প্রজাতির ঊর্ধ্বে কোন সত্তা। এরই ধারাবাহিকতায় সমাজ, গোষ্ঠী, কওম বা জাতির প্রধান সৃষ্টি। তারাই নিজেদের তৈরি আইনের মাধ্যমে পৃথিবীকে করালগ্রাস করতে চায়। পৃথিবীব্যাপী এমন কিছু স্বৈরশাসকের পরিচয়, শেষ পরিণতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নীতির সারসংক্ষেপ বর্ণনা মাত্র-
অ্যাডলফ হিটলার : অ্যাডলফ হিটলার ছিলেন জার্মানির সর্বকালের সেরা স্বৈরশাসক। ফ্যাসিবাদের জনক হিটলারের রাজ্য জয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। ৬০ লাখ ইহুদিকে পরিকল্পনা মাফিক হত্যা করা হয়। ইহুদি নিধনের এই ঘটনা ইতিহাসে হলোকস্ট নামে সবাই জানে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে হিটলার বার্লিনেই ছিলেন। রেড আর্মি যখন বার্লিন প্রায় দখল করে নিচ্ছিল সেরকম একটা সময়ে তিনি ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তিনি ফিউরার বাংকারে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। তার ক্ষমতা আর দাম্ভিকতা তাকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
বেনিতো মুসোলিনি : ইতালির মুসোলিনিও হিটলারের মতো বক্রপথ অনুসরণ করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিণতি তাকেও বরণ করতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সবদিক থেকে বিধ্বস্ত ইতালির ভিক্টর ইমানুয়েলের গণতান্ত্রিক সরকার ও জার্মানির হিন্ডেনবার্গ সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনিও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর হিটলারের মতো তার চেহারাও পাল্টে যায়। পরবর্তীতে স্বৈরাচারী ও একনায়ক হিসাবে আবির্ভূত হন। মুসোলিনি সুইজারল্যান্ডে পালাবার সময় কম্যুনিস্ট প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, পরে তাকে হত্যা করা হয়। দুজনের বিস্তার ও মৃত্যুর মধ্যে কি অসাধারণ মিল! আজ দু’জনের রাজনৈতিক দলই দুদেশে নিষিদ্ধ।
নেপোলিয়ান : ফ্রান্সের নেপোলিয়ান, তার বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিলো মাদ্রিদ থেকে মস্কো পর্যন্ত, সম্রাট হন তিনি ফ্রান্স এবং অর্ধ পৃথিবীর। পৃথিবীর মানুষ তাকে মনে রাখবে একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে। কিন্তু কিছু মানুষ তাকে বেশিদিন রাজত্ব করতে দেয়নি এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একটু ইতিহাসের পাতা থেকে ঘুরে আসলে দেখা যাবে, ফরাসী জাতি সারা বিশ্বে একটি সম্মানিত জাতি, ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দু। আর ফ্রান্সের এই সফলতার একমাত্র নায়ক নেপোলিয়ান। নিজের দেশে সম্রাট ছিলেন মর্যাদাবান। কিন্তু বাইরের দেশে তার রূপ ছিলো ভিন্ন। সম্রাটের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অন্য দেশের জন্য হুমকি বলে মনে করা হত। তাই তারা তাকে ভাল দৃষ্টিতে দেখতে পারেনি। তাই সম্রাটের বিরোধী দলগুলো জোট বাঁধে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে। নিজ দেশের জনমতকে উপেক্ষা করে তার সম্রাজ্য সাম্প্রসারণের প্রধান শত্রু ব্রিটেন, ক্রোয়েশিয়া ও রাশিয়াকে ধ্বংস করে দেশ দখলের নিমিত্তে নেপোলিয়ান ৫ লাখ সৈন্য নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন। কিছু দেশ তার আয়ত্বে চলে আসে। রাশিয়া, ব্রিটেন ও ক্রোয়েশিয়া নেপোলিয়নের বেপরোয়া সম্রাজ্য সম্প্রসারণ ঠেকাতে চুক্তিবদ্ধ হয়। শক্র বাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আক্রমণে নেপোলিয়ান পরাজিত হয়ে পড়েন এবং এক সময় তিনি রাজত্ব হারান। ক্ষমতাধর নেপোলিয়নের একনায়কতন্ত্রের মসনদ তাকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে অপদস্থ ও অপমানিত করে স্বৈরশাসকদের তালিকায় যুক্ত করেছে। ক্ষমতান্ধতা তার অভূতপূর্ব জনকল্যাণকর কাজসমূহকে ম্লান করে দেয়।
হোসনী মোবারক : মিসরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলীর পর হোসনী মোবারক সে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক। আরব বিশ্বে লম্বা সময় দেশ শাসন করছেন অনেকে। হোসনী মোবারক তাদের অন্যতম। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর সেনাবাহিনী এক সদস্য কর্তৃক তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাত নিহত হওয়ার পর হোসনী মোবারক ক্ষমতায় আসেন। জাতীয় নির্বাচনে পার্লামেন্ট অনুমোদিত মাত্র একজন প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন সেই প্রার্থী ছিলেন হোসনী মোবারক। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার দায়ে বিশ্বজুড়ে তিনি নিন্দিত। মিসরে গণজাগরণের মাধ্যমে তাকে লাঞ্ছিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। আর বর্তমান মিসরের রাজনৈতিক উত্তপ্ততার জন্য তাকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দায়ী করছেন।
সাদ্দাম হোসেন : ইরাকের স্বৈরাচারী একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের পতন হয় ২০০৩ সালে। সে সময় ইরাকে বহু অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও রক্তক্ষয় দেখা গেছে। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর তার হত্যাকা- নিয়ে মূল্যায়নের শেষ নেই। বলা হয়ে থাকে একনায়তান্ত্রিক শাসন ও অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব না দেয়ায় তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে পশ্চিমা বিশ্ব। আর তাই তাকে জনমত নিয়ে জনসম্মুখে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। বিদেশী প্রভুদের যতই হস্তক্ষেপ থাকুক না কেন জনগণ যদি তার সাথে থাকত তাহলে হয়তবা এই পরিণতি হত না। সাদ্দামের জনবিচ্ছিন্ন বেপরোয়া শাসননীতিতে মার্কিনীরা যেমন তাকে ক্ষমতা”্যুত করতে সচেষ্ট হয় একি ভাবে ইরাকী জনগণও তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। তার স্বৈরনীতির শেষ ফল হিসেবে মার্কিন সেনারা তাকে টেনেহিঁচড়ে গর্ত থেকে বের করে এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলায়। এ ধরনের শাসকরা তাদের স্বৈরনীতির কারণেই লাঞ্ছিত হয় বা মৃত্যুমুখে পতিত হয় শুধু তাই নয় বরং একটি জাতিকেও মেরুদ-হীন করে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দেয়।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি : লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি জনপ্রিয় ‘ব্রাদারলি লিডার হলেও তিনি মূলত একনায়ক, স্বৈরশাসক হিসেবেই পরিচিত। দীর্ঘ ৪২ বছর তিনি এক হাতে শাসন করেছেন উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া। দেশ-বিদেশে সুনামের পাশাপাশি তাকে নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। গাদ্দাফি ফিলিস্তিনের ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’র একজন ভক্ত হলেও পশ্চিমাবিরোধী নীতির কারণে গাদ্দাফিকে পশ্চিমারা সব সময়ই নেতিবাচক চোখে দেখেছে। কূটনৈতিক অঙ্গনেও তার প্রতি দৃষ্টি তেমনই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান নিজেই গাদ্দাফিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে অভিহিত করেন। তারা একাধিকবার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেষ্টা চালায়। সর্বশেষ বিদ্রোহীরা তার বাব আল আজিজিয়া প্রাসাদ দখল করে নেয়। সেখান থেকে তার আগেই পালিয়ে যান মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তার পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্য দিয়েই মূলত গাদ্দাফির পতন ঘটে। তারপরও তার অনুগতরা লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। সর্বশেষ তারা তার জন্মশহর সির্তে অভিযান চালায়। সেই অভিযানেই গুলিবিদ্ধ হন গাদ্দাফি। দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন থাকার সুবাদে তার মাঝে স্বৈরতান্ত্রিকতা জেঁকে বসে। এমন সুযোগেই জেনারেল গাদ্দাফির পতনের জন্য তার কাছের লোকরাই শত্রুদের সাথে হাত মিলায়।
রবার্ট মুগাবে : জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে, ১৯৮০ সালে দেশটি ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মুগাবে শাসন ভার নিয়েছেন। ৩৩ বছর ধরে তার শাসনই চলে আসছে। নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মুগাবে ৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। যদিও বিরোধীরা এ নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন বলে দাবি করেছেন। দেশটিতে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলন ও সহিংসতার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
বাশার আল আসাদ : সিরিয়ার বাশার আল আসাদ গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে বিরোধী সকল মতকে উপেক্ষা করে স্বীয় মতকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আসাদ বিরোধীরা প্রতিবাদ করে। শুরু হয় তার দমন-পীড়ন। এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য বিরোধীদের উস্কাতে থাকে এবং আসাদ সরকারকে পরাস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে সিরিয়াতে আসাদ সরকার ও বিরোধী জোট এক ভয়াবহ সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যদি আসাদ ও তার বিরোধী জোট সমস্যা সমাধানে না পৌঁছে তাহলে দেশটিতে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটবে এবং সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব যে ভাবে মাথা ঘামাচ্ছে তাতে এর অবস্থা ইরাকের চাইতেও ভয়াবহ হবে। প্রতিনিয়ত সরকার ও বিরোধীদের সংঘর্ষে বেসামরিক বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এর সমাধানে আসাদের লক্ষ্যণীয় ভূমিকা না থাকায় দেশাভ্যন্তরে আসাদের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠছে আবার অন্যদিকে বহির্বিশ্বও মাতব্বরি করছে। এতে স্পষ্ট যে আসাদের স্বৈরনীতিই তাকে অপদস্ত করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ক্ষমতাচ্চ্যুত করবে।
স্বৈরশাসকের ভূমিকায় শেখ মুজিব : শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে এসে ৭২-৭৫ সাল নাগাদ প্রায় ৪৪ মাস সরকার চালিয়েছেন। ৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের একচ্ছত্র নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে মেনে নেয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল তারই। সেটা তার আইনগত অধিকার ছিল। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য তখন সামরিক জান্তা ও জুলফিকার আলী ভূট্টোর প্ররোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের ওপর সামরিক আক্রমণ চালানো হয়। এই জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক নেতাই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করে। সরকারি মালিকানা ছাড়া সকল খবরের কাগজ বন্ধ করে দেন। এমনিভাবেই তিনি একজন সিভিল ডিক্টেটরে পরিণত হয়েছেন। সকল সরকারি কর্মচারীকে একদলের সদস্য ঘোষণা করলেন। দেশের সেনাবাহিনীকেও একদলের সদস্য করা হলো। তিনি আমরণ রাষ্ট্রপতি থাকার ব্যবস্থা করলেন। কেন বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় নেতা এমন কাজটি করলেন তা আজও দেশবাসী জানে না। হয়ত ক্ষমতা লাভের নেশাই এক্ষেত্রে তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। অনেকেই মনে করেন, তিনি সিপিবির প্ররোচনায় একাজ করেছিলেন। শেখ মুজিব যদি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম না করতেন তাহলেও তিনি হয়ত নির্বাচনের মাধ্যমে বহু বছর ক্ষমতায় থাকতেন। সেটাও এক ধরনের একনায়কতন্ত্র হয়েই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকত। যার পরিণতিতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে তাকে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার মাধ্যমে জীবন দিতে হল। অপরদিকে পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে ক্ষমতা গ্রহণ করে জেনারেল জিয়াউর রহমান বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যান। নিষিদ্ধ পত্রিকাগুলো চালু করার নির্দেশ দেন। দেশে সকল মত ও পথ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। যা সাধারণত, কোন সামরিক শাসক করেন না। জিয়াউর রহমান ছিলেন ফ্রান্সের দ্য গলের মতো একজন জনপ্রিয় শাসক। দু’জনই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করেছেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন।
স্বৈরশাসক এরশাদ : সাবেক সেনা শাসক হিসাবে সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কারণেই এইচ এম এরশাদের পতন হয়েছিল। যার বিচার বাংলাদেশের আদালতে হয়নি। বরং তিনি সংসদ সদস্য হিসাবে এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দুই যুগ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোর পর এরশাদ গ্রেফতার হলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না-আসা পর্যন্ত কারারূদ্ধ থাকেন। বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। । ছয় বছর অবরুদ্ধ থাকার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার মধ্যে মূল ধারার তিনি চেয়ারম্যান। দলের প্রবীণ নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে আরো একভাগ হল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এরশাদ বর্তমানে আওয়ামী জনবিচ্ছিন্ন পাতানো নির্বাচনে প্রকাশ্যে সমর্থন না দেয়ায় সরকারি হেফাজতে রোগী সাব্যস্ত করে সিএমএইচএ ভর্তি করিয়ে তার স্ত্রী রওশনকে এ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট বানিয়ে জাপাকে নির্বাচনের আনার হাস্যকর আয়োজন করে। জাতির সামনে তা দিবালোকের মত স্পষ্ট; যা ঘৃণার, লজ্জার ও অপমানের। আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় এরশাদ একাধিকবার সংসদ নির্বাচিত হয়েছেন সত্য; কিন্তু তাই বলে তার গায়ে লেগে থাকা স্বৈরশাসকের কালি একটুও মুছে যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে যতগুলো দুর্নীতির মামলা ছিল, সবগুলোর বিচার হলে তার কারাদ-ের মেয়াদ সবচেয়ে আলোচিত হত। আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি বলেই একদা স্বৈরশাসক এখন গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক দল ও নেতা-নেত্রীদের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছেন। নব্বইয়ের পর জাসদের নেতা ও বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তার বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছিলেন। সেই মামলার খবর কী? গত দুই দশক স্বৈরাচারের হাত ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে ছিল। আর তাই এরশাদ একবার একেকরকম কথা বলছেন। বছর খানেক ধরেই এরশাদ মহাজোটের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুলে আসছিলেন যে এ সরকার দুর্নীতিবাজ ও দেশ শাসনে ব্যর্থ। অতএব এ সরকারের সঙ্গে তার কোনো রকম আপস নেই। তিনি বহুবার মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেভাবে মহাজোট ছেড়েছেন, সেটি নাটক নয়, প্রহসনের অংশ। আওয়ামী লীগ মুলা ঝুলিয়ে তিনটি পূর্ণ, দুটি অর্ধমন্ত্রী এবং একটি উপদেষ্টার পদ তাদেরকে দিয়েছে। বর্তমানে প্রহসনের নির্বাচনে মূল বিরোধী দলকে বাইরে রেখে ক্ষমতায় যেতে আওয়ামী লীগ ৬টি মন্ত্রী পদ (!) দিয়েছেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মে শুল্ক কর্তৃপক্ষ প্রতিরক্ষা বিভাগের আমদানি করা এক কোটি টাকা মূল্যের ১৭ হাজার ছয়টি ঘড়ি আটক করে। সেনা গোয়েন্দারা সংশ্লিষ্ট শুল্ক কর্মকর্তা আবদুর রউফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যান। এরপর রউফ রহস্যজনকভাবে মারা যান। তাকে অবশ্যই নির্যাতন করা হয়েছিল। সরকারের মুখপাত্র সব সংবাদপত্রকে সরকারের দেয়া প্রেস রিলিজ ছাপার নির্দেশ দেন। রউফের স্ত্রীকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ১৯৮৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে বছর দেয়া শিল্পঋণের ৫০ ভাগই ২২ জন ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করা হয়, যারা এরশাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৮৫ সালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির এক কোটি টন গমের এক-তৃতীয়াংশ এরশাদের রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মাধ্যমে তছরুপ করা হয়। নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এরশাদ পীরদের ব্যবহার করেছেন। আগের রাতে স্বপ্ন দেখে শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদে যেতেন বলে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছেন। এরশাদ নিজের স্বার্থে এ অবৈধ কাজ করায় রাষ্ট্রের ৬৬.০৪ কোটি টাকা লোকসান করেছেন। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই এ মামলার কার্যক্রম শুরু হলেও এখন পর্যন্ত বিচারকাজ শেষ হয়নি। আমাদের সমাজে যে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ রয়েছে, তার কিছুই এরশাদের নেই। তিনি অনেক নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করেছেন। এরশাদ সম্পর্কে তারই একসময়ের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান লিখেছিলেন: ‘আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগে সামরিক প্রশাসক কীভাবে তাহার প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া স্বৈরতন্ত্র চিরস্থায়ী করিবার সমস্ত কৌশল নিয়োগ করিয়াছে এবং অন্যান্য স্বার্থবাদী মহল ও জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে তাহার অনুকূলে সমর্থন জোগাইয়াছে তাহারই একটি চিত্র এই বইয়ে আঁকিবার চেষ্টা করিয়াছি।’ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে যে স্বৈরশাসকের সঙ্গে সহাস্যবদনে শুভেচ্ছাবিনিময় করেছেন, যাকে গণভবনে ডেকে আপ্যায়ন করেছেন, সেই শেখ হাসিনাই ১৯৯১ সালে বিরোধী দলের নেত্রী থাকতে তাকে অবিলম্বে জেলখানায় পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার বক্তব্য ছিল এরূপ, ‘মাননীয় স্পিকার, সংসদ নেত্রী (খালেদা জিয়া) নির্বাচনের পূর্বে সাত দিনের মধ্যে এরশাদের বিচার এবং ফাঁসির দাবি করেছিলেন। এখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী, আজকে আমরাও বলতে চাই তিনি এখনো কেন এরশাদকে শায়েস্তা করতে পারেননি? শেখ হাসিনা এরশাদের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা নেননি বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বিএনপি আমলে যাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জেলখানায় পাঠানো এবং বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁর দুই মেয়াদের পুরো সময়টাই তাঁকে কারাগারের বাইরে রেখেছেন। যদিও খালেদার প্রথম শাসনামলের পুরো সময়টাই তিনি জেলে ছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ আমলে এরশাদ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোট করার পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সব চোর এক হয়েছে। এখন সেই ‘সব চোরের’ পালের গোদাকে তিনিই সসম্মানে বরণ করে নিলেন। তার দল থেকে ছয়জন মন্ত্রী এবং একজন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিলেন। নূর হোসেন-তাজুলদের আত্মা আপনাদের ক্ষমা করবে কি?
স্বৈরশাসনের পথে শেখ হাসিনা : শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নিজের মতো করে দলীয় আদর্শের ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করেন, সংবিধানকে উলট-পালট করে আইনের বুলি আওড়িয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মানসে দেশকে চরম অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন শেখ হাসিনার আসপাশে যারা আছেন তারা তাকে ঘিরে রেখেছেন, তৈলমর্দন করছেন ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে বাধ্য করছেন। কারণ সে ক’য়েকশ দলীয় ও আমলা ব্যক্তি এত বেশী দুর্নীতি ও অপকর্ম করেছেন যে ক্ষমতা হারালে কারো রক্ষা হবে না বলে তারা ভয় করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর নির্বিচারে গুলীতে এত লোকের হানাহানির ঘটনা কখনো ঘটেনি। হাসিনা সরকারের এহেন আচরণের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিবাদও করার সুযোগ নেই। বিরোধীদলীয় অফিসগুলো বন্ধ করে রেখেছে মাসের পর মাস। সব বক্তব্য শুধু ওনাদের, শুধু ওনারাই বলবেন; বিরোধী দলগুলোর কিছুই বলার বা মতপ্রকাশের সুযোগ নেই। সভা-সমাবেশে গুলী, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এখন আইন-শৃংখলা বাহিনীর নিয়মিত দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করে নির্মম নির্যাতন এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গুম-হত্যা এখন বিরোধী শিবিরের সকল নেতাকর্মীকে তাড়িয়ে বেড়ায়। রিমান্ডের নামে যে নির্যাতনের খড়গহস্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাতে অনেক নিরপরাধ মানুষকে জীবনের তরে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। যা সভ্যসমাজে কখনো চিন্তাও করা যায় না। দেশের সকল বিরোধী মতকে দমনের জন্য হাজার হাজার সাজানো মামলায় জড়িয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদ-ের ফ্রেমে পিষ্ট করছে। অতীতের যে কোন স্বৈরশাসককে হার মানিয়েছেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে দেশাভ্যন্তরে আসন্ন ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে দেশ বাণিজ্যিক অবরোধের মুখে পড়তে পারে। ভারতনির্ভর শেখ হাসিনা তার অবস্থান কি তাহলে স্বৈরাচারীর তালিকায় এক নাম্বারে নাম লিখাতে চলছেন? হয়ত বা তার এমন পরিনতির জন্য দেশবাসীকে আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতে হবে। ইতিহাস এটিই বলে।
৭২-৭৫ এ দেশের রাজনীতিতে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো এখন হুবহু সেই পরিবেশই বিরাজ করছে। জীবনযাপনের সকল উপকরণের ব্যাপক দাম বেড়েছে। কোথাও কেউ সরকারি নির্দেশ মানছে না। দেশের দশভাগ লোকের নেতারা ৯০ ভাগ মানুষের ধর্ম নিয়ে তামাশা শুরু করেছেন। একসময় মরহুম শেখ মুজিব বলেছিলেন বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। তিনিই ভারতের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও শেখ মুজিব সেটা আমলে নেননি। তিনি নিজেকে একজন মুসলমানই মনে করতেন। মুজিবকন্যা এখন যাদের দলে তুলে নিয়ে ক্ষমতায় এককভাবে টিকে আছেন তারা সবাই তার মেকি শুভাকাঙ্খী । তিনি কি ভুলে গেছেন? তার পিতার খুনের পর তার লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে বিদেশ পালিয়ে তাকে ফেরাউন বলে গালি দিয়েছে। এছাড়া পৃথিবীব্যাপী যত স্বৈরশাসক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে জেঁকে বসেছিল, কারো পরিণতিই শুভকর হয়নি, শুধুমাত্র তাদের একঁগুয়েমী ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য। এদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু রয়েছে বাংলাদেশের। স্বৈরাচারী কোন শাসক যখন একটি জনবসতির উপর কর্তৃত্ব লাভ করে তখন তারা সেই জনপদের মানুষদের ধ্বংস করে ফেলে। তারা সবচেয়ে বেশী অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে জনপদের সম্মানিত ব্যক্তিদের। আমরা আমাদের এই জনপদে অনেক স্বৈরশাসককে দেখেছি। আমাদের আশপাশের দেশেও বহু অত্যাচারী স্বৈরশাসক ছিল। তারা কেউই আজ আর নেই। ইতিহাসের পাতা থেকেও আমরা বহু অত্যাচারী ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বৈরশাসকের কথা জেনেছি। ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য এখনও বহুদেশের শাসকরা যুদ্ধে নেমেছে। তারা কখনই সফল হবে না। বাংলাদেশেও কোন শাসকের এই অপচেষ্টা সফল হবে না। মহান আল্লাহ এই জনপদকে ইসলাম ও মুসলমানের জন্য তৈরি করেছেন। তিনিই মুসলমানদের কল্যাণে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন।

Ads