বাংলাদেশে বিপন্ন গণতন্ত্র ও মানবতা
পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। কিন্তু দেশে কতটুকু গণতন্ত্রের চর্চা আছে তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। অতীতে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর কালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থেকে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতার হাল ধরেন। তখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে গণতন্ত্র বিদায় দিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতা শুরু হয়।
স্বাধীনতা উত্তর কালে দেশে রক্ষীবাহিনী সহ বিভিন্ন ঠ্যাংগাড়ে বাহিনী গঠন করা হয় এবং তাদের মাধ্যমে বিরোধী দলের উপর নিপীড়ন নির্যাতন চালান হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন করে ভিন্ন সকল দলের অস্তিত্ব বিলোপ, চারটি সংবাদ পত্র ব্যতিত অন্য সকল সংবাদ পত্রের বিলুপ্তি সহ জেলা গভর্নর নিয়োগের মাধ্যমে দেশে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
এ দেশে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই দেশে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী যখন নির্দেশ দেন একটির বদলে ১০টি লাশ ফেলাতে, যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী তাদের দলের পেটুয়া বাহিনীকে নির্দেশ দেয় ‘জামাত শিবির যেখানে দেখ শেষ কর', তখন দেশে গণতন্ত্র আছে কেমন করে বিশ্বাস করা যায় ? যদি কেউ অপরাধ করে তার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে; কিন্তু পুলিশের সাথে দলীয় জনশক্তিকে নিরস্ত্র নিরীহ জনতার দিকে লেলিয়ে দেয়া কোন গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে বলে কেউ মনে করে না। এ গুলোতো নাৎসীবাদী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের কাজ।
ফ্যাসিবাদী শাসক মুসোলিনী যেমন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য নৈশ প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে না' ফ্যাসিবাদী ঐ একই সুর বেজে উঠেছে বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর কণ্ঠে। সাংবাদিক দম্পতি নিহত হওয়ার পরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ‘‘আমি কারও বেডরুমের পাহারার দায়িত্ব নেইনি।’’ তাই মুসোলিনী ও আমাদের প্রধান মন্ত্রীর কথায় পার্থক্যটা কোথায়?
ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী রূপে গণ্য করা হয়। ফাসিবাদে দমন পীড়নের মাধ্যমে জনসাধারণকে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করে। আমাদের বর্তমান সরকারও তেমনি হকের পথে, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জামায়াতসহ বিরোধীদলীয় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্বাধীনতাবিরোধী নামে অভিহিত করে তাদের উপর বছরকে বছর ধরে জুলুম নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরকে মিথ্যা মামলায় জেলের অভ্যন্তরে শাস্তি দিচ্ছে , তাদের দলীয় অফিস জ্বালিয়ে দিচ্ছে, প্রায় দু'বছর ধরে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও মহানগরী অফিস এবং ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস পুলিশ দিয়ে অন্যায় ভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছে, এমনকি তাদের কথা বলার জন্য রাস্তায়ও দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে ফ্যাসিবাদী তৎপরতার সাক্ষাৎ নমুনা হিসাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এমনকি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হাসপাতালে আগুন লাগানো হচ্ছে, ভাংচুর চালানো হচ্ছে। পাঁয়তারা চলছে বিরোধীদলের সমস্ত কর্মকান্ড স্তব্ধ করে দেবার। এর পরেও যদি এ সরকার গণতান্ত্রিক সরকার হয় তা হলে ফ্যাসিবাদী সরকার কোনটি?
নির্বাচনের মাধ্যমে কোন সরকার ক্ষমতায় এলেই তারা গণতন্ত্রী সরকার হবে এমন ধারণা ঠিক নয়। জার্মানিতে হিটলার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সে হয়ে গেল ফ্যাসিস্ট।
হাসিনা সরকারের অবস্থাও এ থেকে ভিন্ন নয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহকে তারা দেশের জন্য বৈরী শক্তি মনে করে তাদেরকে দমনের জন্য তাদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাদেরকে দমনের জন্য খাহেশ অনুযায়ী সমস্ত নিয়ম নীতি লংঘন করে রাতারাতি আইন প্রণয়ন করছে। আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাৎক্ষণিক ভাবে বা স্বল্পমেয়াদী কোন পরিকল্পনা নিয়ে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি এবং ঘাটতিগুলো দূর করা সম্ভব নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন নতুন আইন তৈরী করে বিরোধী দলকে ফাঁসাবার ফন্দি করছে। এর পরেও যদি এ সরকার নিজকে গণতন্ত্রী হিসাবে দাবি করেন তা হলে তার চেয়ে আর বড় মিথ্যাচার আর কী হতে পারে?
অতীত ও বর্তমান সব আওয়ামী সরকারের আমলে এক অভিন্ন কৌশলে দেশে হিটলারী শাসন প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত চলছে। আওয়ামী সরকারের যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় পুলিশ আর ছাত্রলীগ এক দেহে বিলীন হয়ে গেছে। তাইতো দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ নিরীহ ছাত্রদের শিবির বলে পুলিশের সামনে পিটাচ্ছে আর পুলিশ সে নারকীয় যজ্ঞ নীরবে উপভোগ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ শিবিরের উপর হামলাসহ বর্তমানে শিবিরের উপরে আওয়ামী ক্যাডারদের নির্যাতন পুলিশ নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে দেখছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাস কাল ধরে যে ভাবে পুলিশ শিবিরের উপর গুলীসহ নানা বীভৎস নির্যাতন চালাচ্ছে তাতে মনে হয় ওদের দৃষ্টিতে শিবির কোন মানুষের স্তরে নেই। পুলিশের এমন নীচ আচরণ এদেশের বিবেক জাগ্রত জনতাকে নাড়া দিয়েছে। যে কারণে পুলিশের উপর ঘৃণা জমে উঠতে শুরু করেছে।
একটি সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে নাগরিকদের জান-মালের হেফাজত করা, তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সামাজিক শান্তি শৃক্মখলা সুনিশ্চিত করা। নিয়ন্ত্রণহীন কোন শক্তি দ্বারা যদি সামাজিক শৃক্মখলা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয় তা হলে সরকারকে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার স্বয়ং নিয়ন্ত্রণহীন। সরকার দলের নেতাকর্মী ও আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রদের সমস্ত অন্যায়, জুলুম, হত্যা, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্যকে বে মা'লুম উপেক্ষা করে চলছে। অপর দিকে পরীক্ষিত উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছাত্র সংগঠনকে দেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। একটি ছাত্রের হত্যার অপরাধকে ছুতা হিসাবে গ্রহণ করে তারা সারা দেশ থেকে শত শত নিরিহ ছাত্রদেরকে ধরে জেলে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের রাজনীতি বন্ধ করার অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। অপর দিকে দেশময় বিভিষিকা সৃষ্টিকারী, বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের পক্ষে ছাফাই গাওয়া হচ্ছে। কি বিচিত্র এই দেশ!
আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য এ দেশ থেকে ইসলামের উৎখাত। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রথম পর্যায়ে বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন ,‘‘আওয়ামী লীগতো এখনও কিছু শুরুই করেনি। শুরু করলে বুঝতে পারবেন যে আওয়ামী লীগ কী জিনিস।’’ আওয়ামী মন্ত্রীর এ দম্ভোক্তির তাৎপর্য ও আওয়ামী চরিত্র আজ দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। আওয়ামী লীগ চায় এ দেশ থেকে ইসলামের ঊৎখাত। এজন্য আওয়ামী লীগ প্রাথমিক পর্যায়ে বেছে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামীকে। আওয়ামী সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যু তৈরী করে জামায়াত নেতা কর্মীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষে ফারুক হত্যাকে কেন্দ্র করে ৬৪টি জেলা থেকে জমায়াত শিবিরের নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করে তাদের উপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো শুরু হয়, যা এখনো চলছে। আবার জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে প্রহসনের বিচার বন্ধ ও মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন কালে ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ বিনা উস্কানিতে জামায়াতে ইসলামীর মিছিলে হামলা চালালে এক অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে রমনা থানার এস আই ১২০ জনকে আসামী অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন। অভিযুক্তদের অনেকেই কারাগারে আবার অনেকে এখনও গা ঢাকা দিয়ে আছেন। চলতি সরকারের আমলে জামাত শিবিরের ২০ হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুলেটের আঘাতে পঙ্গু করা হয়েছে শতশত জামাত ও শিবির কর্মী। শহীদ করা হয়েছে বেহিসাবে। ২ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এ অত্যাচার মিসরের ফেরআউন জামাল আবদুন নাসের ও হোসনী মোবারকের অত্যাচারকে যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়। তারস্বরে রাম বাম দলের হাতে গোটা জনগণ কর্তৃক উপেক্ষিত কয়েকজন নেতা চিৎকার করছে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। এ যেন নানীর কাছে মোয়া খাওয়ার আবদার। জামায়াতে ইসলামী ও শিবির রাজনৈতিক ভাবে স্বীকৃত দল, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বৈধ দল। শুধু কি তাই, জামায়াতে ইসলামী গত নির্বাচনগুলোতে এ দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর সমর্থন পেয়ে সংসদে আসন করে নিয়েছে। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ও শতকরা হার ছিল যথাক্রমে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ৩শ' ৬১ ও ৪.২৮%, প্রাপ্ত আসন ১৭টি। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ও শতকরা হার যথাক্রমে ৩২ লাখ ৮৯ হাজার ৯শ' ৬৭ ও ৪.৭০%। এ উপাত্ত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের জামায়াত বিরোধী প্রচারণার ফলে জাতির কাছে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা মোটেই হ্রাস পায়নি বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাইতো আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে উঠেছে জামায়াত নিধন নিসূদন যজ্ঞে। বর্তমান সংসদেও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছে। এমন একটি গণতান্ত্রিক সুশৃংখল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি প্রকৃতপক্ষে এদেশের তৌহীদী জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারকে গলা টিপে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
জামায়াতে ইসলামী সংবিধান পরিপন্থী কোন দল নয়। দেশের প্রথম সংবিধানে রাজনীতির ভিত্তিতে ইসলামী দল করা নিষিদ্ধ ছিল। পচাত্তরের পর সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে ইসলামিক রাজনৈতিক দল করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক অধিকার প্রাপ্ত এমন একটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি পাগলের প্রলাপ মনে করা ঠিক নয় বরং তা প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শক্তির নির্মূল চক্রান্ত।
ছাত্রশিবির নয় বরং ছাত্রলীগই প্রকৃত সন্ত্রাসী। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের ইতিহাস বহুত লম্বা। সমস্ত আলোচনায় না এনে সাম্প্রতিককালের তাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে শিবিরের উপর আক্রমণ, সিলেট এমসি কলেজ আগুন দিয়ে পোড়ান, বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকদের উপরে ন্যক্কারজনক হামলা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ শিক্ষক পেটানোসহ নিজদের অভ্যন্তরীন কোন্দলের জেরে ছাত্রলীগ নেতা রুমান ফকির নিহত, সত্যজিত হত্যাসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যা ও ছাত্রী ধর্ষণের মত ন্যক্কারজনক অপরাধ করেও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী নয় , অন্যদিকে সৎ, খোদা ভীরু, চরিত্রবান ও মেধাবী সংগঠন ছাত্র শিবিরকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে তাকে নির্মূল করার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নির্দেশ জাতিকে হতবাক করে দিয়েছে। জাতি মুক, বিমূঢ় হয়ে যায় যখন দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতা ধর্ষণে সেঞ্চুরি করে শাস্তির বদলে পুরস্কার লাভ করে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে দেখতে হাসপাতালে যায়। এমন পক্ষপাত দুষ্ট সরকার কর্তৃক জামাত শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করার তান্ডবতা দেখে জাতি বিস্ময় বোধ করে না, শুধু লজ্জায় মাথা নিচু করে।
আজ জামাত শিবিরকে স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে আওয়ামী লীগ, এই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগই ১৯৭০ সনের ১৮ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে জামায়াতের ১২ শত কর্মীকে আহত এবং ২ জন কর্মীকে শহীদ করে। তখনতো স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল না, জামায়াত স্বাধীনতা বিরোধী ছিল না, তা হলে তখন কেন এই আক্রমণ? জবাব একটাই, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামের সর্বনাশ সাধন করতে আগ্রহী। আওয়ামী লীগের জন্মই তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। ১৯৪৯ সনে আওয়ামী লীগ তার যাত্রা শুরু করে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। এ পরিচয়েই আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। পরবর্তী আমলে কংগ্রেসী সদস্যদের সমর্থন আদায়ের প্রয়োজনে আওয়ামী মুসলিম লীগ হতে ‘মুসলিম ' শব্দটি তুলে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ তার দলের শীর্ষ থেকে ‘মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়েই খুশি নয়, দেশ থেকে ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য তারা আজ ব্যস্ত। প্রজন্ম চত্বরের নামে গুটি কতক নাস্তিক যুবক যুবতীর নর্তন কুর্দনকে গোটা জাতির চেতনার উন্মেষ মিথ্যা আখ্যা দিয়ে জাতিকে বোকা বানাবার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করতে যখন যা প্রয়োজন তা করতে বড়ই পারঙ্গম আওয়ামী লীগ। ১৯৭২-৭৫-এর শাসন কালে জনগণের উপর চরম নিপীড়ন ও অত্যাচার করে পরবর্তী নির্বাচনের আগে তারা লোক দেখানো ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করেনি। প্রয়োজনে তারা ধর্মীয় লেবাস ও আচরণের মাধ্যমে মানুষকে ধোকা দিতে মোটেই কসুর করে না। '৯৬-এর নির্বাচনের কয়েক দিন আগে শেখ হাসিনাকে দেখান হয়েছে মোনাজাতরত অবস্থায়। এমনকি যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করতে আসেন তখন তাকে তসবিহ জপতে দেখা গেছে। তার এ ধর্মীয় ভাবমূর্তি তৈরির জন্য তথা কথিত ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা কোন প্রতিবাদ করেনি। প্রয়োজনের খাতিরে তারা গোলাম আযমের বাড়িতে ধর্ণা দিতে লজ্জা পায় না। নিজামীর সাথে বৈঠক করতে দ্বিধা বোধ করে না।
জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরকে তারা দেশদ্রোহী বলে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছে। রাজাকার আলবদরদের ফাঁসির দাবিতে জামাত নেতাদের প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু ফাঁসির দাবি তোলার আগে প্রকৃত অপরাধীদের খোঁজ নেয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের তৈরি ট্রাইব্যুনাল, তাদের নিয়োগকৃত বিচারক সাক্ষী সবাই ব্যর্থ হয়েছে জামাত নেতাদেরকে শাস্তি দেয়ার মতো আপরাধ খুঁজে বের করতে। নৈতিকভাবে পরাজিত আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা তাই তারস্বরে চিৎকার দিয়ে বলছে, তখনকার জামায়াতের লোকেরাই ছিল রাজাকার আলবদর। তাই তাদেরকে ফাঁসি দিতে হবেই। এ এক গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচার।
রাজাকার আল বদর সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টস ঃ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড' গ্রন্থের ৮১ পৃষ্ঠায় বলেন, রাজাকার বাহিনী ছিল সরকারি বাহিনী এবং এর পরিচালনার দায়িত্বে নিয়েজিত জনাব আবদুর রহীমকে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটের প্রধান নিয়োগ করেছিলেন। এই গ্রন্থের ৮৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, ১৯৭০ সাল থেকে ই পাকিস্তান আর্মীর প্যারা মিলিটারি হিসাবে গঠিত হয়েছিল আলবদর বাহিনী। এর অন্যতম সংগঠক জনাব মুসলেহ উদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুই এনএসআই-এর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। একই গ্রন্থের ৫০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শান্তি বাহিনী প্রধান খাজা খয়ের উদ্দিনকে জেল থেকে বের করে এনে নিজ বাসায় খাইয়ে দাইয়ে টিকেট কাটিয়ে পাকিস্তান প্রেরণ করেছিলেন। যে খাজা কায়সার চীনস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত হিসাবে মাওসেতুঙ ও চৌ এন লাই-এর সংগে হেনরী কিসিঞ্জারের বৈঠকের বন্দেবস্ত করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের তৎকালীন দুই বৈরী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চীনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই খাজা কায়সার কে বঙ্গবন্ধুই বার্মার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেছিলেন। তাই রাজাকার আল বদরদের শাস্তি দেয়ার আগে তাদেরকে যারা এদেশে পুনর্বাসিত করেছে তাদের বিচার হওয়া আইনের দাবি।
শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু স্বয়ং ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর দালাল আইনে সাজা প্রাপ্ত ও বিচারাধীন সকল ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তারই ব্যক্তিগত নির্দেশে সকলকে এক সপ্তাহের মধ্যে মুক্ত করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর এসব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কর্মকান্ডকে বর্তমান আওয়ামী সরকার ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শেখ সাহেব থেকে আগ বাড়িয়ে বর্তমান আওয়ামী সরকার মূল অপরাধীদেরকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়ে রাজাকার আলবদরদের দায়দায়িত্ব ইসলামপন্থী বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের উপর নানা নির্যাতন চালাচ্ছে কোন শক্তির ইঙ্গিতে তা জাতির পক্ষে বোঝা কঠিন নয়। আশঙ্কা হচ্ছে আওয়ামী লীগ কখন না জানি বঙ্গবন্ধুকেও দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদেরকে ক্ষমা করার অপরাধে? যুদ্ধাপরাধী বলে তোহমৎ লাগায়।
এখন আবার আইন করা হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলিকে শাস্তি দিতে হবে। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষাকারীদের যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে যারা পকিস্তান সৃষ্টির নায়ক ছিলেন তাদের প্রথমে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে তো মুক্তিযুদ্ধেরও প্রয়োজন হতো না। আমাদের জনপ্রিয় জাতীয় নেতারা-শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাষাণী, শহীদ সোহরায়ার্দীসহ প্রত্যেকেই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম লীগতো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অন্যতম রাজনৈতিক দল। তাই পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণের অপরাধে আওয়ামী লীগের সূত্র মতে তারাও কি অপরাধী?
যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রহসন ইসলামী শক্তিকে কোনঠাসা করার এটি একটা অজুহাত মাত্র। কারণ স্বাধীনতার বিরোধীতা দেশদ্রোহীতা নয়, রাজনৈতিক মতভিন্নতা মাত্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগের দিন পর্যন্ত অনেক হিন্দু মুসলিম ব্যক্তি ও পাটি পাকিস্তানের বিরোধীতা করেছিলেন। ভারত স্বাধীন ও পাকিস্তান হাছিল হওয়ার পরে ঐ কারণে কেউই দন্ডিত হয়নি। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে হল উল্টাটা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে যেসব নেতারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য, দেশের কল্যাণের জন্য নিজদেরকে নিবেদিত রেখেছেন, যাদের চারিত্রিক পদস্খলন বা জনস্বার্থ বিরোধী কোন তৎপরতা কেউই লক্ষ্য করেনি, যাদের বিরুদ্ধে কোন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত হয়নি, এমনকি যাদের সাথে নিয়ে বর্তমান আওয়ামী সরকার রাজনীতি করেছে, আন্দোলন করেছে তাদের জব্দ করার জন্য এখন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে কঠিন শাস্তির পায়তারা চালাচ্ছে। এই মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হচ্ছে তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে তাদেরকে নির্বিচারে জেলের প্রকোষ্ঠে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, প্রকাশ্যে তাদেরকে নির্মূল করার জন্য পুলিশসহ নিজস্ব বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর তা ঠেকাতে গিয়ে নিজদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঈমানী চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে যখন তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন দেশময় তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালান হচ্ছে যে তারা পুলিশ পিটাচ্ছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শাসকদের প্রবৃত্তি পূজা ও জনগণের অধিকর হরণে তাদের দুঃশাসন ও সীমালংঘনের কারণে সমাজে বিভিন্ন সময় উগ্রপন্থীর আবির্ভাব ঘটে। সরকারের দুঃশাসন ও সীমালংঘনের কারণে ছাত্রশিবিরকে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। শিবিরের উপর সন্ত্রাসী মিথ্যা অজুহাতে তাদের নির্মূল করার জন্য তাদের উপর বেপরোয়া অত্যাচার চালান হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ছাত্রীদেরও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। এ সত্য উপলদ্ধি করে দেশের আপামর জনতা বিরক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর প্রতি সহানুভুতি হারিয়ে ফেলছে। সমাজের এ অস্থিরতার জন্য সরকারই দায়ী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরকে তাদের স্বাভাবিক কর্মকান্ড পালনে বাধা প্রদানের কারণেই পুলিশের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকার জামায়াত- শিবিরের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাষ্ট্র পক্ষের কার্য কলাপে উদ্বেগ প্রকাশ করে বুদ্ধিজীবীরা লিখছেন, ‘‘সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে ইসলামিক রাজনৈতিক দল করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তা হলে কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যুবলীগকে দায়িত্ব দিলেন যেখানে জামায়াত পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিহত করতে হবে।’’ এ আহবানের পরিণতি কি হতে পারে এ আশঙ্কা করে এক জাদরেল সাংবাদিক সাবধান করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘ইচ্ছে করলে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি করতে তাদের তিন মিনিটও লাগবে না। কিন্তু পরে কী হবে ভেবে দেখার মতো বিজ্ঞতা কিংবা দূরদৃষ্টি সুরঞ্জিত- হানিফদের আছে কি? এখন তারা পুলিশ আর গুন্ডা দিয়ে জামায়াত- শিবিরকে পেটাচ্ছে , ধরে ধরে জেলে পুরছে। কিন্তু নিষিদ্ধ হলে তারা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাবে সামনা সামনি সংঘাতে আসবে না, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করবে।’’ পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে নির্যাতনের মাধ্যমে কোন গোষ্ঠীর পিঠকে দেয়ালে ঠেকালে তারা টিকে থাকার জন্য ফিরে দাঁড়ায়। তাই দেশকে এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র ক্ষমতাসীন সরকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের গণতন্ত্রের চর্চা ও পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে। অসুয়া ও বিদ্বেষ দ্বারা কখন সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। হিন্দু পুরাণে আছে, বেদবতীকে ভোগ করার জন্য রাবণ হাত বাড়াতেই সে তপস্বিনী বললো, তিষ্ঠ। সে তিষ্ঠ বলতেই ব্যস, রাবণ আর এগোতে পারে না। এ কাহিনী থেকে রাবণের অনুচরদের শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন,
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন