শনিবারের পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম হয়েছে শাহবাগের মহাসমাবেশ। এ মহাসমাবেশে আব্দুল কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দাবি করা হয়। সমাবেশে ছাত্র-যুবকসহ নানা শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শাহবাগ-আন্দোলনকে রাজনীতির বাইরে ব্লগারদের আন্দোলন হিসেবেই অভিহিত করা হয়েছিল। কিন্তু গত শুক্রবারের মহাসমাবেশে ভিন্ন রূপ লক্ষ্য করা গেছে। আমার দেশ পত্রিকার শিরোনামে প্রশ্ন করা হয়, ‘চরমপত্র পাঠকারী কে এই ব্লগার ইমরান?' পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমরান কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক তিনি পেশায় চিকিৎসক এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা। শুধু তাই নয়, ইমরান সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানকে ‘রাজাকার' অভিহিত করে সংসদ ভবন সংলগ্ন জিয়া উদ্যানে অবস্থিত শহীদ জিয়ার মাজার নিয়েও কটাক্ষপূর্ণ ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। ব্লগ ও ফেসবুকে ইমরানের যাবতীয় লেখা ও স্টেটাস আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং বিএনপি-জামায়াতের বিপক্ষে বিষোদগারে পূর্ণ। এ নিয়ে ব্লগারদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এদিকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের মহাসমাবেশে শুক্রবারের ঘোষণা নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের সাইট ও ব্লগে চলছে ব্যাপক আলোচনা। অনেক ব্লগার ও প্রতিবাদী যারা তিনদিন থেকে শাহবাগ প্রাঙ্গণে গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, তারা শুক্রবারের ঘোষণার পর থেকে হতাশা ব্যক্ত করছেন। তাদের ক্ষোভ এটা কেন রাজনৈতিক মঞ্চ হলো? এমন হওয়ার তো কথা ছিল না।
গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ মতামত প্রকাশ করতে পারে, বিতর্কও করতে পারে। তবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও বিধি-বিধানের বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হয়। বর্তমান সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছে। এই ইস্যু নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যেও মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একপক্ষ যে কোনোভাবে যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেখতে চায়। আরেক পক্ষ বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। এ পক্ষ আরো বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের প্রকৃত বিচার আমরাও চাই, কিন্তু তা হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও স্বচ্ছ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে যখন জাতির মধ্যে বিভক্তির বার্তা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল তখনই আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায় ঘোষিত হলো। এ রায়ের ব্যাপারে আব্দুল কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এমন কিছু প্রমাণিত হয়নি যার মাধ্যমে তাকে এক মিনিটের শাস্তিও দেয়া যায়। তাই আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সরকার পক্ষও এ রায়ের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নয়। তারা বলছেন, যাবজ্জীবনের রায সঠিক হয়নি, আমরা কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যুদ্ধাপরাধ আদালতের রায় কেউই মানতে চাইছেন না। এ রায়কে উভয়পক্ষই বিতর্কিত রায় হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে শাহবাগ স্কোয়ারে লক্ষ্য করা গেল ব্লগারদের মহাসমাবেশের আয়োজন। ব্লগারদের এ আন্দোলনকে যতই অরাজনৈতিক হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা হোক না কেন, প্রকৃত অর্থে তা ভিন্ন মোড়কে সরকারি ঘরানার রাজনৈতিক জোটের এক কৌশলী সমাবেশে পরিণত হয়েছে। ব্লগারদের ব্যানারে চারদিন ধরে চলা কর্মসূচি গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ ও বাম রাজনৈতিক দল, তাদের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট এবং একই ঘরানার চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী ও নেতাদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা, জয়-বঙ্গবন্ধু' স্লোগানের বাতাবরণে বক্তারা আওয়ামী-বাকশালী কায়দায় ভিন্নমত দলন ও দমনের হুঙ্কার দিয়েছেন। তারা সরকারের অপকর্মের সমালোচনাকারী গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে তা বন্ধ ও বর্জনের ডাক দিয়েছেন। এমন কি তারা বিরোধী মতাদর্শের নাগরিকদের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক আক্রমণ ও দখলের ঘোষণা দিয়েছেন। জামায়াত সমর্থকদের নাগরিকত্ব বাতিল এবং জামায়াত-শিবির সদস্যদের ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ারও দাবি জানানো হয়েছে। এখন পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্লগারদের অরাজনৈতিক একটি প্লাটফর্ম থেকে এসব দাবি উত্থাপিত হতে পারে কিনা?
শুক্রবার ব্লগারদের সমাবেশে বিশেষ রাজনৈতিক ঘরানার সমর্থনপুষ্ট যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তাতে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। সমাবেশে ঐসব দাবির সাথে সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন ব্যক্তি যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন তাকে গৃহযুদ্ধের উস্কানি হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। সরকারি মদদে যদি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয় তাহলে তাকে দায়িত্বশীল কৌশল হিসেবে কোন সচেতন নাগরিক মানতে পারেন না। কারণ ফ্যাসিবাদ ও গৃহযুদ্ধের বাতাবরণে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের হিসেব কষলেও আখেরে সে হিসেবে গরমিল লক্ষ্য করা যায়। এতে শুধু যে ভুল পথের পথিকদেরই ক্ষতি হয় তা নয়, অপূরণীয় ক্ষতি হয় দেশ ও জনগণের। যুদ্ধাপরাধ বিচারের স্বচ্ছতা ও মান নিয়ে শুধু যে দেশেই বিতর্ক লক্ষ্য করা গেছে তা নয় বিতর্ক লক্ষ্য করা গেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোভ হাইন্স ও গ্যাব্রিয়েলা কানাউল যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা মৃত্যুদন্ডসহ সাম্প্রতিক কয়েকটি রায়ের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে অতীত অপরাধের ব্যাপারে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সুষ্ঠু বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দন্ডাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি বলে তারা বিবৃতিতে উল্লেখ করেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিচার কিংবা বিবদমান কোন বিষয়ে মত পার্থক্যের অধিকারকে সব পক্ষেরই মেনে নেয়া প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও সঙ্গত পরিণতি কাম্য হলে সংশ্লিষ্ট সবার আরো ধৈর্যশীল ভূমিকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও, লাঠি সোটার হুমকি, দখল-বেদখল, নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার বাতিলের অসাংবিধানিক ও বেআইনী বক্তব্য সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বড় বিপদ সংকেত। এ বিপদ থেকে বাঁচতে হলে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষ, বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ প্রয়োজন। কারণ ফ্যাসিবাদ ও গৃহযুদ্ধের পাগলামিকে কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক সমর্থন করতে পারেন না। সবাই শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবেন এটাই জাতি আশা করে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন