শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আজন্ম রক্তাক্ত জেরুসালেম নয়


মিনা ফারাহ

জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচন এক নয়। এটি প্রধানমন্ত্রী ভুলে করলেও খালেদা জিয়ার ভুল করার কোনোই অবকাশ নেই। দেশ শাসনের উৎপত্তিস্থল উত্তরাধিকার হলে কাউকে কিছু না জানানোর অধিকার রাজা-রানীদের থাকে, যেমন ইংল্যান্ডের রানী। সরকার কি ২০০৬-০৭-এ বিরোধী দলের কথা সত্যিই ভুলে গেছে? ভুলে গেলে তখনকার পত্রপত্রিকা এবং ইউটিউবের অসংখ্য ফুটেজ থেকে স্মৃতি ঝালাই করা উচিত। বিচারকের রায় নয় বরং রায় যিনি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সাহায্য নেয়ার পর তার রায়ের এক পয়সাও মূল্য নেই। চিকিৎসার জন্য আনুমানিক ৩০ লাখ ১০ হাজার ৫৩১ টাকা সাহায্যের চেক আদান-প্রদানে প্রধানমন্ত্রী এবং বিচারক উভয়ই পশ্চিমের হলে আইনের ফেলোনি বলে গণ্য হতেন। পশ্চিমে এই উদাহরণ ভূরি ভূরি, আইনের বইয়ে ‘কনফিক্ট অব ইন্টারেস্ট।’
৮০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়কের পে মত দিলেও সেটা বিলুপ্ত করে আবারো ১/১১-এর প্রোপট তৈরির ল্েয শেষ বছরে সেনাবাহিনীকে এই পর্যায়ের হেদায়েত অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না (দ্রষ্টব্য : উইকিলিকসে বাংলাদেশ)। ইচ্ছে হলেই সংবিধান কাটাছেঁড়া সস্তা করছে সংবিধানকে। বরং সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ’৭২-এর অবাস্তব সংবিধানের পুরো অবকাঠামো ভেঙে দিয়ে সংবিধানের পুনর্জন্ম দিতে হবে।
সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদে সীমান্তে অবাধ হত্যাকাণ্ড বৈধতা পেয়েছে? রোহিঙ্গা ঠেকাতে সক্রিয় আর বিএসএফ ঠেকাতে নিষ্ক্রিয়? বিজিবির অবস্থা অনেকটাই এই রকম, পাচার করা মুদ্রা ফিরিয়ে আনতে বিদেশীদের সহযোগিতা পাচ্ছি কিন্তু সেটা একমাত্র সরকারি দল বাদে। সুতরাং বিজিবির রহস্যজনক নীরবতায় সরকারের এক মাসের মাথায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড রহস্যজনক। সেই থেকে সীমান্ত, রাজনীতি, ট্রানজিট, সেতু, নদী, পণ্যের বাজার, ইলিশের বাজার সব কিছুই ‘তৃতীয় শক্তির’ দখলে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ এবং রক্তাক্ত সীমান্তে প্রতি বছরই কেন খুন হচ্ছে শুধু এই পারের নিরস্ত্র মানুষ? নিরস্ত্র মানুষ হত্যা অপরাধ হলে সালমান খুরশিদের মতো দিপু মনিও কেন কঠোর অবস্থানে যাচ্ছেন না কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব কাদের প্রতি বেশি? তার কথা, আত্মরার জন্য গুলি করবে বিএসএফ আর বিকাশের মুক্তি হয়েছে আইনি প্রক্রিয়ায়? চাঞ্চল্যকর ফালানী হত্যাকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত থাকা সত্ত্বেও করেননি। এ দিকে মাত্র দুইজন ভারতীয় সৈন্য মারা গেলে পাক-ভারত সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। সামান্য সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার মতা না থাকলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র নিয়ে কি আমরা সুন্দরবনে হরিণ শিকারে যাবো?
সিটি করপোরেশন : অভিযোগ মশারি টানিয়ে ভাত খেতে হয়। উন্নত সেবার নামে রাতারাতি খোকাকে দূর করে পথের কাঁটা দূর করা হলো। এই অভিযোগ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। নির্বাচন কমিশনের সকলেই সরকারের নিজ বাগানের পুষ্প আর বাগানের মালিরা সবাই নিজ হাতে বাছাই করা গোলাপ। দ্বৈতনীতির দোলাচলে আজো পর্যন্ত অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়েই চলছে সিটি করপোরেশন। এ দিকে অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে মতা দেয়ার বিরুদ্ধে ক্রুসেডে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে সাপের মতো ঘিরে ফেলেছে অনির্বাচিত উপদেষ্টারা, যাদের দাপটে মন্ত্রীরা পর্যন্ত বিরক্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয় বরং অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে মতা না ছাড়ার যুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমির আর এক পয়সাও মূল্য আছে কি? তিনি ভালো করেই জানেন, তার এই একগুঁয়েমির জন্য কত মায়ের কোল খালি হবে, কত নারী বিধবা হবে (ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে)। আদর্শের দিক থেকে খালেদার দুর্নীতিবাজ আজিজ কমিশনের সাথে এই কমিশনের পার্থক্য স্পষ্ট করতে গণশুনানির বিকল্প নেই।
গুম-খুন, ক্রসফায়ার : আর কত মৃত্যু হলে যথেষ্ট হবে? স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নয় বরং স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বাভাবিক বেঁচে থাকার গ্যারান্টি কোথায়? চৌধুরী আলম, লিয়াকত, ইলিয়াস আলী, আমিনুল ইসলামসহ অসংখ্য মানুষের স্বাভাবিক বাঁচার গ্যারান্টি ছিল না; নেই গার্মেন্টশ্রমিকদেরও। তাই তো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অপঘাতে চার বছরে খুনের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি, ধর্ষণ প্রায় তিন হাজার, ডাকাতির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯ হাজার, গুম ৫৫৬…। চার বছরের গুম-খুন, ক্রসফায়ার সংখ্যা ও সময় তুলনায় অতীতের রীবাহিনী আর কিনহার্ট অপারেশনেরও রেকর্ড ভেঙেছে। বিশ্বমানবাধিকার কমিশন, টিআইবি, স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ সকলেরই এক অভিযোগ সত্ত্বেও স্ববিরোধী দিপু মনির তৈরি জবাব, সবাই ভুল শুধু তিনিই ঠিক। নির্বাচন সামনে রেখে কঙ্গোর ফ্যাসিবাদী সরকারের মতো পোষা খুনি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড  ঘটানো হচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সর্বশেষ রিপোর্টে তা স্পষ্ট হয়েছে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আরো ভয়াবহ। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া বিরোধী দলের জন্য জরুরি। হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের অভিযোগ নাকচ করার মতো মাটি সরকারের পায়ের তলায় নেই। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সাগর-রুনির খুনিদের র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আনা হবে কবে?
মুজিবীকরণ : আমরা কি বলব পদ্মার উৎপত্তিস্থল হিমালয়, এটাও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, এখানেও সাইনবোর্ড লাগানো হোক। আমরা হয়তো ভাবি, বিশ্বজুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ কিন্তু না, এর প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি প্রভাবিত করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীকে। মহাত্মা গান্ধী প্রভাবিত করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে, যিনি দণি আফ্রিকাকে পার্টাইডÑ মুক্ত করেছিলেন আর গান্ধীবাদের ছাত্র ড. কিং মুক্ত করেছেন কৃষ্ণাঙ্গদেরকে তাদের ৪০০ বছরের নিগ্রোত্বের অভিশাপ থেকে। জীবদ্দশায় ড. কিং যত সংগঠন করেছিলেন, একটিও নিজের নামে নয়। পরে  নামের ধারা ভঙ্গ না করে ভক্তরা করেছেন যতটুকু প্রয়োজন। চাইলে বারাক ওবামার নেতৃত্বে ড. কিংয়ের ছবি দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে আমেরিকার চেহারা পাল্টে ক্রীতদাস বানানোর প্রতিশোধ নিতে পারতো কিন্তু কালোরা সেটা করেনি। সুতরাং এইমাত্রার মুজিবীকরণ প্রজন্মকে ভুল তথ্য দিচ্ছে। ’৩৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত ডাকসাঁইটে জাতীয়তাবাদী নেতাদেরকে পর্যায়ক্রমে ইতিহাস থেকে প্রায় বিলুপ্ত করা শেষ। আওয়ামী মুসলিম লীগের জনক যিনি সেই মওলানা ভাসানী পর্যন্ত বইপুস্তক থেকে উধাও? সামান্য নভোথিয়েটারের লোভ সংবরণ করতে পারলো না মুজিববাদীরা? ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে একটি পরিবারের বিলবোর্ডের আওতায় আনার মধ্যে দিয়ে ’৪৭ আর ’৭১-এর অন্য মহানায়কদের অপমান চূড়ান্ত হয়েছে। যে দিকেই তাকাই সে দিকেই পরিবারতন্ত্র। প্রবাসে পোস্টার মহামারী দেখে বিদেশীরা অবাক, এত জনপ্রিয় লোকটা কে? গণতান্ত্রিক দেশে সবার মতামত গ্রাহ্য করা সাংবিধানিক অধিকার। নবী-মহানবীর সমালোচনা নিষেধ কিন্তু গণতন্ত্রের মানসকন্যার সমালোচনা করলে ছাগল-মামলা কেন? তাহলে সংবিধানের সেই জায়গাটা স্পষ্ট করা উচিত। আমাদের গণতন্ত্র কি মার্কিন গণতন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী? প্রবাসী ভাইয়েরা মুজিব সমালোচকের চাপার দাঁত আর পাসপোর্ট কেড়ে নেয়ার হুমকি দেয়, আবার পান থেকে চুন খসলেই নিজেরা মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে স্লোগান দেয়। মার্কিনিরা মহাশক্তিধর ওবামাকেও খোলামেলা গালাগাল করে যেমনÑ কসাই, খুনি, হারামজাদা, অপদার্থ…। ওবামার বিরুদ্ধে বইয়ের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। টকশোতে শত শত ঘণ্টা ওবামা ধোলাই দণিপন্থী মিডিয়ার বড় ব্যবসা। গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী ডটার অব পিস, বিশ্বনেত্রী সমুদ্রকন্যা বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, নারীর মতায়ন পথ প্রদর্শক, দুঃখী মানুষের কাণ্ডারি, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, দার্শনিক জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা… বুলি?
ড. ইউনূস এবং গালাগাল: সংসদকে স্পিকার বলেন মাছের বাজার, আমি বলি সংসদ হচ্ছে গালাগালির বাজার। ইয়া মাবুদ! সংসদ সদস্যরা এত গালাগালি শিখলেন কোত্থেকে? লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট। জিয়া পরিবারের জন্য কত জানা নেই কিন্তু ইউনূস ধোলাই কাজে অন্তত ৩০ কোটি টাকা খরচা করেছেন সংসদ সদস্যরা। সবাই খারাপ শুধু আওয়ামী লীগ ভালো। সর্বশেষ ওয়াশিংটন পোস্ট। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় অখ্যাত এবং অত্যন্ত নিম্নমানের পত্রিকা যা কেউ পড়ে না। পাঠক! এই পত্রিকাটি মুক্তবাজার অর্থনীতির হেডলাইন সৃষ্টি করে। দেশ-বিদেশে শেয়াল রোগের নাম ‘ইউনূস এপিডেমিকস।’ বাঙালি মুসলমানেরা রবীন্দ্রনাথের নোবেল শত বর্ষ পালন করে আর নোবেলপ্রাপ্ত ইউনূসের চৌদ্দগোষ্ঠী ধোলাই করে।
ড. কামাল হোমরাচোমরা হলে মুসা ভাইয়ের মাথা খারাপ? ড. আকবর আলি খান অম হলে ব্যারিস্টার হক মুই কার খালুরে? এরপর আর কাকে উলঙ্গ করা যায়? নিঃসন্দেহে অপমানের রেকর্ড করার জন্য শেখ হাসিনা গিনিস বুকেও যেতে পারেন। তবে প্রশাসনের মধ্যে দুই ব্লকের কমিউনিস্ট আর একটি তথাকথিত সেকুলারিস্ট ব্লকের ক্রমাগত ইউনূস আক্রমণ সরকারের অঙ্গে গাজী গোলাম মোস্তফার কম্বল চুরির মতো জড়িয়ে গেছে। ভদ্রলোকের অপরাধ, শেখ মুজিব এবং হাসিনাকে টপকে নোবেল পেয়েছেন। আমি নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী পথ না দেখালে মতিয়া কিংবা গাফফার চৌধুরীদের মতো আওয়ামী গোয়েবলসরাও একজন নোবেল লরিয়েটকে এইভাবে গালাগাল আর অপমান করতেন না। প্রশ্ন সংসদে গালাগালের সংস্কৃতি শুরু হলো কেন? পত্রিকার রিপোর্ট এটা প্রভাবশালী মন্ত্রীর হিংসুটে উকিল স্বামীর কাজ। তাই যদি হবে তাহলে ভোট দিয়ে বরং তাকেই প্রধানমন্ত্রী বানালাম না কেন? দুষ্কৃতকারী নিক্সনের কলঙ্ক নিয়ে ড. কিসিঞ্জার কিন্তু পদত্যাগ করেননি বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে অপরাধ করায় নিক্সনকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল। এবার ওয়াটারগেটের মতো আমাদের দায়িত্বহীনদেরও মুখোশ খুলে দিলো বিশ্বব্যাংক।
সংখ্যালঘু : ধর্মনিপে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকলে কমিউনিজমের গঠনতন্ত্রে ডেমোক্র্যাসি থাকবে না কেন? মুসলিম প্রধান সংবিধান এখন না হিন্দু না মুসলমান। ফলে ’৭২-এর দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। জমিদখল, বৌদ্ধবিহার, বিশ্বজিৎ, মূর্তিভাঙা… ধর্মনিরপেতার আয়াতে সাম্প্রদায়িকতার ভার্স? রামকৃষ্ণ মিশন সস্পর্কে মো: নাসিমের বক্তব্য সাম্প্রদায়িক এবং আপত্তিকর। হাজার বছরের বুদ্ধবিহার ধ্বংস হলে যে নাটক হলো, অন্য সময় হলে এর সমাপ্তি হতো বেনগাজি কিংবা বাবরি মসজিদের মতো। বলছি সংখ্যালঘুদের মেরুদণ্ডহীনতার কথা। কমিউনিজমের মধ্যে যেমন গণতন্ত্র ঢুকিয়ে দেয়া যায় না, তেমনিই গণতান্ত্রিক সংসদে কমিউনিজমের চর্চা ফ্যাসিবাদী পার্লামেন্টের পরিচয়। সতীত্বের কোনো ছটাক হয় না। নানান কর্মকাণ্ডে এই সরকার প্রমাণ করেছেন সংখ্যালঘুদের তারা পছন্দ করেন না। প্রশ্ন সংখ্যালঘুরা অন্তত একবার বিড়াল থেকে মানুষ হয়ে উঠবে কি না। অন্তত ভারতের সংখ্যালঘুদের থেকে অধিকারবাদ, জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদের শিা নেয়া উচিত।
বিশ্বজিৎ : ‘মুসলমান হয়ে মুসলমানকে খুন করে না’ ৩১ জানুয়ারির প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কি ঠিক? তিনি কী বলতে চান, তাহলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান খুন করলে সমস্যা নেই? সেই জন্যই কি বিশ্বজিৎকে খুন করা? আওয়ামী আন্দোলনে যখন মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়, আওয়ামী লীগ কি তখন মুসলমান নয়? প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমির কারণে এত মানুষ মরছে এটা কোন মুসলমানের কাজ? সুতরাং পাবলিক রেকর্ডে যাওয়া বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রীসহ সবারই উচিত সতর্ক থাকা। অন্য দলের, অন্য বর্ণের, অন্য ধর্মের হলেই তাকে খুন করে মতায় যাওয়ার আইন কোন অনুচ্ছেদে? খুনিকে ধরতে দলীয় সার্টিফিকেট? রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত খুনের আসামিদের মার রেকর্ড করে গায়ে মল মাখালেন। হুইপ পেটানো পুলিশকে রাষ্ট্রপদক দিলেন। পুলিশ যখন দাঁড়িয়ে থেকে খুন উপভোগ করছিল তখন একজন রিকশাওয়ালা তাকে তুলে নিয়ে দু’টি হাসপাতালে প্রাণভিার জন্য ছুটে যায়, অতিরিক্ত রক্তরণে বিশ্বজিৎ যখন মারা যাচ্ছে ডাক্তার জিজ্ঞেস করল ছেলে কি শিবির করে (ইউটিউবে পুলিশ)? মর্গের ডাক্তার সুরতহাল রিপোর্ট লিখে বিশ্বজগৎ কাঁদায় আর তখন হতভম্ব আদালত ভিডিও দেখে প্রশ্ন করেন, ডাক্তার! রিপোর্ট বানানোর আগে দলীয় পরিচয় বিবেচনা করা হয়েছিল কি? ছাত্রলীগের সোনার ছেলে চাপাতি শাকিল নয়, বরং বিশ্বজিৎ খুনের আগে উত্তেজক বক্তব্য দেয়ার অপরাধে আজ পর্যন্ত গ্রেফতার হননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রশ্ন বিশ্বজিতের খুনিরা কি ’৭১-এর খুনিদের মতো চাপাতি মারার আগে উল্লসিত ধ্বনি দিয়ে বলেছিল, ‘লড়কে লেঙ্গে গুলিস্তান’? বা! যে প্রক্রিয়ায় এবং যেভাবে খুন করল ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা, একটিমাত্র ঘটনাই ’৭৪-এর জাল পরা বাসন্তীর মতো যুগ যুগ ধরে কলঙ্ক হয়ে সরকারকে ভোগাবে। এর চেয়েও তুচ্ছ ঘটনায় আমেরিকা, ইউরোপ, ভারতে রায়ট পর্যন্ত হয়েছে। ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা বিশ্বজিৎ পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে, ঘিরে রেখেছে। অপরাধীরা ঘুরে বেড়ায় আর মসনদবাদীরা সব এক সাথে চিৎকার করেন, সব দোষ জজ মিয়ার। ‘একনায়কতন্ত্রের চর্মরোগ এইসব।’ বিশ্বজিৎ, রাব্বী, জুবায়েরের ঘটনা প্রমাণ করেছে দেশে সবচেয়ে বড় টেরোর ছাত্রদল-ছাত্রলীগ। যারা জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে সে বিবেকহীনদের কাছে প্রশ্ন, বিশ্বজিৎ আর রাব্বীর ঘটনার পর, ছাত্রলীগ না জামায়াত, কোনটা নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি? ছাত্রলীগের উলঙ্গ সন্ত্রাস দেখার পরও কি তাদের উচিত নয় ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্না হাজারের মতো আমৃত্যু অনশন কিংবা রামপালে বিদ্যুতের নামে ‘সুন্দরবন’ ধ্বংস বন্ধ করার আন্দোলন? অন্যথায় ঘোড়ার ডিমের রাজনীতির কী মূল্য আছে? সরকার যাদেরকে পছন্দ করে না তাদের বিরুদ্ধে হরতাল করে সস্তা বাম দলগুলো আরো মূল্যহীন হয়েছে।
লিমন: র‌্যাব বলেই যাকে খুশি গুলি করার অধিকার যে সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে সেটি দেখতে চাই। প্রশ্ন লিমনের এক পা নয় বরং যারা তার এক পা নিলো তাদের দুই পা কেটে ফেলার জন্য আইন পাস হবে কি না। অতীতের রীবাহিনী আর কিনহার্টের মতো র‌্যাবের অভিনব অপারেশনের নাম লিমন। এক পা নিয়ে প্রমাণ করেছে সরকারের এজেন্ডা পরিষ্কার নয়। একজন মানুষের ভবিষ্যৎ তৈরি হয় তার সব কিছু নিয়ে। কিশোরটির পা নেয়ার অধিকার সরকারের নেই কিন্তু নিয়েছে। মা এবং ছেলের বিরুদ্ধে দুটো মামলা দিয়ে প্রমাণ করেছে এরা কত বড় দানব। লিমনের ঘটনা পশ্চিমাদের ও সর্বশেষ হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের নজর কাড়লেও অপদার্থ মানবাধিকার কমিশন হঠাৎ হঠাৎ হুঙ্কার ছেড়ে উধাও। গা ঝুলিয়ে ড. মিজানুর রহমানের বক্তৃতা সাময়িক আনন্দ দেয় মাত্র। তাতে ১০ হাজার মাইল দূরে বসে আমি আনন্দিত হই।
তেল-গ্যাস পাচার : মতায় যেতে হলে ডিল করতেই হয় কিন্তু অন্যেরা করলে সেটা অপরাধ, কোন অনুচ্ছেদে লেখা? তেল-গ্যাস ষড়যন্ত্রে যারাই বাধা দিচ্ছে, তাদের ওপর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছুড়ে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করা কেন? পাগলা কুকুর মারা মরিচের গুঁড়া ছুড়ে ইতোমধ্যে দুইজনকে হত্যা করা হয়েছে। অতীতে তেল-গ্যাস বিকিয়ে দিয়ে মতায় আসার জন্য খালেদাকে গালাগাল নয় বরং তেল-গ্যাস দেয়ার প্রতিশ্র“তিতেই ২০০৮-এর বিজয় সত্য হলে ভবিষ্যতে একই অভিযোগ খালেদাও হাসিনার বিরুদ্ধে আনবেন। প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত গ্যাস আর কুকুর মারা গুঁড়া আমদানি হয়েছে নির্বাচন ঠেকানোর অস্ত্র হিসেবে। প্রশ্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা সত্য হলে জনসমে নিজের চোখে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন না কেন?
গার্মেন্ট : আগুন আর আগুন! আজ গার্মেন্ট কাল বস্তিতে। পরবর্তীকালে দুরবস্থার ফলোআপ হয় না। বস্তিতে আগুন দেয় কারা? বিদেশী মুদ্রার নামে হচ্ছেটা কী? স্মার্ট গার্মেন্টে মৃত সাতজনের মধ্যে ছয়জনই নাবালক? গার্মেন্টজুড়ে কম পয়সায় শিশু শ্রমিকের অভয়ারণ্য? চট্টগ্রামে যখন তিনি ভোট চাইছিলেন তখন সিএনএন-এ দেখছি গার্মেন্টে আবারো মানুষ পুড়ে ছাই। অভিযোগ, গেটের মধ্যে তালা, আগুন নেভানোর কিছুই নেই।
বক্তৃতা চাই না, দায়িত্বশীলতা চাই। হয়তো এরপর অনুষ্ঠান করে প্রধানমন্ত্রী চেক দেবেন, বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন, জজ মিয়াকেও বের করবেন। প্রশ্ন ১৫ বিলিয়ন ডলার পোশাক শিল্পের কথা বলতে বলতে যারা মুখের ফেনা তুলে ফেলছে, সংস্কারের স্বার্থে তারা কি জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা শ্মশানগুলো বন্ধ করবে না? বিদেশী শ্রমিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, প্রতি সপ্তাহেই শ্রমিক মরে, প্রকাশ করে না। সস্তা হলেই শ্রমিক পুড়িয়ে ব্যবসায় করার বিধান কোন শাস্ত্রে লেখা? গোশতের কেজি ৪০০ টাকা হলে দিনে ১০০ টাকা মজুরি সরকারের চরম ব্যর্থতা। এক দিনের বেতন দিয়ে একজন গার্মেন্ট কর্মী বড়জোর মধ্যম শ্রেণীর হোটেলে একবেলা ভাত খেতে পারে। ব্যবসায়ী সংগঠনের সাথে সরকারের গড়াগড়ি গার্মেন্ট শিল্পকে আরো দুর্নীতিবাজ করছে। শ্রমিকের জানমাল নিরাপত্তা চুলায় দিয়ে বড় অঙ্কের মুনাফা করছে ব্যবসায়ীরা, ইন্ধন জোগাচ্ছে সরকার। পোশাক শিল্পের টাকায় উন্নতির যে অজুহাত সব ভুয়া আর অপপ্রচার। বরং লাখ লাখ গরিবের শ্রম ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে এরা যে টাকার পাহাড় গড়েছে তা টাটা বিড়লাদের মতো সুইস ব্যাংক ছাড়াও নিজেদের রাজকীয় ভোগবিলাসে খরচা করে। জনকল্যাণে এরা কিছুই করে না। বরং কয়েক লাখ গরিবের জন্য অত্যন্ত নিম্নমূল্যের কর্মসংস্থানের নামে এরা যে বৈষম্যময় অর্থনীতি সৃষ্টি করছে তা দেখলে দাস ক্যাপিটালের লেখক কার্লমার্কস হয়তো লিখতেন, ‘দাস ক্যাপিটাল- ঢাকা।’
শেষ কথা : খালেদা জিয়ার দুঃশাসনের শাস্তি তিনি পেয়েছেন। পেয়েছেন এরশাদ এবং ১/১১। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তার পরিপ্রেেিত বলতেই হয়, তাহলে কী দোষ করেছিলেন খালেদা জিয়া? ’৭৪-৭৫-এর ভিশন বাকশালের পর ভিশন-২০২১-এর দূষণে স্খলন চূড়ান্ত হয়েছে। একটি নির্দলীয় নিরপে নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও দলীয় নির্বাচনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ১০৬ ভাগ নিশ্চিত করে জাতিকে শঙ্কিত করেছেন এই মর্মে যে, অতীত থেকে শিা তিনি কিছুতেই নেবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। ভোটারেরা চায় ফিউডালিজমের রাজনীতি পরিহার করবে দু’টি দল। স্খলন ঠেকাতে চার বছর আর দুই টার্ম মতা জরুরি। রাজনীতি থেকে পরিবারতন্ত্র দূর করে এখন থেকেই ওবামা তৈরির অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। এ দেশেও ওবামা আছে, ছিল, থাকবে। এই ল্েয জনমত গড়ে তোলা দেশপ্রেমিকের কাজ। কারণ দেশটাকে এই পর্যায়ে আনার জন্য দায়ী রাজনীতিবিদেরা নন বরং আমরা। জনসভায় যোগ না দিলে ধুলায় উড়ে যাবে জনসমর্থন আর জনপ্রিয়তা। নেহরুর প্রতি বিপুল জনসমর্থন তাকে সফল করেছিল আর ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে বিপ্লবী নেতাজীর প্রতি দুর্বল জনসমর্থন তাকে ব্যর্থ করেছিল। আমরা ভুগছি সমালোচক আর অ্যাক্টিভিস্টদের খরায়। ফিউডালিজম রুখতে প্রয়োজন মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় অ্যাক্টিভিজম এবং সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পুনরুদ্ধার করে দেশটাকে আজন্ম রক্তাক্ত জেরুসালেম হওয়া থেকে রা করতে হবে।
লেখিকা : নিউ ইয়র্ক প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।
farahmina@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads