বিগত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে একদল তরুণ ব্লগারের শহরের ব্যস্ততম শাহবাগ মোড়ে অবস্থান গ্রহণ এবং সেখান থেকে তাদের অভিনব তৎপরতাকে যেভাবে যতই অরাজনৈতিক বলা হোক না কেন, তা যে মহলবিশেষের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উৎসর্গকৃত, তা এখন একজন নাবালকও বোঝে। এ দেশের সচরাচর অবমূল্যায়িত সাধারণ মানুষদের বিচারবুদ্ধি এতটাই প্রখর যেÑ আমি গত তিন সপ্তাহের অধিককাল থেকে যা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছি, তারা তা শুরুর দিন থেকেই বুঝেছিলেন এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। আমরা অতি বুদ্ধিমানেরা তখনো শাহবাগের এই জমায়েতের মধ্যে তারুণ্যের দর্শন বা অতিবাস্তব আরো অনেক কিছু খুঁজছিলাম এবং বিষয়টিকে মহিমান্বিত করার লক্ষ্যে যথাযথ শব্দচয়ন ও জুৎসই প্রকাশের শৈলী বাছাই করছিলাম। ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি যে ব্যাপারটি প্রচণ্ডভাবে শুধু রাজনৈতিকই নয়, অতীতের কোনো কোনো পর্যায়ের সেই বহুল পরিচিত নোংরা রাজনীতিরই পুনরাবৃত্তি। একটি ব্যর্থ সরকারের অনেক দুষ্টকর্মকে জনগণের দৃষ্টির অন্তরাল করতে একধরনের নতুন চমক সৃষ্টি।
অতীতেও যেমন হয়েছে, তেমনি শাহবাগের কুশীলবেরা হয়তো জানেও না যে কী উদ্দেশ্যে তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। সেটা সম্ভবও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তারুণ্যের আকর্ষণের উপাদানগুলোর সরবরাহ অব্যাহত থাকে। এমনিতেই রোমান্টিকতায় টইটম্বুর তরুণেরা শৌর্য-সৌজন্যের মিশ্রণে একটি বর্ণিল পারিপার্শ্বিকতায় তাদের বাছাই করা প্রিয়জন সংসর্গে উম্মুখ থাকে। শাহবাগ পূর্ণপাত্রে তা তাদেরকে দিয়েছে। সেখানে আছে বাদ্যি-বাজনা, সঙ্গীত পরিবেশন, রমণীকুূলের সপ্রশংস উপস্থিতিÑ যা তরুণ ও যুবা বয়সে সবার কাছে আকর্ষণীয়। তা ছাড়াও অবিরাম চলছে সেখানে কোনো না কোনো কর্মসূচি, যা এমন জমায়েত নিরন্তর বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য শাহবাগ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি, যুদ্ধাপরাধী নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি কটাক্ষ এবং তাদের নিয়ে ব্লগে খিস্তিখেউড়। যেকারো সম্পর্কে যেকোনো কুৎসা শ্রবণ ও আলোচনা মানুষের, বিশেষ করে যেকোনো প্রকার আড্ডাবাজদের সহজাত প্রবৃত্তি। শাহবাগে আরো রয়েছে স্বাধীনতাÑ যেকোনো কিছু করবার ও বলবার। শাহবাগে সমবেত তরুণ-তরুণীরা নির্বিবাদে তা করে চলেছে। দিনরাতব্যাপী ুন্নিবৃত্তি নিবৃত্তির কী ব্যবস্থা সেখানে আছে জানি না, তবে শুনেছি সেখানে সমবেতদের জন্য নাকি অসংখ্য উৎস থেকে ‘মান্না-সালওয়া’র ব্যবস্থা আছে। অবাক লাগে যে, এ দেশের রাস্তাঘাটে অসংখ্য নিঃস্ব-দরিদ্রদের জন্য আসমান থেকে কখনো কোনো স্বর্গীয় খাদ্য নেমে আসার ঘটনা শোনা যায়নি।
আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেন যে, কোনো পিতামাতা যদি তাদের সোমত্ত কন্যাকে শাহবাগ চত্বরে রাতযাপনের জন্য অনুমতি দেন, তার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? মুখ কাচুমাচু করে বলেছি যে, তাদের সম্পর্কে ধারণা করার অধিকার আমার নেই; তবে আমার কাছে তেমন কিছু অচিন্তনীয়। কৈশোরে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করা মসজিদের ইমামকে বলতে শুনেছি যে, অভিভাবকহীন অবস্থায় কোনো সাবালিকা যদি রাত্রিবাস তো দূরের কথা কোনো অপরিচিতের সান্নিধ্যে একাকী যায়, তাদের মাঝখানে প্ররোচনাদানকারী শয়তান হাজির হয়। অথচ শাহবাগে প্রতি রাতে শত শত মা-বোনকে সেই প্ররোচনার ফাঁদে পা দেয়ানো হচ্ছে।
আজ দীর্ঘ দিন ধরে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী যে গগনবিদারী কণ্ঠে কর্তৃপক্ষের কাছে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি করে আসছে এবং সেই দাবিতে সাড়া দিয়ে সরকারও তা কার্যকর করার জন্য অগ্রসর হচ্ছেÑ তার পরও কি শাহবাগ জমায়েতের আদৌ আর কোনো প্রয়োজন আছে? আর ফাঁসির দাবি করার পণ্ডশ্রমের দরকার হবে? এমনিতেই তো কোমলমতি শিশু-কিশোর চেতনায় গেঁথে গেছে এই দাবিগুলো। কিন্তু ওই যে বলেÑ টগবগে তরুণের জন্য বিদ্রোহী, বিপ্লবী ও প্রতিবাদী হওয়ার একটি অপ্রতিরোধ্য আবেদন আছে। তার চেয়েও বড় আবেদন প্রজন্ম চত্বরের কার্নিভ্যালস্থলে শামিল থাকা।
আরা উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত যে, ইতোমধ্যে আমাদের অবক্ষয়-কবলিত তরুণেরা কোনো অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে অবক্ষয়ের চূড়ান্তপর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, বা পৌঁছিয়ে দেয়া হচ্ছে। নিন্দুকদের কথায়Ñ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই নাকি গাঁজা-চরসের উৎকট গন্ধে শাহবাগ চত্বরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। যে বয়সে মানুষ নৈতিকতার দীক্ষা পায়; তার স্রষ্টাকে চেনে এবং জীবনের উদ্দেশ্যকে বুঝতে শেখে, শাহবাগের রাতভর আসর অবশ্যই তার অনুকূল নয়।
সুতরাং শাহবাগের ক্যার্নিভ্যাল চলতেই থাকবে। বিদ্রোহী-প্রতিবাদী তরুণেরা যতই শ্রান্তকান্ত হোক, এই কার্নিভ্যালের পরিকল্পিত এবং কৌশলী নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, তারা অচিরেই এই যজ্ঞের ইতি টানতে দেবেন না। বরং যতই তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে কার্নিভ্যাল জমে উঠছে। নতুন নতুন গানের সুর বাঁধছেন সীমান্তের ওপার থেকে সুমন কবিরেরা। একাত্মতা জানাতে ভারত থেকে আসছে সাইকেলারোহী তরুণেরা। পথে পথে তারা সংবর্ধিত হচ্ছেন এমন আবেগে, যা তারা ভাবতে পারেননি। পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা হচ্ছে। আমি একবার শারদীয়া পূজার মওসুমে সড়কপথে কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলাম। বিপদে পড়েছিলাম, যখন সড়ক পথে কলকাতা থেকে বেনাপোল এসেছিলাম। এখন আর মনেও নেই যে, এই আশি-নব্বই কিলোমিটার রাস্তার কত স্থানে যে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে স্থানীয়রা আমাদের কাছ থেকে জোর করে পূজার চাঁদা আদায় করেছিল। সে ছিল আমার জীবনের তিক্ততম অভিজ্ঞতার অন্যতম। আর আমরা সে দেশের প্রজন্ম চত্বর দেখতে আসা তরুণদের পুষ্পার্ঘ্য দিই। পরিহাসই বটে!
পরিহাস যে, প্রজন্ম চত্বর কার বা কাদের উৎসাহে তাক করেছে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় আবেগ, বিশ্বাস এবং তাদের হাজার বছরের ইতিহাসকে। সেই ইতিহাসের পরিক্রমায় কিন্তু আমরা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গে ছিলাম, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগে ছিলাম। সেগুলো থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আমরা ১৯৫২ বা ১৯৭১-এ আসিনি। যখন তাদের এই ইতিহাসকে সামগ্রিকভাবে নিরীক্ষণ করার কথা এবং সেসব ঘটনাপ্রবাহে আমাদের বঞ্চনা ও সংগ্রামকে তুলে ধরার কথা ছিল, সেখানে উপস্থাপনের কারসাজিতে আমাদের খণ্ডিত রূপে তুলে ধরা হচ্ছে।
অবজ্ঞা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে আমাদের ধর্মীয় পূর্বসূরিদের। প্রীতিলতা বা সূর্যসেনই শুধু আমাদের সংগ্রামের ঐতিহ্য লালন করেননি। সেখানে আরো ছিল তিতুমীর বা হাজী শরীয়তুল্লাহর মতো সংস্কারকেরা। প্রজন্মের সমস্যা এই যে, সম্ভবত এদের জাগরণের সম্ভাবানায় মুগ্ধ হয়ে মহলবিশেষ এর গতিধারাকে ইতোমধ্যেই কুক্ষিগত করেছে। এতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে স্বার্থান্বেষীদের।
এই নিবন্ধকার বিশ্বাস করে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চায় যে, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। স্বয়ং স্রষ্টাÑ অন্যায়, তা হত্যাই হোক, ধর্ষণই হোক বা যেকোনো প্রকার নির্যাতন হোকÑ ইহজীবনে অনিষ্পন্ন থাকলে তার মানদণ্ডে সে বিচার নিষ্পন্ন করবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাসহ রাজনীতিকেরা তাদের স্বার্থে এ বিচার নিয়ে রাজনীতি করায় তা এত দিনেও ঝুলে আছে এবং সে বিচারপ্রক্রিয়াকে রাজনৈতিকভাবে একটি অরাজনৈতিক গণজাগরণের মাধ্যমে নিজেদের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতাকে ঢাকতে রাজনীতিকরণের চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন।
এ দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে ব্যর্থ ও প্রশ্নবিদ্ধ শাসকদল সব অপকর্মকে আড়াল করতে এই স্বাধীনতা চত্বরের ঢাল ব্যবহার করছেন, যার অবগতি হয়তো স্বাধীনতা প্রজন্মেরও নেই; নেই তাদের অসংখ্য ভক্ত-সমর্থকদেরও। তারা এখন সময়ের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন। আজ বড়ই প্রয়োজন আমাদের শেকড়ের অনুসন্ধানের, বড়উ প্রয়োজন আত্ম-অনুসন্ধানের। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে এবং বিপন্ন বর্তমানকে যদি ধরে রাখা যায় ভবিষ্যতের বিনির্মাণ কঠিন হবে না। এক বন্ধুকে বলেছিলাম : শাহবাগে গেলে না? স্বাভাবিক প্রশ্ন : কিসের জন্য? শুধালাম : এত কিছু হচ্ছে সেখানে, তোমার জানতে কৌতূহল হয় না? চৌকস উত্তর : না, কৌতূহলও হয় না। কেননা জানি তো কী হচ্ছে, কারা করছে।
আমার বিশ্বাসÑ সেটাই শেষ কথা নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন