ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা ও সরকারকে আলটিমেটাম দেয়ার মাধ্যমে ‘গণজাগরণ’ মঞ্চের প্রথম পর্বের সমাপ্তি টানা হয়েছে। শাহবাগও খুলে দেয়া হয়েছে। তারুণ্যের আবেগ-উচ্ছ্বাসমাখা এমন সতেরো দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন, অভিনব ও ব্যতিক্রমধর্মী।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের অসঙ্গতি এবং একটি রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগ স্কোয়ার, মিডিয়া ও মানুষের মনে নতুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ব্লগার পরিচয়ে কতিপয় যুবকের আহ্বানে ফাঁসির দাবিতে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ গড়ে ওঠে। শুরু থেকেই এর নেপথ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল স্পষ্ট। তার পরও একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে অসংখ্য মানুষ তরুণদের ডাকে সাড়া দেয়। তাদের উৎসাহ জোগায়। অনেকেই এর ইতিবাচক দিকটিকে বিবেচনায় নিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন। আমরাও দেশের তরুণসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের স্বাধীনতার প্রতি মমত্ববোধের এই বহিঃপ্রকাশকে আশাবাদের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছি। দুর্ভাগ্য যে, ক’দিনের মাথায় এর সাথে সরকারি পরিকল্পনার যোগসাজশ ও বামপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মীদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রত্যক্ষ করা গেল। ব্যর্থতা আড়াল করে, অন্যায়, দুর্নীতি ও জনগণের স্বার্থ এড়িয়ে তরুণদের দেশাত্মবোধকে অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার একটা দুরভিসন্ধিও জনগণ প্রত্যক্ষ করল। শেষ পর্যন্ত লক্ষ করা গেলÑ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোটের দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের তারুণ্যের আবেগমাখা একটি উদ্যোগের মঞ্চটিকে চাতুর্যের সাথে হাইজ্যাক করা হলো। সরকারের প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে এই মঞ্চ থেকে আদালত ও বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা সৃষ্টি করা হলো। মিডিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার ও ভিন্ন মতের প্রতি একধরনের ফ্যাসিবাদী প্রচারণার জন্য তারুণ্যের জাগরণ মঞ্চটিকে ব্যবহার করা হলো। একপর্যায়ে লক্ষ করা গেল, শুধু আইন-আদালত ও বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান মানবাধিকার সংস্থাগুলোকেই অভিযুক্ত করা হলো না, দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিকেও আহত করার চেষ্টা করা হলো। কখনো কখনো অতি উৎসাহীরা ধর্মবিদ্বেষ প্রদর্শনের মতো ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করল। একসময় মনে হলো, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগ থেকে আরো একটি সমান্তরাল সরকার পরিচালিত হচ্ছে। তাদের দাবি অনুযায়ী আইন সংশোধন করে আরো বিতর্ক সৃষ্টি করা হলো। এটা যেন তরুণদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের আরো একটি অপকৌশল।
এই মঞ্চের সংগঠকদের কারো কারো ব্লগে আল্লাহ-রাসূলের বিরুদ্ধে সীমাহীন ঔদ্ধত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকল। বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন বন্ধ ও সংস্থা বন্ধের আওয়াজ তোলা হলো। এই মঞ্চে ফাঁসির মহড়া দিতে গিয়ে এক যুবক প্রাণ হারাল। অপর ব্লগার নিহত হলো আততায়ীর হাতে। স্লোগান দিতে দিতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেল আরো একজন উদ্যোক্তা তরুণ। এই সব করুণ মৃত্যু, না সরকারের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের দুঃখজনক শিকারÑ তা আজও অস্পষ্ট থেকে গেল। অথচ হাজারো তরুণ জড়ো হয়েছিল নিজেদের দেশপ্রেমকে আরো উজ্জীবিত করার জন্য। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে প্রত্যক্ষ করলামÑ সরকার তারুণ্যকে পুঁজি বানিয়ে, তাদের দেশপ্রেমকে ব্যবহার করে ক্ষমতার রাজনীতিকে আরো পোক্ত করার অপচেষ্টা চালাল। ইতিহাসে এমন নজির নেই সরকার পুরো প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে আদালতের মুখোমুখি দাঁড়ায়, রাজপথে আইন-আদালত ও বিচারাচারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে উৎসাহ দিয়ে আদালত অবমাননার মতো মহড়া প্রদর্শন করে, বিকল্প সরকার পরিচালনার মতো একটি দ্রোহকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।
এত সব প্রশ্নের সৃষ্টি করে গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম পর্বটি শেষ হলেও আমরা প্রকৃত দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে শ্রদ্ধা করার পক্ষে। একই সাথে সরকারের রাজনৈতিক চাতুর্য প্রদর্শন ও তারুণ্যকে প্রতারিত করার এই হীন ও ঘৃণ্য ভূমিকার বিষয়টিকে নিন্দনীয় মনে করি। ক্ষমতার রাজনীতির জন্য তরুণসমাজের দেশপ্রেমকে অপব্যবহারের এমন অপতৎপরতা বন্ধ হওয়া জরুরি। আমরা মনে করি, মিডিয়ার যে অংশটি তারুণ্যের আবেগ-উচ্ছ্বাসকে ভুল পথে পরিচালিত করতে উসকানিদাতার ভূমিকা পালন করেছে, তারা ও সরকার ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন