শাহবাগের বিক্ষোভ নিয়ে এখন পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনায় যারা অংশগ্রহণ করছেন তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনদর্শন এবং রুচি-অভিরুচির বিষয়গুলোও তেমন গোপন থাকছে না। তবে কেউ কেউ নিজেকে গোপন রেখে সর্বজনগ্রাহ্য হওয়ার একটা প্রচেষ্টা চালালেও কোনো না কোনো প্রশ্নে কিংবা উত্তেজনাকর কোনো মুহূর্তে গোমর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আর বর্তমান মিডিয়া প্রাচুর্যের যুগে অনুষ্ঠান কিভাবে পরিকল্পিত হয়, কারা আসে, কি বলে সেই ক্যামেস্ট্রিটাও মানুষের অজানা নেই। তারা এই বিষয়টিইও লক্ষ্য করে আসছে যে, টক-শোগুলোতে ভাল মানুষের সাথে দলকানা বুদ্ধিজীবীরাও আসেন, এমনকি সরকারি জোটের রাজনীতিবিদরাও আসেন কিন্তু নানা অভিযোগের আঘাতে যাদের ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে সেই দলের কাউকে টকশোতে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। ফলে একপক্ষের বক্তব্য মানুষের আর জানা হয় না। মিডিয়ার এমন আবহকে কি গণতান্ত্রিক কিংবা মুক্ত আবহ বলে বিবেচনা করা যায়? মিডিয়ার বাইরেও মানুষ কথা বলে, জনগণ কথাবলে, সেই কথার গুরুত্বও কম নয়। এছাড়া ইতিহাসের পাতায়ও লিপিবদ্ধ রয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞানের অনেক কথা। ইতিহাসের কথাকে যারা গুরুত্ব দেয়, সেখান থেকে আলো নেয়, তারা বিভ্রান্তি ও ক্ষতি থেকে বেঁচে যেতে পারে।
ইতিহাসের একটি সত্য হলো, জনপ্রিয় আন্দোলন থেকেও ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। যারা ‘ঐতিহাসিক দ্বানিদ্বক বস্তুবাদের' তত্ত্বকথায় বিশ্বাসী সেইসব প্রগতিবাদীরাও এখন ইতিহাসের সত্য তুলে ধরতে চান না। চাইবেন কি করে? তারাও যে এখন ক্ষমতার চারপাশে থাকতে চান, কড়ির চেতনায় বিলাসী জীবনকে ভালবাসেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে এখন নানা কথা হচ্ছে, শাহবাগে আন্দোলন চলছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার সবাই চায়, এমনকি যাদেরকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তারাও এই বিচার চায়। তবে তাদের বক্তব্য হলো- বিচার যেন দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতার আলোকে হয়। ইতোমধ্যে বিচারের রায় প্রদান শুরু হয়ে গেছে। একজনের ফাঁসির রায় হয়েছে, অন্যজনের যাবজ্জীবন। ফাঁসির রায় মনপুত হলেও যাবজ্জীবন রায় অনেকের মনপুত হয়নি। শুরু হলো শাহবাগের আন্দোলন। এই আন্দোলনকে ‘ব্লগারদের' রাজনীতি নিরপেক্ষ আন্দোলন হিসেবে বয়ান করা হলেও রাজনৈতিক ঘরানার লোকজনই এর সাথে জড়িয়ে আছে। শুরুতে বামধারার রাজনীতিক ও ছাত্র-যুবকরা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আন্দোলনটি শুরু করলেও রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগও এতে যুক্ত হয়েছে। নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে তা নিয়ে দ্বনদ্বও শুরু হয়ে গেছে। গত রোববার আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদকে শাহবাগ মঞ্চে বক্তৃতা দিতে বাধা দেয়ায় ছাত্রইউনিয়ন নেত্রী ও ‘শ্লোগানকন্যা' লাকি আক্তারকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। ফলে মঞ্চ থেকে তাকে স্থানান্তর করতে হয়েছে বারডেম হাসপাতালে। এনিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন রাতে সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলেও সরকার ও সিপিবির হস্তক্ষেপে তা আর হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনটি কেন বন্ধ করা হলো তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে তখন শাহবাগ আন্দোলনের গোমর ফাঁস হয়ে যেত। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে নতুন প্রজন্মকে কোন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই রহস্যও জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত। এমন অবস্থাতো সরকার ও বামরাজনীতিকরা চাইতে পারবেন না, অতএব সংবাদ সম্মেলন বন্ধ। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যুদ্ধাপরাধ আদালত সরকার গঠন করেছে, রায় দেয়াও শুরু হয়েছে কিন্তু রায় ‘ফাঁসি' হবে, না ‘যাবজ্জীবন' তা ঠিক করে দিতে চায় ‘শাহবাগ মঞ্চ'। এখনতো শাহবাগ মঞ্চ থেকে বলা হচ্ছে, ‘বিচার নয় ফাঁসি চাই'। দেশে একটি সরকার থাকার পরও যদি প্রকাশ্যে রাজপথে এমন কথা বলা হয়, তাহলে যুদ্ধাপরাধ বিচারে আদালতের আর কোনো প্রয়োজন আছে কি?
আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, গত রোববার সংসদে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহবাগ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, বিচারের রায় দেবে ট্রাইব্যুনাল, আইন দেখেই তারা চলবে। তারপরও তাদের অনুরোধ করবো, মানুষের আকাঙ্ক্ষা যেন তারা বিবেচনায় নেন। দেশের মানুষ কি চায় সেটা বিবেচনায় নিতে এই মহান সংসদ থেকে তাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর এমন অনুরোধ ও আবেদনের পরও বিচার সুষ্ঠু হবে, স্বচ্ছ হবে তা কি কোনো সুস্থ মানুষ আশা করতে পারে। সরকারের এমন প্রশ্রয় পেয়েই হয়তো পত্রিকায় আগুন দেয়া হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংকের বুথে আগুন লাগানো হয়েছে। এ কারণেই ইতিহাসের আলোকে বলা হচ্ছে, একটি জনপ্রিয় আন্দোলন থেকেও ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। এমন ভয়ঙ্কর ফাঁদে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ পা দেবে না। জনপদের মানুষ যখন শাহবাগ-আন্দোলনের আসল রূপটা উপলব্ধি করবে, তখন ষড়যন্ত্রকারীরা আর পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পাবে না। তবে এই মুহূর্তে এই কথাটি বলে রাখা প্রয়োজন যে, শাহবাগের এই ছোট্ট চত্বরটি কিন্তু পুরো বাংলাদেশ নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন