সোমবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

পদ্মা সেতুর ঘটনায় পিছিয়ে যাচ্ছে দাতাগোষ্ঠী



কোনো একটি ঘটনার কারণে নানামুখী প্রতিক্রিয়া ঘটে থাকে বলে যে কথা প্রচলিত রয়েছে মহাজোট সরকার তার প্রমাণ পেতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ৪৩টি দাতা সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করেছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বড় বড় সংস্থাগুলো তো বটেই, এমনকি ছোট কিছু সংস্থাও তাদের প্রতিনিধিদের পাঠায়নি। সে কারণে বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে গেছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, যে কয়েকটি মাত্র সংস্থার প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন তারাও শুধু বাংলাদেশের বক্তব্য শুনেছেন। কোনো প্রসঙ্গেই সহায়তার কোনো আশ্বাস দেননি। অর্থাৎ ইআরডির ঐ বৈঠক থেকে বাংলাদেশ কিছুই অর্জন করতে পারেনি। সরকারের কর্তা ব্যক্তিরাও সম্ভবত আগেই এ ব্যাপারে অনুমান করতে পেরেছিলেন। এজন্যই বিশেষ করে পদ্মা সেতু এবং বিশ্বব্যাংককে না করে দেয়ার অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টির উল্লেখ করেননি তারা। সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন দায়সারাভাবে। বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনেও দাতা সংস্থার কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। অথচ প্রচলিত নিয়ম হলো, বৈঠক শেষে সাধারণত যৌথ ব্রিফিং হয়ে থাকে এবং এতে দাতাদের পক্ষে একজন অংশ নেন। অন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সংবাদ সম্মেলনে পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে গেছেন ইআরডি সচিব। তিনি শুধু এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন যে, বিশ্বব্যাংক না থাকায় এডিবি ও জাইকার পর ইসলামিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিবি)-ও চুক্তি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এর অর্থ, পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পাশে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাই আর নেই। নেই কোনো দেশও। ক্ষমতাসীনদের বাগাড়ম্বর তাই বলে থেমে নেই। তারা বরং নতুন পর্যায়ে আবারও নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা শোনাতে শুরু করেছেন। মাত্র সেদিনের খবর হলেও স্মরণ করা দরকার, পদ্মা সেতু নিয়ে বহুদিন ধরে শোরগোল করার পর ৩১ জানুয়ারি হঠাৎ করেই বিশ্বব্যাংককে ‘না' করে দিয়েছে সরকার। বলেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যে ঋণচুক্তি হয়েছিল সে ঋণের আর দরকার নেই। এমন সিদ্ধান্ত তাই বলে প্রশংসিত হয়নি বরং জনগণকে বিস্মিত করেছে। কারণ, সেদিনই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয় নিরসনের চেষ্টা চলছে। মীমাংসা হলেই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। অর্থমন্ত্রীও বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংক টাকা না দিলে বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব নাও হতে পারে। অর্থাৎ সরকার শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিল। অর্থমন্ত্রী তো ওয়াশিংটন যাওয়ারও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রশ্নও উঠেছে এসব কারণেই মাঝখানে এমন কি ঘটে গেছে যার জন্য বিশ্বব্যাংককে সোজা না করে দেয়া হলো? এই না করার পেছনের প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসতেও অবশ্য দেরি হয়নি। আসল কারণ হলো, প্রধানমন্ত্রী যেদিন ঢাকায় বক্তব্য রাখছিলেন সেদিনই ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন, সরকার সংস্থার ‘শর্ত' পূরণ না করলে পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ দেয়া হবে না। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি তদন্তের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। সে সুপারিশে ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের' দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হতো। সেটাই ছিল বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বর্ণিত ‘শর্ত'। কিন্তু বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংককে সরকার ‘না' করে দিয়েছে। কথাটা জানা মাত্র পিছিয়ে গেছে এডিবি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দ্বিতীয় প্রধান অংশীদার সংস্থাটি বলেছে, চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক না থাকায় এডিবির পক্ষেও জড়িত থাকা সম্ভব হবে না। উল্লেখ্য, ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি এবং এডিবির ৬১ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা ছিল। এডিবির পরপর জাইকা ও আইডিবিও পিছুটানই দিয়েছে। সমগ্র এই প্রেক্ষাপটে কথা উঠেছে আসলে ক্ষমতাসীনদের বাগাড়ম্বরের কারণে। ক্ষমতাসীনরা বলে চলেছেন, নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেন তারা। এটা করার সামর্থ্যও নাকি সরকারের রয়েছে। এ ব্যাপারে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক একটি কথা শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। নিজেদের ‘সামর্থ্যের' ব্যাপারে জানান দিতে গিয়ে জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীন বাংলাদেশের সঙ্গে ২০০৬-০৭ সালের বাংলাদেশের নাকি ‘আকাশ-পাতাল' ব্যবধান! তারা চাইলে নিজেরাই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারেন। এমন ঘোষণা শুনে জনগণের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। অন্যদিকে জনমনে কিন্তু উল্টো প্রবল সংশয়েরই সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিপুল ব্যয়ের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে শুধু টাকা থাকলে চলে না, প্রযুক্তি, উপকরণ ও প্রকৌশলগত দক্ষতাসহ আরো অনেক বিষয়েরই প্রয়োজন রয়েছে- যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। তাছাড়া দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই হিসাব কষে দেখিয়ে দিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গেলে লাভের চাইতে ক্ষতি হবে হাজার গুণ বেশি। কথা আরো আছে। মালয়েশিয়া, চীন বা ভারতের মতো কোনো দেশ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হলে সুদই গুণতে হবে পাঁচ শতাংশ বা তারও বেশি। অথচ বিশ্বব্যাংকের সুদের হার ছিল শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ। তাছাড়া প্রথম ১৫ বা ২০ বছর সুদের রেয়াতও পাওয়া যেতো। অন্যদিকে সম্ভাব্য দেশগুলো কিন্তু তেমন কোনো সুবিধা দেবে না। ফলে চাপ পড়বে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর। সরকারকে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কাটছাঁট করতে হবে। ফলে উন্নয়ন স্তিমিত হয়ে পড়বে। পাশাপাশি জনগণের ওপর বাড়বে ট্যাক্সের পরিমাণ। সব মিলিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় অর্থনীতি। আমরা তাই নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের বাগাড়ম্বর থামানোর আহবান জানাই এবং মনে করি, বিশ্বব্যংকের দাবি অনুযায়ী চিহ্নিত বিশেষজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াটাই সরকারের উচিত ছিল। তাহলে অবশ্য থলের অনেক বেড়ালই বেরিয়ে পড়তো। মানুষ জেনে ফেলতো, একজন মাত্র আবুল হোসেনের জন্যই এত বড় একটি সুযোগ হাতছাড়া করেনি সরকার। ‘সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ' আরো অনেকেই ছিলেন, আবুল হোসেন যাদের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে ‘বলির পাঁঠা' হয়েছেন। মূলত সে কারণেই বিশ্বব্যাংককে ‘না' করে দিয়েছে সরকার। তা সত্বেও আমরা মনে করি, সময় ও সুযোগ একেবারে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের উচিত, পদ্মা সেতু নিয়ে বাগাড়ম্বর থামিয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া। অন্তত নোংরা রাজনীতি বন্ধ করা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads