শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

গলাবাজির রাজনীতি আর নয়া বাকশালী খেল


সাদেক খান




স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খায়েশ পূরণ হতে চলেছে। এত দিন তিনি একাই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আসছিলেন : জামায়াত-শিবিরের ‘ভূত’ তাড়াতে যুবলীগ-ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগকে ‘লাঠি-বৈঠা’ নিয়ে পথে নামাতে হবে; ‘জনতার গ্রেফতারের অধিকার’ প্রয়োগ করে জামায়াত-শিবির কর্মীদের কোথাও দেখা পেলেই ‘ধর ধর’ করে তাড়িয়ে পুলিশে সোপর্দের ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ তার কথা না শুনে জামায়াতকে এক দিন মাত্র কড়া পাহারায় শান্তিপূর্ণ একটা সমাবেশ ও মিছিলের অনুমতি দিয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক লীগও আপত্তি জানিয়েছিল, বিপ দলের কর্মী শায়েস্তা করা তাদের কাজ নয়, দলের হয়ে জনসংযোগ ও জনসেবাই তাদের কাজ। তবুও মিসর সফররত অবস্থায় জামায়াতকে কায়রো থেকেই আবারো লাঠি-বৈঠার ভয় দেখিয়ে তিনি একটা ফ্যাসিবাদী নয়া বাকশালী এজেন্ডার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। এখন তার সমমনা বহুরূপী নানা গোষ্ঠী সরকারি নিরাপত্তা বেষ্টনীর আশ্রয়ে সেই এজেন্ডাই বাস্তবায়নে মত্ত।
ইতোমধ্যে ঢাকায় জামায়াত-শিবির বাস্তবিক শান্তিপূর্ণ সমাবেশ থেকে জেলবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবিতে ৫ ফেব্র“য়ারি হরতালের ঘোষণা দিয়েছিল। আরো বলেছিল, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের মোল্লার বিচারের রায় ন্যায়নিষ্ঠ না হলে এবং দীর্ঘ দিন ধরে বিচারাধীন বন্দী তাদের অন্য নেতাদের মুক্তি না দিলে তারা লাগাতার হরতালের ডাক দেবে। হরতালের ঘোষণার পর দেশের একাধিক জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, রক্তপাত ও জীবনহানি ঘটেছে। হরতাল ঠেকাতে পুলিশের সাথে আধা সামরিক বর্ডার গার্ড নেমেছে। হরতালের মধ্যে আবার সহিংসতা ঘটেছে, পুলিশ-পিকেটার সংঘর্ষ ঘটেছে, বেশ কিছু হতাহত হয়েছে। আরো আরো জামায়াত নেতা ও শিবিরকর্মী গ্রেফতার হয়েছে, প্রকাশ্যে কোথাও দাঁড়াতে পারেনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিদেশে ফেরারি মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির প্রথম রায়ের পর দ্বিতীয় রায় ঘোষিত হয়েছে হরতালের ওই দিন জামায়াতের সহকারী সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। মূলত শোনা কথার সা্েযর এক অভিযোগ খারিজ করে বাকি পাঁচ অভিযোগের একই রকম স্যা আমলে নিয়ে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন ওই আদালত। সরকারপরে উকিল বলেন, তিনি ওই রায়ে সন্তুষ্ট নন, তিনি ফাঁসির আদেশ চেয়েছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল আর আইন প্রতিমন্ত্রীও একই কথা বললেন। অন্য দিকে ‘সাজানো’ মামলা আর শোনা কথার ওই রায় প্রত্যাখ্যান করে জামায়াত-শিবির আরো এক দিন সারা দেশে হরতাল ডাকে। সেই হরতালেও কোনো পিকেটার রাস্তায় নামতে দেয়নি সরকারের পুলিশ আর আধা সামরিক টহলদারেরা। অন্য দিকে শাহবাগ চত্বরে পুলিশের ব্যারিকেড ফেলে ‘ব্লগার’ ইশারা দিয়ে জড়ো করা হয়েছে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা আর কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে ‘তরুণ প্রজন্ম’ সমাবেশ। পুলিশের পোশাকে কাউকে না দেখা গেলেও সাদা পোশাকে অস্ত্রধারী গোয়েন্দা নিরাপত্তাকর্মীরা থেকেছে চত্বর ঘিরে। দিন-রাত গান গেয়ে, নাটক করে গলাবাজি করে চলেছে শাহবাগের মেলা। নি®প্রভ হয়ে গেছে একুশের বইমেলা। মহাজোটভুক্ত পাতিনেতারা বিশেষ করে দিল্লিবান্ধব বাম নেতারা শাহবাগ মঞ্চে শামিল হয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। উপদলীয় প্ররোচনায় সরকারের নেতামন্ত্রীরা কেউ কেউ অপদস্থও হয়েছেন। তারপর আপসে ছাত্রলীগ নেতারাই ওই মেলার মূল দায়িত্ব হাতে নিয়ে নিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের চোরাগোপ্তা আক্রমণ হতে পারেÑ এই ভেবে ‘আত্মরার্থে’ আগ্নেয়াস্ত্রও সাথে রেখেছেন তাদের কেউ কেউ। মেলা জমে উঠেছে দুই দিন হরতালের পর থেকে সপ্তাহান্তে। আওয়াজÑ ‘সারা বাংলায় এক লড়াই, ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’।
১০ ফেব্র“য়ারি শাহবাগের গণজাগরণের মঞ্চের সংগ্রামীদের দাবির প্রতি সংহতি ঘোষণা করেছে জাতীয় সংসদ। সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর স্পিকার আবদুল হামিদ এ ঘোষণা দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত তরুণদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “তারুণ্যের জোয়ার দেখে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। তরুণেরা দেশ গড়বে, সঠিক নেতৃত্ব এ দেশে আসবেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। ‘শাহবাগ’ শব্দটিতে পাকিস্তানি গন্ধ আছে। এর নাম তরুণ প্রজন্ম স্কয়ার হতে পারে। তরুণেরা কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়েছে! এখানে কোনো দল নেই। স্বাধীনতার চেতনায় তারা জেগে উঠেছে। তরুণ প্রজন্মকে বলতে চাই, আমি তোমাদের সাথে একমত, আমিও সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।”
সংসদে দাঁড়িয়েই তিনি আরো বলেছেন, ‘ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী রায় দেবে। তারপরও আমি বিচারকদের বলছি, তারা যেন (শাহবাগের) এই গণপ্রত্যাশাকে আমলে নিয়ে রায় দেন। আমরা আইন সংশোধন করব। আমিও আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন কথায় পরদিন একটি আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে যে আন্দোলন হচ্ছে তার প্রতি সমর্থন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশে নতুন রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন। শাহবাগ চত্বরের জমায়েত থেকে বলা হয়েছে, তারা এই ট্রাইব্যুনালের রায় মানেন না। এই ট্রাইব্যুনালের প্রতি তদের আস্থা নেই। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে শাহবাগের সমাবেশের ওই ঘোষণার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছেন। এভাবে প্রধানমন্ত্রীও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সরকারের গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দিলেন। তাই ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের পদত্যাগ করা উচিত। (কারণ) চলমান রাজনৈতিক প্রোপটে বিচারকেরা স্বাধীন ও নিরপেভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তারা যে রায়ই দেন না কেন, তা বিতর্কিত হবে।’
এ দিকে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ভুলে গেছেন, শাহবাগ পরীবাগ এসব আদি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নাম।
পাকিস্তান আমলের দেয়া নাম নয়। শাহ, শেখ, খাওয়াজা, খন্দকার এসব এ দেশের সুফি সমাজবিন্যাসলব্ধ পদবি। সেসব ভুলতে গেলে জাতির ইতিহাস ভুলতে হয়।
যা হোক, প্রধানমন্ত্রীর ওই কথায় শাহবাগের নতুন নামকরণ হয়েছে। শাহবাগ মেলা ‘প্রজন্ম চত্বর’ বলে আখ্যায়িত করেছে মিডিয়ার একাংশ। বলতে গেলে এই প্রজন্ম চত্বর নিয়ে সামান্য কয়েকটি পত্রপত্রিকা টেলিচ্যানেল ছাড়া দেশের পুরো মিডিয়াগোষ্ঠী ভাবাবেগে পাগল হয়ে উঠেছে। তারা ভুলে যেতে চায়, ভিন্ন মতের কর্মীরাও নতুন প্রজন্ম। আর সারা দেশের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ফেসবুক ব্যবহারকারী
সন্তানেরা ছাড়া শ্রমিকসন্তান কৃষকসন্তান আত্মকর্মসংস্থানকারী কর্মজীবীদের সন্তানেরা শাহবাগে প্রায় নেই বললেই চলে। আর ‘ব্লগার’দের মধ্যেও সত্যসন্ধানী জ্ঞানসন্ধানী অনেক তরুণ রয়েছে, যারা হুজুগে মাতেনি।
যেমন ‘টুডে ব্লগ’-এ একজন লিখেছেন : “আমি এমদাদ ১০ ফেব্র“য়ারি ২০১৩, ১১:৪৫:০৯ সকাল।
আগে লেখা ছিল দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড। এখন শাহবাগ আন্দোলনের ফলে লেখা হলো মৃত্যুদণ্ড।
শাহবাগকে এভাবেই সাজানো হয়েছে, যাতে কোনোক্রমেই সাঈদীরটা ফসকে না যায়। সেটাই করলেন আমাদের বিচারপতিরা গত রাতে।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সবাইকে ফাঁসি দিতে হবে; যেভাবেই হোক। আইন আপনারা সেভাবেই বানান। ওসব বুঝি না। ফাঁসি চাই। হাসিনার কথা হলোÑ সব জামায়াত নেতার ফাঁসির রায় এবং কার্যকরও এই ৯ মাসে এই সরকারের আমলেই করতে হবে।
নিজামুল হক নাসিম ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন মিলে সাঈদীরটা দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড রেখেছিলেন। রায় ওভাবেই লেখা হয়ে গিয়েছিল, যেহেতু কোনো কিছুই সাঈদীর সাথে মেলাতে পারা যাচ্ছে না। না সাঈদী ১৯৭১ সালে জামায়াতি ছিলেন, না আছে তার বিপরীতে কোনো প্রকৃত সাী। এত বড় আলেমকে বড় শাস্তি দিতে ভয় পাচ্ছিলেন নাসিম সাহেব। তাই দু’জন মিলে এমন শাস্তি রেখেছিলেন, যাতে করে উনি মুক্তি পেয়ে যান। কারণ দুই বছর উনি ইতোমধ্যে পারও করে ফেলেছেন।
এরই মধ্যে এসে গেল শাহবাগ আন্দোলন। মন্ত্রীরাও রেডি। কাদের মোল্লারটাও রেডি হয়ে গেছে। মন্ত্রী বলেও ফেলেছেন। কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় যেকোনোভাবে পরিবর্তন করে ফাঁসির আদেশ দেয়া হবে।
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বললেনÑ জনগণ এখন যেভাবে মাঠে নেমেছে আগে থেকেই এমনভাবে মাঠে থাকলে রায় অন্যরকম হতো।
সে মোতাবেকই রায় লেখা হয়ে গেল সাঈদী সাহেবের েেত্র।”
সেই রায় প্রদান অবশ্য আপাতত মুলতবি রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল। সেই ফাঁসির রায়ের প্রতীায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে শাহবাগ মেলা। আর মিডিয়ায় নতুন প্রজন্মের শিবির তেমন প্রচার না পেলেও কিংবা রাস্তায় দাঁড়াতে না পারলেও ঝটিকা মিছিল করে পুলিশের গুলি-লাঠি-হাতকড়া উপো করে নয়া কর্মসপ্তাহের শুরু থেকেই এখানে ওখানে জানান দিয়ে যাচ্ছে, তারা হাল ছাড়েনি। ১২ ফেব্র“য়ারি ‘শান্তিপূর্ণ’ মিছিল-সমাবেশের অনুমতি চেয়েছিল জামায়াত। অনুমতি মেলেনি। ১৩ ফেব্র“য়ারি সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে আগের দিনের পত্রপত্রিকায় সারা দেশের ১০ হাজার উলামায়ে কেরাম এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, “দেশ থেকে ইসলাম নির্মূল করার জন্য ইসলামের দুশমনেরা আজ বেসামাল হয়ে পড়েছে। ইসলাম ধ্বংসের নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য তারা আলেম, উলামা ও পীর-মাশায়েখদের চরিত্র হননে সক্রিয়। বিশ্ববরেণ্য মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চরিত্র হনন করে তার বিরুদ্ধে যেভাবে ইসলামের দুশমনদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে, তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো একজন ইসলামি ব্যক্তিত্বকে জোরপূর্বক দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেয়ার পাঁয়তারা করলে সর্বস্তরের তৌহিদি জনতাকে সাথে নিয়ে লাগাতার কঠিন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ইসলাম রায় গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ। আগামী ১৩ ফেব্র“য়ারি সকাল ১০টায় মাওলানা সাঈদীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আহূত ‘ইসলামি মঞ্চ’-এ সর্বস্তরের মুফাসসির, পীর-মাশায়েখ, উলামায়ে কেরাম ও সব ইসলামপ্রিয় জনতা জিকিরের সাথে দলে দলে হাজির হওয়া ঈমানি দায়িত্ব।” সেই ‘ইসলামি মঞ্চ’কেও বৈঠক করতে দেয়া হয়নি।
ফলে ঝটিকা মিছিল হয়েছে মহানগরে, বন্দর-নগরে। এক দিকে ফাঁসির লাশ দেখতে চেয়ে নবপ্রজন্মের পথমেলা, আর অন্য দিকে ককটেল ফুটিয়ে শিবির প্রজন্মের ঝটিকা মিছিলÑ দুই মিলে কোথাও যানজট, কোথাও রাস্তা ফাঁকা। কাজকর্ম ব্যবসায়-বাণিজ্য অচল হয়ে পড়েছে।
বিএনপিরও সমাবেশ কর্মসূচি ছিল এই কর্মসপ্তাহের শুরুতে। পুলিশের অনুমতি না পেয়ে ঘরোয়া বৈঠক করেছে বিএনপি। প্রথমে শাহবাগের ‘গণ-আদালত’কে বাহ্যত একটা গণ-আন্দোলনে রূপ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। বলেছে, সেটা না হলে ‘গণজাগরণ’ বলে যে বিশেষণ মিডিয়ায় জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে, সেটা জায়েজ হবে না। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে ১১ ফেব্র“য়ারি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের তরফে বিবৃতি দিলেন। “শাহবাগ চত্বরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে তরুণ-তরুণীদের জমায়েতের যৌক্তিকতা থাকতেই পারে। তাদের এই উচ্ছ্বাস ও আবেগের ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সব সময়ই ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে এসেছে। কিন্তু বিএনপি গভীর উদ্বেগের সাথে ল করছে, তরুণদের এই দাবিকে মহলবিশেষ দলীয়করণ করার সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের উচ্ছ্বাসকে একদলীয় অখণ্ড কর্তৃত্বাধীন করার জন্য মতাসীন গোষ্ঠী রাষ্ট্রমতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি নীলনকশায় তরুণদের এই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার বিষয়টি ইতোমধ্যে জনগণের সামনে ভেসে উঠেছে। শাহবাগ চত্বরের সমাবেশস্থলে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম পত্রিকায় অগ্নিসংযোগ করেছে এবং পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য প্রতিদিন হুমকি দিচ্ছে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ’৭৫-এর একদলীয় ফ্যাসিবাদের সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল মনে করেÑ যারা দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা করছে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ওপর বাংলাদেশী কিশোরী ফালানীর লাশ ঝুলিয়ে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের নির্লিপ্ততার বিষয়টি যদি তরুণেরা শাহবাগ চত্বরে আন্দোলনের দাবিতে অন্তর্ভুক্ত করত তাহলে তা আরো গ্রহণযোগ্য হতো। কারণ এগুলোও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার ধস, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারির মাধ্যমে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে যারা লাখ লাখ মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে, তাদেরকে আইনের ফাঁক দিয়ে রেহাই দেয়া হচ্ছে; কারণ এরা সবাই মতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত। এই লুটেরারাও মানবতাবিরোধী ও অপরাধী। এদের বিচারের জন্য শাহবাগ চত্বরে তরুণদের বর্তমান আন্দোলনে দাবি উঠলেই আন্দোলন সর্বব্যাপী রূপ লাভ করত। সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী, কমিশনার চৌধুরী আলম, শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামসহ অসংখ্য মানুষের গুম এবং গুপ্তহত্যা যে সরকারি মদদেই ঘটে চলেছে, তা কারো জানতে বাকি নেই। প্রখ্যাত বাম নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ শিকদারসহ ৪০ হাজার প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে যারা চরম ফ্যাসিবাদী একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের হাতের ক্রীড়নক হওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে তরুণদের।
নব্য বাকশালী আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে শাহবাগ চত্বরে, আওয়ামী লীগ নেতাকে মঞ্চে উঠতে বাধা দেয়ায় কিশোরী লাকি আক্তারের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদকের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী। মঞ্চের ওপরেই তার মাথা ও পিঠে প্রচণ্ড আঘাত করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। যারা নিরীহ বিশ্বজিতের হত্যাকারী, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসিড নিপে করে শিক-ছাত্রদের মুখ যারা বিকৃত করে দিয়েছে, যারা কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিকদের কুপিয়ে আহত করে এবং ঘরে আটকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, যারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নি®পাপ কিশোরীদের নির্যাতন করে সেঞ্চুরির উৎসব করেছেÑ তাদেরকে সাথে নিয়ে কোনো আন্দোলনেই নৈতিকতা যোগ হতে পারে না। এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার এক অশুভ অভিপ্রায় নিয়েই শাহবাগ চত্বরকে ব্যবহার করার চক্রান্তে মেতে উঠেছে সরকার।”
পরদিন স্থায়ী কমিটির সভা থেকে আরো ঘটা করে শাহবাগ মেলাকে স্বাগত জানালেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। রুহুল কবির রিজভী স্বারিত ১২ ফেব্র“য়ারি বিবৃতিতে বিএনপি শাহবাগ মেলা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন দানের আবদার পেশ করল : “এক সপ্তাহ ধরে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি প্রদানের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে অবস্থান করছেন। তাদের সমাবেশে অবশ্য আরো কিছু অতিরিক্ত বিষয় নিয়ে প্রস্তাব পাঠ করা হয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম জাতির বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আগ্রহী হবেন এবং যৌক্তিক ও কার্যকর অবস্থান নেবেনÑ এটাই কাক্সিত। তাই তারুণ্যের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। সমাবেশ মঞ্চ থেকে সমাবেশটিকে দলনিরপে বলে দাবি করলেও ক্রমান্বয়ে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক ঘরানার ব্যক্তিদের হাতেই এর নেতৃত্ব কুগিত করার প্রয়াস চলছে।
তরুণ প্রজন্ম দেশের ভবিষ্যৎ। তারা অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, অবস্থান নেবেন এবং প্রয়োজনে আন্দোলনে নামবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। আমরা বিশ্বাস করি, তরুণ-তরুণীরা সব ধরনের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করবেন এবং এ দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী সব অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই সিরাজ শিকদারসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও অগণিত তরুণ-তরুণী যেভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং সাম্প্রতিক কালে ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমসহ যারা গুম হয়েছেন, গার্মেন্টশ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা এবং অ্যাডভোকেট এম ইউ আহমেদসহ যারা পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়, শিশু ও নারী নির্যাতন, বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহার, হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার, কুইক রেন্টাল কেলেঙ্কারি, শাসক দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে সন্ত্রাস বাংলাদেশের কপালে কলঙ্কের তিলক এঁকে দিয়েছে।
আমরা আশা করব, শাহবাগে সমবেত তরুণ-তরুণী দেশবাসীর এসব উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ধারণ করবেন। আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, বিএনপি যদি নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসে, তাহলে বিচার বিভাগের পূর্ণস্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এবং অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধের নিরপে ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশের জনগণ বর্তমানে নির্দলীয় ও নিরপে সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছেন। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের এই ক্রান্তিকালে গণতন্ত্রকে রা এবং অব্যাহত রাখার জন্য আগামী নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপে। একমাত্র নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। তাই আমাদের সবার প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্ম বহুদলীয় গণতন্ত্রকে রা এবং অব্যাহত রাখার জন্য একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করবে।”
যারা ‘একদলীয় ফ্যাসিবাদের সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি’ করছে, তারা বিএনপির এমন ধর্মের কাহিনী শুনতে যাবে কেন? জাতীয় সংসদের আইনপ্রণেতারাই বা আদালতকে কিভাবে জনসভার আওয়াজকে আমলে নিয়ে রায় দিতে বলতে পারেন? নতুন প্রযুক্তি আমরা আমদানি করেছি। বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিযোগিতাম হতে জ্ঞান বৃদ্ধিতে প্রয়োগ কৌশল অর্জনে সেই প্রযুক্তির ব্যবহারকে রাজনৈতিক নেতারা উৎসাহিত করছেন না। তাদের শেখাচ্ছেন অতীতমুখী হতে আর গলাবাজির রাজনীতিতে দীা নিতে। এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন দেউলিয়াপনা আর কী-ই বা শেখাতে পারে নবপ্রজন্মকে?
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads