সারাদেশের আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। হঠাৎ করেই যে এই চরম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা বলা যাবে না। বলা যায়, প্রতিদিনই অবনতি ঘটতে ঘটতে এই চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর জাতীয় সংসদে বর্তমান আওয়ামী সরকারের গত চার বছরে সংঘটিত অপরাধসমূহের যে তথ্য তুলে ধরেছেন তা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি কতোটা বেহাল হয়ে পড়েছে। একাধিক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত চার বছরে ৫১টি রাজনৈতিক খুনসহ ১৬ হাজার ২৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে সর্বাধিক ১ হাজার ৮৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ৯৮ হাজার ১৮৪টি। এই সময়ে গুম ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ১৫৯, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫০ হাজার ৬৬৯ এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২ হাজার ৭৫০টি। অপরাধসমূহের এই তথ্য সরকারি। সরকারিভাবে নথিভুক্ত করা তথ্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন। এর বাইরে অপরাধের ঘটনা আরো বেশ কয়েকগুণ বেশি থাকতে পারে এবং আছে যে, তাতে দেশের সচেতন নাগিরক মহলে দ্বিমত নেই। গত চার বছরে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারাদেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, দস্যুতা, রাহাজানি, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ মাদক বেচাকেনা, পাচার ইত্যাদি অপরাধের অনেক ঘটনাই থানা পুলিশ, আইন-আদালত পর্যন্ত পৌঁছায় না। নতুন করে উল্টো ঝুঁকিতে পড়া ও অর্থহানি এবং জীবনাহানির আশঙ্কায় বিশেষ করে মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে অনেকেই ঘটনা চেপে যায়। সরকারি নথিভুক্ত অপরাধের সাথে নথিবহির্ভূত অপরাধের সংখ্যা মেলানো যেতে পারলে দেশের আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব হতো। সেটা অবশ্যই পাওয়া সম্ভব নয়। তবে পর্যবেক্ষক মহল একমত পোষণ করেন যে, গত চার বছরে দেশের আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির চরম অবনতির জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীন সররকারি দল ও মহলের একশ্রেণীর লোকের বেপরোয়া অপরাধ প্রবণতা যেমন অনেকাংশে দায়ী ঠিক তেমনি আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকাংশের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা এবং দায়িত্ব পালনে সরকারি দল ও মহলের প্রতি প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতও কম দায়ী নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য কথাটাই বলতে হচ্ছে, সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের একশ্রেণীর নেতাকর্মীরা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই প্রকাশ্যভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাস, খুনোখুনি, হানাহানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতিসহ নানা অপরাধ করে যাচ্ছে। এই চিহ্নিত দাগী অপরাধীদের সরকার ও আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই নিরস্ত করা কিংবা সামলানোর উদ্যোগ, পদক্ষেপ নেয়ার গরজ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও সদস্যদের একাংশ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। গত চার বছরে প্রায় ক্ষেত্রে তাদের অপরাধীদের সহযোগিতা করতেও দেখা গেছে। পুলিশ-র্যাব ও গোয়েন্দাদের চোখের সামনেই অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিত করছে অথচ তারা কোনো প্রকার বাধা পর্যন্ত দিচ্ছেন না। ক্ষেত্র বিশেষে কর্তব্যরত পুলিশ অপরাধীদের প্রটেকশন দিচ্ছেন এমন ঘটনা বহু ঘটতে দেখা গেছে। পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডারদের মতোই রাষ্ট্রের সংবিধান পরিপন্থী, প্রচলিত আইন বহির্ভূত, সন্ত্রাসী ও মানবতাবিরোধী আচরণ ও ভূমিকা পালন করতেও দেখা গেছে এবং এখনো যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, পেশাদার সন্ত্রাসী-অপরাধীদের সার্বিক সুযোগ পাওয়া ও সুযোগ ভোগ করা আজ স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। সরকার বিরোধী বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক জোটের নেতবৃন্দের একটি বড় অভিযোগ এই যে, আওয়ামী সরকার বাকশাল স্টাইলে পুলিশে ব্যাপক দলীয়করণ করেছে। পুলিশকে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতা-কর্মীদের দমনের অশুভ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাই এর লক্ষ্য। এই অকাট্য সত্য অভিযোগটি সরকারি দল ও মহল কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেন কি না সন্দেহ। বাস্তবতা হচ্ছে, পুলিশ সরকারি দল ও মহলের পরিকল্পিত এজেন্ডা বাস্তবায়নে তথাকথিত নাশকতার ধুয়া তুলে বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহের বৈঠক, মিছিল, সমাবেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গণাতন্ত্রিক কর্মসূচি বানচালে যতটা তৎপর, রাজধানীসহ সারাদেশের আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা সুরক্ষায় ততোটা সক্রিয় তৎপর নয়। এমতাবস্থায় দেশব্যাপী অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধ সংঘটনের মাত্রা আরো বহুগুণে বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল এই যে, সরকারি দল ও মহলের অন্তর্গত সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে বরং সারাদেশের মানুষের উপর লেলিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই প্রতিদিন অপরাধের মাত্রা কেবল বেড়েই চলছে। দেশের প্রবীণ সাংবাদিক, গবেষক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণাকে, মতামতকে একেবারে ঠেলে ফেলে দেয়া যাবে না যে, সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রভাব এবং পদে পদে হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশ আইন মাফিক যথাযথভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। পুলিশকে আইন ও শৃক্মখলা মোতাবেক বিশেষ করে পুলিশের নিয়মবিধি অনুযায়ী স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দাযিত্ব পালন করার সুযোগ দেয়া হলে দেশব্যাপী অপরাধ পরিস্থিতির এমন ভয়াবহ অবনতি ঘটতে পারতো না। তাদের মতে, পুলিশকে সরকারি দল ও মহলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা হলে পুলিশ আইন-শৃ্ক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা সুরক্ষার দাযিত্ব আরো সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারতো। সন্ত্রাসী ও পেশাদার অপরাধীদের দমনে পুলিশ ও র্যাব আরো সময় ও কড়া নজর রাখতে পারতো। আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা সুরক্ষা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অন্যতম বড় দায়িত্ব। সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা, সুশাসন, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক কার্যাক্রম পরিচালনা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান পূর্বশর্তই হলো, সুষ্ঠু আইন-শৃক্মখলা ও নাগরিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা। গত চার বছর ধরে দেশের আইন-শৃক্মখলা উন্নয়ন, নাগরিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের ব্যর্থতার পাল্লা কেবল ভারিই হয়েছে। অতএব সফলতার উদ্যোগ-পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন