বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

গণতন্ত্র ও সহনশীল সহাবস্থান


মাসুম খলিলী

গণতন্ত্রকে বিশ্বে সবাই সর্বোৎকৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে মনে করেনÑ এমনটি নয়। তবে সরকার ও রাজনৈতিকব্যবস্থা হিসেবে যেসব পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুসরণ হয়, তার মধ্যে তুলনামূলক গণতন্ত্রকে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। আবার গণতন্ত্রের চর্চাও বিশ্বের সব দেশে একই মাত্রায় হয় না। কোনো দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ ন্যূনতম ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের শাসন বলে ধরে নেয়া হয়। আবার কোনো কোনো দেশের শাসনতন্ত্র অনুসারে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুয়ের অধিক প্রার্থীর মধ্যে হলে প্রার্থীদের মধ্যে যিনি বেশি মানুষের ভোট পান তিনি নির্বাচিত হন। এ কারণে দলের প্রাপ্ত ভোটের সাথে আসনপ্রাপ্তির আনুপাতিক হার মেলে না। বিষয়টি বিবেচনা করে কোনো কোনো দেশে দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদের আসন বণ্টন করা হয়। আবার গণতন্ত্র রাষ্ট্রপতিশাসিত বা প্রধানমন্ত্রী (সংসদীয়)-শাসিতও হতে পারে। কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের মধ্যে আবার ক্ষমতার বিভাজন এমনভাবে করা থাকে, যাতে সেটাকে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীশাসিতÑ কোনোটাই বলা যায় না। সরকারপদ্ধতির এই পার্থক্য সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কতগুলো অভিন্ন মতাদর্শ বা বৈশিষ্ট্যকে সব ব্যবস্থাতেই ধারণ করা হয়। অন্তর্নিহিত এসব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করা সম্ভব না হলে সেসব সমাজ বা রাষ্ট্রে নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলেও গণতন্ত্র কার্যকর হয় না।
ছোট বা বড় যেকোনো রাষ্ট্রে একাধিক ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বিশ্বাস, ভাষা বা সংস্কৃতির মানুষের বাস থাকতে পারে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি হয় সংখ্যাগুরু আবার কোনো কোনোটি হয় সংখ্যালঘু। সংখ্যার বিচারে কোনো কোনো জনগোষ্ঠী অনুল্লেখযোগ্যও হতে পারে। জনবিন্যাস যেটিই হোক না কেন, গণতন্ত্র মানে মনে করা হয় সংখ্যারিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী শাসন আর সংখ্যালঘুদের সব ধরনের অধিকারের নিশ্চয়তাবিধান।
গণতন্ত্রের যে নানা রকম সংজ্ঞা দেয়া হয় তার মধ্যে একটি মতবাদে গণতন্ত্রের তিনটি মৌলিক নীতিমালার কথা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রথমত ঊর্ধ্বমুখী নিয়ন্ত্রণÑ এই নীতিমালা অনুযায়ী সার্বভৌমত্ব থাকবে কর্তৃত্বের সর্বনিম্নপর্যায়ে। দ্বিতীয় নীতিটি হলো রাজনৈতিক সমতা। আর তৃতীয় নীতিমালায় রয়েছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে এমন সামাজিক রীতি, যার মধ্যে প্রথম দুই মূলনীতির ঊর্ধ্বমুখী নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক সমতার প্রতিফলন ঘটাবে। উদার গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রাজনৈতিক বহুমত, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান হওয়া, অন্যায় বঞ্চনার প্রতিকার চাওয়ার অধিকার, যথাযথ প্রক্রিয়ার সুযোগ লাভ, নাগরিক স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং সরকারের বাইরে সুশীলসমাজের উপস্থিতি ইত্যাদিও বিবেচনা করা হয়।
বহু বর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্ঘাত নিরসনের জন্য গণতন্ত্র তার সহনশীল সহাবস্থানের আদর্শ দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। সহনশীলতা হলো নৈতিক, বস্তুনিষ্ঠ ও সম্মতির এমন এক প্রবণতা, যাতে কোনো এক ব্যক্তি তার মত, কাজ, বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা ইত্যাদি অন্য ব্যক্তি থেকে আলাদা হওয়ার পরও তা পালনের সুযোগ পাবে। আর সহাবস্থান হলোÑ ভিন্ন মত, পথ, বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতির অনুসারী বহু মানুষের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ বসবাস। এই সহনশীলতা ও সহাবস্থান একটি দেশ বা সমাজের গণতন্ত্রকে কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য প্রধান শর্ত হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে।
গণতন্ত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে বহু পথ, আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা আইনের সমপ্রয়োগ এবং সংখ্যালঘুদের যৌথ ও নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকারের স্বীকৃতি থাকে। বিশ্বের সমকালীন যেসব দেশে সঙ্ঘাত, সহিংসতা ও গভীর বিভাজন আমরা দেখে থাকি, সেটির কারণ ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো না থাকায় সেসব সমাজ বা রাষ্ট্র ভেঙে পড়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, ইসরাইল, লেবানন, ফিলিস্তিন, কঙ্গো বা এ ধরনের অনেক দেশের উদাহরণ দেয়া যাবে, যেগুলোতে একসময় সমাজে স্থিতি, সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থান ছিল। সেসব দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধিও ছিল। জনগণের সমভোটাধিকার বা নি¤œপর্যায়ের সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বমুখী নিয়ন্ত্রণ হয়তো সব সমাজে পুরোপুরি ছিল না। কিন্তু সহনশীলতা ও সহাবস্থান থাকায় সমাজে শান্তিময় পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল। পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো কোনো উৎসের উসকানি সমাজের সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ভেঙে দেয়। আফগানিস্তানে এর শুরুটা হয়েছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনীর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর সমাজ ও রাজনৈতিক-ব্যবস্থায় যে অস্থিরতা শুরু হয় তা নানা বাঁক ঘুরে এখনো যুদ্ধবিগ্রহের চক্র থেকে বের হতে পারেনি।
১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে ইহুদিদের জন্য জোরপূর্বক ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সহাবস্থান ও সহনশীলতা সেখানে ভেঙে দেয়া হয়েছে। এরপর দীর্ঘ ছয় দশক পার হলেও সেখানে শান্তি আসেনি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের দীর্ঘ শাসনব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক ছিল অনেক ক্ষেত্রে। সে ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে এখন যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে তাতে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বিবেচনায় সব পক্ষ সহনশীল আচরণ ও সহাবস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না বলে অস্থিরতা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এভাবে আফ্রিকার অস্থির দেশগুলোতে নতুন নতুন সঙ্ঘাত দেখা দিচ্ছে অসহিষ্ণু আচরণের কারণে।
কোনো একটি দেশ বা জাতির নতুন বিকাশের পর স্থিতি ও সংহতির জন্য সব মত, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও ধর্মকে পালন করার মতো একটি আবহ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই অসহিষ্ণুতা ও বিভক্তি সমাজে বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকার সে পরিস্থিতিকে একটি গণতান্ত্রিক এবং সব মত ধারণ করার ধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যারা ফৌজদারি ও যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেন। এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে দালাল আইনে বহুসংখ্যক মানুষের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচারের ব্যবস্থা হয়েছে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় সহযোগীদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট অপরাধের সাথে যুক্তদের এ বিচারের আওতায় আনা হয়। এর বাইরে রাজনৈতিকভাবে যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমার আওতায় তাদের দেশের মূল ধারায় নিয়ে আসেন। বৈদেশিক ক্ষেত্রে তিনি ব্যাপক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচারে চিহ্নিত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিষয়টিকেও ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমার আওতায় এনে নিষ্পত্তি করেন। তবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্য কিছু অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর পৃথক স্বীকৃতির বিষয়টি তিনি বিবেচনায় আনেননি। তাদেরকে তিনি হয়তো সরল মনে বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটি একটি ুদ্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তাদের সব ধরনের অধিকার নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ বসবাস করার অভিপ্রায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এর পরবর্তী সরকারগুলোর কিছু পদক্ষেপ তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষকে আরো বৃদ্ধি করেছে। এর জন্য বাংলাদেশকে এই পার্বত্য অঞ্চলে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, যদিও দেশের এক-দশমাংশ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা মাত্র ১০ লাখের মতো আর তার অর্ধেক হলো উপজাতীয় জনগোষ্ঠী।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমানের সরকার রাজনৈতিক সহাবস্থানের আওতাকে আরো বর্ধিত করে বৃহৎ জাতীয় ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সরকার ১৯৭১ সালে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির রাজনীতিতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে যে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন, সেই বাধা তিনি তুলে দেন। ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক বিভক্তি আইনগতভাবে ১৯৭৫-এর পর আর থাকেনি। বাংলাদেশের স্বাধীন বাস্তবতাকে যারা গ্রহণ করে নিয়েছেন, তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আর বাধা থাকেনি। তবে বিশ্বে অনেক দেশের রাজনীতিতে যেভাবে দু’টি ধারা সৃষ্টি হয়ে থাকে, ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশেও সেই ধরনের দু’টি ধারার সৃষ্টি হয়। এ দু’টি ধারার একটি হলোÑ স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সক্রিয় রাজনৈতিক ধারা; আর অপরটি হলোÑ এর পরবর্তী সময়কালে সৃষ্ট রাজনীতির ধারা। এই দুই ধারার মধ্যে ২০ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় শেষোক্ত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় ছিল। অন্য দিকে নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ এবং এরপর ২০০৮ সাল থেকে শেষোক্ত ধারার রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিকভাবে শেষোক্ত ধারা প্রাধান্য বিস্তার করলেও এর বিপরীত ধারাকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা বা অন্য কোনো নির্মূলকরণ-প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়নি। অন্য দিকে নব্বইয়ে দশকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথম ধারার রাজনৈতিক দল আবার ক্ষমতায় এলেও প্রতিপক্ষের রাজনীতিকে নির্মূলকরণের কোনো কর্মসূচি হাতে নেয়নি। বর্তমান মেয়াদে এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কার্যত ১৯৭৫-এর পরবর্তী ধারার রাজনীতিকে ক্ষমতাহীন এবং কোনো ক্ষেত্রে নির্মূলকরণ ধরনের কর্মসূচি নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি বড় ইস্যু হিসেবে সামনে আনা হয়েছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি। ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগে ও পরে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। এই যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পর আর আলোচনায় ছিল না। এই চুক্তির পর বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেছিলেন, বাঙালি যে ক্ষমা করতে জানে এ বিষয়টি আবার প্রমাণিত হলো। ২০০০ সাল নাগাদ এই ইস্যুটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর উত্থাপিত হয়নি। এমনকি নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যে গণ-আদালত করা হয়, সেটির বিষয়ও যুদ্ধাপরাধ ছিল না। স্বাধীনতার শত্রু রাজাকার আলবদর ইত্যাদি ইস্যু তখন সক্রিয় ছিল।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য এখন সংবিধানের সুরক্ষা দেয়া ১৯৭৩ সালের আইনটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেটি পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তদের মধ্যে একজনের ব্যাপারে রায় প্রদান করেছে। আরেকজনের ব্যাপারে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রয়েছে। এই ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে শাহবাগে ১০ দিন ধরে একটি জাগরণমঞ্চ করা হয়েছে, যেখান থেকে ট্রাইব্যুনালের রায় প্রত্যাখ্যান করে সব অভিযুক্তকে ফাঁসির দণ্ড দেয়ার জন্য দাবি জানানো হচ্ছে। এই মঞ্চ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়া, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষাঙ্গন, ব্যবসায়-শিল্পপ্রতিষ্ঠান, এনজিও, ধর্মীয় ট্রাস্টের নাম উল্লেখ করে এগুলোকে জাতীয়করণ অথবা বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। জাগরণমঞ্চের উদ্যোগ যেসব ব্লগার ও অনলাইন মিডিয়ার ব্যক্তিরা নিয়েছেন এবং যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তি সেখানে সংহতি প্রকাশ করতে যাচ্ছন, তাদের পরিচয় বিভিন্ন মিডিয়ায় আসছে। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক পেশাজীবী অঙ্গনের ১৯৭৫ পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ধারার সাথে সংযুক্ত এবং তারা যেসব দাবি জানাচ্ছেন তার সাথে ’৭৫-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ধারার দলগুলোর দাবির অনেকটা হুবহু মিল রয়েছে।
বাংলাদেশে অন্য যেকোনো দেশের মতো আদর্শগত বিরোধের কারণে পরস্পর বিপরীত কর্মসূচি থাকতে পারে। কিন্তু রাজনীতির নতুন যে মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে একটি পক্ষ আরেক পক্ষকে উৎখাতের কর্মসূচি দিচ্ছে। আর সে কর্মসূচিকে প্রশাসন ও সরকার থেকে সমর্থন দেয়া হচ্ছে। সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক) অলিখিত নির্দেশনায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের শাহবাগের জাগরণমঞ্চে হাজির করে স্লোগান দেয়ানো হচ্ছে ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই কর’ ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী সংসদে শাহবাগ মঞ্চের দাবিদাওয়ার সাথে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এরপর যুদ্ধাপরাধ বিচারের ১৯৭৩ সালের আইনটিতে আরেকবার সংশোধনী এনে আপিল নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে যে রাজনৈতিক পরিবেশ, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং এতে অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে, তা সমাজকে সুস্পষ্টভাবে দ্বিধাবিভক্ত করছে। বিষয়টি যেহেতু এক পক্ষ আরেক পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তাই এটি সঙ্ঘাত ও সহিংসতার শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মাত্র পাঁচ লাখ উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্ঘাত দমন করতে জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এখন একটি মূল ধারার রাজনৈতিক শক্তিকে যাদের সক্রিয় সমর্থকের সংখ্যা কোটির বেশি এবং যাদের সামাজিক শেকড় অনেক গভীরে, তাদের উপড়ে ফেলা খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। এ ধরনের উদ্যোগ এ দেশকে আফগানিস্তান, সুদান এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সে পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এ আশঙ্কার অবশ্যই মূল্য রয়েছে।
এ অবস্থা থেকে প্রস্থানের বিষয় নিয়ে না ভাবলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে যে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়তে পারে সে আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যু নিয়ে যতই বিতর্ক হোক না কেন এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও মানবাধিকার সংস্থা এ বিচার-উদ্যোগের ব্যাপারে খুব বেশি দ্বিমত প্রকাশ করেনি। তাদের উদ্বেগ ছিল এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বিষয় এবং বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে। এখন যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়ে দেশে-বিদেশে যে সমালোচনা-বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তাতে এর কোনো বিচারিক কার্যক্রম গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে মনে হচ্ছে না। এ অবস্থায় জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এই বিচারকার্যক্রম সম্পন্ন করার ব্যাপারে আইনজীবীদের পক্ষ থেকে যে দাবি উঠেছে, সেটিকে গভীরভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটি হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে যে স্পর্শকাতরতা রয়েছে, সেটির নিষ্পত্তি হতে পারে। অন্য দিকে গণতন্ত্রের জন্য যেসব পক্ষের সহনশীল সহাবস্থান প্রয়োজন, সেটিও নিশ্চিত হবে। একই সাথে বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের সঙ্ঘাত বিভাজনের শঙ্কা থেকেও মুক্ত হবে।
mrkmmb@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads