পদ্মা সেতু শেষ পর্যন্ত ঝুলেই গেলো। আওয়ামী লীগ সরকারের দিক থেকে চেষ্টার সম্ভবত ত্রুটি ছিল না। বিশ্বব্যাংকের মান ভাঙানোর জন্য অর্থমন্ত্রী আরো একবার ওয়াশিংটন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে গত ৩০ জানুয়ারি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিং সরকারের উদ্দেশে শেষকথা শুনিয়ে দিয়েছেন। ওইদিন ওয়াশিংটনের এক অনুষ্ঠানে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, শর্ত পূরণ না করলে পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ দেবে না বিশ্বব্যাংক। আসল কাজে অষ্টরম্ভা হলেও প্রতিক্রিয়া দেখানোর ব্যাপারে সরকার অবশ্য যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে খবর আসার পর দেরি না করে বিশ্বব্যাংককে লেখা এক চিঠিতে সরকার জানিয়ে দিয়েছে, তারাও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেবেন না। ঋণ চেয়ে এর আগে যেসব চিঠি ও প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল সেগুলোও প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। বিষয়টিকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখাতে চাইতে পারেন। বলতে পারেন, বিশ্বব্যাংক ‘না' করে দেয়ার আগে তারাই বিশ্বব্যাংককে ‘না' করে দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রকৃত সত্য কিন্তু তেমন নয়। ৩০ জানুয়ারির কথাই ধরা যাক, যেদিন ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিং যথেষ্ট কঠোর ভাষায় নিজেদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানান দিয়েছেন। একই দিন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয় নিরসনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মীমাংসা হয়ে গেলেই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে অনেকাংশে ঘোষণার ঢঙে বলেছেন, তার সরকারের আমলেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। কথা শুধু এটুকুই নয়। যোগাযোগমন্ত্রী কিন্তু সেদিনই ভিন্ন কথা শুনিয়েছেন। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের ‘চ্যাপ্টার' শেষ হয়ে গেছে! মন্ত্রী অবশ্য ‘যদি' ও ‘তাহলে'ও যোগ করেছিলেন। বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যদি না আসে তাহলে সরকার নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করবে। এটা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য নাকি সরকারের রয়েছে! এখানে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যও উল্লেখ করা দরকার। ৩০ জানুয়ারির একই দিনে তিনি আবার শুনিয়েছেন সম্পূর্ণ উল্টো কথা। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বিশ্বব্যাংক টাকা না দিলে বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব নাও হতে পারে। যোগাযোগমন্ত্রীর মতো অর্থমন্ত্রীও অবশ্য নিজেদের ‘সামর্থ্যের' ব্যাপারে জানান দিয়ে বলেছেন, দাতারা এগিয়ে না এলে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে ২০০৬-০৭ সালের বাংলাদেশের নাকি ‘আকাশ-পাতাল' ব্যবধান । সে কারণে সরকার চাইলে নিজেরাই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারেন!
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সর্বশেষ উপলক্ষেও ক্ষমতাসীনরা জনগণকে দ্বনেদ্বর মধ্যেই ফেলেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী যেখানে বিশ্বব্যাংকের ‘চ্যাপ্টার'ই শেষ করে দিয়েছেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী কিন্তু অন্য কথা শুনিয়েছিলেন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ‘অমীমাংসিত বিষয় নিরসনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে' তখন ধরে নেয়া যায়, তারা এখনো টাকার জন্য বিশ্বব্যাংকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর কথায়ও পরিষ্কার হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক টাকা না দিলে তাদের পক্ষে অন্তত বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। সম্ভব যে হবে না সে কথাটা এতদিনে সাধারণ মানুষও বুঝে ফেলেছে। কিন্তু সে সত্যটুকু সহজে স্বীকার করতে চাননি ক্ষমতাসীনরা। অথচ সত্য স্বীকার করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ করলে কারো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো না। কিন্তু সহজ সে পথটিতে যাওয়ার নাম করেননি তারা। সে কারণেই বিশ্বব্যাংকও এক হাত দেখিয়ে ছেড়েছে। বোঝা গেছে, প্রধানমন্ত্রী যতোই বলুন না কেন, ‘অমীমাংসিত বিষয়ের' আসলে ‘নিরসন' হয়নি।
কি সেই অমীমাংসিত বিষয় সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গত বছরের জুন মাসে এসে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত ঋণ চুক্তিটি বাতিল করেছিল। ৩০ জুন ওয়াশিংটনের সদর দফতর থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী মহাজোট সরকারের অসহযোগিতার উল্লেখ করেছিল। সংস্থাটি বলেছিল, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ' পাওয়া গেছে। এসবের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের পরিচালিত তদন্তের দুটি রিপোর্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে এবং ২০১২ সালের এপ্রিলে রিপোর্ট দুটি পৌঁছে দেয়ার সময় বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ব্যাপারে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছিল। সংস্থার অবস্থান ব্যাখ্যা করার এবং পাঠানো প্রস্তাবের জবাবে সরকারের সিদ্ধান্ত ও তৎপরতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার জন্য বিশ্বব্যাংক ঢাকায় একটি প্রতিনিধি দলও পাঠিয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া ও জবাব ‘সন্তোষজনক' ছিল না। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আহবান ও দুর্নীতি সংক্রান্ত তিনটি প্রসঙ্গের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কোনো পদক্ষেপও নেয়নি সরকার। সে কারণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষে ‘চোখ বুজে থাকা' সম্ভব হয়নি। সংস্থাটি পদ্মা সেতু চুক্তি বাতিল করেছিল।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ যে বানোয়াট ছিল না সে সম্পর্কে জানা গিয়েছিল তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়া কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের অভিযুক্ত দু'জন কর্মকর্তার কাছে। তারা স্বীকার করেছিলেন, মন্ত্রী ও যোগাযোগ সচিবসহ তিনজন ১০ শতাংশ হারে ঘুষ দাবি করেছিলেন এবং এসএনসি-লাভালিনও সম্মত হয়েছিল। এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর এক মরহুম ফুফাত ভাইয়ের ছেলে। ওয়াশিংটন, লন্ডন ও টরেন্টোতে বসবাসরত বিশিষ্ট আরো জনাকয়েকের নামও আলোচনায় এসেছিল। এসব বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক তাগিদ দিয়েছিল। সংস্থাটি একই সাথে মন্ত্রী আবুল হোসেনের পাসপোর্ট ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বলেছিল। উইকিলিকসের তথ্যেও প্রথমে অবুল হোসেনের নামই এসেছিল। অন্যদিকে সরকার শুধু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগই অস্বীকার করেনি, মন্ত্রী আবুল হোসেনকেও ‘মিস্টার ক্লিন' হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আবুল হোসেনকে ‘মহান দেশপ্রেমিক' বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। ঘটনাপ্রবাহের ওই পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে তারা যেন যুদ্ধই ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন! মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা শুধু নন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, টাকাই যেখানে আসেনি সেখানে ঘুষ খাওয়ার ও দুর্নীতি করার প্রশ্ন আসে কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্যই করেননি যে, ঘুষের বাণিজ্যে ‘সমঝোতা' ও ‘আয়োজন' ধরনেরও কিছু কথা আছে। ‘সমঝোতা' হলে সবই আগাম বা নগদে দিতে হয় না বরং নির্ধারিত সময়ে ‘আয়োজন' অনুযায়ী দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। বিশ্বব্যাংক নিশ্চয়ই সে ধরনের কিছু তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিল। অন্যদিকে সরকারের পাশাপাশি দুদকও জনগণকে স্তম্ভিত করেছে। তদন্তের নামে হৈচৈ করলেও এক সপ্তাহের মধ্যেই আবুল হোসেনকে সততার সার্টিফিকেট দিয়েছিল দুদক। দুদকের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন, ১০ শতাংশ হারে ঘুষ চাওয়ার ব্যাপারটিতে নাকি হিসাবের ‘গরমিল' রয়েছে! অর্থাৎ ঘুষের অভিযোগ সঠিক, ভুল আছে শুধু শতকরা হারের হিসাবে! এসবের ফলে বিশ্বব্যাংকের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, তাদের রিপোর্টে যেহেতু ‘প্রভাবশালী' অনেকের নাম এসেছে সে কারণে দুদকের পক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না। এজন্যই বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করেছিল।
ঘটনাপ্রবাহের ঠিক সে পর্যায়েই এসেছিল ‘চমক' দেখানোর পালা। লম্বা অনেক বাগাড়ম্বর করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ ‘নিজেদের অর্থে' পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে বসেছিলেন। বলেছিলেন, তারা আর কারো কাছে ভিক্ষা চাইবেন না। ‘নিজেদের অর্থ' সংগ্রহের পন্থা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকেও অর্থ সংগ্রহের হুকুম দিয়েছেন। সে হুকুম পালনের জন্যই দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল চাঁদাবাজি। এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে প্রথমে হাতাহাতি, তারপর গোলাগুলী এবং সবশেষে একজনের লাশ ফেলেছে কীর্তিমানেরা। ১৫ জুলাই আবারও হত্যাকান্ড ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘নিজেদের অর্থে' পদ্মা সেতু নির্মাণের কর্মকান্ডে এররপর ছিল সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ও উৎসব ভাতা কেটে নেয়া, মোবাইল ও বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতিটি পণ্যের ওপর বাড়তি কর বসানো পর্যন্ত জনগণের পকেট কেটে নেয়ার নানা পন্থা। বিপুল সে অর্থের কিছুটা যেতো নেতা-কর্মীদের পকেটে, বাকিটা দিয়ে দলের নির্বাচনী তহবিল বানাতেন ক্ষমতাসীনরা। লোক দেখানোর জন্য সেতু নির্মাণের কিছু তৎপরতাও তারা চালাতেন। কিন্তু চাঁদাবাজিই হতো আসল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি ছিল নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার কৌশল। এজন্যই তারা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী বক্তব্য রেখেছেন, ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সরদারের মতো হওয়ায় তরবারি ঘুরিয়েছেন।
এতে অবশ্য কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ক্ষমতাসীনদের শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের ইচ্ছার কাছেই নতিস্বীকার করতে হয়েছিল। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ছুটি নিয়ে সরে পড়েছিলেন। তারপর পদত্যাগ করেছিলেন ‘মিস্টার ক্লিন' ও ‘মহান দেশপ্রেমিক' মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। আবুল হোসেনের পদত্যাগের ফলে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ নাটকীয় মোড় নিয়েছিল, সৃষ্টি হয়েছিল নতুন সম্ভাবনার। কারণ, পদ্মাসেতু নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির যে অভিযোগে বিশ্বব্যাংক শেষ পর্যন্ত ঋণচুক্তিই বাতিল করেছিল সেসবের প্রতিটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে আবুল হোসেনের নাম। দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত প্রধানজনেরা প্রকল্পে জড়িত থাকছেন না বলে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিশ্বব্যাংক আবারও ঋণ দিতে সম্মত হয়েছিল। সংস্থাটি সেই সঙ্গে চারটি শর্তও জুড়ে দিয়েছিল। শর্ত চারটি হলো, সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ছুটিতে পাঠানো, অনিয়ম তদন্তে দুদকের নেতৃত্বে বিশেষ একটি তদন্ত দল গঠন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া এবং নতুন প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা গোষ্ঠীকে ক্রয় ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া। কিন্তু সরকার যথারীতি সেই বিশেষ কয়েকজনকে আড়াল করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিশ্বব্যাংক যাদের ‘সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ঠিক কারা এবং তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারো ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা রয়েছেন কি না সেকথা জনগণকে এখনো জানতে দেয়া হয়নি, যদিও বিশ্বব্যাংক নাম ধরে ধরেই সবার কথা সরকারকে জানিয়েছিল। বলেছিল, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ শুধু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল না, দেশের ভেতরেও এসব নিয়ে যথেষ্টই কথা হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সোচ্চার হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া সরাসরি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ‘পরিবার' এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলেই সরকার চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করে চলেছে, যার ফলে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত ও অসম্মানিত হতে হচ্ছে। জবাবে শেখ হাসিনা নিজেই তার ‘পরিবার' সদস্যদের সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। বলেছেন, তার ‘পরিবার' বলতে তিনি নিজে, বোন রেহানা এবং দু'জনের পাঁচ সন্তানকে বোঝায়। কথাটা কিন্তু না বললেও চলতো। কারণ, এটুকু সবই জানেন। জনগণ যা জানে না তা হলো, তার বোন রেহানা এবং সুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও সুকন্যা পুতুলসহ পাঁচ সন্তানের কে ঠিক কোন ধরনের কাজ করেন অর্থাৎ তাদের আয় আসে কোত্থেকে? সবাই তারা বিদেশে থাকেন- কেউ লন্ডনে, কেউ ওয়াশিংটনে, কেউ কানাডার টরেন্টোতে। শোনা যায়, প্রত্যেকে থাকেনও আবার প্রচুর বিলাসিতার মধ্যে, তাদের বিত্ত-বৈভবও নাকি বিপুল। প্রশ্ন উঠেছে, এত বিপুল টাকা তারা পান কোথায়? তাদের কেউই তো নাকি এমন কোনো চাকরি বা ব্যবসা করেন না, যা থেকে এত বিপুল টাকার আয় আসতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এসব প্রশ্নের জবাব দেননি। তিনি বরং ‘নিজেদের অর্থে' পদ্মা সেতু নির্মাণের গালগল্প শুনিয়েছেন। বিরোধী দলের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করেছেন।
কিন্তু এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যটি হলো, প্রকাশ্যে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে তরবারি ঘোরালেও ভেতরে ভেতরে আপস আর সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েছে সরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ছাড় দেয়নি এক ইঞ্চি পরিমাণও। শেষ পর্যন্তও নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছে সংস্থাটি। এজন্যই সরকার আড়াল করতে চাইলেও বিশ্বব্যাংকের চিঠিগুলো এবং রিপোর্ট দুটি প্রকাশ করার জোর দাবি উঠেছে। বলা হয়েছে, প্রকাশ করা হলে জনগণ জানতে পারবে, কোন পক্ষ আসলে দায়ী- বিশ্বব্যাংক না ক্ষমতাসীনরা? জনগণ আরো জানতে পারবে, বিশ্বব্যাংকের আহবান সত্ত্বেও সরকার কেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি, সরকারের প্রতিক্রিয়া ও জবাব কেন বিশ্বব্যাংকের জন্য ‘সন্তোষজনক' ছিল না এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষে কেন ‘চোখ বুজে থাকা' সম্ভব হয়নি। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, চুক্তি বাতিল করার পর মুহূর্ত থেকে বিশ্বব্যাংককে তুলোধুনো করলেও ক্ষমতাসীনরা কিন্তু কোনো অভিযোগেরই যুৎসই জবাব দিতে পারেননি। বরং অর্থ উপদেষ্টা মশিউর রহমানের ছুটি, মন্ত্রী আবুল হোসেনের পদত্যাগ এবং তৎকালীন যোগাযোগ সচিব ও প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট অফিসারদের সরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে তারা বরং স্বীকার করে নিয়েছেন, দুর্নীতি আসলেও হচ্ছিল। ওই পর্যায়ে উচিত যেখানে ছিল বিশ্বব্যাংকের বাকি শর্তগুলো পূরণ করা, ক্ষমতাসীনরা সেখানে চাতুরিপূর্ণ কৌশল নিয়ে পদ্মা পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এজন্যই বিশ্বব্যাংককেও কঠোর অবস্থান নিতে হয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ পর্যায়ে এসে সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ না নেয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলেও পদ্মা সেতুর বিষয়টি কিন্তু ঝুলেই রইল। কারণ, দেশকে ক্ষমতাসীনরা যতো আসমানেই তুলে থাকুন না কেন এবং ‘সামর্থ্য' তাদের যতোই থাকুক না কেন, বাস্তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি সরকারের নেই। এটা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পুলিশ দিয়ে লাঠি পেটা করানোর মতো সহজ কোনো কাজ নয়। অথচ বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিতে জড়িত ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের' ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যে দাবি জানিয়েছিল সে দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে অনেক আগেই ঝামেলা মিটে যেতো। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের' ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, তাহলে একজন আবুল হোসেন শুধু নন, আরো অনেকের নামই বেরিয়ে আসবে যাদের কারো কারো সঙ্গে আবার ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের'ই সম্পর্ক রয়েছে! বলার অপেক্ষা রাখে না, পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তিকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে সবশেষে দেশ ও জাতিকে লজ্জায় ডুবিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ, নিজেদের সামর্থ্যের কথা শোনানো হলেও দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা সরকারের চিন্তা ও কল্পনার সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারেননি। তারা হিসাব কষে দেখিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গেলে লাভের চাইতে ক্ষতি হবে হাজার গুণ বেশি। বিশ্বব্যাংক যেখানে শতকরা মাত্র ০.৫ ভাগ সুদে ঋণ দিতে চেয়েছিল সেখানে পাঁচ শতাংশের কমে অন্য কোনো সংস্থা বা রাষ্ট্রের কাছেই ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। আর পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি হারে সুদ গুনতে হলে পদ্মা সেতুকে মোটেও সম্ভাবনাময় বা ভায়াবল বলা যায় না। সব জেনে-বুঝেও সরকার যেভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে তা দেখে মনে হচ্ছে, সেতু নির্মাণের মাধ্যমে জনগণের সেবা করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য আসলে চমক দেখানো। অর্থাৎ পদ্মা সেতুকে নিয়ে রাজনীতি করা। এভাবে সাধারণ মানুষের সামনে গালগল্প শোনানো যাবে সত্য কিন্তু ‘নিজেদের অর্থে' আর যা কিছুই হোক পদ্মা সেতু অন্তত নির্মাণ করা সম্ভব হবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন