বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

কোন পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ


বাংলাদেশ ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল অনেক সমস্যায় কণ্টকিত হয়ে। ভাত-কাপড়ের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তো ছিলই; আর সব সমস্যা ছিল দেশটাকে প্রায় পুরো বেস্টন করে রাখা ভারতের সঙ্গে।
অতীতের খবর যারা রাখেন, তারা জানেন, শেখ মুজিবের সময় থেকেই ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিরোধীয় বিষয়গুলো নিত্তি নিয়ে টালবাহানা চলেছে। কিন্তু কোনো সমস্যারই সমাধান তখন হয়নি। সমাধান হয়নি গঙ্গার পানি বন্টনের, দহগ্রাম-তিনবিঘা করিডোরের, ট্রানজিটের, দক্ষিণ তালপট্টির, অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয়ের। বলতে দ্বিধা নেই, মুজিব ভারতের কোনো ‘আবদার'ই রক্ষা করেননি। তিনি সেই সময় ভারতের প্রধান দাবি গ্যাস দিতেও সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। তখন বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনো নিত্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। যেগুলো ছিল বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরার সমস্যা, সেগুলো ভারতের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। তারা গুরুত্ব দিয়েছিল, তারা বাংলাদেশ থেকে যা পেতে চায়, সেগুলোর ওপর। তারা পেতে চেয়েছিল বাংলাদেশের গ্যাস, পেতে চেয়েছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে যাতায়াতের ট্রানজিট, পেতে চেয়েছিল ছিটমহল বেরুবাড়ি, দক্ষিণ তালপট্টি। মুজিব অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন এসব ব্যাপারে। তিনি সতর্ক ছিলেন ভারতের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাওয়ার বিষয়েও। কিন্তু তারপরও সামাল দিতে পারেননি-ছিটমহল, বেরুবাড়ি-দহগ্রামের বিষয়টিকে।
মুজিব পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসার প্রায় পরপরই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করে নিয়েছিল ভারত। চুক্তিটি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত বেরুবাড়ি দখল নিয়ে সমস্যায় ফেলে রাখে দহগ্রাম-তিনবিঘাকে। এ বিষয়ে মুজিবের সময় বার বার বৈঠক হয়েছে ভারতের সঙ্গে। কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি। তিনবিঘা করিডোর কথাটির ব্যাখ্যা নিয়েই সেসব বৈঠক ভেঙ্গে গেছে। এ বিষয়ে ভারত যা পেতে চেয়েছে এবং বাংলাদেশকে যা বোঝাতে চেয়েছে মুজিব তা মানেননি।
আওয়ামী লীগ কোন পথে হাঁটছে আজ, এটি একটি সরব প্রশ্ন। বর্তমান পথ তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদর্শিত পথ?  আজ যখন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তার মন্ত্রীরা ভারতের পক্ষে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলছেন, তখন তাদের দেশপ্রেমই বা কি আছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
মুজিব বিদ্বেষীদের কাছে টেনে আস্থায় নেওয়া, অন্যদিকে দল ও নেতার প্রতি আজীবন অনুগত অবিচল নেতা-কর্মীকে অবিশ্বাস করে অনাস্থায় দূরে ঠেলে দেওয়া অবিশ্বাস্য। অসংখ্য মুজিব অন্তঃপ্রাণ কর্মী আজ পরাহূতই নন, অবিশ্বাসের পাত্রও। প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আছেন দেউলিয়া মুজিব বিদ্বেষী, আওয়ামী লীগ বিরোধী, স্তাবক ও মোসাহেব।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এমন অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নূরে আলম সিদ্দিকি। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২)
শেখ মুজিব সব সময়ই সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রাদর্শের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সে সমাজতন্ত্রের রূপরেখা তিনি কখনো খুলে বলেননি এবং এটাও পরিস্কার যে, মুজিবের সমাজতন্ত্রে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর কোনো স্থান ছিল না। হাই কমান্ড গোড়া থেকেই একদলীয় পদ্ধতি চেয়েছিলেন। ‘লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দেবো' তিনি জাসদকে লক্ষ্য করেই বলেছিলেন। লাল ঘোড়াকে দমনের কোনো চেষ্টারই ত্রুটি হয়নি।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা সহিংসতা ও অসাধুতা দ্বারা অন্তত চারটি আসনে (জাসদের কাছ থেকে) বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। মনে রাখতে হবে সে সময় বাংলাদেশে জাসদ ছাড়া অন্য কোনো সুসংগঠিত সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে জাসদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। (সূত্রঃ মুজিব হত্যায় জাসদের কোন ভূমিকা ছিল কি?, সিরাজুর রহমান, দৈনিক নয়াদিগন্ত ৩০ নবেম্বর ২০১২)
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে রক্ষীবাহিনী যে কম বেশি ৪০ হাজার লোককে হত্যা করেছিল তাদের প্রায় সবাই ছিল জাসদের কর্মী কিংবা সমর্থক। জাসদের প্রভাবমুক্ত একদলীয় সংসদ গঠনের উদ্দেশ্যেই ১৯৭৩ সালে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। সে নির্বাচনে জাসদ অল্প কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকেরা সেটাকে বেয়াদবি বলেই তাকে বুঝিয়েছিল। অথচ জাসদের হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনা সরকারের তথ্য মন্ত্রী হয়েছেন।
নির্বাচন সস্পর্কে মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘.....নির্বাচনের পরও দেখা গেল প্রশাসনযন্ত্রের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা তাদের ফলাফল পরিবর্তন করে ফেলেছেন। মেজর (অবঃ) জলিল, শাহজাহান সিরাজ, নূরুদ্দিন জাহিদ, নুরুল ইসলাম মাষ্টার ও মোহাম্মদ ইসমাইলকে তাদের আসনে নিশ্চিত বিজয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে....বেতার ও টিভিতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা যায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রথম সারির নেতা নির্বাচনে পরাজিত হতে চলেছেন। তখন তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রচারের জন্য গণভবনে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলেন.....এমনকি ভোট গণনা ও ফলাফলের প্রবণতা যখন কয়েকজন বিরোধী দলের নেতার সুনিশ্চিত বিজয়ের ইংগিত দিচ্ছিল, তখন অন্ততঃ পক্ষে ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। তারা সমস্ত ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয় এবং সেখানে ব্যালট ভর্তি বাক্স রেখে আসে.......আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা শুধু নির্বাচিত হবারই চিন্তা করেননি বরং নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের প্রতিযোগিতায় নেমে নির্বাচনের পরিবেশকে উত্তপ্ত করেছেন। নিজেদের মধ্যেই একটি অকথিত প্রতিযোগিতা ছিল কে বেশী ভোট লাভ করতে পারেন। ঢাকা-১৩ আসনে দেখা গেল গাজী গোলাম মোস্তফা প্রদত্ত ১,৬২,৩০৬ ভোটের মধ্যে ১,১০,২৮৪ ভোট পেয়েছেন, অথচ শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা-১৫ আসন থেকে পেয়েছেন ১,০৫,৯৫৮ ভোট। তখন তাঁর (শেখ মুজিবের) ভোট বাড়িয়ে ১,১৪,৯২৮ টি করা হয়। এসব এলাকায় সত্তরের স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনেও এত বিপুল ভোট পড়েনি.......।'
আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ভাষায়, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রী ছিলেন বলে ইনুদের দাবি অনুযায়ী বিপ্লবী সরকার গঠন না করে নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করতে যান। সে সময় ইনুরা মুজিব সরকারকে উৎখাত করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করে গণবাহিনী গঠনের মাধ্যমে গোপন রাজনীতিতে গিয়ে অন্ধকারের কর্মকান্ডে সরকারকে নাস্তানাবুদই করেননি, দলের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে জুতা বানানোর কথাও বলেছিলেন। এমনকি বিপ্লবী সরকার গঠনে তাহেরের নেতৃত্বে নিষ্ফল যে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন তার তৎপরতা মুজিব শাসনামলেই শুরু করেছিলেন। তাই সেদিন সংসদে কী বলবেন জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনুকে বলে বসেন, সংসদে তোমার বক্তব্য রাখা যত সহজ, আওয়ামী লীগ নেতাদের তত সহজ নয়। তুমি সংসদে বলবে, যে বঙ্গবন্ধুকে যৌবনে উৎখাত করতে পারিনি, আজ জীবনসায়াহ্নে তার কন্যার শাড়ির অাঁচল ধরে সংসদে আসায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
মঞ্জু বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ ইরাক আক্রমণ ও সাদ্দামকে হত্যা করার জন্য অনেক কারণের মধ্যে একটি উল্লেখ করেছিলেন যে সাদ্দাম তার পিতাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তাই পিতার শত্রুকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সেখানে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিশোধ নয়, এমপি-মন্ত্রী বানিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন। আমরা সবাই বলি, রাজনীতিতে চিরশত্রু বা চিরমিত্র বলে কিছু নেই, সেটি প্রধানমন্ত্রী বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২)
শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার গুটি কয়েক সদস্য ছাড়া অধিকাংশেরই রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে দেশবাসীর কোনো ধারণা নেই। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝাপড়ায় তারা কতটা যোগ্য বা পারদর্শী, তা নিয়েও মন্তব্য করা কঠিন। আসলে এদের সম্পর্কে জানার সুযোগই তো আগে কখনো হয়নি। এদের অনেককেই আগে মন্ত্রী হিসেবে তো দূরের কথা, একটি সিটি কর্পোরেশন বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হিসেবেও মিডিয়ায় নাম দেখা যায়নি।
রাজনীতির ময়দানেও কি ডা. দীপু মণি, ফারুক খান, খন্দকার মোশাররফ হেসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাকদের কখনো দেখা গেছে? এরাই তো আজ বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন!
জোট সরকারের শাসনামলে বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকার সময় বোমাবাজির অজুহাতকে পুঁজি করে শেখ হাসিনার জন্য সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দাবিটি এতো শিগগির কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এক একটি বোমাবাজি হয়েছে বা ঘটানো হয়েছে এবং সাথে সাথেই দলীয়ভাবে প্রকাশ্যেই দাবী করা হয়েছিল যে, শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন; তাই বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় খরচেই করতে হবে।
তিনি যখন দেশে থাকবেন, তখন যেমন বিশেষ সরকারী ভবন তার জন্য ছিদ্রহীন নিরাপত্তাসহ সংরক্ষণ করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে তিনি যখন বিদেশে-ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে এমনকি বেসরকারীভাবে ভ্রমণ করবেন, অবস্থান করবেন, তখনও প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয় করে তার নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করতে হবে।
নজিরবিহীন এমন দাবীর ঘটনা কোন সভ্য দেশে কেন, অন্য কোন দেশেই খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও এই নজিরবিহীন বিশেষ নিরাপত্তার জন্য ওরা নিজেদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে বিশেষ বিধানও তৈরি করেছে। শুধু কি তাই? এই আইনী নিরাপত্তার জন্য দেশের গরীব জনগণের ট্যাকসের টাকার কোষাগার থেকে কোটি কোটি ডলারের খরচাদিও বরাদ্দ হয়েছে।
শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলেই সরকারী বিশাল গণভবন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও নেয়া হয়েছিল। জাতীয় সংসদে আইন তৈরি করে হাসিনার আজীবন বসবাসের জন্য নিশ্চিত করেছিল। জোর জবরদস্তিমূলকভাবে জনগণের সম্পত্তি ব্যক্তিগতভাবে কুক্ষিগত করার জঘন্য নজির এই বাংলাদেশেই আওয়ামী লীগ সম্ভব করেছিল। ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি যে অসংখ্য প্রপাগান্ডা আমরা শুনতাম, তাকি এতদিনে নিছক উদ্দেশ্যমূলক প্রপাগান্ডা বলে প্রমাণিত হয়নি?
সংবাদপত্রে প্রকাশ, ভারতের সঙ্গে নাকি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় দু'দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্রমেই অবনতি হতে থাকে ও অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দিল্লির কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোন আশ্বাস না পাওয়ায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। মনমোহনের ঢাকা সফরকালে যে অভিযোগ তুলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তিস্তা চুক্তিতে রাজি হননি, সেই অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেননি তিনি। বরং ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তিস্তা চুক্তি না করতে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতাকে রাজি করাতে একাধিকবার চেষ্টা করেছে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার। দিল্লিকে বোঝানোর জন্য পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেন মমতা ব্যানার্জি। মমতা এক সদস্যের এই কমিশনকে দায়িত্ব দেন তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে। কমিশন তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে কোন প্রতিবেদন পেশ করেনি। রুদ্র কমিশনের প্রতিবেদন তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী পানি দেয়ার জন্য অনুকূল নয়। তাই এই কমিশনের প্রতিবেদনটি আর আলোর মুখ দেখেনি। মনমোহনের ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিট চুক্তিতে রাজি হয়নি বাংলাদেশ। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিটের ব্যাপারেও বাংলাদেশ আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি।
সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই মহাজোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। মহাজোটের ভোটের বাক্সে যে উলম্ফন ঘটিয়েছিল গেল বার, আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার ব্যত্যয় ঘটবে; উল্টে যেতে পারে ভোটের হিসাব-নিকাশ।
শেয়ারবাজারে পুঁজি খোয়ানো ক্ষুদে বিনিয়োগকারীরা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। বৈদেশিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে অসস্তুষ্টি রয়েছে। বেসামাল আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক মহলে ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগ। এ ধরনের অস্বস্তি, বিব্রতকর ও উৎকণ্ঠাময় পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ঘটনা।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের ‘অনুরোধ' সত্ত্বেও ড. ইউনূস ইস্যুর সম্মানজনক নিত্তি না হওয়ায় দূরত্ব তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে। ড. ইউনূস ইস্যুতে সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ঢাকায় এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে দূরত্ব। এ পরিস্থিতিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায়। শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকান্ডের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র।
দূরদৃষ্টিমূলক সিদ্ধান্ত না থাকায় উদার হয়ে পড়া মিয়ানমারের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ এখনও গড়ে উঠছে না। স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বক্তৃতা হলেও কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারগুলোতে এখন প্রতিদ্বনদ্বী দেশগুলোর প্রাধান্য। তছনছ হয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে খুব একটা ভালো করতে পারছে না বাংলাদেশ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস-ইউপিডিএফের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একে অপরকে ঘায়েল করতে তারা মরিয়া। পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটির কুদুকছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১০০ জন নিহত হয়েছেন।
 নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি। প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন স্থানে নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হচ্ছে। পুলিশ ও র‌্যাব স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় অপরাধ কর্মকান্ড চালাচ্ছে। বেপরোয়া সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। খুন, ডাকাতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জবরদখল ও নারী নির্যাতনসহ সব ক্ষেত্রেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামাল। সাধারণ মানুষের মধ্যে অপহরণ বা নিখোঁজ আতংক বিরাজ করছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তেষ্টি রয়েছে ঘরে-বাইরে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রায়ই তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা তুলে ধরেন। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও পিছিয়ে নেই। বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী জীবিত না মৃত কেউ বলতে পারছেন না। মহাজোট সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭ হাজার ৩২ জনকে মামলা থেকে নাম প্রত্যাহার করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় যাদের নাম প্রত্যাহার করা হয়েছে অধিকাংশই সরাসরি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত।
বর্তমান সরকার চাঞ্চল্যকর দুটি হত্যা মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ২২ আসামির দন্ডাদেশ মওকুফ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
 সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকান্ড, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা, সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার ও এমপি হোস্টেলের ভেতরে অজ্ঞাত এক মহিলার গলিত লাশ উদ্ধারের রহস্য উদঘাটিত হয়নি।
আন্তর্জাতিক বাজারে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় সরকারের খরচ বেড়েছে। শুধু অতিপ্রয়োজনীয় নয়, শৌখিন পণ্যের দামও বেড়েছে। সোনার দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
গ্যাস সংকটে দেশের শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। রাজধানীর আশপাশের এলাকায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট বেশ প্রকট হচ্ছে। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সফিপুর, কোনাবাড়ী এলাকায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দিনরাতে কারখানাগুলো ৩০ শতাংশ উৎপাদন করতে পারছে না। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট খুব শিগগির কাটবে এমন কোন সংবাদ জানা যায়নি।
দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না গেলে অনেক বিনিয়োগ রুগ্ন হয়ে পড়বে। মাত্র কয়েক বছর আগে বলা হয়েছিল দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। এ অফুরন্ত গ্যাস ভান্ডারের ফর্মুলা দিয়ে তখন গ্যাস রফতানির জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল সরকার। আর এখন গ্যাস মিলছে না। বিদ্যুৎ সংকটে শিল্প ইউনিটগুলোর শত শত কোটি টাকার চলমান প্রকল্প মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ২৪ হাজার কোটি টাকা।
দেশে যেভাবে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি চলছে তাতে ক্ষমতাবানদের অবৈধ সম্পদ বাড়বেই। তাই সম্পদ অর্জনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হিসাব দাখিল করতে হবে।  শুধু মন্ত্রী কিংবা এমপির  সম্পদ বিবরণী নিলে হবে না, তাদের ওপর নির্ভর কিংবা নির্ভরশীল নয়-পরিবার ও পোষ্যদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরও সম্পদ বিবরণী দিতে হবে। কেননা মন্ত্রী-এমপিদের সন্তান ছাড়াও পরিবারের নিকটতম বিভিন্ন সদস্যদের নামে অঢেল সম্পত্তি থাকার প্রমাণ এরই মধ্যে মিলেছে। এছাড়া শুধু একবার সম্পদ বিবরণী নিলে কাজ হবে না, নিয়মিত প্রতি বছর নিতে হবে এবং তা মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকতে হবে

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads