ইয়াছিন মাহমুদ :
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার অনুষদ ভবনের তৃতীয় তলায় দাঁড়িয়েছিলাম। নিচতলায় ফুলের বাগান থেকে একটা ছেলে একটা গোলাপ ছেঁড়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ কোথা থেকে কে যেন ধর ধর বলে হাঁক ডাক শুরু করলে চারিদিক থেকে হৈ-চৈ শোরগোলের সাড়া পড়ে। ছাত্র-শিক্ষক সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যাহোক ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। এদিকে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩, মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী পন্থী গুটি কয়েক ছাত্র-শিক্ষক মিলে মানববন্ধন ও ঝটিকা মিছিল বের করে। মিছিলটি যখন বিজ্ঞান অনুষদ পার হয় তখন আন্দোলনকারীদের প্রচার মাইকটি মাটিতে পড়ে যায়। এ অবস্থা দেখে অনুষদ ভবনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী পঁচা মাইক, পঁচা মাইক বলে চিৎকার করে। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিক থেকে করতালির শব্দ ভেসে আসে। বিষয়টি হঠাৎ বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে সেটা ছিল একটা মামুলি ব্যাপার মাত্র। হাসার কি আছে? তার মানে একেই বলে হুজুগে বাঙালি।
সম্প্রতি বিরোধীদলীয় একটি ছাত্র সংগঠন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে বিক্ষোভ করছিল। একটা ছেলে সাইকেলে টিউশনিতে যাচ্ছিল । মিছিলটি দেখে সাইকেলটি পাশের একটা দোকানে রেখে সেও মিছিলে অংশ নেয়। ছেলেটি কিন্তু তার গন্তব্যে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারবে না। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে একটা প্রবাদের কথা। রথও দেখা হল কলাও বেচা হল। গল্পটি এমন ছিল-এক ব্যক্তি রথের বাজারে গিয়েছিল। ওর সখ ছিল রথে যাওয়ার। কিন্তু উপলক্ষ পাচ্ছিল না। হঠাৎ রথে কলা বিক্রির সৌভাগ্য হয়। তার মানে তার দোকানদারীও চলল, সাথে সাথে রথ দেখাও হল। আমার লেখাটি মূলত শাহবাগ চত্বরের তরুণ প্রজন্মদের নিয়ে। কি ঘটছে সেখানে। তাদের লক্ষ্যবস্তু কি? গত ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধীর অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় ঘোষণা হয়। রায় ঘোষণার দিন জামায়াত-শিবিরকর্মীরা রায়কে প্রহসন বলে তা প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
অন্যদিকে কয়েকজন ব্লগার মিলে শাহবাগ মোড়ে টোঙপেতে মোমবাতি জালিয়ে কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য জামায়াত নেতাদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। যুগের সাথে সাথে আজ বদলে গেছে অনেক কিছু। আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা, তখন কেউ চিঠি পোস্ট করলে সেটি পৌঁছাতে ১ সপ্তাহ সময় লাগতো। যে উদ্দেশ্যে প্রেরক চিঠিটি পাঠাত তা বুমেরাং হয়ে যেত। কি দারুন বিড়ম্বনা সহ্য করতে হতো। যাহোক আজ আর সে কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। মুহূর্তের মধ্যে নিজের প্রয়োজনীয় কথা বলা যাচ্ছে অনায়াসে । মিডিয়ার কল্যাণে রান্নাঘর থেকে সংসদ ভবনের সকল খবর পৌঁছানো যাচ্ছে সবার দ্বারে দ্বারে । কেউ ৫/১০ জন লোক নিয়ে একটি মানববন্ধন কিংবা ঝটিকা মিছিল করলে সেটিও লীড নিউজে কাভার পেজে বড় বড় হরফে ছাপা হচ্ছে।
আর সে কথাগুলো যদি ইসলাম বিদ্বেষী হয় তাহলে তো আর কথা নেই। সব খবরের সেরা খবর সেটিই। গত ৭ই ডিসেম্বর ‘‘প্রথম আলো’’তে জনাব জাফর ইকবাল সাহেব লিখেছিলেন ‘‘তোমরা যারা শিবির কর’’। ঐ দিন সারাদেশে পত্রিকাটির ব্যাপক চাহিদা ছিল। অনেকে শত শত টাকা দিয়ে পত্রিকাটি সংগ্রহের চেষ্টা করে। আর একটি বিষয় শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকারীদের অন্যতম ব্লগার রাজীব হায়দারের ইসলাম ও মহানবী (সা:), সাহাবায়ে কেরামদের প্রতি কটূক্তিমূলক লেখা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ইনকিলাবে ছাপা হওয়ার পর পাঠকের আগ্রহটা দেখে বিস্মিত হওয়ার মতো।
ফিরে আসি শাহবাগ চত্বরের দিকে। যারা তরুণ প্রজন্মের নাম ভাঙিয়ে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলনের কথা বলছে। মাত্র কয়েকজন মানুষ মিলে আন্দোলনটি শুরু করেছিল। তারা কখনো ভাবতে পারেনি আন্দোলনটির প্রেক্ষাপট পাল্টে যাবে। চলছে ভাষার মাস। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমীতে বইমেলার ধুম পড়েছে। সারা দেশ থেকে লেখক-প্রকাশকদের মিলনমেলায় ঢাকা যেন ঢেকে গেছে। ঠিক এমন মুহূর্তে শাহবাগের আন্দোলনটি শুরু হয়। আমি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬৯'র গণঅভ্যুত্থান, ৭১'র মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০'র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে অস্বীকার করতে চাইনা। ঠিক তেমনি যারা শাহবাগ চত্বরে আন্দোলন করছে তাদের তারুণ্যকে স্যালুট জানাই। কারণ এই তারুণ্যই আমার অহংকার। আমার প্রেরণার বাতিঘর। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্য শুধু শাহবাগে নয় বরং গোটা দেশের তরুণ প্রজন্মকে একই প্লাটফর্মে দাঁড়াতে হবে। আমি এই লেখাটি লেখার জন্য কখনো ভাবিনি। কিন্তু আমাদের এক শ্রেণীর তরুণ প্রজন্ম ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের মতিভ্রম দেখে কিছু না লিখে পারলাম না। ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি, মার্চ আসলে আমাদের যুব সমাজকে লক্ষ্য করে কতিপয় নষ্ট চিন্তার বুদ্ধিজীবী মহল বুলি আওড়াতে থাকেন। তোমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে। তোমাদেরকে এই দেশকে রাজাকার মুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া আরো অনেক বক্তব্য ......।
আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যেন বক্তৃতার ডিকশনারীতে কোন শব্দ খুঁজে পান না। তাই খাঁজকাটা সেই কুমিরের গল্পের মতো কিছু শুনিয়ে তার দায়িত্ব ছিকেয় তোলে। শাহবাগের আন্দোলনটি কি আসলে মানবতা, গণতন্ত্রকে সমুন্নত করার। মানবতার বিরুদ্ধাচারীদের প্রতি ধিক্কার জানানোর, তাহলে তো কোন প্রশ্ন নেই। আমিও তোমাদের মিছিলে থাকব। কিন্তু যখন দেখছিলাম ২৮ শে অক্টোবর ২০০৬, লগি বৈঠা আন্দোলনের হোতাদের। যারা তাদের পায়ের তলে মানবতাকে ধুলার সাথে মিশিয়েছিল। যারা গণতন্ত্রের টুটি চেপে হত্যা করেছিল। আমি দেখছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিম, সজীব, সানি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র যোবায়ের, ঢাকা মেডিকেলের রাজীব, ঢাকা পলিটেকনিকের নাহিদ হত্যার খুনীরা মানবতার ফেরিওয়ালার ভূমিকায় গণ জাগরণের কথা বলছে। ধিক তোমাদের হে প্রজন্ম ভিখারী। নিজের নামটা যখন নেতা বনে না দেখ তখন তোমরাতো প্রজন্মের দোহাই দিয়ে জনগণকে বোকা বানাতে চাও।
তোমরা যারা স্বাধীনতার স্বপক্ষের ব্যানারে নিজেদের উপস্থাপন করে দেশের সার্বভৌমত্বকে ভূলুন্ঠিত করতে চাও। তোমরা যতই প্রজন্ম, প্রজন্ম জিকির তোল, আর সকল মুদি দোকানের মোমবাতি ফুরিয়ে ফেল এদেশের দেশপ্রেমিক তরুণরা তোমাদেরকে বয়কট করে তোমাদের অপরাধনামাকে জনগণের কাঠগড়ায় তুলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবে। সুতরাং অপেক্ষায় থাকো ...। আজ তোমরা মানবতার কল্যাণকামী হয়েছো তাই না? এতদিন কোথায় ছিলে? যখন বিডিআর বিদ্রোহে এদেশের অসংখ্য সেনা কর্মকর্তা খুন হল, যখন ফেলানিরা কাঁটাতারে ঝুলছিল, বিশ্বজিতের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত, ইলিয়াস আলী, ওলী, মুকাদ্দাস, সাইফুল ইসলাম, চৌধুরী আলম, নুর হাজী গুম হয়। যখন সুরঞ্জিত, আবুল হোসেনরা দুর্নীতিতে দেশকে ছেয়ে ফেলল। সিলেট এমসি কলেজ পুড়ে ছাঁই হল। সাংবাদিক সাগর রুনীকে হত্যা করা হল, যখন পরাগ মন্ডলের মতো নিাপ শিশুর অপহরণের ঘটনা ঘটল, হলমার্ক কেলেঙ্কারীর মত দুর্নীতি আমার অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করল, তখন তো কোন মামুরে প্রতিবাদ করতে দেখেনি। আর তোমরা যারা কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবসহ ইসলামী মণীষাদের প্রতি ধর্ষণের মত জঘন্য মিথ্যাচার আরোপিত করেছ তোমরা একটু নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখ তো! তোমরা তো তারা যারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ যুবতীকে ধর্ষণের সেঞ্চুরী অর্জন করে বিজয় উল্লাস করেছিলে। আর তোমরা যে শাহবাগে দাঁড়িয়ে মানবতাবিরোধীর বিচারের দাবিতে হুঙ্কার তুলেছ। ঐ শাহবাগে নানা কুকীর্তির খবর জাতির ইতিহাসে কলঙ্কের লেপন এঁকে দিয়েছে। তাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট ও স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়না । সুতরাং হৃদয়ের গলদকে মুছে ফেল। আর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এদেশের সচেতন আপামর জনতাকে ফ্যাসিবাদের সকল ষড়যন্ত্রকে রুখে দেয়ার আহবান জানাচ্ছি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।, E-mail : mahmudaraiu@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন