রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

মিথ্যা পরিহার করলে রাজনীতি সুস্থ হয়ে যাবে



ধূমকেতু : মিথ্যা বলাকে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়। শুধু ধর্মের কথাই বা বলি কেন? যে কোনো বিবেকসম্পন্ন লোকই মিথ্যা বলাকে ঘৃণা করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে মিথ্যাই হচ্ছে সকল পাপের উৎস। এমন কোনো অপরাধ নেই যা মিথ্যা ছাড়া সংঘটিত হতে পারে। তাই সব বিবেকবান সুস্থ মানুষই মিথ্যা বলাকে অপছন্দ করেন। একমাত্র মিথ্যা বলাকে পরিহার করে আমরা প্রায় সকল প্রকার পাপ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। একমাত্র মিথ্যা বলা পরিহার করে আমরা পৃথিবীর প্রায় সব অপরাধ হতে মুক্ত হতে পারি। মহান আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআন পাকে বলেছেন, ‘‘তোমরা মিথ্যার সাথে সত্যের সংমিশ্রণ করো না। আর জেনেশুনে সত্য গোপন করবে না।’’
কিন্তু আমরা এসব মৌলিক আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। তাই সামাজিক অশান্তি আর অনাচার আমাদের নিত্য সাথীতে পরিণত হয়েছে। সত্যি বলতে কি মিথ্যা বলা এবং মিথ্যা শোনা আজ আমাদের কালচারের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ এবং মিথ্যার বেসাতি আমাদের দৈনন্দিন কালচার হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন ঘর থেকে বেরুনোর পর প্রথমেই মিথ্যা ভাষণ দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ড শুরু হয়। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে রাস্তায় বেরুনোর পর কেউ কুশল জিজ্ঞেস করলে মনে হাজারো দুঃখ চেপে রেখেও মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে এনে বলি ভালো আছি। যদি বলা হয় ভালো নেই, তাহলে হাজারো অনাবশ্যক প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হবে। তাই মিথ্যা করে হলেও ভালো আছি বলাই উত্তম ও নিরাপদ।
আসলে আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও কালচারটাই এমন যে, এখানে মিথ্যা না বলে উপায় থাকে না। সমাজ ব্যবস্থাই আমাদেরকে মিথ্যা বলতে ও চর্চা করতে বাধ্য করে। উল্লেখ্য, অফিসে কিছু বিশেষ গ্রাউন্ড না দেখালে ছুটি পাওয়া যায় না। আপনার মন খারাপ ছিল তাই অফিসে যাননি এমন নিরেট সত্য লিখলে ছুটি মঞ্জুর হবে না তাই মন খারাপ না লিখে লিখতে হবে অসুস্থতা হেতু অফিসে আসেননি। সর্বত্রই চলছে ভাওতাবাজি ও মিথ্যার বেসাতি। দোকানদারের কাছে সওদা কিনতে যাবেন, দোকানি ভেজাল পণ্যকেও একশতভাগ খাঁটি দাবি করবে। দাম চাওয়ার সময় বলবে স্যার বা ভাই, আল্লাহর কসম একদম কেনাদামে দিলাম। এক পয়সাও লাভ করলাম না। ভাবখানা এমন যেন ক্রেতা দোকানির নতুন দুলাভাই। আবেগে গদগদ হয়ে বিনা লাভেই দিয়ে দিলেন।
মহান আল্লাহ তা'আলা সুদকে করেছেন হারাম আর ব্যবসাকে করেছেন হালাল। ইসলাম ধর্মে সৎ ব্যবসায়ীর মর্তবা অনেক ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের যে আচরণ লক্ষ্য করা যায়, তাতে তাদের মর্যাদা নিরূপণ করা কষ্টকর। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক সরকারি কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন প্লেনযোগে। ঢাকা এসে তিনি যাতায়াত বিল দাখিল করলে বলা হলো, আপনি প্লেনে ভ্রমণের অধিকারপ্রাপ্ত নন। তাই আপনাকে রেলজার্নি দেখাতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভদ্রলোককে মিথ্যা ট্রেন ভ্রমণ দেখাতে হলো। অবশ্য ট্রেন ভ্রমণ দেখিয়ে তার ২০০ টাকা লাভ হলো।
ক'দিন পূর্বে রাজধানীর অন্যতম সেরা স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি ফরম আনতে গিয়ে দেখলাম আর এক দৃশ্য। ঐ স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তির জন্য ৬ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো বাচ্চাকে ভর্তি ফরম দেয়া হয় না। দেখা গেল সব বাচ্চার মা-বাবাই তার বাচ্চার বয়স ৬ লিখে দিল। এমনকি ৭/৮ বছর বয়স্ক বাচ্চার বয়স ৬ দেখানো হলো। বাচ্চার অভিভাবকরা বাচ্চাদের শিখিয়ে দিল যে বয়সের কথা জিজ্ঞেস করলে সে যেন ৬ বছর বলে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের তার শিক্ষাজীবনের শুরুতেই মিথ্যা বলার চমৎকার ট্রেনিং দিয়ে দিলেন। এসব বাচ্চা যদি ভবিষ্যতে মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত হয় তার জন্য কে দোষী হবে? বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একবারও ভেবে দেখলেন না রাজধানীর সব বাচ্চাই ২০০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছে?
যে কোনো অপরাধ কর্ম করতে গেলেই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অফিসে যে কর্মচারী-কর্মকর্তা প্রতিনিয়তই ঘুষ গ্রহণ করেন তারও প্রধান অস্ত্র হলো মিথ্যাচার। মিথ্যা কথা বলা ছাড়া কোনোভাবেই ঘুষ-দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। আপনি যদি পরিবারের সাথে দেখা করতে চান তাহলে ছুটি পাবার সম্ভাবনা কম। যারা একটু বেশি বুদ্ধিমান তারা পরিচিত কাউকে দিয়ে টেলিগ্রাম পাঠান, ‘মাদার/ওয়াইফ সিরিয়াস, কাম শার্প'। এ ধরনের টেলিগ্রাম অধিকাংশ সময়ই থাকে। অথচ এই টেলিগ্রাম পাবার পর ছুটি না দিয়ে উপায় থাকে না। শুধু অফিসের কথাই বা বলি কেন? সর্বত্রই চলছে মিথ্যাচারের প্রাধান্য। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও মিথ্যার বেসাতি করে চলেছেন। মিথ্যা বলায় পারদর্শী না হলে জনতার মন জয় করা যায় না।
আমরা প্রতিনিয়তই মিথ্যার আবর্তে জড়িয়ে যাচ্ছি। তা থেকে পরিত্রাণের কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মিথ্যাচার আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বেড়াজালের অচলায়তন ভেঙে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা প্রতি বছর নানা দিবস ও সপ্তাহ পালন করে থাকি। আমরা কি সমবায় দিবস বা মৎস্য সপ্তাহের মতো বছরে এক সপ্তাহ, পারতপক্ষে একদিন ‘জাতীয় মিথ্যা বর্জন সপ্তাহ বা দিবস' পালন করতে পারি না? ব্যক্তি বা পারিবারিক পর্যায়েও আমরা এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও মিথ্যা বর্জন দিবস পালন করা যেতে পারে।
মিথ্যা পরিহার থেকে সবচেয়ে লাভবান হবে আমাদের রাজনীতি। রাজনীতিতে যদি মিথ্যার বর্জন সম্ভব হয়, তাহলে আজ রাজনীতি নিয়ে যে সমস্যা তার প্রায় ষোল আনাই দূর হয়ে যাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads