বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

বিভেদের রাজনীতি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ


প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, ঠিক এই মুহূর্তে, মানে এই লেখাটি তৈরি করার সময় আমি মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ। কলম দ্বারা আমার মনের অবস্থা বুঝানো একেবারেই অসম্ভব। মন বা হৃদয়ের অবস্থা লিখে বা বলে মানুষ বিশ-পঁচিশ ভাগ প্রকাশ করতে পারে। তাই আমার প্রিয় কবি মাওলানা রুমি বলেন, শব্দহীনতার শব্দ। সময়হীনতার মাঝে বসবাস করা। আমার মালিক মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, তোমরা সময়কে গালি দিয়ো না, আমিই সময়।’ যা হোক, চলমান সময়ের ঘটনাবলি আমাকে কাহিল করে ফেলেছে। বহু দিন ধরেই প্রিয়জনদের বলে যাচ্ছিলাম, আমার এখানে কোনো কাজ নেই। আল্লাহ পাকের কাছ থেকেও কোনো নির্দেশ পাচ্ছি না। এখানে থেকে চলে যাওয়া মানে, এই বয়সে আরো গোনাহের ভাগীদার হওয়া।

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অনেক কাছ থেকে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। ’৭১ সালে আমার বয়স ৩১। ২৫ মার্চ রাতে মতিঝিলের অবজারভার হাউজে আটকা পড়েছিলাম। ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠে গেলে বাসার দিকে রওনা হলাম দৌড়াতে দৌড়াতে। মনে হচ্ছিল, রিকশায় গেলে দেরি হয়ে যাবে। রাস্তায় তেমন রিকশাও ছিল না। সবাই আতঙ্কে দৌড়াচ্ছে। আমার বাসা ছিল           শান্তিনগরে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে। রাতেই জানতে পেরেছিলাম, সেনাবাহিনী রাজারবাগ আক্রমণ করেছে। সেখানে আগুন দিয়েছে। অবজারভারের ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছিল সারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় আগুন জ্বলছে। বিশেষ করে সব বস্তিতেই সেনাবাহিনী আগুন দিয়েছিল। ভাবছিলাম, বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রী আর প্রিয় সন্তান রনিকে দেখতে পাবো কি না। রাতের আগুনে পুড়ে গেছে কি না। বাসায় গিয়ে দেখলাম, দুই বছরের রনি আর তার মা খাটের নিচে লুকিয়ে আছে। ২৫ মার্চ রাত থেকেই তারা ওই খাটের নিচে ছিল। আমার ডাকাডাকিতে সাড়া দিচ্ছিল না। ভয়ে হুঁশহারা হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, আমি ফিরে এসেছি। রনির জন্য একটা ট্রাইসাইকেল কেনার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর কেনা হয়নি। বলেছিলাম, সব কিছু ঠাণ্ডা হলে তোমাকে সাইকেল কিনে দেবো। পরে রনি জানতে চাইত সব কিছু ‘ঠান্না’ হয়েছে কি না। ও ঠাণ্ডা শব্দটি উচ্চারণ করতে পারত না।
অবজারভার অফিসে আর ফিরে যাইনি। কিন্তু ঢাকা ছেড়ে কিভাবে কোন পথে পালাব, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। মিলিটারি টহল দিচ্ছে। রাস্তায় চেকপোস্ট বসেছে। জীবন তো আর থেমে থাকে না। মানুষ বাঁচার তাগিদেই ঘরের বাইরে আসে বা যায়। যারা দিনমজুর, তাদের তো বের হতেই হবে। এর আগে অবজারভার অফিসে থাকতেই ২৬ মার্চ রাতে শুনেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে কোনো এক মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা রেডিওতে টিউনিং করে অনেক চেষ্টা করেও ঘোষণা শুনতে পাইনি। ২৭ মার্চ রাতে প্রথম নিজ কানে শুনতে পেলাম মেজর জিয়ার ঘোষণা। তিনি সংসদের মেজরিটি দলের নেতা এবং তখনকার একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধকে সমর্থন দেয়ার জন্য।
জানুয়ারি থেকেই একজন সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে রাজধানী ঢাকার রাজনৈতিক ঘটনাবলি দেখেছি। ’৭০-এর নির্বাচনে মওলানা ভাসানী নির্বাচন না করার ফলে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার দু’টি সিট ছাড়া বাকি সব সিট মানে, ১৬৭টিতে জয় লাভ করে। ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট খুবই প্রকট হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সিট পায়নি। একই ভাবে, ভুট্টোর দল পূর্ব পাকিস্তানে কোনো সিট পায়নি। মতায় আছে সামরিক জান্তা। নির্বাচনে জয় লাভ করেছে দু’টি রাজনৈতিক দল, যারা কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। সমঝোতার ব্যাপারে ভুট্টো ছিলেন খুবই অনমনীয়। ফলে পুরো বিষয়টার ভেতর ‘তৃতীয় শক্তি’ ঢুকে পড়ে। তৃতীয় শক্তির খেলাতেই সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। শেখ মুজিব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমঝোতার চেষ্টা করে গেছেন। শুনেছি, ২৫ মার্চ দুপুর পর্যন্ত শেখ সাহেব সমঝোতার দলিলে স্বার করার জন্য অপো করেছিলেন। তিনি ২৬ মার্চ হরতাল ডেকেছিলেন বলে শুনেছি। না, জেনারেল ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সারল্যের সাথে বেঈমানি করে পূর্ব বাংলার নিরীহ জনগণের ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে ইসলামাবাদ চলে যান। ২৫ মার্চ রাতেই ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করে চলে গেলেন।
মেজর জিয়ার ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশবাসী জানতে পারেনি, পূর্ব বাংলার ভাগ্যে কী ঘটেছে। শেখ মুজিব চলে গেলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনী তাকে ২৫ মার্চ রাত ১২টার দিকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যায়। আর আওয়ামী লীগ নেতারা কোনো উপায় না দেখে দিশেহারা হয়ে ভারতের দিকে চলে যান। দেশে থেকে গেলে সেনাবাহিনী তাদের গ্রেফতার করবে, না হয় হত্যা করবে। তাই ভারতে না গিয়ে উপায় ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে নির্বিচারে সারা ঢাকায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। ২৭ মার্চ সকালে আমরা রাস্তায় বহু লাশ দেখেছি। জিয়ার ঘোষণার পর দেশবাসী বুকে সাহস পেল। আস্থা ফিরে পায়। বুঝতে পারল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করা হবে। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি। সেনাবাহিনীকে অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলো, শেখ মুজিব তাদের হেফাজতে আছেন এবং পাকিস্তানের ইংরেজি কাগজ দৈনিক ডনে তার ছবি ছাপা হলো সম্ভবত ৪ এপ্রিল। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল ১৭ এপ্রিল। অপর দিকে মেজর জিয়া তার অধীনস্থ সৈনিক ও অফিসারদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করেই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তের ঘটনার সামান্য কিছু কথা লিখলাম আমাদের সন্তানদের জন্য। এখন শুনতে পাচ্ছি, মেজর জিয়া ছিলেন ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এজেন্ট’ বা চর। তিনি গোয়েন্দা হিসেবেই নাকি কাজ করেছেন। বঙ্গবীর বাঘা সিদ্দিকী নাকি ’৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এখন নব্য রাজাকার। আর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, তিনি যদি রাজাকার হয়ে থাকেন তাহলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের কমান্ডার। নব্য রাজাকার কারা, তার ঘোষণা দিচ্ছে প্রজন্ম চত্বর থেকে আমাদের সন্তানেরা। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগকে হেডকোয়ার্টার করে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। এ যুদ্ধে ‘চেতনা’ই নাকি হাতিয়ার। তরুণেরা বলছে, তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; তাই চেতনা দেখার জন্য চত্বরে যাচ্ছে। মাথায় ব্যান্ড বেঁধে, স্লোগান দিয়ে, গান গেয়ে নেচে নেচে তারা মুক্তিযুদ্ধ করছে। নাম দিয়েছে গণজাগরণের মঞ্চ। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতেই তারা মঞ্চ সাজিয়েছে। শুরুতে তাদের দাবি ছিল শুধু একটিÑ কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। আদালতের রায় মানি না। এখন তাদের অনেক দাবি। দিন দিন দাবির তালিকা বাড়ছে। এমনকি একজন সম্পাদককে গ্রেফতার করার জন্যও তারা ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগে নতুন প্রজন্মের দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল। হঠাৎ শোনা গেল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সিপাহসালার বা জেনারেলদের কেউ কেউ নাস্তিক এবং আল্লাহ পাক সুবহানাহু তায়ালা, তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল সা:, ইমামুল মুরসালিন ও কালামে পাক আল কুরআনের বিরুদ্ধে অকথ্য, অশ্লীল ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। খবরটি নাকি প্রথম ফাঁস করে দেয় ভারতের ইংরেজি কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া। হেডিং ছিলÑ ‘অ্যান্টি-ইসলামিক ব্লগার কিল্ড’। ব্লগার রাজীব নিহত হওয়ার পর ওই খবরটি ছাপা হয়। এর পরে তা ছাপা হয় সরকারপন্থী কাগজ দৈনিক ইনকিলাবে। তার পর ছাপা হয়েছে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত ও সংগ্রামে। আসলে প্রজন্ম চত্বরের নেতা ব্লগাররা অনেক দিন ধরেই ধর্মহীনতার পে লিখে যাচ্ছে। তাদের কাছে ধর্ম মুক্তমনের ও প্রগতির বিরোধী। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে ধর্মহীনতা। ’৭১-এ নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সেকুলার বা ধর্মহীন। যাদের চেতনা এখন সেকুলার বা ধর্মহীন নয়, তারা নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে পারবে না। মনে প্রশ্ন জেগেছেÑ তাহলে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি বা করেছি, তারা কি ভুল জেনেছি? আমি তো দেখেছি, বহু মুক্তিযোদ্ধা নামাজের সময় হলে বা আজান শুনলে সাথে সাথে অজু করে নামাজ আদায় করেছেন। যারা নামাজ পড়েননি, তারা কখনোই বলেননি, নামাজ পড়া যাবে না। সেক্টর কমান্ডারেরাও বলেননি মুক্তিযুদ্ধ সেকুলার বা ধর্মহীন। বহু মাদরাসার ছাত্রও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে এ কথা সত্যি, যারা সেকুলার বা ধর্মহীন বা ধর্মনিরপে; তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে দেখেন বা ব্যাখ্যা করেন। মুক্তিযুদ্ধ কখনোই বাংলাদেশের মানুষকে সেকুলার বানানোর যুদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ কখনোই ধর্মহীন বা ধর্মবিরোধী ছিল না। বরং ’৭১-এ দেখেছি পাকিস্তানি সৈনিকেরা কারফিউর সময় মসজিদে ঢুকে মুসল্লিদের গুলি করেছে। তখন আমি সমাজে এবং বন্ধুদের কাছে বামপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলাম। ছাত্রাবস্থায় অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। পরে মওলানা ভাসানীর ন্যাপকে সমর্থন করতাম। বামপন্থীসংবাদে চাকরি করেছি অবজারভারের  চাকরি ছেড়ে দিয়ে। এখন আমাদের সন্তানেরা জানতে চায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে কি না। আমরা সেকুলার কি না। প্রজন্ম চত্বরের সাথে একাত্মতা ঘোষণা না করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে না। তাই শুরুতেই নিজের আবেগের কথা প্রকাশ করেছি। ১৫-১৬ বছরের ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে প্রশ্ন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে কি না। চেতনা না থাকলে কাদের সিদ্দিকীর মতো নব্য রাজাকার হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি শাহবাগ যাও, মাথায় ব্যান্ড বা পট্টি বাঁধো। লাল-সবুজের জামা গায়ে দাও। আমার সন্তানদের সারল্য ও নিষ্পাপ অবুঝ আবেগকে ভালোবাসি। কিন্তু তাদের কে বা কারা অমন পথে পরিচালিত করছে হেমিলনের বংশীবাদকের মতো? কারা আজ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা তুলেছে? নাস্তিক-আস্তিকের কথা তুলেছে। কারা নতুন প্রজন্মকে ধর্মহীনতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে?
সামান্য একটু পেছনের দিকে যেতে চাই। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সময় ১১ দফা ও ৮ দফার কথা মনে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দিয়েছিলেন ১১ দফা দাবি। ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ দিয়েছিল ৮ দফা। ফলে ধর্মবাদীরা বা ধর্মপন্থীরা ৮ দফার পে চলে গেল। আমি ছিলাম ১১ দফার প।ে সারা জেলায় ঘুরে ঘুরে ১১ দফার পে জনসভা করেছি। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব এবং অনেক রাজনৈতিক দল ১১ দফাকে সমর্থন দিয়েছিল। প্রতিদিনই এ নিয়ে সারা দেশে চলছিল প্রচণ্ড টেনশন। কোথাও কোথাও মারামারি। সে সময় শুনেছি পতাকার অবমাননার কথা, কুরআন পোড়ানোর কথা। তখন ১১ দফার সমর্থকদের বিরুদ্ধে সরকার ও ইসলামপন্থী দলগুলো এসব অভিযোগ এনেছিল।
এবারো শুনতে পাচ্ছি সেসব পুরনো কথা। পুলিশ মসজিদে ঢুকে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গোলাগুলি করেছে। শুনতে পাচ্ছি, পুলিশ এ পর্যন্ত ১৯ জন আলেম ও সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। আসামি করে গ্রেফতার করছে। ‘জামায়াত’ আখ্যা দিয়ে ইসলামি নেতাদের গ্রেফতার করছে সরকার। ব্লগার বলে পরিচিত ইসলামবিরোধী নাস্তিক প্রজন্ম নেতাদের প নিয়েছে সরকার। সংসদে    নাস্তিককে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে সরকার সব সময় ইসলামের ধুয়া তুলত। তখন আমেরিকানরাও ইসলামি দলগুলোকে কৌশলগত সমর্থন করত প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর সরকার কৌশলে প্রজন্ম চত্বর বানিয়েছে, নাস্তিকদের প নিয়েছে, ধর্মের পরে মিডিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমরা কখনোই শুনিনি কোনো গণজাগরণ সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে হতে পারে।
সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এ দেশে কোনোভাবেই বিভেদ উসকে দেয়া যায় না। বিভেদ সৃষ্টিকারীরা দেশের বাইরে থেকে খেলছে। তারা চায় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তাদের ফায়দা লুটতে। এ দেশে কেউ কারো শত্রু নয়। এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক চেহারা, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এক ধর্ম। তাহলে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে বাধা কোথায়? আসুন, একমত হওয়ার জন্য আমরা যাত্রা শুরু করি। রাজনৈতিক সুবিধা আদায় কিংবা নির্বাচনে জয় লাভের জন্য নিজের দেশকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করবেন না। প্রজন্ম চত্বরের নেতাদের বলব, তোমরা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ডাক দাও, দেশের ১৬ কোটি লোকই তোমাদের সাথে থাকবে। এখন যা করছ তা ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। ইসলামি দল ও ১৮ দলীয় জোট তোমাদের বিপে অবস্থান নিয়েছে। গায়ের জোরে, কিছু আবেগপূর্ণ স্লোগান দিয়ে তোমরা বেশি দূর এগোতে পারবে না।
তোমরা শুধু একবার দণি আফ্রিকার মানবতাবাদী বিশ্বনেতা, নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ভাবো। সাদা শাসকদের জেলে তিনি ২৬ বছর ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে জগদ্বিখ্যাত ভাষণ দিলেন। বললেন, সাদারাও এ দেশের সন্তান। তাদেরও সমান অধিকার। যে লোকটি তাকে জেলে রেখেছিলেন, তাকে নিয়েই ম্যান্ডেলা সরকার গঠন করলেন। তিনি যদি শুধু ইশারা করতেন তাহলে লাখ লাখ সাদা দাঙ্গার শিকার হতো। ম্যান্ডেলা তা করেননি। কারণ তিনি খুবই উঁচুমানের একজন মানবতাবাদী নেতা।
তোমরা স্মরণ করো আমাদের মহানবী সা:-এর কথা। তাঁর ‘মদিনা সনদ’ বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসকেই পরিবর্তন করে দিয়েছে। তিনিই জগতে প্রথম গণমানুষের রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। মদিনায় তিনি ছিলেন মুহাজির। তিনি ছিলেন মাইনরিটি। শুধু মেধা-মনন ও নেতৃত্বের গুণে তিনি মদিনার ইহুদি ও খৃষ্টানদের মদিনা চুক্তিতে আবদ্ধ করেছিলেন। মদিনা রাষ্ট্রের সব নাগরিক রাসূল সা:কে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। খুবই ধ্বংসাত্মক এই বিভক্তি। বিভাজনের এই মানসিকতা থাকলে বাংলাদেশ টিকবে না। তখন বঙ্গবন্ধু বা জিয়া কেউই থাকবেন না। দেশবাসীকে বলব, আপনারা জাতি হিসেবে আপনাদের বায়া দলিল খুঁজুন। আসল দলিল ছাড়া নকল দিয়ে বেশি দিন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। আপনাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আপনাদের পূর্বপুরুষের ৯০ ভাগই এক সময় মনুসংহিতায় বর্ণিত অচ্ছুৎ, হরিজন বা আনটাচেবল ছিলেন। দেখতে মানুষ হলেও ধর্মীয়ভাবে তাদের মানবিক মর্যাদা ছিল না। তারা ছিলেন দাসের চেয়েও অধম। এক সময় তারা অমানবিক জীবন থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাম্যবাদী ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এটা ছিল তাদের জন্য একটা বিপ্লব। মানুষ হয়ে ওঠার বিদ্রোহ। তাই আজ আপনারা স্বাধীন একটি ভূখণ্ডের মালিক। শত শত বছর অপোর পর আপনাদের পূর্বপুরুষের সীমাহীন ত্যাগের ফলেই আজ আপনারা একটি স্বাধীন দেশের সম্মানিত নাগরিক। পূর্বপুরুষদের ত্যাগকে জানুন, মানুন এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রা করুন। আবারো বলছি, খুবই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলছি, জাতি হিসেবে নিজেদের বায়া দলিল রা করুন। মিষ্টিকথায়, ‘বন্ধু’দের কথায় বিভ্রান্ত হবেন না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads