মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

অবরুদ্ধ দিনলিপি


রুহুল কবির রিজভী আহমেদ
গত ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের দেশব্যাপী রাজপথ অবরোধের পরদিন থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। উল্লেখ্য, গাড়ি পোড়ানোর দুটি মামলায় তাকে আসামি করেছে পুলিশ। অবরুদ্ধজীবনে রুদ্ধদ্বার রাজনীতিচর্চার পাশাপাশি রিজভী আহমেদ সময় কাটিয়েছেন বই পড়ে এবং রাজনৈতিক চিন্তাশীল দিনলিপি লিখে। একান্ত সেই দিনলিপি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে আমাদের সময়ে। আজ প্রকাশিত হল অবরুদ্ধ দিনলিপির শেষ কিস্তি 
০৬/০২/১৩
গতকাল রাত ২টার সময় বিছানায় গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু মোটেও ঘুম হল না। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত টানা ৩ ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ছেড়ে আমার অফিস রুমে ঢুকতেই দেখি বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক কর্নেল (অব.) আব্দুল লতিফ নাস্তা নিয়ে বসে আছেন। কর্নেল লতিফ বড় ভাইয়ের মতো, রাজশাহীর সন্তান। তিনি নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। ক্রীড়া ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
অফিসকক্ষে চকোর মালিথা, মাহমুদ আজহারসহ বেশকিছু সাংবাদিক জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। আমি ভাবলাম সকাল ৯টায় এরা কেন। পরে মনে হল আজকে তো জামায়াতের হরতাল চলছে, সুতরাং বিএনপি বিটের সাংবাদিকরা কিছুটা ঢিলেঢালা সময় কাটাচ্ছে। তবে তাদের কাছ থেকে হরতালসংক্রান্ত নানা তথ্য জানা যাচ্ছে, ঢাকা মহানগরীসহ দেশের কোথাও কোনও ঘটনা ঘটেছে কি না। হরতাল এখনও প্রতিবাদের সর্বোচ্চ ভাষা হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে, কারণ যেহেতু এই উপমহাদেশে এখন পর্যন্ত হরতালের তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বিকল্প বের হয়নি, আর বিকল্প হবেই বা কীভাবে? বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভীত এখনও শক্ত হয়নি এই উপমহাদেশে। গণতন্ত্র বলতে শুধু নির্বাচন নয়, এর মধ্যে রয়েছে আরও বৃহত্তর বিস্তৃত পরিধি। মানবিক সাম্য, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, ন্যায়পরায়ণতা এবং ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতা গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক মৌলিক উপাদান।
বস্তুতপক্ষে গণতন্ত্রে একদলীয় একমাত্রিক পরিচয়ের কোনও স্থান নেই। এ প্রসঙ্গে একজন বিদগ্ধ লেখক বলেছেন, ঐক্যের মাঝে বৈচিত্র্য এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত ঐক্য গণতন্ত্রের সারাত্সার।
মূল রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোয় জাতীয় ঐকমত্য, সফল গণতন্ত্রের বুনিয়াদ গড়ে তোলে।
আজ হরতালের কারণে দলীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিল কম। দুপুরের খাবারের আগে বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম আমার অফিস কক্ষে এসে আসন্ন ঢাকা বারের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেন।
সুতরাং দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রামের জন্য বিছানায় যায়। আজ বিকাল ৫টা পর্যন্ত একটা গাঢ় ঘুম হল নিরুপদ্রবভাবে। কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হওয়ার পর এই প্রথম প্রশান্ত নিদ্রামগ্ন থাকি। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসে তখন লোকজন কম। তাই আজকের সন্ধ্যাটা একটা গৃহকাতরতায় পেয়ে বসে।
আমার পরিবারের বসবাস বগুড়ার আবাসিক এলাকা মালতিনগরে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এই পাড়ায়। পাড়ার মধ্যে অনেক বনেদি হিন্দুদের বাড়ি ছিল। সন্ধ্যার সময় আজানের পরপরই হিন্দুদের অনেক বাড়িতে শঙ্খ বাজত, বাড়িগুলো থেকে ধূপধোঁয়ার গন্ধ বেরিয়ে আসত। আমার মনে হত ধূপধুনোর বাড়িগুলো যেন সব হিন্দুদের বাড়ি। আমাদের বাসা থেকে দুইশ/আড়াইশ গজ দূরে পূজামন্দিরে সন্ধ্যার সময় ঘণ্টা বাজত। বাড়ির পেছনেই ছিল ক্ষীণতোয়া করতোয়া নদী।
শহরের বাজার থেকে অসংখ্য দোকানিকে নদী পার হয়ে দূর গ্রামে চলে যেতে দেখতাম। নদীর ওপার থেকে আসা দুধওয়ালারা বাড়িতে বাড়িতে দুধ সরবরাহ করে সন্ধ্যার সময় নদী অতিক্রম করত। পূজামণ্ডপ থেকে আমাদের বাড়ির দিকে এলে রাস্তায় একটা বিশাল ঝাকড়াগাছ ছিল— (গাছটির নাম আমি ভুলে গেছি)। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সময় কখনও সন্ধ্যা হয়ে গেলে মনে হত ওই গাছটি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। অশুভ এক আক্রমণের আশঙ্কা ছিল আমার মনে। গাছটি ছিল মহল্লার আষাঢ়ে গল্পকারদের এক উপজীব্য বিষয়। নানা ভৌতিক কাহিনির মিশেল দিয়ে হাড়-হিম করা রহস্যবৃক্ষ বানিয়ে ছেড়ে ছিল তারা। সব মিলিয়ে ছেলেবেলা সন্ধ্যার একটা বিষাদ আনন্দ-বিষাদের স্মৃতি জেগে উঠেছিল আজকের সন্ধ্যায়।
সন্ধ্যা অতিক্রম করে রাত বাড়তে বাড়তেই দলীয় নেতা-কর্মীদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠল দলীয় কার্যালয়টি। শেরপুর ও পিরোজপুরে জেলা থেকে অনেক নেতা সাংগঠনিক নানা বিষয় জানাল। শেরপুরে দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক সমস্যা আর পিরোজপুরে আওয়ামী লীগের লোকজন কর্তৃক বিএনপি নেতাদের ওপর হামলার বিষয় ইত্যাদি। হামলা, মামলা এদেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। এই উপমহাদেশে ব্রিটিশরা আসার পর যখন স্থানীয় অধিবাসীরা ইউরোপীয় আদলে রাজনীতির কার্যক্রম শুরু করে তখন থেকেই রাজনীতির যে রূপ পরিগ্রহ করেছিল, এখন সেই রূপটি আরও কদর্য হয়ে উঠেছে। তা যেন বর্বর যুগ থেকে একবারে অধঃপতনের যুগে এসে পড়েছে। মাঝখানে সভ্যতার যুগ ব্যতিরেকে। তাই স্বাধীনতার অর্থ শুধুই ঔপনিবেশিক শাসনের বিদায় নয় আরও বিবিধ বিষয় এর মধ্যে নিহিত থাকে।  (Freedom had to mean something more than departure of the British-MJ Akbar)।
নানা বিপর্যয় মোকাবিলা করে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের ভেতর প্রকৃত গণতন্ত্র শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারেনি বলেই মামলা, হামলা ও গুপ্তহত্যানির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
আজ রাত সাড়ে ৮টায় নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইকবাল ও চিত্রপরিচালক শেখ নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিফিং রুমে চক্রাকারে পদভ্রমণ করতে থাকি। ব্রিফিং টেবিলটাকে কেন্দ্র করে আমার পদভ্রমণ অব্যাহত থাকে। ব্রিফিং টেবিলটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এবং দুই প্রান্ত উপ-বৃত্তাকারের মতো। সুতরাং আয়তকার বা বর্গাকৃত টেবিলের ন্যায় কোনও প্রান্তের গুঁতা খাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কক্ষের উত্তর দিকের দেয়ালের সঙ্গে একটি বারান্দা। পশ্চিম দিকে কক্ষে ঢোকার একটি দরজা রয়েছে। কক্ষে ঢুকলেই দরজার পাশে একটি ৪ ড্রয়ারের ফাইল কেবিনেট দণ্ডায়মান। জনশূন্য অবস্থায় ওই কক্ষে হাঁটলে কেবিনেটটিকে মনে হয় অনুসরণরত কোনও ব্যক্তি।
আজ ৫০ মিনিট অবিরাম এবং নিমগ্ন মনে পদযাত্রা অব্যাহত রইল। আজকের পদভ্রমণটি ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় অসাধারণ। প্রথমে নিমগ্ন মনে নচিকেতার ‘কেউ হতে চায় ডাক্তার কেউবা ইঞ্জিনিয়ার... আমি ভবঘুরেই হব’ গানটি বারবার শুনি। এই গানটির অনবদ্য মুগ্ধতা কাটিয়ে তারপর শুরু হয় আলাপচারিতা। বিশেষ করে বিশ্বচরাচরে অশরীরী কোনও কিছুর অস্তিত্ব আছে কি না, তাদের কতটুকু ক্ষমতা, কোনও পরিবেশে তাদের কেমন বসবাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পদভ্রমণে গল্প করি। তবে প্রকৌশলী ইকবাল এ প্রসঙ্গে আইনস্টাইনের একটি উদ্ধৃতি দেন, যা খুবই প্রণিধানযোগ্য— There are only two ways to live your life, one is as though nothing is a miracle. The other is though everything is a miracle.’
খুব কষ্ট করে হলেও অপেক্ষারত নেতাদের দ্রুত বিদায় জানিয়ে ‘অবরুদ্ধ দিনলিপি’ লিখতে থাকি। হাতের লেখা শেষ করে পরের দিনের কম্পিউটার কম্পোজের জন্য ফাইলে ঢুকিয়ে রাখি। আজ বার্টান্ড রাসেলের ‘ক্ষমতা’ বইটি পড়ছিলাম। অসাধারণ একটি গ্রন্থ। তবে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ। মূল ইংরেজি বইটি পড়তে পারলে ভালো হত। অনুবাদ বইটিতে অনেক হেরফের হয়েছে বলে আমার মনে হল। বইটি পড়া শেষ করতেই রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা মনে পড়ে গেল।
‘জগতে যত রাজা মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ
সকালে ফুটেছে সুখ-দুঃখ লাজ
টুটেছে সন্ধ্যাবেলা’
আস্তে আস্তে গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads