মিনা ফারাহ
স্বৈরাচার তাড়াতে যে মন্ত্র লাগে, সেটি আমাদের জানা নেই। আজ পর্যন্ত যত স্বৈরাচার তাড়িয়েছি, এর মূলে সস্তা উত্তেজনা আর হালকা মাপের হইচই। এর বেশি আমরা যেতে পারিনি। ফলে যতবারই ভেবেছি স্বৈরাচার নিপাত গেছে, গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে, ততবারই স্বৈরাচার ফিরে এসেছে আরো বেশি দানবরূপে। অর্থে নাদুস-নুদুস আর মস্তিষ্ক ফাঁকাদের হাতেই রাজনীতি। যারা কলঙ্কমুক্ত হতে চান, কলঙ্ক তারা চেনেন না। যারা জাতির ললাট থেকে কলঙ্কমুক্তির কথা বলেন, জাতির ললাট কি তারা বোঝেন না। যারা মুক্তিযুদ্ধের গবেষক বলে দাবি করেন তাদের গবেষণায় ’৭১ সম্পর্কে অসংখ্য মিথ্যা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন যে যার মতো করে লিখছেন। ‘বিশ্বজগৎ অনেক বড় হলেও শেষ পর্যন্ত তা বিচারের দিকেই ঝুঁকে পড়ে’ (ড. কিং)।
জাতির ললাটে কলঙ্ক শিা মসনদের কোনো হানিফের মস্তিষ্কহীন উগ্রবাদের স্কুলে মস্তিষ্ক ধোলাই করে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানির শিা নয়, বরং নিজেদের বুদ্ধিবিবেকের সর্বোচ্চ চর্চা। মানবতাবিরোধীদের বিচার হওয়ায় আনন্দিত আমরা, কিন্তু ১৯৭৩-এর ১৫ এপ্রিলে যাদের বিচারের জন্য অনুচ্ছেদ ৩৭ সংশোধন করে ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ পাস হলো, সংশোধন ছাড়াই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়ে প্রথম সংবিধান সংশোধনীর অবমাননা করা হয়েছে। বাকশাল আইনের মতো ভিশন ২০২১-এর গর্তে পড়ে ভবিষ্যতে এই দেশে বিরোধী দলের প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে। মুসলিম লীগ, হিন্দু লীগ, খ্রিষ্টান লীগ, বুদ্ধ লীগ, জামায়াত লীগ বুঝি না; শুধু বুঝি অতীতের যেকোনো সময় থেকে বিএনপি লীগ আর আওয়ামী লীগের নামে জাতি ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মতো বিভক্ত। জেরুসালেমকে কেন্দ্র করে নবী ইব্রাহিমের দুই বংশ আজন্ম হানাহানিতে লিপ্ত। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সেই জেরুসালেম। ইহুদি-মুসলমানদের মতো এই যুদ্ধও শেষ হবে না, যতণ না একপ বিলীন হয়ে যায়। দুই নেত্রী এ কথা স্পষ্ট করেই জানলেও এত সহজ-সরল কথাটি বিশ্লেষকেরা বুঝতে চান না। রাজনীতিবিদদের বিস্ফোরক বক্তৃতা মানুষকে করেছে খুনি, বেয়াদব। দুর্ভাগ্যবান নই, বরং পরজীবী আমরা। একনায়কতন্ত্রের অশুভ শক্তি দ্বারা সর্বস্তরের মানুষের চিন্তাচেতনা অবরুদ্ধ আজ ৪২ বছর। কিছু প্রলাপসর্বস্ব মাথাখারাপ মাথার পরগাছা আজকের ১৬ কোটি মানুষ। অতীতের রীবাহিনী, সামাজিক অস্থিরতা, গুপ্ত হত্যার কলঙ্ক নিয়ে ভিশন ২০২১ ফিরছে বাকশালের প্রেতাত্মায়। নীরব পুলিশ, উত্তাল জামায়াত-শিবির। জরুরি অবস্থা আগমনের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ। বাকি শুধু রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে অনির্দিষ্টকালের জন্য মতা। মাত্র ওহাইওর সমান ভূমিতে ৩০ জনের বদলে প্রতি বর্গমাইলে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। আমেরিকার অর্ধেক জনসংখ্যার দেশের রাষ্ট্রনায়ক হওয়া চাট্টিখানি নয়। এর পরও যোগ্যতা আর কর্ম অভিজ্ঞতার বদলে যখন একমাত্র পারিবারিক পরিচয় প্রাধান্য পায় সেই সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা মাপার সূচক কী? ৪২ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের ব্যবসা আর আমৃত্যু মতাই দলগুলোর উদ্দেশ্য বলে প্রমাণ হয়েছে। কোটি কোটি নিঃস্ব মানুষ হিসাব করে তারা কয় ছটাক বা কয় তোলা মানুষ। আইয়ুব-এরশাদের মধ্যে স্বৈরাচার সীমাবদ্ধ করলেই মানুষ কি তা বিশ্বাস করে? প্রথম বিশ্বে ৩২ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে এই রকমের দেশ শাসন দেখলে আমার একমাত্র হৃদযন্ত্রটির ক্রিয়া প্রায়ই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তাহলে কী দোষ করেছিলেন খালেদা জিয়া এবং হাওয়া ভবন?
স্ববিরোধী রাষ্ট্র
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন কিসাস আর মন্ত্রীরা বলেছিলেন ডিসেম্বরের মধ্যে ১৪ জনের ফাঁসি। বিতর্ক করতে চাইলে সারগর্ভ বিতর্ক হতে হবে, যা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। কুপির আলোয় চোর ধরা নয়, বরং সূর্যের আলোয় ডাকাত ধরলে ভালো। শরিয়া আইনে চারজন চাুষ প্রমাণ আর মানুষ তৈরির আইনে লাগে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ। হিটলারকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে দারোয়ানের ফাঁসির আদেশে আরেক ধাপ ইতিহাস বিতর্ক শুরু হলো। খুন, ধর্ষণ, আগুন দিয়েছিল ওই ১৯৫ জন, যাদের বিচারের বিষয়টি ’৭৩-এর ২০ এপ্রিলে সংসদে সাব্যস্ত হয়। শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে বিচার করতেন না, কারণ নিজের সিদ্ধান্তে মূল অপরাধীদের মুক্তি দিয়ে সাধারণ মায় তিনি বিষয়টির নিষ্পত্তি করেছিলেন। বরং বিচার হচ্ছে ‘নির্মূল কমিটির’ গণ-আদালত থেকে উত্তেজিত জনতার সেন্টিমেন্ট মূলধন করে। পরবর্তীকালে যার নাম হয়েছে স্বাধীনতার প-বিপ। এর সুফল ভোগ করছে আওয়ামী লীগ। অন্তত ১৯৫ জনের প্রতীকী বিচার চাইতে পারত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, কিন্তু চায়নি। নুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে কবির সাহেবরা অনেক লিখেছেন, তারা জানেন যে ২৪ জনের বিচার হয়েছিল তারা নিয়াজী, ফরমান আলী, টিক্কা খান পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধী। দেরিতে হলেও আবেগ ত্যাগ করে ১৯৫ জনের বিষয়টি আমলে নিলে প-বিপ বিতর্কে কবির সাহেবদের পুনর্জন্ম হতে পারত।
মুক্তিযুদ্ধ একটি অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই শব্দটিকে আমরা অপরাধী বানাব না। দুই লাখ বাঙালিকে জিম্মি করে ১৯৫ জনের মুক্তির দরকষাকষি হয়েছিল অন্য দেশের মাটিতে তাদের নিজস্ব স্বার্থ আমলে নিয়ে। বিনিময়ে তিন লাখ বিহারি ফিরিয়ে নেয়ার কথা দিয়েও ফিরিয়ে নেননি ভুট্টো। বিহারি ও ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর দিল্লিচুক্তি পুরোপুরি ব্যর্থ। ফলে ভুগছেন বিহারেরা, ভুগছি আমরাও। আন্তর্জাতিক মহল থাকতে জিম্মি দুই লাখ বাঙালিকে কী করতেন ভুট্টো? মুক্তি হয়তো বিলম্বিত হতো। শেখ সাহেবকে ছুঁতে পেরেছিলেন ইয়াহিয়া খান? ১৯৫ জনের মুক্তির বিষয়টি যদি অমার্জনীয় অপরাধ হয়ে না থাকে, সহকারীদের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে অপরাধ কেন? ১৯৫ জনের মুক্তি মেনে নিলে সেটা হবে আত্মঘাতী। অবসরপ্রাপ্ত মেজর আখরুজ্জামান বলেছেন, টিক্কা খানের কবর তুলে আনতে। ইংল্যান্ডেও মৃত ‘ক্রোমওয়েলে’র বিচারের উদাহরণ আছে। সেই পর্যায়ে আমি যাচ্ছি না। তবে সশরীরে সম্ভব না হলেও বাংলার মাটিতেই ১৯৫ জনের অন্তত ন্যূনতম প্রতীকী বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। কারণ ওরাই মা-বোনদের ইজ্জত লুটেছিল, খুন-ধর্ষণ-লুটপাট করেছিল, আগুন দিয়েছিল। সুতরাং জাহানারা ইমামের মতো গণ-আদালত করে নিয়াজীদেরকে প্রতীকী ফাঁসি দিয়ে সব পরে প্রতি সুবিচার করাটাই হতে পারে ৪২ বছরের সমস্যা সমাধানের ল্েয একমাত্র ম্যাজিক। রক্তরণ বন্ধের সময় এসেছে। সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষ উত্তেজিত না করার। সময় এসেছে খুনোখুনির বদলে গলাগলির।
কাদের বিচার হওয়া উচিত? যাদের হচ্ছে, নাকি যাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলো। যারা খুনিদেরকে রা করতে চায়, শেখ হাসিনা তাদেরও বিচারের ঘোষণা দিয়েছেন। তাহলে যেকোনো অল্প বুদ্ধির মানুষও প্রশ্ন করবেÑ সজ্ঞানে ১৯৫ জনকে যিনি মুক্তি দিলেন তারও বিচার করবেন কি না। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির চুক্তিটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সত্ত্বেও বিষয়টি কখনোই আলোচনায় আসছে না, ফলে কাদের বিচার হচ্ছে না প্রজন্ম তা জানছে না, গবেষণাও করতে পারছে না দিল্লিচুক্তির ব্লুপ্রিন্ট। মন্ত্রীরা বারবার ফাঁসির রায় কার্যকরের কথা বললে (সর্বশেষ মতিয়া চৌধুরী, জানুয়ারি ১৯, ২০১৩) ধরে নেব রায় কী হবে, সরকার তা ঠিক করে দেন (দ্র: স্কাইপ, সরকার একটা রায়ের জন্য পাগল হয়া গেছে)। ত্যাগ করা মল গায়ে মাখালে বেশি টের পায় যে পাশে বসে। ধরুন আমরা একটি আদালতে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে প্রসিকিউটর যদি একবার বলেন, প্রমাণ আছে? চারজন নয়, ৪০ হাজার মানুষ তার দিকে আঙুল তুলে বলবেÑ ওই তো এরশাদ! এর হাতে নূর হোসেন, ডা: মিলনসহ অসংখ্য মানুষের রক্ত। সুতরাং মহাজোটের এক লম্পট খলনায়কের মুখ থেকে যখন মানবতাবিরোধী বিচারের উপদেশ শুনতে হয়, সেই জাতির পতন কি অনিবার্য মনে করব?
নতুন-পুরনো হাওয়া ভবনের নামে বাংলাদেশে যত অন্যায় হয়ে চলেছে, লিখতে হলে বৈদিক যুগে ফিরে গিয়ে শুরু করতে হবে মহাভারত দিয়ে। ১৫ আগস্টের মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করলেও সরকারের অবস্থান দেখলে মনে হচ্ছে, তারা গৃহযুদ্ধ ও ১/১১-এর পথেই এগোচ্ছে। কিন্তু কোন ধর্মশাস্ত্রে আছে মানুষ হত্যা করে মতায় যেতে হবে, নাহলে দৈববাণী অস্পৃশ্য হবে? আমৃত্যু মতার কথা কোন পুরাণের বাণী? অপরাধীকে পুরস্কার দিতে হবে, এ কথাও লেখা নেই কোনো শাস্ত্রে।
রাষ্ট্রপতির শীতকালীন ভাষণ
মাননীয় রাষ্ট্রপতি! উন্নতির লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন, কিন্তু হাওয়া ভবনকে পরাজিত করার মতো যে খবরগুলো প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে আজ প্রায় চার বছর, যদি বিশ্বজিতের মৃত্যু এভাবেই হয়ে থাকে, তাহলে এসব উন্নতি দিয়ে আমরা কী করব? সরকার মানেই একমাত্র মানবতাবিরোধীদের বিচার আর পদ্মা সেতু না হওয়া সত্ত্বেও চার বছর নষ্ট করল শুধু পদ্মা সেতু আর যুদ্ধাপরাধীদের পেছনে। বিচার হচ্ছে মানবতাবিরোধীদের, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলছেন যুদ্ধাপরাধী? তিনি বোধ করি অজান্তেই ওই ১৯৫ জনের কথা বলছেন মহামান্য! সত্য কখনোই চাপা থাকে না। সুতরাং জাতির অভিভাবকের কাছে আমার কিছু আরজি। আয়নায় নিজের মুখ দেখার একটি প্রবাদ আছে, তাই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সেক্রেটারিয়েটের মুখে জনতার মঞ্চ নামে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলল, আজকের বিরোধী দল এর ধারেকাছেও যেতে পারছে না কেন? যখন ৩০৩ দিনের হরতালে সারা বাংলাদেশ তাদের দখলে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, পিটিয়ে খুন, ১/১১-এর সূচনালগ্নে জনজীবন স্তব্ধ করে দেয়া, অচল দেশ, অচল বন্দর, বায়তুল মোকাররম ও পল্টনে পুলিশে-মানুষে রণত্রে, গোলাগুলির মুখে কারফিউ জারি এবং রাস্তাজুড়ে পড়ে থাকা লাশের পর লাশ… ঈদ শেষে ঘরে না ফিরতে পারা মানুষদের আহাজারি, শিা-সেবা প্রশাসন স্তব্ধ, ১১ জনকে বাসের মধ্যে জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলা… সব কিছুই তো পত্রপত্রিকা আর ইন্টারনেটে… আপনি তখন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান। এ ছাড়াও রয়েছে বিপ্লবে, আন্দোলনে আপনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, বিশেষ করে ১/১১-এর আগে এবং পরে যে জন্য আপনার এই পুরস্কার। তাই শীতকালীন অধিবেশনে আপনি যখন এ রকম কঠিন ভাষায় একটি ভবনের নামে বিষোদগার করলেন তখন মনে হওয়াই স্বাভাবিক আপনি হয়তো দলের বাইরে যেতে পারছেন না। মহামান্য! আপনার কথাই ঠিক! যুদ্ধাপরাধীদের মা নেই। কিন্তু সেই আপনিই যখন ডজনকে ডজন ফাঁসির খুনিদের মা করে আইভি রহমানের বিচার চাইছেন, বিষয়টি কি সাংঘর্ষিক নয়?
মাননীয় রাষ্ট্রপতি! আমরা কেউই মৃত্যুঞ্জয়ী নই। সৎ রাজনীতিবিদেরা কিছু ‘ল্যাগেসি’ রেখে যেতে চায়, কিন্তু কার বুদ্ধিতে এই বয়সে পৌঁছে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের গৌরবময় অর্জনের এক কড়াই দুধে এক ফোঁটা গরুর চোনা?
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আশা করি, আমার বিশ্লেষণটি আপনার নজরে আসবে এবং ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে আপনি যখন দলে ফিরবেন, একই প্রস্তাব প্রযোজ্য হবে আশা করি। বর্তমান মসনদ যেভাবে চলছে সাধারণ মানুষ মনে করে এটা ২০০১-এর থেকে ২০০৬-এর মুনর্মুদ্রণ। দুঃখের বিষয়, বিরোধী দল সেদিন ৩০৩ দিন হরতালের ১০৬ ভাগ অধিকার ভোগ করলেও চার বছর ধরে ১৮ দল রাস্তায় দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছে না। লগি-বৈঠা-চইড় আন্দোলনের ২৮ অক্টোবর আর ভয়াল ২১ আগস্ট এক ও অভিন্ন হলেও বিচার হচ্ছে শুধু ২১ আগস্টেরই। হরতালে মানুষ খুনের জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিচার করতে চান প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু ২৮ অক্টোবরে ১১ জনকে বাসের মধ্যে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগে ১/১১-এর সরকার যে বিচার শুরু করেছিলেন, সেটাও পাবলিক রেকর্ডে। ৯ ডিসেম্বরের গাড়ি ভাঙচুরের জন্য দায়ী হলো ফখরুলের বক্তব্য, কিন্তু ২৬ অক্টোবরে লগি-বৈঠা-চইড় নিয়ে রাস্তা দখল আন্দোলনের ঘোষণার পরই যে খুনোখুনি হলো, এর দায়িত্ব কি প্রধানমন্ত্রীর নয় (ইউটিউব)? সুতরাং মহামান্য! দুই টার্মে ৩০৩ দিন হরতালে জ্বালাও-পোড়াও করে রাস্তা দখলে রাখলে বর্তমান বিরোধী দলের আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারের ক্রুসেড কোনোক্রমেই গণতান্ত্রিক নয়। (বিরোধী দল সেসব ভিডিও ফুটেজ দিয়ে সভা করতে পারত)। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নয়, বরং চলছে পিনোশের মতো লাশের রাজনীতি জিইয়ে রেখে মঞ্চে চেক বিতরণের পৈশাচিক আনন্দ-উত্তেজনা। মিগ মামলাসহ প্রধানমন্ত্রীর ১৫টি এবং দলের প্রায় সাড়ে সাত হাজার মামলা খারিজ করিয়ে নেয়ার পরও বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার মামলা মোশতাক সরকারের মতোই আওয়ামী লীগের ললাটে কলঙ্ক লেপন করেছে।
শুধু নিজামীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এরশাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিলে সেটাও মুক্তিযুদ্ধের সাথে বেঈমানি। শুধু নিজামী নয়, নূর হোসেন হত্যাকারীকে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নামানোর পরও মহাজোটে তার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদ ও স্মৃতিসৌধ অপবিত্র হয়েছে। আগের দুই
কিস্তিতে জামায়াতকে নিয়ে জোটের চেষ্টার পরও শেষ কিস্তিতে জামায়াতের বিচার স্ববিরোধী। বিরোধী দল পেটালে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেয় সরকার।
মাননীয় রাষ্ট্রপতি! বিএনপিকে প্রার্থীহীন করার ল্েয জেলহাজতে নেতাকর্মী ঢুকিয়ে নির্বাচনের নকশার সাথে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫-এর কী অদ্ভুত মিল। কিন্তু মসনদবাদীরা এভাবে পেটালে আইনশৃঙ্খলার কী হবে? (২৪ জানুয়ারি প্রথম আলোর রিপোর্ট ছাত্রলীগ নেতাদের ধরছে না পুলিশ)। মাননীয় রাষ্ট্রপতি! খুনি হুদা আর রশিদের পদোন্নতির জন্য সংসদে ও রাস্তায় জিয়াউর রহমানকে গালাগাল নয়, বরং ১/১১-এর গং জেনারেল মাসুদকে অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসে পদোন্নতি দেয়ার পর জিয়াউর রহমানকে গালাগালের নৈতিক অধিকার আওয়ামী লীগের আর নেই। ১৫ আগস্টের নায়কদের বিদেশে হেফাজত করার জন্য জিয়াউর রহমানকে গালাগাল নয়, বরং ১/১১-এর গংদেরকে বিদেশে হেফাজতের পর একই অভিযোগ বিরোধী দল তাদের বিরুদ্ধেও তুলতে পারে (তোলার সময় পার হয়ে যাচ্ছে)।
৩০ লাখ ম্যাজিক সংখ্যাটি জাতির মস্তিষ্ক ধোলাই কাজে চরমভাবে অপব্যবহার করে আসল সংখ্যাটি কখনোই জানতে না দিয়ে সত্যের বিরুদ্ধে ক্রুসেড? বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট… দাতারা ধমক মারলে বিচার হবে, না হলে হবে নাÑ এমন বিশৃঙ্খল বিচারব্যবস্থার ওপর কেন আস্থা রাখবে মানুষ? মহামান্য! এতিমের টাকার মামলা খারিজ না হলে প্রধানমন্ত্রীর ১৫ মামলা খারিজ হলো কোন প্রক্রিয়ায় সবটুকু জানতে চাই। ম্যালকম এক্সের ব্যুলেট আর ব্যালট তত্ত্ব অনেক আগেই পড়েছি। ভোট না কম্বল, এ মুহূর্তে কোনটা জরুরি জবাব দেবেন কালমার্কস, টটস্কি অ্যাঙ্গেলস। কিন্তু ১/১১-এর চেয়ে বড় জরুরি অবস্থা জারি করেছে শীত। আর এ রকম দুঃসময়ে যেদিন আরো ১০ বছর মতা লম্বা করার জন্য জাতির কাছে ভোট চাইলেন ডটার অব পিচ, সেদিন লাখ লাখ শীতার্ত গৃহহীন শুধু একটি কম্বলের অভাবে রাস্তায় শুয়ে খিঁচুনি রোগীর মতো কাঁপছিল। প্রশ্ন দেশজুড়ে যখন এত হতদরিদ্র তখন শেষ বছরে হঠাৎ এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার যুক্তি সরকারের আছে কি? রাষ্ট্রের অর্থ চুরি আর ট্রাস্টের অর্থ ব্যয়ের আইনি পার্থক্য যে ব্যারিস্টারেরা বোঝেন না তাদের হাতে কোনো মামলাই নিরাপদ নয়। সুতরাং এতিমখানার নামে অপদার্থ মামলা দিয়ে বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে আটকানোর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার অধিকার খালেদা জিয়ার আছে বলেই দেশে ও বাইরে বক্তব্য তুলে ধরছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথাই যদি বলি, অতীতে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে ফ্রান্স, আমেরিকা, লন্ডন, কানাডা, ভারত… বাংলাদেশকে সাহায্য বন্ধ করার জন্য যত বক্তৃতা এবং লবি করেছিলেন সব তথ্যপ্রমাণ মিডিয়ায় রয়েছে। এমনকি ‘ওআইসি’ নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রার্থীকে ভোট না দেয়ার জন্য যে কাজটি তিনি করেছিলেন সেটা যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা না হয়, তাহলে অন্য কোনো কিছুই রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতে পারে না (দ্র: ইনকিলাব, ৩ ফেব্র“য়ারি)। ২০০৮ সালে সোনিয়া গান্ধীর মতো দলীয় সভানেত্রী থাকার পরামর্শ দিলে ওয়াশিংটনকে করা হয়েছে ‘না’। ঘোষণা দিয়েও ৫৮ বছর বয়সে রাজনীতি থেকে সরে না গিয়ে বরং ৬৫ বছর বয়সে পৌঁছে আরো ১০ বছরের জন্য মতার খায়েশের পরও ওবামার নির্বাচনের সাথে নিজেকে তুলনা করলে আমারো প্রশ্নÑ আট বছর শেষে ওবামার মতা নেই এক দিনও বেশি গদিতে থাকার, কিন্তু ১০ বছর পূর্ণ করেও আপনি কেন ২০২১ সাল পর্যন্ত মতার ক্যাম্পেইন করছেন? ওই দেশে কি ভোটকেন্দ্র দখল হয়? বিরোধী দলকে পার্লামেন্টের বাইরে রেখে নির্যাতন চালানো হয়? বিশ্বমঞ্চে অহিংসতার বাণী শুনিয়ে স্বদেশে যে সহিংস আগুন জ্বালিয়ে রাখা তাতে ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে শাকিল-শাওনদের মতো ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী। গুম-খুন-সামাজিক অস্থিরতার ভয়ে মানুষ ঘুমায় না পর্যন্ত। তাই হরতাল বন্ধের বিরুদ্ধে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিল না আনার কারণ ভবিষ্যতে আগের চেয়েও বেশি হরতাল দিয়ে জনজীবন পঙ্গু করে ফেলার ১০৬ ভাগ রাস্তা খোলা রাখা। মতা আওয়ামী লীগ কিছুতেই ছাড়বে না, তাই দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন বারবার স্পষ্ট করলেও সহজ কথাটি রফিকুল হক প্রমুখ সুশীলরা বুঝতে চাইছেন না কেন? দুই নারীর নেতৃত্বে বিগত চার বছরে ইহুদি-মুসলমানদের মতো বিভক্ত হয়েছে জাতি। দু’টি দলের নামে ১৫৬টি দেশে শাখা-প্রশাখা। বাঙালির বাপের নাম এখনÑ জিয়া কিংবা মুজিব। দু’টি দলের ক্রুসেডের জন্যই কি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন মানুষ? এ রকম স্ববিরোধী শত শত উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন