শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

উস্কানি শাহবাগ নাটকের পরও



 আহমদ আশিকুল হামিদ : দৃশ্যগুলো নিজে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম না। গতকাল, ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে ও পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ মুসল্লিদের ওপর যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হামলা চালিয়েছে সে সম্পর্কে লিখতে গেলেও কারো পক্ষে মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব নয়। এসব দৃশ্য টেলিভিশনে দেখার সময় মনেই হচ্ছিল না যে, এটা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের রাজধানী। প্রথমত, পুলিশ মুসল্লিদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঢুকতেই দিতে চায়নি। গেটগুলোতে তারা তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। তালা ভেঙে ঢুকলেও এবং নামাজ আদায় করলেও বেরিয়ে আসা মাত্র মুসল্লিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুলিশ। পুলিশ বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে টার্গেট করে গুলী পর্যন্ত চালিয়েছে। মূল হামলা ও নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছে মসজিদের বাইরে। বায়তুল মোকাররম থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব হয়ে মৎস্য ভবন পর্যন্ত পুরো এলাকা জুড়ে চলেছে এই তান্ডব। একটি ঘটনায় পুরানা পল্টনের ফুট ওভারব্রিজের সিঁড়িতে একজন মুসল্লির মুখের ওপর একের এক লাথি মেরেছে একজন আওয়ামী পুলিশ। রক্তাক্ত অবস্থায় বেচারা মুসল্লি সিঁড়িতেই পড়ে গেছেন। তখনও লাথি বন্ধ হয়নি পুলিশের। আরো অনেক মুসল্লিকেই পুলিশের লাথি খেতে হয়েছে। কাঁটাবন মসজিদের বাইরে মার খেয়েছেন একজন ব্রিটিশ নাগরিকও। পরিচয় দেয়ার পরও পুলিশ তাকে রেহাই দেয়নি। বায়তুল মোকাররমের মতো কাঁটাবন মসজিদের ভেতরেও গুলী চালিয়েছে পুলিশ। পুলিশ মুসল্লিদের বয়সকেও বিবেচনায় নেয়নি। নির্বিচারে লাথি মেরেছে এমনকি পিতার বয়সীদেরকেও। কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার, ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরা ও বাড্ডা-রামপুরা পর্যন্ত প্রতিটি এলাকায় পুলিশ একই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে মুসল্লিদের লাঠিপেটা করেছে। টিয়ার গ্যাস তো ছুঁড়েছেই, কয়েকশ রাউন্ড গুলীও করেছে। এসব গুলীতে মুসল্লিরা শুধু নন, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষও আহত হয়েছেন। তাদের অনেককে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল সুনির্দিষ্টভাবে। নাহলে পুলিশের পক্ষে এতটা নিষ্ঠুরতা দেখানো সম্ভব হওয়ার কথা নয়।
বলা বাহুল্য, সবই করা হয়েছে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে। আর এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের উদ্যোগে মঞ্চায়িত শাহবাগের সেই নাটক। ‘জয় বাংলা' ও ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা'র মতো ‘নির্দলীয়' স্লোগানের মাধ্যমে শুরু হলেও ‘জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান দিয়ে শেষ করার কারণে শুধু নয়, সব মিলিয়েই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, নাটকটির পেছনে শুরু থেকে আসলে কারা ছিল এবং শেষ পর্যন্তও কারা রয়েছে। কথিত ‘তরুণ প্রজন্ম'কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হলেও ঘটনাপ্রবাহে অনেক বিষয় নিয়েই আপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকাশ্যে অবমাননার পাশাপাশি আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি ছিল আপত্তির প্রধান কারণ। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায় প্রত্যাখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বন্দী সব নেতাকে সরাসরি ফাঁসির আদেশ দেয়ার জন্য প্রচন্ড চাপও সৃষ্টি করেছে তারা। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারপতিদের কাছ থেকে তারা গায়ের জোরে রায় আদায় করার চেষ্টা চালিয়েছে। অথচ বিধান হচ্ছে তথ্য, দলিলপত্র, সাক্ষ্য, জেরা প্রভৃতির ভিত্তিতে বিচারের যে বিধান রয়েছে তাকেও প্রত্যাখ্যান ও চ্যালেঞ্জ করেছে ওই প্রজন্ম নামধারীরা। আইনের বিধান অনুযায়ী যে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারপতিরা। অভিযোগ প্রমাণিত না হলে কাউকে মুক্তি দেয়ারও অধিকার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের। অন্যদিকে ‘তরুণ প্রজন্ম'কে দিয়ে এমন দাবিই উত্থাপন করা হয়েছে যাতে এক ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো সাজা দেয়ার কথা ট্রাইব্যুনাল বিবেচনাও না করতে পারেন। এর ফলে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই কথিত ‘তরুণ প্রজন্ম'কে নামানো হয়েছিল। এখানেই প্রবল আপত্তি উঠেছে। কারণ, এভাবে দাবি ও মেসেজ পাঠানো চলতে থাকলে মাননীয় বিচারপতিদের ওপর প্রচন্ড মানসিক চাপের সৃষ্টি হবে, দেশের বিচার ব্যবস্থাও একেবারে তছনছ হয়ে যাবে।
‘তরুণ প্রজন্ম' নামধারীদের ফ্যাসিস্ট বক্তব্য এসেছে আপত্তির অন্য এক প্রধান কারণ হিসেবে। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে তো বটেই, শাহবাগের সমাবেশ থেকে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও ফ্যাসিস্ট সুরে ভয়ংকর হুমকি উচ্চারিত হয়েছে। যেমন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এরকম এক ঘোষণায় দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উদ্দেশে কথিত তরুণ প্রজন্মের নেতারা বলেছে, শাহবাগের নাটক সম্পর্কে আর একটা ‘উল্টাপাল্টা কথা' লিখলে আমার দেশ সম্পাদককে ‘খতম' করা হবে। মাহমুদুর রহমানকেই শুধু ‘খতম' করার হুমকি দেয়া হয়নি, একই সঙ্গে টিভি টকশোর জনপ্রিয় দুই আলোচক অধ্যাপক পিয়াস করিম ও ড. আসিফ নজরুলের ‘পিঠের চামড়া' তুলে নেয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আলোচক দু'জনকে ‘কুলাঙ্গার' হিসেবে উল্লেখ করে তারা এই বলে ‘সাবধান' করে দিয়েছে যে, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে ‘উল্টাপাল্টা কথা' বললে তাদেরকেও ‘নির্মূল' করা হবে। তাদের ‘পিঠের চামড়া' থাকবে না। সমাবেশে এসব হুমকি ও ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম এবং ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু- ২০০৬ সালের অক্টোবরে যাকে লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছিল। আমার দেশ-এর পাশাপাশি দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম এবং দিগন্ত টিভির বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বক্তারা। বর্জনের আহবান তো জানিয়েছেই, এসব গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের ‘প্রতিহত' করার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। মুহুর্মুহু স্লোগান দিয়ে ও তালি বাজিয়ে হুমকিদাতাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে সমাবেশে আগত লোকজনের একটি অংশ, যাদের মধ্যে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত ভিসি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতিসহ দেশের কতিপয় ‘বিশিষ্টজন'ও। অনেকের ধারণা ছিল, এই ‘বিশিষ্টজনেরা' হয়তো হুমকিদাতাদের নিবৃত্ত করবেন। কিন্তু তারা তা না করায় এবং উল্টো একাত্মতা প্রকাশ করায় ধরে নেয়া হয়েছে ‘বিশিষ্টজনেরা'ও সমর্থনই দিয়েছেন এবং শাহবাগের ওই সমাবেশ থেকে হুমকি ও ঘোষণা এসেছে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। এ ধরনের হুমকি শেষদিন পর্যন্তও উচ্চারণ করেছে তারা। ২১ ফেব্রুয়ারি সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণার আগে অন্য অনেকের মধ্যে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছে, তাকে ক্ষমাও চাইতে বলেছে। এছাড়া নাম ধরে ধরে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে সে। অথচ গণতন্ত্রের মূলকথা হলো, ভিন্নমত প্রকাশ করতে তো দিতে হবেই, ভিন্নমতপোষণকারীদের পরামর্শও গ্রহণ করতে হবে। শাহবাগের সমাবেশে কিন্তু তেমন চিন্তা ও মানসিকতার লক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়নি। ‘খতম' করা, ‘নির্মূল' করা এবং ‘পিঠের চামড়া' তুলে নেয়ার মতো হুমকি ও ঘোষণার মধ্যে গণতন্ত্রের ন্যূনতম উপাদানও থাকতে পারে না। এসবের মধ্য দিয়ে বরং উগ্র ফ্যাসিস্ট মানসিকতা ও উদ্দেশ্যেরই ন্যক্কারজনক প্রকাশ ঘটেছে। ‘বিচার নয়, ফাঁসি চাই' এবং ‘ফাঁসি চাই, জবাই করো' ধরনের স্লোগানগুলোকেও কোনোক্রমেই গণতন্ত্রসম্মত বলা যায় না। অন্যদিকে এসব স্লোগান মুখেই উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল তথাকথিত তরুণ প্রজন্ম। সবশেষে তারা ‘খতম' ও ‘নির্মূল' করার এবং ‘পিঠের চামড়া' তুলে নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে। বাপ্পাদিত্য বসুদের মতো লগি-বৈঠার চিহ্নিত খুনি-সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভয়-ভীতিও যথেষ্টই দেখিয়েছে তারা।
এরপর রয়েছে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধিতার দিকটি। এ ব্যাপারেও অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছে শাহবাগ মঞ্চের কুশীলবরাই। তরুণ প্রজন্ম নামের আড়ালে তারা আসলে এমন একটি গোষ্ঠী যারা বহুদিন ধরে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। মহান আল্লাহ, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র আল-কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত অসভ্য ভাষায় মন্তব্য করার ও কুৎসা রটানোর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম নামধারী এই ব্লগাররা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুচিন্তিতভাবে বিষোদগার করে এসেছে। চালাচ্ছে বিরামহীন সাইবার ওয়ার। যে ধরনের ভাষা ও শব্দ তারা ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে সে সবের কোনো একটিও ধর্মপরায়ণ কোনো মুসলমানের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। সে কারণে এগুলোর উল্লেখ থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। ওই ব্লগাররা কিন্তু শুধু ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী কটূক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি,  দেশের আইন ও আদালতের প্রতিও তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে। গত বছরের মার্চে দেয়া হাইকোর্টের একটি রায়ের কথাই ধরা যাক। ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকসহ কয়েকজন মিলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা চিহ্নিত ব্লগগুলো বন্ধ করাসহ ব্লগার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিটিআরসি, র‌্যাব ও পুলিশসহ সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিটিআরসি বা সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, গোয়েন্দারা একজন ব্লগারকে গ্রেফতার করার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাকে ছেড়ে তো দিতে হয়েছিলই, গ্রেফতারকারী গোয়েন্দাদের উল্টো ক্ষমাও চাইতে হয়েছিল। ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার গোষ্ঠীও সরকারের এ মনোভাবের সুযোগ নিতে ভুল করেনি। প্রচারণা বন্ধ করার কিংবা সংযত হওয়ার পরিবর্তে ব্লগাররা বরং নিজেদের কর্মকান্ডকে আরো জোরদার করেছে। ব্লগাররা একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের প্রতিও প্রকাশ্যে অবজ্ঞা দেখিয়েছে। যেমন গত বছরের ২১ মার্চ রায় ঘোষিত হওয়ার পর আসিফ নামের একজন ব্লগার লিখেছে, ‘সম্পূর্ণ সজ্ঞানে সচেতনভাবে ঐ যুক্তিহীন অন্ধ ষাঁড়ের মতো উৎকট দুর্গন্ধময় ধর্মীয় অনুভূতি এবং ঐ যুক্তিহীন ধর্মীয় অনুভূতির রক্ষক আদালত, দুই জিনিসেরই অবমাননা করলাম।' একযোগে আরো কুৎসিত ভাষা ও শব্দেও অনেক মন্তব্য করেছে ব্লগাররা। ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে তো বটেই, মন্তব্য করেছে দেশের উচ্চ আদালত সম্পর্কেও। অন্যদিকে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার পাশাপাশি এই ব্লগার গোষ্ঠীকে দিয়েই ক্ষমতাসীনরা শাহবাগে নাটক সাজিয়েছেন। ১৭ দিন ধরে ব্লগাররাও শাহবাগে নানা ধরনের অশ্লীল কান্ডকারখানা করেছে।
এদিকে যারা ওই ব্লগারদের ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন সরকার উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মারমুখী হয়ে উঠেছে। পুলিশকে দিয়ে সরকার জোর তৎপরতাও চালাতে শুরু করেছে যার ফলে আক্রান্ত ও অসম্মানিত হয়েছেন ধর্মপরায়ণ মুসলমানরা। জনগণ স্তম্ভিত হয়েছে সরকারের নীতি মনোভাব ও কর্মকান্ড দেখে। গতকাল জুমার পর পুলিশ যে মুসল্লিদের ওপর গুলী পর্যন্ত চালিয়েছে সে কথা আগেই বলেছি। ওদিকে ইসলামবিরোধী সর্বাত্মক প্রচারণা ও কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তব্য যখন ছিল ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সরকার তখন ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা চাপিয়ে দেয়ার অভিযানে নেমেছে। কারণটিও কৌতূহলোদ্দীপক। সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে কটূক্তি করার অভিযোগে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে সাংবাদিক এবং মফস্বলের কলেজ ছাত্র পর্যন্ত সমাজের সব পর্যায়ের মানুষকেই এ অভিযোগে হেনস্তা করা হচ্ছে। বাদ যাচ্ছেন না এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও। তাদের বিরুদ্ধে সোজা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। সাজাও হচ্ছে কারো কারো। যেমন ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কথিত কটূক্তি করায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলাই শুধু করা হয়নি, ছয় মাসের কারাদন্ডও দেয়া হয়েছে তাকে। এর কারণ, উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে থাকায় ওই শিক্ষকের পক্ষে নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির হতে পারেননি। এজন্য তার ওপর আদালত অবমাননার অভিযোগ চাপানো হয়েছে। একই অভিযোগে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে পুলিশ। ভয়ে বেচারা শিক্ষক থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ না করে পারেননি। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মন্তব্য করায় চাকরি খুইয়েছেন নেত্রকোণার এক শিক্ষিকা, সুনামগঞ্জে একজন কলেজ শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানের বেশ কয়েকজন ছাত্রকেও জেলের ভাত খাওয়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি মন্ত্রীরা পর্যন্ত পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। যেমন জয়পুরহাটের এক ওয়াজ মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিপরিষদ সম্পর্কে  নিন্দা করায় পাঁচবিবির একজন ইমামের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এভাবে মামলার পর মামলা ঠুকে পরিস্থিতিকে অত্যন্ত বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রে বিরোধী মতামত থাকাটাই স্বাভাবিক। সংবিধানও নাগরিককে ভিন্নমত প্রকাশ করার অধিকার দিয়েছে। সে অনুযায়ী যে কেউই সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে পারেন। আর প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সরকারপ্রধান সেহেতু বক্তব্য তার বিরুদ্ধেও উচ্চারিত হতে পারে। এর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতা খোঁজাটা অবশ্যই অনুচিত। তাছাড়া বর্তমান ‘ডিজিটাল' সরকারের বদৌলতে ইন্টারনেটের আজকাল সর্বাত্মক ব্যবহার হচ্ছে। সরকারবিরোধীরাই শুধু লিখছেন না বা প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মন্তব্য করছেন না। বাস্তবে চলমান সাইবার ওয়ারে সরকার সমর্থকদেরকেই অনেক বেশি তৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে। বড়কথা, গণতন্ত্রসম্মত সমালোচনা বা শালীনতার মধ্যেও থাকছে না তারা। অশ্লীলতার কারণে তাদের বক্তব্য পাঠযোগ্যও থাকছে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হুমকিও তারাই বেশি দিচ্ছে। কিন্তু এদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। এমনকি মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পাশাপাশি পবিত্র আল-কোরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে যারা ভয়ংকর রকমের অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের প্রতিও অঘোষিত উদারতাই দেখানো হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার বিরোধীদের সম্পর্কে এমনভাবেই শোরগোল তোলা হচ্ছে যেন তারা সরকারের ‘মহাভারত'কে অশুদ্ধ করে ফেলেছেন! এ ব্যাপারে স্বয়ং তথ্যমন্ত্রী দৃশ্যপটে এসে হাজির হয়েছেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি হুমকি পর্যন্ত উচ্চারণ করেছেন। যেসব গণমাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষীদের বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধেও ‘আইনগত' ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে বাস্তব বিভিন্ন কারণেই  ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এ ধরনের হুমকি মোটেও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির যে অপচেষ্টার কথা তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, সেটা প্রতিহত করার সত্যি সদিচ্ছা থাকলে সরকারের উচিত ছিল প্রথমে ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। কারণ, সর্বাত্মক উস্কানি আসলে তারাই দিয়েছে। ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের আবেগ ও অনুভূতিতে চরমভাবে আঘাত করার মধ্য দিয়ে সাইবার ওয়ারের সূচনাও তারাই করেছে। অন্যদিকে তথ্যমন্ত্রী কিন্তু তাদের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। অনেকাংশে অনুগ্রহ দেখানোর ঢঙে শুধু জানিয়েছেন, ইসলামবিদ্বেষী কয়েকটি ব্লগ বন্ধ করে দেয়ার জন্য তিনি নাকি বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। সত্যি তিনি তেমন কোনো নির্দেশ দিয়েছেন কি না এবং দিলেও বিটিআরসি সত্যি কোনো ব্লগ বন্ধ করেছে কি না সে বিষয়ে জানার কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাছাড়া ইসলামবিদ্বেষীরা এতটাই বাড়াবাড়ি করে চলেছে যে, কয়েকটি মাত্র ব্লগ বন্ধ করলেই তাদের প্রচারণা বন্ধ হয়ে যাবে না। তারা বরং নিত্য নতুন ব্লগের মাধ্যমে উস্কানি আরো বাড়িয়ে চলবে। এজন্যই শুধু বন্ধ করার আশ্বাস দিলে চলবে না, সত্যিই বন্ধ যে করা হয়েছে তারও প্রমাণ দিতে হবে। একযোগে ব্যবস্থা নিতে হবে বিশেষ করে এরই মধ্যে যারা ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। না হলে জনগণ যেমন মোটেই বিশ্বাস করবে না, তেমনি শান্ত করা যাবে না মন্ত্রী বর্ণিত সামাজিক অস্থিরতাও- যার প্রমাণ পাওয়া গেছে গতকাল। সরকারকে একই সঙ্গে গণতন্ত্রসম্মত বিরোধিতার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা চাপানোর অভিযানও বন্ধ করতে হবে।
সবশেষে বলা দরকার, একটি নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার গোষ্ঠীকে সমর্থন-সহযোগিতা দেয়ার পাশাপাশি তাদের দিয়ে শাহবাগ নাটক সাজানোর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ইসলামবিরোধী উদ্দেশ্যের ন্যক্কারজনক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই সত্য ভুলে যাওয়ার পরিণতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে যে, বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ শুধু মুসলমান নন, ধর্মপরায়ণ, অসাম্প্রদায়িক ও সংগ্রামী মানুষও। নিজেদের অধিকার রক্ষা ও আদায় করার জন্য যুগে যুগে তারা সংগ্রাম করে এসেছেন। সংগ্রাম যে আরো করবেন তার প্রমাণও তারা দিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে নাস্তিক ব্লগাররা শুধু নয়, সরকারও সে ৯০ শতাংশ মুসলমানের বিরুদ্ধেই সর্বাত্মক অভিযানে নেমে পড়েছে। গতকাল অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পুলিশকে দিয়ে লাঠিপেটা শুধু নয়, গুলীও করিয়েছে সরকার। এমন নীতি ও কর্মকান্ড কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। সরকারের উচিত সময় একেবারে পেরিয়ে যাওয়ার আগেই ইসলামবিদ্বেষী ব্লগগুলোকে বন্ধ করে দেয়া এবং চিহ্নিত ব্লগারদের গ্রেফতার করা। কারণ, তারা শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধেই সাইবার ওয়ার চালাচ্ছে না, দেশের উচ্চ আদালতকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads