বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

কী হতে যাচ্ছে


দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কারো কারো উচ্ছ্বাস থাকলেও অনেকের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে। সরকার অবস্থাকে সাংঘর্ষিক করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে বলেই সাধারণ মানুষের ধারণা। এই ধারণা ভুল প্রমাণ করার মতো নৈতিক যুক্তি সরকারের হাতে নেই।

সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা কী হতে যাচ্ছে, কী হচ্ছে, কী হবে। মিডিয়ার সাথে জড়িত থাকার কারণে এমন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি প্রায়ই হতে হয়। সবার ধারণা, মিডিয়ার লোকজন সব জান্তা। আসলেই মিডিয়ার সাথে জড়িত সিনিয়রদের সাথে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণী ও রাজনীতিবিদের একটা নিবিড় সম্পর্ক থাকা খুবই স্বাভাবিক। আছেও। কারো পরিধিটি বড়, কারো ছোট। তবে কিছু দলান্ধ সাংবাদিক রাজনীতি ও ক্ষমতার পাড়ায় ঘুর ঘুর করলেও পেশাদার সাংবাদিক সব জান্তা এমন ধারণা ষোলআনা সঠিক না হলেও তাদের জানার বিষয়টি উপেক্ষণীয় নয়। মিডিয়ার লোকজন তথ্যের সাম্রাজ্যে বিচরণ করে। খবরাখবরের সাগরে সাঁতার কাটে। কিছু তথ্যউপাত্ত বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক।
কারো কারো ভাবনাÑ দেশটা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির ভেতর ভাগ-বিভাজন হয়ে গেছে। অনেকের  কাছেই এমন ধারণা অমূলক। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দেশটা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীদের মাঝে বিভক্ত হয়ে একটা নতুন মেরুকরণ হয়ে গেছে। এমন ধারণা নাকচ করে অন্যরা মনে করেন,্ দেশটা ভারতপন্থী ও ভারত বিরোধীদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টির ব্যাপার মাত্র। কোনো কোনো বামতাত্ত্বিক বলে বেড়াচ্ছেনÑ এবারের মেরুকরণ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিপরীতে প্রগতিশীলদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের বিষয়, এমনটা ভেবে তারা বেশ পুলকিতও। কিছু মানুষ মনে করছেন, আসলে যুদ্ধটা শুরু হয়েছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এবং তা ইসলামপন্থীদের সাথে ইসলাম বিরোধীদের ভেতর আদর্শগত লড়াই। এর সাথে সম্প্রসারণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। কিছু মানুষের ঋজু মূল্যায়ন, আদর্শ এখানে গৌণ, দ্বন্দ্বটা ক্ষমতার। কেউ ক্ষমতায় যেতে চায়, কেউ আঁকড়ে থাকতে চায়। এর বাইরেও আরো মূল্যায়ন আছে। কারণও বলে দিচ্ছেন কেউ কেউ। তাদের ধারণা, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত খেলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও খেলার অংশ। চীন দূরতম সম্পর্ক রেখেও এ খেলায় কাউকে ওয়াকওভার দিতে চায় না। বঙ্গোপাসাগর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ভিন্নমাত্রার একটা জমজমাট খেলার প্রসঙ্গও কারো কারো বিশ্লেষণে রয়েছে। বিষয়টা আসলে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, একই সাথে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ও। যে যেভাবে বুঝতে চাচ্ছেন কিংবা দেখতে চাচ্ছেন তিনি সেভাবেই বুঝবার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ যে বিভিন্ন প্রভাবক রাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের জন্য যথেষ্ট উর্বর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে জনগণ নিছক দর্শক নয়, তারাও খেলা বুঝে বাহবা দেয় আবার পাতানো খেলা ভণ্ডুলও করে দেয়। তাই জনগণই শেষ কথা, তাদের মানসিক দিকটি নিয়ে একটু ভাবা যাক।
আমরা জনগণের ভাবনার জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে ভাবতে চেষ্টা করলে ভোটের একটা সংখ্যাতত্ত্ব সহজেই বেরিয়ে আসবে। জানা মতে, বিগত চার বছরে কোনো আওয়ামী লীগার বিএনপি হয়ে যায়নি। একজন বিএনপিপন্থীও আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়নি। বামও ডানপন্থী হয়নি, ডানও বামপন্থী হয়নি। কোনো জামায়াতের লোক দল ছেড়ে অন্য দলে যায়নি, জাতীয় পার্টির কিছু লোক অবশ্য অবস্থান পরিবর্তন করেছে। সেই সংখ্যাও নগণ্য। তাই আওয়ামী লীগ তার মিত্রশক্তি নিয়ে মহাজোট গঠন করে ক্ষমতায় গেলেও ভোটারের সংখ্যাতত্ত্বে বড় ধরনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
সাধারণ বিবেচনায় দিনবদল ও ডিজিটালের স্বপ্ন দেখিয়ে যাদের আওয়ামী লীগ প্রলুব্ধ করেছিল, তাদের অনেকের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। ঘোরও কেটেছে। মোহও ভেঙেছে। তাই বলে কোনো আওয়ামী লীগার বিএনপি হয়ে গেছে এমন কোনো তথ্য দেয়া কঠিন। তবে এটা সত্য যে, বামপন্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগনির্ভরতা এতটা বেড়েছে যে, অনেক বামপন্থী আওয়ামী ‘ব্রাহ্মণ’ সেজে গেছেন। এজন্যও ভোটের সংখ্যাতত্ত্বে তেমন কোনো রকমফের হওয়ার কথা নয়। কারণ ১৪ দলীয় জোটের ভোটব্যাংক হিসেবে তাদের হাতেগোনা জনশক্তি আগেই নৌকার ভেতর ঢুকে পড়েছে। সাইনবোর্ড ও ব্যানারটা আছে রাজনীতি করার জন্য, বার্গেনিং করে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট কুড়ানোর জন্য। মহাজোটের সাথে তুলনামূলক বিচারে ১৮ দলীয় জোট অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। নামসর্বস্ব দল ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত আলাদা আলাদাভাবে সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। আবার সরকারের কারণেই ইসলামপন্থীরা ১৮ দলীয় জোটের পক্ষপুটে থাকছে। তার ওপর নেগেটিভ ভোটের সুফল যাবে বিরোধী দলের ঘরে।
তারপরও ক্ষমতাসীনেরা ভাবছে, এখন শুধু প্রকৃতির ষড়ঋতুর বসন্তকালই নয়, তাদেরও বসন্তকাল। এ ধরনের আত্মতুষ্টি ও সুখানুভূতি লাগার কারণ তিনটি। শাহবাগ উপসর্গ, ১৮ দলীয় জোটের রক্ষণভাগে চলে যাওয়া এবং ক্ষমতার দেয়াল।  অবশ্য ভারতীয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কেও মহাজোট সরকারের হতাশা কেটে গেছে। তারা মনে করছে নির্বাচনের আগেই ভারত কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ করে জনগণের ক্ষোভ প্রশমনে ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া বিপদ-আপদেও তারা বল-ভরসা জোগাবে। খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের পর যে এজেন্সি হাতছাড়া হওয়ার ভয় করেছিল আওয়ামী লীগ, তাও আর নেই।
শাহবাগ নিয়ে মূল্যায়ন করে কাউকে কিছু বলার নেই। যা বলার ছিল তাও গত বৃহস্পতিবারের কলামে পাঠকদের বলে দিয়েছি। প্রচারণার ধূম্রজাল ভেদ করে এক সময় সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। ব্লগারদের রাজনৈতিক স্বরূপও উন্মোচিত হবে। দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, আমাদের সেসব মন্তব্য ষোলআনা মিলে যাবে। ১৮ দলীয় জোট রক্ষণভাগে চলে যাওয়ার বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য শেষ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অবশিষ্ট থাকে ক্ষমতার দেয়াল। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে। চাটুকার পরিবেষ্টিত থেকে ক্ষমতার পুরোহিত সব কিছু ঠিকঠাক দেখতে পান না। দেয়ালের অপর পার্শ্বে কী থাকে তারা সেটাও টের পান না। তার ওপর ইয়ার-দোস্ত মিডিয়া থাকলে সত্যটা সাদা চোখে দেখতেও পান না। শক্তিমান ‘প্রভু’ থাকলে ‘আল্লাহ ভরসার’ কথাও ভুলে যান। শাসকেরা আসলেই বাস্তবতা থেকে শুধু আড়ালে নেই, যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে।
এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ কী ভাবছে, সেটাই মুখ্য বিষয়। দলনিরপেক্ষ প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ শতাংশ মানুষ নিজেদের বিপন্ন ভাবছে। সরকারের আচরণে তারা অস্বস্তিবোধ করছে। তারা আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর করার ঘটনা থেকে শুরু করে ঘড়ির কাঁটা উল্টো ঘুরিয়ে দেয়ার মতো বিষয়গুলোও ভুলে যায়নি। শেয়ারবাজার নিয়ে লাখ লাখ মানুষের মাতম চার বছরে আরো দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সরকারের নির্লিপ্তভাব সেই ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। পিলখানা ট্র্যাজেডির রেশ ও দীর্ঘশ্বাস মুছে যায়নি। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার যত চালাকি করুক, জনগণ নিজেদের মতো করে একটা উপসংহার টেনে নিয়েছে। ড. ইউনূস প্রসঙ্গসহ হলমার্ক, ডেসটিনি মিলিয়ে সরকার অনেক ‘শত্রুর’ জন্ম দিয়েছে। একমাত্র ছাত্রলীগের কারণে দেশজুড়ে যত প্রতিপক্ষ সরকার সৃষ্টি করেছে তার সংখ্যা বেসুমার। তার ওপর ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রভাবশালী কিছু বিশ্বমিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থা। তারা জনগণকে বারবার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
এটা ঠিক, সরকার উচ্ছিষ্ট ও সুবিধাভোগী একটি শ্রেণী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এ শ্রেণীটির অস্তিত্ব দলীয় অবয়বের বাইরে নেই। টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজিসহ নানা লুণ্ঠনে যারা লাভবান হয়েছে, কুইক রেন্টালসহ নানা উপায়ে যারা পুকুরচুরি করে মিডিয়ার মালিক সেজেছে, ব্যাংক গড়েছে, বাণিজ্য হাতিয়ে নিয়েছে, আরো যারা লাইসেন্স পারমিট পেয়েছে তারা শেষ চেষ্টা করেও সরকার টিকাতে ও ভবিষ্যতে উৎরাতে চেষ্টা করবে। আবার ক্ষমতায় আনার জন্য বড় ধরনের ‘ত্যাগ’ স্বীকার করতেও তারা কার্পণ্য করবে না। প্রশাসন ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যাদের ক্ষমতার শেয়ার উপভোগ করতে দিয়েছে তারাও কায়েমি স্বার্থবাদী হিসেবে মেরুকরণে সরকার পক্ষে অবস্থান নেবে। তবে এর সাথে গরিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোনো সংযোগ থাকবে না।
এ হিসাব মাথায় রেখেও মেরুবদ্ধ রাজনীতিতে বিগড়ে যাওয়া জনমতের মোকাবেলায় ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব ১৪ দলীয় জোটকে ভালো অবস্থানে যাওয়ার সূচক নির্ণয় করে দেয় না। জনগণ প্রত্যক্ষ করল কিভাবে মুসলিম বিশ্বকে এড়িয়ে গিয়ে সরকার রুশ-ভারত বান্ধবনীতি গ্রহণ করল। কিভাবে সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা’ উপড়ে ফেলা হলো, কোন প্রক্রিয়ায় আদালতের দোহাইতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণা মুছে ফেলা হলো। মৌলবাদ জঙ্গিবাদ দলনের নামে আবহমান বাংলার ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোকে নিগৃহীত করার কী ভয়াবহ চিত্রই না প্রত্যক্ষ করা গেল! এর বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি, ওআইসি ও জিএইট এড়িয়ে যাওয়ার খেসারত পুষিয়ে দিতে ভারত তিস্তা, সীমান্ত ইস্যু, টিপাইবাঁধসহ কিছু ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে ভালো অবস্থানে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দেয়ার চেষ্টা করবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে ঠেলে দেয়ার ব্যাপারেও ভারত মহাজোট সরকারকে ভরসা জোগাবে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিও জনগণ দেখতে পাচ্ছে। ঘন ঘন সফরের মাজেজাও তাই।
মহাজোট সরকার অনেকটা না বুঝেই ইসলামবিদ্বেষীদের অভিযোগ মাথায় নিয়েছে। এটা এই মাটির সাথে, এই দেশের বুনিয়াদি শিকড়ের সাথে সম্পর্কছেদের ঝুঁকি সৃষ্টি করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থী ধর্মভীরু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দলের অবস্থান থেকে সরে ইসলামের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠায় ভোটার মনে নেতিবাচক দাগ কেটেছে।
সরকার রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য যেসব ইস্যু সৃষ্টি করেছে, তার সুফল জনগণের কাছে অর্থবহ করে তুলে ধরার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ভোটার মনে আবেগের চেয়ে বাস্তবতা, তাদের বাঁচা মরার সংগ্রাম এবং বঞ্চনার বিষয়টি মুখ্য। সেখানে সরকার অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম।
তাই যাই ঘটুকু কিংবা ঘটানোর চেষ্টা করা হোক, জনগণ পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। ১৮ দলীয় জোট রক্ষণভাগ থেকে আক্রমণভাগে আসতে পারলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। একটা রাজনৈতিক ভারসাম্যেরও সৃষ্টি হবে। নয়তো কী হতে যাচ্ছে তা বলা কঠিন।  তবে আশাবাদী মানুষগুলো মনে করেন, রাজনৈতিক সমঝোতা অনিবার্য। তা না হলে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এ পরিণতি কেউ প্রত্যাশা করেন না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads