জনগণের জীবন, সম্পদ, আইন ও শৃক্মখলা সুরক্ষার দায়দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর। এই দায়িত্ব পালনে পুলিশের কর্তব্যনিষ্ঠার স্বীকৃতি বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বা সরকারি বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যে দল যে সময় শাসন ক্ষমতায় থেকেছে তারা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে এই বাহিনীকে দলীয়করণ করে: দলীয় সন্ত্রাস-গুম-হত্যায় সহযোগী বাহিনী হিসেবে কাজে লাগায়: লুটপাট ও দুর্নীতি প্রতিরোধে অকার্যকর করে রাখে। ফলে স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই এই পুলিশ বাহিনীকে স্বাধীন বাহিনীরূপে গড়ে তুলেনি ও কাজ করতে দেয়নি। এই অভিযোগের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর। একটা হিসাবে দেখা গেছে এই সরকারের সময়ে যে বিপুলসংখ্যক পুলিশ নিয়োগ পেয়েছে তার অর্ধেকই গোপালগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের। এইসব পুলিশই আইন-শৃক্মখলা ভঙ্গ করে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য হাসিল করছে।
বর্তমান সরকারের চার বছরে পুলিশ বাহিনী যা যা করেছে মোটা দাগে তার একটা সূচি করা যায় অনায়াসে। ক. জনগণের, বিশেষভাবে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত করা; খ. সরাসরি বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম ও নির্যাতনে সক্রিয় ভূমিকা পালন; গ. ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র বাহিনীকে সন্ত্রাস ও যে কোন মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা; ঘ. চোখের সামনে সংঘটিত আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর অপরাধমূলক কাজে দর্শকের মতো আচরণ: ঙ. নিরপরাধ জনগণকে নির্বিচারে আটক, মিথ্যা মামলা দায়ের, রিমান্ডের নামে বর্বর নির্যাতন এবং জেলখানা থেকে বের হওয়ার পর আবার শ্যোন অ্যারেস্ট; চ. জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে মিছিল-মিটিং করতে না দেয়া এবং বেধড়ক-নির্মম লাঠিপেটা, টিয়ার সেল, জলকামান ও পিপার স্প্রে নিক্ষেপ; ছ. সরকারি দলের হরতালে সহযোগিতা ও বিরোধী দলের হরতালে রাস্তায় নামতে বাধা, শান্তিপূর্ণ মিছিলে লাঠিপেটা এবং দলীয় অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা; জ. গ্রেফতার বাণিজ্য, রিমান্ড ব্যবসা ও হুমকির বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ; ঝ. সরকারের গোলামী করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় অমনোযোগ; ফলে চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধ বৃদ্ধি; ঞ. নিজস্ব আইন, বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী জনগণকে সেবার পরিবর্তে দলীয় অঙ্গ-সংগঠনের ভূমিকা পালন। এক কথায়, পুলিশ দেশের সংবিধান, আইন-শৃক্মখলা ভঙ্গ করে অর্পিত দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যে ও রাজনৈতিক স্বার্থে জনগণের প্রতি হিংসাত্মক আচরণে অবতীর্ণ হয়েছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে এইসব মারাত্মক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পর্কে জনগণ সম্পূর্ণভাবে সচেতন। কিন্তু সাধারণ জনগণ অসংগঠিত ও নেতৃত্বহীন। এখন কথা উঠতে পারে, পুলিশ তো হুকুমের দাস, সরকার যা বলবে সে তাই করবে। এক্ষেত্রে পুলিশের কিছু করার নাই। এসব কোন যুক্তির কথা নয়। কারণ সে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে নয়। অর্পিত দায়িত্বের বদলে সে দলীয় দায়িত্ব পালন করছে অন্ধ আনুগত্য। জনগণের জানমালের সুরক্ষার বদলে রাজনৈতিক বাহিনীর কাজ করছে। বদলি বা বরখাস্তের ভয় ও পদোন্নতির লোভে সে নিমজ্জিত। পুলিশ আইনের বাইরে গিয়ে আপন আগ্রহে ও স্বার্থে জঘন্য সব অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এইসব অপরাধের কারণে একদিকে মানবাধিকার ও আইনের শাসন লঙ্ঘিত হচ্ছে; অন্যদিকে সরকার তাদেরকে নানাভাবে পুরস্কার দিচ্ছে। পুরস্কারের আশায় সরকারের অন্যায় কাজে সহযোগিতা এবং হিংসাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে পুলিশ। অর্থাৎ লোভ, নীতিহীনতা, হিংসা ও ভয় এখন পুলিশ বাহিনী পরিচালনায় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
পুলিশ হিংসাত্মক কাজের হাজার হাজার নজির সৃষ্টি করেছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে সাদা পোশাকের পুলিশ বাহিনী আটক ও গুম করে। বিএনপির উপদেষ্টা হান্নান শাহকে অন্যায়ভাবে আটক করার পর একের পর এক মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ এবং জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও বারবার শ্যেন অ্যারেস্ট করা হয়েছে। মাওলানা সাঈদীকে একইভাবে একটি মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করার পর তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার করা হচ্ছে। সম্প্রতি মির্জা ফখরুল ইসলামকে গাড়ি পোড়ানোর মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে এবং জামিন পাওয়ার পরও বারবার শ্যেন অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। মানে মিথ্যা মামলা দায়ের, অবৈধভাবে আটক এবং বারবার শ্যেন অ্যারেস্ট করে পুলিশ বাহিনী কলঙ্কজনক এক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। শুধুমাত্র রাজশাহী মহানগরে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছরে সাতজন ছাত্র-জনতা প্রাণ হারিয়েছে। তার মধ্যে পুলিশই ছাত্রশিবিরের দুইজন নেতাকে সরাসরি প্রকাশ্যে গুলী করে হত্যা করে। রাবিতে পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বনেদ্ব খুন হয়েছে দুইজন ছাত্র। অন্যরা পুলিশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় খুন হয়েছে নির্মমভাবে। পুলিশ যথাযথভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করলে এইসব মূল্যবান প্রাণ অকালে মারা যেতো না। এই হলো একটিমাত্র জেলার অপরাধে পুলিশের দায়িত্বহীন ও রাজনৈতিক ভূমিকা।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে পুলিশ প্রতিহিংসার শিকার হয়ে হামলায় আহত হচ্ছে। বলা হচ্ছে বেশিরভাগই ছাত্রশিবিরের কর্মীদের হাতে পুলিশ মার খাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, এসব তাদের ‘প্রতিহিংসা'র বহিঃপ্রকাশ। মিডিয়াতে এই প্রতিহিংসা প্রচার হচ্ছে ফলাও করে, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আবার অধিকাংশ মিডিয়া যেহেতু বর্তমান সরকারপন্থী, সেহেতু পুলিশের মার খাওয়ার দৃশ্য শুধু প্রচার হচ্ছে; তার আগে বা পরে শান্তিপূর্ণ মিছিল বা সমাবেশে পুলিশের অতর্কিত হামলা, লাঠিপেটা ও নির্মম প্রহার ক্যামেরায় ধারণ করা হলেও প্রচার করা হচ্ছে না। অন্যদিকে আড়ালেই থেকে গেছে গত চার বছরে বিরোধী দল, বিশেষভাবে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদেরকে পুলিশের হত্যা, গুম, নির্যাতন ও অসংখ্য মিথ্যা মামলায় জড়ানোর করুণ কাহিনী।
বর্তমান সরকারের চার বছরে পুলিশের ভূমিকা পুলিশ ও নাগরিক সবাইকে ভাবা দরকার। পুলিশের প্রতি জনগণের ও বিরোধীদলের নেই কোন আস্থা ও বিশ্বাস। তাদের কাছে পুলিশ মানেই হিংস্রতা ও হিংসার প্রতিমূর্তি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই হিংসা ও প্রতিহিংসার উপাদান ভয়ঙ্কর হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সরকারের যদি সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার ইচ্ছা থাকে, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার আশা থাকে, ভবিষ্যতে নিজেদের রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থাকে; তাহলে পুলিশকে হিংসাত্মক কাজে লেলিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে; আবার পুলিশকেও নিজের ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠা এবং দেশের আইন-শৃক্মখলা রক্ষার জন্য এই হিংসাত্মক পথ থেকে সরে এসে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। পুলিশ কারো বন্ধু বা শত্রু নয়, কারো গোলামও নয়। জনগণের অর্থে পরিচালিত এই বাহিনীকে জনগণের রক্ষক, সেবক ও বন্ধু হয়ে কাজ করতে হবে। পুলিশকে নিজস্ব আইনের পথেই চলতে হবে। কারণ পুলিশের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। তাই পুলিশের প্রতি অনুরোধ: হিংসার রাস্তায় না চলে আইনের
পথে হাঁটুন আর প্রতিহিংসার শিকার থেকে বাঁচুন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন