একজন তরুণের বীভৎস মৃতদেহ। শরীরে গুলীর চিহ্ন, দু'চোখ উপড়ানো। ছবিটি দেখলে তাকানো যায় না। শরীর শিহরে ওঠে। এমনই বীভৎস ছবি এখন আমাদের দেখতে হচ্ছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারির দুটি জাতীয় দৈনিকে এ ছবি ছাপা হয়েছে। ৬ এবং ৭ ফেব্রুয়ারির বেশ কয়েকটি দৈনিকে আরো কিছু ছবি ছাপা হয়েছে যা দেখার এবং সহ্য করার মতো নয়। চট্টগ্রামে এক যুবককে গ্রেফতার করার পর তার শরীরে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলী করছেন বন্দর থানার ওসি প্রদীপ কুমার, নারায়ণগঞ্জে এক যুবককে গ্রেফতার করার পর তাকে পা দিয়ে চেপে ধরে শরীরে গুলী করছেন জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা। ঐ দু'দিনের জাতীয় দৈনিকসমূহে এমন আরো বহু ছাপা হয়েছে, ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে গুলীবিদ্ধ হয় পাঁচ শতাধিক ছাত্র-যুবক। ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে কয়েকটি দৃশ্য বার বার দেখানো হয়েছে, একটি দৃশ্য হচ্ছে রামপুরার, সেখানে পুলিশ দু'জন যুবককে গ্রেফতার করার পর টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই বেধড়ক পেটাচ্ছে। একই দৃশ্য দেখা গেছে মিরপুর, শনির আখড়া এবং হাজারীবাগে। পুলিশ যাদের শরীরে গুলী করেছে তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। যখন তাদের গায়ে গুলী করা হচ্ছে তখন তারা ছিল পুলিশের হাতে বন্দী। একজন লোককে গ্রেফতার করার পর অথবা গ্রেফতার করার পূর্বেও সেই ব্যক্তি যদি নিরস্ত্র হয় পুলিশ কিভাবে তার ওপর গুলী করতে পারে? শুধু গুলী করেই শেষ হয়নি। গ্রেফতার করে ধরে নিয়ে যাবার পর গুলী করে শুধু হত্যাই করেনি তার চোখ দুটি পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছে। ইতিপূর্বে একই ঘটনা ঘটেছে বগুড়ায়, বগুড়ায় জামায়াতে ইসলামীর ডাকে হরতাল চলাকালে ছাত্রলীগ যুবলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন শিবির কর্মীকে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে জনতা মিছিল করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলী করে আরো দুজন যুবককে হত্যা করে, গুলীবিদ্ধ হয় প্রায় ৫০ জন। ঐ দিন ইন্টারনেটে আরো একটি ছবি দেখলাম যে, মসজিদে ফজরের নামাজ চলছে আর নামাজ চলাকালীন সময়েই কয়েকজন পুলিশ সদস্য বেশ কয়েকজন নামাজীকে ধরে টানা-হেঁচড়া করছে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার জন্য। ছবির নিচে ক্যাপশন দেয়া হয়েছে ‘নামাজ পড়তে বড়জোর ৫ মিনিট সময় লাগে কিন্তু এতটুকু সময় সহ্য হচ্ছে না আওয়ামী পুলিশ বাহিনীর'। এ যেন যুদ্ধ চলাকালীন কোন হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, এ যেন ফিলিস্তিনের অসহায় জনগণের ওপর ইসরাইলী নরপশুদের নির্মমতা, এ যেন রোহিঙ্গাদের ওপর বর্মী সামরিক জান্তার নির্মম নির্যাতন, এ যেন কাশ্মীরের অসহায় জনতার প্রতি ভারতীয় বাহিনীর নিষ্ঠুরতা, এ যেন বসনিয়ার সাধারণ নাগরিকদের উপর সার্বদের পৈশাচিকতা। না যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, বার্মা কিংবা বসনিয়ায় ঘটেনি তা ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। যে দেশের ৯০% লোক মুসলমান। যে দেশে স্বাধীনতার জন্য বহু রক্ত ঝরেছে। যে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে যদিও আজ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক অধিকার পুরোমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি কিংবা গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। চট্টগ্রামে চোখ উপড়ে এবং গুলী করে যে তরুণকে হত্যা করা হয়েছে তার নাম আবিদ। ঐ দিন আমার দেশ পত্রিকায় যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি ‘‘গুলীবিদ্ধ ও চোখ উৎপাটন করা লাশ মিললো চট্টগ্রামের ইসলামী ছাত্রশিবির নেতা আবিদ বিন ইসলামের। পরিবারের অভিযোগ পুলিশ হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম সিটি কলেজের এইচএসসি পড়ুয়া মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে। তার দুটি চোখই তুলে নেয়া হয়। শরীরে ছিল দুটি গুলীর চিহ্ন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নগরীর দেওয়ানহাট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে হরতাল সমর্থক জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের তিন নেতাকর্মী মারা যায়। সন্ধ্যা নাগাদ শফিক ও আফজালের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। মধ্যরাতে উদ্ধার হয় আবিদ বিন ইসলামের লাশ। সংঘর্ষস্থলের অদূরে মিস্ত্রিপাড়া এলাকা থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। আবিদের মৃত্যুর পর পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তার বাবা এডভোকেট মনিরুল ইসলাম ও মা স্কুল শিক্ষিকা নার্গিস ছেলেকে হারিয়ে এখন অনেকটাই নির্বাক। পারিবারিক সূত্র জানায়, আবিদ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী পর্যায়ের নেতা ছিল। তার এবার চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা। তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সনদ্বীপ উপজেলায়। বাবা-মার সঙ্গে আবিদ থাকতেন নগরীর হালিশহরে। তার বাবা এডভোকেট মনিরুল ইসলাম গতকাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমার দেশকে বলেন, ঘটনার সময় অনেক মানুষ দেখেছে আমার ছেলেকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে পুলিশ দেওয়ানহাট মোড় থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যে ছেলে পুলিশের হাতে ছিল সে লাশ হয়ে হাসপাতালে গেল কীভাবে? এডভোকেট মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, পুলিশ আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে দিয়ে উদ্ধারের নাটক সাজিয়েছে। এর বিচার আমি কার কাছে চাইবো। আবিদের পরিবারের সদস্যরা জানান, হত্যার আগে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে। তার দু'টি চোখই তুলে নেয়া হয়েছে। এছাড়া দু'টি গুলীর চিহ্ন রয়েছে তার বুকে। গুলীর আগে বা পরে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। একটি ক্ষত-বিক্ষত দেহ তারা পেয়েছেন হাসপাতাল থেকে।’’
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খুন, ধর্ষণ যে হারে বেড়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ জনগণের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। এমন কোন অপরাধ নেই যা ছাত্রলীগ করে না। এত হত্যা, ধর্ষণ এবং অপকর্মের পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রলীগকে হুকুম দিয়েছেন শিবির নিধনের জন্য। ঢাকার পুলিশ কমিশনার পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন শিবির দেখামাত্র গুলী করার জন্য। যেখানেই জামায়াতের অথবা শিবিরের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় সেখানেই পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায় আর বর্তমানে তার সাথে সঙ্গী হয়েছে ছাত্রলীগ। পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তারা আজ রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কোথাও ছাত্রলীগ বিরোধী দলের কর্মসূচিতে হামলা করছে সেখানে সহযোগীর ভূমিকায় পুলিশ আবার কোথাও পুলিশের সহযোগী যুবলীগ ছাত্রলীগ। গত এক সপ্তাহে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের যৌথ হামলায় শিবির ও জামায়াতের আটজন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন, গুলীবিদ্ধ হয়েছেন তিন শাতধিক, আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার একটি কলামে লিখেছেন- ‘‘একটা জিনিস বড় বেদনার লাগছে, এই ক'দিনে যারা পুলিশের গুলীতে নিহত হয়েছে তারা একজনও পাকিস্তান হানাদারদের দোসর নয়, দালাল-আলবদর-রাজাকার নয়। তাদের স্বাধীন দেশে জন্ম তারা স্বাধীনতার সন্তান। তারা কোনো আন্দোলন করছে বলেই পাখির মতো গুলী করে মারা হবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। তারা আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করলে গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। রাস্তাঘাটে গুলী করে মারা হবে কেন? সে হোক না জামায়াত কর্মী, ছাত্রশিবির, তাতে কী এসে যায়। তার দাবিদাওয়া অন্যায্য হলে তার কর্মকান্ড আইনবিরোধী হলে আইনানুগ শাস্তিভোগ করবে। এমনকি অপরাধ প্রমাণ করে তাকে ফাঁসিতে ঝুলালেও কারো কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু আইনের বাইরে কাউকে হত্যা করা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’’
জনগণের প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কি হত্যা এবং জিঘাংসার ঘটনা ঘটতেই থাকবে? মূলত যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখনই এ ধরনের হত্যা সন্ত্রাস বেড়ে যায়। '৭২-৭৫ সালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। শুধুমাত্র তৎকালীন বিরোধী দল জাসদের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কর্মী খুন হয়েছে চল্লিশ হাজার। যদিও সেই জাসদের একটি অংশ বর্তমানে আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার অংশীদার। বুর্জোয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ঠেলে দিয়ে অসংখ্য যুবকের জীবনের হানি ঘটিয়ে হাসানুল হক ইনু অবশ্য এখন ক্ষমতার হালুয়া রুটি পাওয়ার পর তথাকথিত গণতন্ত্রের কথা বলেন। অবশ্য ইনু সাহেবদের অথবা আওয়ামী লীগারদের গণতন্ত্র শুধুমাত্র তাদের জন্য। ভাবখানা এমন এই দেশে আমরাই বসবাস করবো, আমরাই রাজনীতি করবো, আমরাই কথা বলবো, আমরাই মিটিং-মিছিল সমাবেশে করবো। যে সকল মিডিয়া তাদের বিরুদ্ধে লিখবে তারা পত্রিকা প্রকাশ করতে পারবে না, টেলিভিশন চ্যানেল পরিচালনা করতে পারবে না। এই লেখা যখন লিখছি তার আগের দিন অর্থাৎ ৮ ফেব্রুয়ারি সরকার এবং বামদের ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠিত শাহবাগের সমাবেশে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, দিগন্ত টেলিভিশন, সোনার বাংলা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে। জামায়াতের সাথে সম্পর্কিত সকল ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিলের অবৈধ ও অসাংবিধানিক দাবি জানানো হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের সেক্রেটারির নেতৃত্বে আমার দেশ এবং নয়াদিগন্ত পত্রিকা পোড়ানো হয়েছে। সোজা সাপ্টা কথা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদেরই শুধু রাজনীতি করার এবং বাঁচার অধিকার থাকবে আর কেউ এ দেশে রাজনীতি করতে পারবে না, বাঁচতে পারবে না, বসবাস করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের এই ফ্যাসিবাদী আচরণ থেকে মুক্তির জন্য যে গণজাগরণ সৃষ্টি হওয়া দরকার সেই ধরনের গণজাগরণ সৃষ্টি করতে বর্তমান বিরোধী দল ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ আজ হতাশ, তারা দিধাগ্রস্ত, আতঙ্কিত, তাদের বোবা কান্না শোনার যেন কেউ নেই। সরকারের ছত্রছায়ার এই যে, হত্যা খুনের মহড়া চলছে, লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, অসহায় মানুষের আর্তনাদ আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলছে। প্রতিটি দুয়ারে আজ হিংস্র শাপদের পদচারণা, পথে প্রান্তরে মানুষরূপী হায়েনার হিংস্র ছোবল কারো জীবন কেড়ে নিচ্ছে, কাউকে গুম করা হচ্ছে, কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করছে, কেউবা আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। আজ সময়ের দাবি এক তীব্র গণআন্দোলনের, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক নিরন্তর সংগ্রামের।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন