বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শাহবাগের সাম্প্রতিক আন্দোলন এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ১৯৯৩ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পর্যন্ত এ দেশে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এমন অবাক করা আন্দোলন এ দেশের মানুষ আর কখনো দেখেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সব আন্দোলন হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের দাবি আদায়ের জন্য। কিন্তু শাহবাগে আন্দোলন চলছে সরকারের সমর্থনে। আন্দোলনকারীদের পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে, খাওয়ার জন্য তিন বেলা বিরিয়ানি ও পানি সরবরাহ করা হয়েছে, নগদ অর্থ পেয়েছেন কেউ কেউ। কান্তি দূর করতে নাচগান আর চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থাও ছিল। কমপক্ষে ১০টি টেলিভিশন চ্যানেল লাইভ প্রচার করেছে আন্দোলনের দৃশ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র সেই আন্দোলনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে টেলিভিশনে হাজির হয়েছেন। বহু ত্রিকালদর্শী রাজনীতিকেরও এমন মিডিয়া-ভাগ্য হয়নি। অনেকে আবার এই আন্দোলনকে মিসরের তাহরির স্কোয়ারের সাথে তুলনা করেছেন। আরব বসন্তের মতো শাহবাগে নাকি বাংলা বসন্ত শুরু হয়ে গেছে। তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের শুরুতে হোসনি মোবারকের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ৩০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের জন্য মোবারক সমর্থক ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে খাবার সরবরাহ তো দূরে থাক, কায়রোর নগর কর্তৃপক্ষ তাহরির স্কয়ারের বর্জ্য অপসারণ পর্যন্ত করেনি। আর শাহবাগে সিটি করপোরেশন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ টয়লেটেরও ব্যবস্থা করেছে। এই আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো হোসনি মোবারক বলেননিÑ তার মন পড়ে আছে তাহরির স্কয়ারে। বরং তার গোয়েন্দা প্রধান ওমর সুলাইমান সারা দিন মোবারকের সাথে বৈঠকে ব্যস্ত থাকতেন এই আন্দোলন ভণ্ডুল ও দমনে নিত্যনতুন কৌশল বের করতে। তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন সমাপ্ত হয়েছে মোবারকের পতনের মধ্য দিয়ে। আর শাহবাগের আন্দোলনকারীরা সরে গেছে নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও দিগন্ত টেলিভিশন বর্জন আর মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের দাবির মধ্য দিয়ে।
জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি নিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নামে কিছু তরুণ শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়েছিলেন। আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে সরকার। বিচারক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেছে সরকার গঠিত প্রসিকিউশন। এখন সরকার সমর্থক তরুণেরা সেই রায় মানতে রাজি নন। তাদের দাবি একটাইÑ ফাঁসি দিতে হবে। বিচার নয়, ফাঁসি চাই। অন্য কোনো রায় তারা মানবেন না। অবশেষে তাদের দাবি মেনে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করা হয়েছে। সরকার এখন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। উচ্চ আদালতে কাদের মোল্লার ফাঁসি হবে, না আগের রায় বহাল থাকবে, নাকি তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্ত হবেনÑ তা দেখতে আমাদের আরো কিছু দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ধৈর্য ধরতে রাজি নন ফাঁসির দাবিদার আন্দোলনকারীরা।
তারা এখন নতুন আসামি হাজির করেছেন। এই আসামি হচ্ছে তাদের অপছন্দের কিছু গণমাধ্যম। আন্দোলনের তৃতীয় দিনে শাহবাগে নয়া দিগন্ত, দিগন্ত টেলিভিশন, আমার দেশ, সংগ্রাম বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানানো হয়। সেখানে এই পত্রিকাগুলোর কপি পোড়ানো হয়। এরপর যে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয় তার ফল হিসেবে ১২ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্ত অফিসে আগুন দেয় সরকার সমর্থকরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ বিতরণে বাধা সৃষ্টি করা হয়। শাহবাগে শিক্ষিত এই তরুণেরা যখন গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধের চেষ্টা করছেন তখন স্বল্প শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত পত্রিকার বিক্রেতা ও হকারেরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। নওগাঁ, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আমার দেশ ও নয়া দিগন্ত বিক্রিতে বাধা দেয়ায় তারা সব পত্রিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন। ফলে সরকার সমর্থকেরা বাধ্য হয়েছেন এই দু’টি পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করার নীতি থেকে সরে আসতে। ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যখন পত্রিকার হকারেরা বাকস্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাহসী ভূমিকা নিতে পেরেছেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া এই তরুণেরা বাকস্বাধীনতা হরণের আওয়াজ তুলেছেন। তারা ভিন্নমতাবলম্বী সংবাদপত্র বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলেন; কিন্তু এ দেশের মানুষ তাদের সে ডাকে সাড়া দেয়নি। পত্রিকার পাঠক ও হকারদের আন্তরিকতায় দু’টি পত্রিকার সার্কুলেশন হু হু করে বেড়েছে। পাঠকেরা নিশ্চয়ই জানেন, ১৬ পৃষ্ঠার নয়া দিগন্ত ১০ টাকা এবং ১৬ পৃষ্ঠার আমার দেশ ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে থাকা অন্য সব পত্রিকার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে হৃদয়ের টানে, সত্য জানার জন্য পাঠকেরা পত্রিকা দু’টি কিনছেন।
আমরা দেখছি, শাহবাগ আন্দোলনকারীদের খবর প্রচারের জন্য কমপক্ষে ১০টি টেলিভিশন চ্যানেল ও সব সংবাদপত্র একযোগে প্রচারণা চালিয়েছে। এখনো সাংবাদিকতার সব ধরনের নীতি লঙ্ঘন করে তাদের প্রবল সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরও এই আন্দোলনকারীরা দু’টি পত্রিকা ও একটি টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থিতি মেনে নিতে রাজি নন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগের এই আন্দোলনের নাম দেয়া হয়েছিল গণজাগরণ। আন্দোলনকারীদের নেতারা এই দু’টি পত্রিকার বিরুদ্ধে যেভাবে আক্রোশে ফেটে পড়েছেন তাতে মনে হয়েছে গণজাগরণের ঢাক যেন ফুটো হয়ে গিয়েছিল দু’টি পত্রিকার খবরে। প্রকৃত অর্থে এই আন্দোলনের রূপ জনগণের সামনে ফুটে ওঠে ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর। থাবা বাবা নামের এই ব্লগারের খুনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে আসে কথিত এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নানা ধরনের কীর্তি-কাহিনী। তিনি খুন হওয়ার একদিন পর সরকার সমর্থক একটি পত্রিকা রাজীব ওরফে থাবা বাবার ইসলামবিরোধী ও মহানবী সা:কে নিয়ে অবমাননাকর লেখা প্রকাশ করে। সরকার সমর্থক পত্রিকাটি খবর প্রকাশের পর আমার দেশ পরের দিন তা প্রকাশ করে।
এরপর সারা দেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম ও মহানবী সা:কে অবমাননার প্রতিবাদে প্রকৃত অর্থে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে শাহবাগী গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেয়া হয়। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিুব্ধ মানুষের আন্দোলন দমনে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। শাহবাগের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯ দিনে ২৩ জন লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে, আল্ট্রা-সেকুলার মিডিয়ার সমর্থনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বিশেষ একটি চক্র রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। একধরনের প্যারালাল সরকার গঠন করছে। তাদের নির্দেশে সরকারকে রাষ্ট্রের আইন বদলাতে হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় নির্দেশ করে দেয়া হয়েছে। তাদের নির্দেশে নির্ধারিত সময়ে জাতীয়সঙ্গীত গাইতে হয়েছে। এমনকি কোমলমতি শিশুদের মাথায় ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই ব্যান্ড বেঁধে শাহবাগে হাজির করতে বাধ্য করা হয়েছে।
এখন তারা নতুন এক দাবি নিয়ে এসেছেন, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে হবে। ফাঁসির দাবি থেকে এখন একজন সম্পাদককে গ্রেফতারের দাবি শাহবাগের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে গত সোমবার বিকেল ৩টার মধ্যে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের আলটিমেটাম দেয়া হয়েছিল। সরকারের মধ্যে হয়তো শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শাহবাগীদের দাবি অনুযায়ী তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, গণমাধ্যমের একটি অংশ এখন মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদগারে মেতে উঠেছে। মাহমুদুর রহমান কেন থাবা বাবার কীর্তি প্রচার করলেন, এটাই তার অপরাধ। কিন্তু থাবা বাবাসহ অন্য যেসব ব্লগার ইসলাম ও মহানবী সা:-এর অবমাননা করেছেন, তাদের গ্রেফতারের দাবি করা হচ্ছে না। অথচ এসব ব্লগারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি যে দৈনিকটি প্রথম এসব বিবরণ প্রকাশ করেছিল সেই দৈনিকটির নাম তারা আর উচ্চারণ করেন না। আজকে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে যেসব সাংবাদিক বিষোদগার করছেন, তারা ডেসটিনির মতো প্রতারক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরি করেছেন। অনেকে হাওয়া ভবনে দৌড়ঝাঁপ করে তারেক জিয়ার মন জয় করে নানা ধরনের সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেছেন।
নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এদের ক্ষোভের কারণ বোঝা খুব কঠিন নয়। আদর্শবিচ্যুত বাম চিন্তাধারার এই মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা শাহবাগের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। অনুল্লেখযোগ্য একটি সমাবেশকে প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে পেরেছিলেন। এর মাধ্যমে সরকারকে দিয়ে উগ্রধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত ব্লগারচক্র একটি নতুন প্লাটফর্ম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেখান থেকে সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু আমার দেশ ও নয়া দিগন্তের রিপোর্টিংয়ে সাধারণ মানুষের এই বিভ্রান্তির অবসান ঘটে। অবস্থা এতটাই বেগতিক হয়ে দাঁড়ায় যে ধর্মকে আলাদা করার এই আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সমাবেশ শুরু করতে হয় কুরআনসহ অন্য ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে। এখন আন্দোলনকারীরা বলছেন, কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য তারা আন্দোলন করছেন না। তাদের আন্দোলন শুধু জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে। অথচ মহানবী সা:কে অবমাননার প্রতিবাদে বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ২৪ ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দিয়েছিল। সেই হরতাল প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল শাহবাগ থেকে। হরতালবিরোধী মিছিলও করেছে শাহবাগী আন্দোলনকারীরা। বিরোধী দলের ডাকা হরতাল ঠেকাতে আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিল আর এই মিছিলের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না।
সরকার শুরু থেকে এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করেছে। শাহবাগের প্রচারণায় পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি এমনকি বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু আড়াল হয়ে যায়। সাময়িক এই লাভের জন্য সরকারকে এখন চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। পতিত বাম ও ধর্মবিদ্বেষী এই ব্লগার চক্রকে আশকারা দিতে গিয়ে সরকার এখন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পুলিশ এখন মহানবী সা:-এর অবমাননায় প্রতিবাদমুখর সাধারণ মানুষকে পাখির মতো হত্যা করছে। কথিত গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদের অন্তঃসারশূন্য আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আর এর ফল হিসেবে দেশে ধর্মবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন