শাহবাগের নর্তন-কুর্দনের অন্তরালে
দেশের রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ বা গবেষণা করার যেমন আমার যোগ্যতার অভাব রয়েছে তেমনি রয়েছে আগ্রহের ঘাটতি। কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে দেশের বর্তমান রাজনীতির অঙ্গনের বেহাল দেখে মনটা বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছে। ভাবনায় পড়েছি তা হলে কি বাংলার মুসলমানরা এখনও রাহু গ্রাস মুক্ত নই? এতোদিন জামায়াত-শিবির নিয়ে শোরগোলে বেশি মাথা ঘামাইনি। ভেবেছিলাম, এটি একটি রাজনৈতিক কোন্দল। কিন্তু শাহবাগ চত্বর ঘিরে যুবক-যুবতীদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের চিৎকার, তাদের সাথে কতিপয় ইসলামবিরোধীর সম্পৃক্ততা ও দেশের সমস্ত মসজিদের মুসুল্লিদেরকে জামায়াত-শিবির কর্মী হিসাবে লাঠিপেটা ও গুলী চালিয়ে নির্মম হত্যা নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
প্রথম চিন্তা ‘নতুন প্রজন্ম' নিয়ে। নতুন প্রজন্ম বলতে কাদেরকে বুঝায়? যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে জন্মগ্রহণকারী সন্তানদেরকে বুঝায় তাহলে দেশের আপামর সন্তানদেরকে বাদ দিয়ে শাহবাগে জমায়েত একটি বিশেষ চিন্তা-চেতনা লালনকারী গুটিকতক কিশোর-কিশোরীকে ‘নব প্রজন্ম' পরচয় করিয়ে দিয়ে জাতিকে ধোঁকায় ফেলার চক্রান্ত কেন? বর্তমান প্রজন্মের এক বিরাট জনশক্তি ‘ছাত্র শিবির' নব প্রজন্মেরই সন্তান। তারা কী চায়, কী বলে তা কেন উপেক্ষা করে তাদের উপর গুলী চালান হয়, পাখির মতো নির্বিচারে তাদেরকে রাস্তায় লুটিয়ে দেয়া হয়। অপরদিকে নব প্রজন্মের দোহাই দিয়ে এক গোষ্ঠীকে নির্মূল আর এক বিশেষ গোষ্ঠীকে ফুল দিয়ে বরণ করার প্রচেষ্টা জাতির জন্য অমঙ্গলই বয়ে আনবে।
বাংলা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক গতি ধারার অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের চক্রান্তের পেছনে রয়েছে এদেশ থেকে মুসলমানদের বিদায় করণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অবস্থান পাকাপোক্তকরণ। ভেবেছিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এ দেশের মানুষ নিজস্ব চিন্তা আকিদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। কিন্তু এ ধারণা দিন দিন বদলে যাচ্ছে।
ভারতে মুসলিম বিজয়ের পর থেকে ইসলাম বিরোধী বৈরী শক্তি তাদেরকে পরাভূত ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। গোড়া থেকে যেভাবে বিভিন্ন পথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেগেছিল আজও তারা তেমনি আছে।
এ জন্য তারা প্রাথমিকভাবে বেছে নিয়েছে তথাকথিত নব প্রজন্মকে। তিনটি রাজনৈতিক উপায় গ্রহণ কররার ফলে নব প্রজন্মকে বিপথে পরিচালনা করা তাদের জন্য সহজতর হয়েছে।
সেগুলো হলো :
১. ইসলাম সম্পর্কে তাদেরকে অজ্ঞ রাখা
২. মুসলমান জাতি ও পাক ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদেরকে অন্ধকারে রাখা এবং
৩. আলেম সমাজের মধ্যে অনৈক্য বিরাজমান রাখা
১. পৃথিবীর অন্যান্য বিজয়ী জাতিসমূহ যেমন বিজিত জাতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তেমনি এদেশের এক শ্রেণীর মুসলমানও পাকিস্তান বিরোধী হিন্দু জাতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আচার-আচরণ, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী এমন কি বিশ্বাসের দিক দিয়ে যে হিন্দু জাতির প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি তার উজ্জ্বল প্রমাণ নব প্রজন্মের বিভিন্ন কর্ম তৎপরতা। তথাকথিত নব প্রজন্মের মনে ইসলামবিরোধী ভাবধারা অনুপ্রবেশের প্রধানতম কারণ হলো, এ প্রজন্মকে ইসলাম সম্পর্কে না বুঝতে দেয়া। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও সে সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোন সরকারই যুব সমাজকে ইসলামী প্রশিক্ষণ প্রদান ও চিন্তাধারার পরিশুদ্ধিকরণের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে ইসলামের সত্যতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভের সুযোগ তাদের হয়নি। আমরা দেখেছি বিংশতি শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত মুসলিম সমাজের একটি অংশকে গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার বিষক্রিয়ায় জর্জরিত করে রেখোছিল। তাই ১৯১১ সালের ঈসায়ী সালের আদম শুমারিতে দেখা যায় কিছু লোক নিজেরা স্বীকারোক্তি করেছে যে, তারা হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়। একই ভাবে এত বছর পরেও নবপ্রজন্মের কতিপয় সন্তান নিজেদেরকে হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয় বলে ঘোষণা দিতে গৌরব বোধ করছে। হিন্দু পরিবেশে লালিত-পালিত হওয়ার কারণে শাহজাহান পুত্র দারা শিকোহ হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন। আর বর্তমানকালে নব প্রজন্মের সন্তানেরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এক চরম অশুভ শক্তি মুসলমানদের তৌহিদী আকীদাহ বিশ্বাস ও ইসলামী তমুদ্দুন ধ্বংসের জন্য এক শ্রেণীর মুসলমানদের প্রতিভাকে ব্যবহার করেছে যেমনটি করেছিল তাদের পূর্বপুরুষেরা। ব্যবহার করেছিল আকবরের প্রাতিভাকে।
২.-নব প্রজন্মকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে বা মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত কারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে তুলতে ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠী যে মারাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে তা হলো তাদেরকে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস জানতে না দেয়া এবং সাথে সাথে মু&&ক্ত যুদ্ধ সম্পর্কে অসত্য তথ্য ও ইতিহাস শিক্ষা দেয়া। তারা এ কৌশল গ্রহণ করেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের পরে যে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সব সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ইচ্ছা করেই অসত্য ও বিকৃত তত্ত্ব সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ফলে এসব কম বয়সী ছেলেমেয়েরা আবেগতাড়িত হয়ে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে মাঠে নেমে পড়েছে। সে সময়ের প্রকৃত ইতিহাস অনেকেই সাহস করে রচনা না করার ফলে এবং তাদের সামনে বিকৃত ইতিহাস পেশ হওয়ার কারণে তাদেরকে ভুল পথে পরিচালনা করা খুব সহজ হয়ে পড়েছে। সঠিক ইতিহাস পেশ করার অযোগ্যতা নব প্রজন্মকে উদ্বেলিত করার জন্য প্রধান ভাবে দায়ী বলে আমার মনে হয়।
কিন্তু বর্তমান সরকারতো নব প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস পেশ করছেই না বরং অসত্য বানোয়াট তথ্য পেশ করে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে, ইসলামপন্থীদেরকে নির্মূল করার জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ ইসলামপন্থীরাই একটি বিরাট শক্তির অন্যায় স্বার্থ রক্ষার বিরোধী শক্তি। সুতরাং তাদেরকে তো দমাতে হবেই।
৩- আলেম সমাজের অনৈক্য ইসলাম বিরোধীদের একটি ধারালো হাতিয়ার। অতীতে যেমন মুহম্মদ বিন আবদুল ওয়াহ্হাবের কার্যকলাপকে ইসলাম বিরোধী এবং মতবাদকে ইসলাম থেকে পৃথক মতবাদ রূপে গণ্য করে ওহাবী মতবাদ রূপে প্রচার করা হলো তেমনি ইসলামী আন্দোলনের সঠিক ধারাকে মওদূদী মতবাদ রূপে আখ্যায়িত করে কিছু আলেমকে এর প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করাতে সক্ষম হলো। এই সুযোগ গ্রহণ করে এতদিন তারা সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে মুখ খুলেনি। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে দেখছে ইসলামী জনতার নাড়ির গতি। তারা দেখেছে যে কিছু ধর্মীয় নেতা জামায়াত-শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করলেও কিছু বলছে না। ইসলামী চেতনায় বিভেদ সৃষ্টি করতে পেরে তারা তাদের চক্রান্তে সফল হয়ে এখন গোটা আলেম সমাজের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গোটা আলেম সমাজের ইসলামবিরোধী আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য বাংলাদেশের সমস্ত মসজিদের মুসুল্লীদেরকে জামায়াত-শিবিরের জনশক্তি আখ্যায়িত করে গোটা দেশে নারকীয় তান্ডব শুরু করে দিয়েছে। সরকারের কাছে দাবি তুলতে ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সরকারের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যখন দেশের সমস্ত মসজিদের মুসুল্লি জামায়াত-শিবিরের জনশক্তি তখন তাদের বিরুদ্ধে যারা স্লোগান দিচ্ছে তাদেরকে আস্কারা না দিয়ে আল্লাহ ওয়ালাদের বিরাট জনশক্তির দাবির প্রতি সম্মান জানানো।
আসলে আওয়ামী সরকারেরর ঘাড়ে চেপে বসেছে নাস্তিক গোষ্ঠী। সে কারণে তাদের চক্রান্ত জাল ছিন্ন করে বের হয়ে আসা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নব প্রজন্মের চিৎকার দেখে স্মরণ হয় কোলকাতার যুগান্তর পত্রিকার আহবান। ১৯০৮ সালে ৩০শে মে কোলকাতার যুগান্তর পত্রিকা হিন্দুদের প্রতি এক উদাত্ত আহবান জানিয়ে বঙ্গ মাতার সমর্থকদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। বলা হয়, ‘‘ মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করছে, একমাত্র কোন বস্তু তার পিপাসা নিবারণ করতে পারে। মানুষের রক্ত ও ছিন্ন মস্তক ব্যতিত অন্য কিছুই তাকে শান্ত করতে পারে না।’’ ঐ একই সুরে ইসলামবিরোধী যুগান্তর দলের কিছু নব প্রজন্মের সন্তানরা তাদের মা জননীকে খুশি করতে ইসলামী নেৃতৃবৃন্দের ফাঁসির দাবিতে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। আর তাদের আন্দোলনের পালে হাওয়া যোগাচ্ছে প্রতিবেশী দেশের ইসলামের চির শত্রুরা। এখনও যদি তৌহিদী জনতার বিবেকোদয় না হয় তা হলে হয়তো কয়েক শতাব্দীর জন্য আবার তারা হারিয়ে যেতে হতে পারে ইতিহাসের পাতা থেকে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যখন কোন রাষ্ট্রে যাবতীয় ঐশ্বরিক ও মানবিক আইন এবং ন্যায়-নীতির প্রতি মানুষের সীমাহীন অশ্রদ্ধা সৃষ্টি হয় তখন সমাজ ও রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয় বিশৃক্মখলা।, খুন রক্তপাত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকার যে ভাবে নব প্রজন্মকে উস্কিয়ে দিয়ে কাল্পনিক গণজাগরণের দোহাই টেনে ঐশ্বরিক ও মানবিক আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর তৎপরতা শুরু করেছে এভাবে এ প্রবণতা বেশি দিন চললে দেশের জন্য এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। জন লকের কথা, ‘‘ধর্ম সম্বন্ধে সরকার যেখানে অনুদার, নিয়ন্ত্রণ ও দমন যেখানে শাসনের অঙ্গ, সেখানে শান্তির আশা দূরাশা মাত্র।’’
নব প্রজন্মের সন্তানরদেরকে দোষ দিয়ে আমরা বুড়ারা দোষ মুক্ত হতে পারি না। কারণ লক বলেছেন ‘‘শিশু কোন দশের বা সরকারের প্রজা হয়ে জন্মায় না। সে থাকে পিতার অভিভাবকত্বে ও ক্ষমতাধীনে যতদিন না সে সাবালক হচ্ছে-’’ আমরাই তো শিশু-কিশোরদেরকে দীর্ঘ প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে কুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছি, তাদের হাতে বিকৃত ইতিহাস তুলে দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি। আধো আধো বোলের শিশুদেরকে অমুকের ফাঁসি চাই স্লোগান শিখাচ্ছি। এসব সন্তান ভবিষ্যতে যখন বিখ্যাত ‘শাহনামা'র বীর সোহরাবের মতো সঠিক পিতৃপরিচয় লাভ করবে তখন ইতিহাস অনেক দূর গড়িয়ে যাবে।