বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

হায় গণতন্ত্র! ব্যর্থতাই তোমার নিয়তি?


আমাদের দেশটা নাকি গণতান্ত্রিক। লোকে তো তাই বলে। হতে পারে। কারণ যা রটে তা তো কিছুটা বটেই। লোকের কথা যদি সত্য ধরি, তবে প্রশ্ন এসে যায়, এই গণতন্ত্রটা কী?
গণতন্ত্রের সবচেয়ে চমকপ্রদ সংজ্ঞাটি হলোÑ গণতন্ত্রের সর্বজন স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা নেই। আর এই গণতন্ত্রের জনক মহামতি প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল। তাই জনক হিসেবে তিনি গণতন্ত্রকে ঠিক কিভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন সেটাই প্রথমে জানা প্রয়োজন। অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রসম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে গিয়ে বলেছিলেনÑ ‘ব্যর্থতাই গণতন্ত্রের নিয়তি।সন্তান সম্পর্কে জনকেরই এমন উক্তি! হায় গণতন্ত্র! কিন্তু আমাদের এটাও উপলব্ধি করা প্রয়োজন, তিনি গণতন্ত্র সম্পর্কে এমন নির্দয় উক্তি কেন করেছিলেন। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, গণতন্ত্রের অর্থই হলো দরিদ্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র পরিচালিত হতে হবে নীতিবোধ দ্বারা। অর্থাৎ শাসকশ্রেণী হবে নীতিবান। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই নীতি-নৈতিকতা দরিদ্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠের চরিত্র নয়। ফলে দরিদ্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যখন শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, তখন তাদের পক্ষে নীতিবোধ বজায় রেখে শাসন করাও সম্ভব হবে না। কারণ, তারা নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় লিপ্ত থাকবে।
তার পরও আধুনিক যুগে গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা আরো উন্নত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আর এ জন্যই হয়তো বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রই গণতন্ত্রকে শাসনপদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। লোকে বলে, আমাদের দেশেও নাকি গণতন্ত্র চলে। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪২ বছরে প্রকৃত ও অর্থবহ গণতন্ত্র ছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। সন্দেহের কারণটা সোজা, ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে শিশু গণতন্ত্রকে বলি দেয়ার পর ৯০-এর দশকে নামকাওয়াস্তে যে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল, তাও সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অগণতান্ত্রিক মানসিকতা, জনস্বার্থের প্রতি উদাসীনতা এবং যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতাই গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে আমরা এমন একটি শাসনব্যবস্থা পেয়েছি, যেখানে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর পদাধিকারী একজন ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের জনক অ্যারিস্টটলের এক ব্যক্তির শাসন বা রাজতন্ত্র এবং গুটিকয়েক ব্যক্তির শাসন বা অভিজাততন্ত্রের বিকল্প হিসেবে যে বহুজনের শাসন বা গণতন্ত্রের কথা আমরা জানি, তার সাথে আমাদের এই গণতন্ত্রের বেশি মিল আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের নামে এমন স্বেচ্ছাচারী শাসনপদ্ধতি চলমান আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় আছে। তাই আমাদের দেশীয় সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সম্প্রতি যে উক্তি করেছেন তা খুবই যথার্থ বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, সংসদীয় পদ্ধতি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে গণতন্ত্র বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ আমাদের দেশে সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে, তবে কার্যত শাসন ক্ষমতা এমন একটি শ্রেণীর হাতে চলে গেছে যারা জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়, বরং নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতেই বেশি মনোযোগী। এই শ্রেণীটির কথাই গণতন্ত্রেরজনক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে।
বাংলাদেশে অর্থবহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলেও দীর্ঘ দিন ধরে একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক ধারা ক্রিয়াশীল রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা মন্দের ভালো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই দুর্বল ধারাটিই অনাকাক্সিতভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বারবার। ফলে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরেও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি খুব একটা মজবুত হয়ে উঠতে পারেনি। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তই হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, আর সেই সরকার হবে জনকল্যাণমুখী। অথচ গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক তেমন কোনো নির্বাচন পদ্ধতিই গত ২৩ বছরে আমরা অর্জন করতে পারিনি। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তই আমরা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
দলীয় সরকারের ব্যাপক কারচুিপ প্রবণতার কারণে ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনই দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এই নির্বাচনগুলো নিয়ে কিছুটা বিতর্ক যে ছিল না তা নয়। তবে সে বিতর্কের মূল কারণ ছিল আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পরাজয় মেনে না নেয়ার মতো অগণতান্ত্রিক মানসিকতা।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেই একই আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই গ্রহণযোগ্য ও মীমাংসিত নির্বাচনব্যবস্থাকে বাতিল করে দেয়। যুক্তি হিসেবে দলটি ব্যবহার করে হাইকোর্টের একটি রায়কে। অথচ হাইকোর্ট ওই রায়ে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন অর্থাৎ দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনেই হতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য কী ছিল? উদ্দেশ্য ছিল, দেশে যাতে অনাকাক্সিত কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি না হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে, সুশীলসমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মতামতকে উপেক্ষা করে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। অথচ এই ব্যবস্থার কোনো সুস্পষ্ট লিখিত রূপ নেই, সাংবিধানিক ভিত্তিও নেই। সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ছাড়া কেউ জানেনও না এই নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতিটি আসলে কী! গণতন্ত্রের জন্য এরচেয়ে বড় হুমকি আর কী হতে পারে!
মূলত এখান থেকেই দুর্বল গণতান্ত্রিক ধারায় নতুন সঙ্কটের শুরু। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে হয়তো কিছুটা সাংঘর্ষিক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যাটাই যখন বিশ্বাস ও সহনশীলতার ঘাটতি, তখন হুট করে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি বাতিল করাকে কেউই ভালো চোখে দেখেনি। শুধু তাই নয়, সরকারের এই একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত রাজনীতির ময়দানে সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, কর্নেল অলি আহমদের এলডিপি এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ দলীয় সরকার তথা আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। বিরোধী দলের এই সিদ্ধান্ত একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়, অযৌক্তিকও নয়। কারণ গণতন্ত্রের অন্যতম একটি শর্ত হলো, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিরোধী দল বা জোটের সেই সুযোগ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে যে ছকে প্রস্তুত করেছে, তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন না আনলে তা কোনোভাবেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা প্রত্যেকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে না। অথচ একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এই শর্ত পূরণ হওয়া জরুরি। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাই সংবিধানের ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। আরো দুঃখের বিষয়, এই ব্যাখ্যাদাতারাও একেক সময় একেক রকম কথা বলছেন। কেউ যখন বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করবে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, সরকার হরতালবিরোধী এমন আইন পাস করবে যাতে হরতাল আহ্বানকারী দলের শীর্ষ নেতাকেও গ্রেফতার করা যায়। কেউ যখন বলছেন, নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত এই সরকার নেবে না, তখন বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তি সম্পাদিত হবে, তা হয়েছেও। সংসদে হরতালবিরোধী আইন পাস করা কিংবা টিকফার মতো সংবেদনশীল চুক্তি স্বাক্ষর করা কি রুটিন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে! হায় গণতন্ত্র!
সরকারের মন্ত্রীরা এমনভাবে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন যাতে স্পষ্ট হচ্ছে বিরোধী জোটকে তারা চরম শত্রু বলেই বিবেচনা করেন। শুধু দলের শত্রুই নয়, রাষ্ট্রের শত্রু বলেও আখ্যায়িত করছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী তো বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতা-নেত্রীকে পর্যন্ত গালিগালাজ করতে ছাড়ছেন না। অথচ এরাই নাকি একটি নিরপেক্ষনির্বাচন জাতিকে উপহার দেবেন!
এই গণতন্ত্রে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে শাসক জনগণকে উদারতা শেখায়। এই গণতন্ত্রে সংবিধানকে ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া করে শাসক জনগণকে সংবিধানের পবিত্রতা শেখায়। এই গণতন্ত্রে বিরোধী শক্তির অধিকার হরণ করে শাসক জনগণকে গণতন্ত্রশেখায়। হায় বাংলাদেশ! হায় গণতন্ত্র! ব্যর্থতাই তোমার নিয়তি।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads