বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৪

হে বাংলাদেশ নিরাময় হও


ক. বিনাবিচারে মানুষ হত্যা কিংবা মৌলিক অধিকার হরণের বৈধতা কেউ পেতে পারে না। এই এখতিয়ার বিধাতা কাউকে দেননি। এই নিয়ম মেনেই আইন ও সভ্যতার ভিত দাঁড়িয়েছে। শুধু প্রতিহিংসা কিংবা আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষ মানুষকে হত্যা করলে তার পরিণাম বর্বর শাসকের দেশে কিংবা জঙ্গলেও ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা। এই সৃষ্টির সেরা সৃষ্টিকে নিয়ে মানুষ বাড়াবাড়ি করুক, এটা সৃষ্টিকর্তা চাননি। প্রথম মানুষ নবী আদম আ:-এর পুত্র প্রথম ভাইহত্যার অভিযোগে অভিশপ্ত হয়েছেন। দুনিয়াতেই তার লাঞ্ছনা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ওল্ড-নিউ টেস্টামেন্ট ও কুরআনে তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। পরকালেও সেই অভিশাপ তাকে বহন করার তথ্য সত্য জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

মানুষ মানুষকে সম্মান করুক, ইজ্জত দিক, মর্যাদা দিক এটা আল্লাহ চেয়েছেন। ইজ্জত বা সম্মান আল্লাহ দেন, আল্লাহই কেড়ে নেন। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষ মানুষ হিসেবে বিধাতার এক অপূর্ব সৃষ্টি। মানুষ বললেই তার একটি ব্যক্তিসত্তা ও মর্যাদা দাঁড়ায়। শুধু মানুষ হওয়ার কারণেই আরেকজন মানুষের কাছে তার কিছু অধিকার ও দায় জন্মায়। তাই মানুষ হত্যা আল্লাহর সৃষ্টিকে হত্যা, একটি হত্যাও যদি বিনাবিচারে হয় সেটা পুরো সৃষ্টিকে হত্যার শামিল। মানুষ এতই মর্যাদাবান যে, মৃত মানুষের লাশটিকেও সম্মান করতে বলা হয়েছে। সব ধর্ম ও প্রকৃতি পূজারিরাও এই বিশ্বাস লালন করেন, ব্যতিক্রম ছাড়া পালনও করেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন বাহিনী এবং এলিট ফোর্স যেন দায়মুক্ত। এরা ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার কিংবা বাহানা সৃষ্টি করে সহজেই গুলি ছুড়তে চায়। মানুষের প্রাণ নিয়ে এমন খেলা যারা করে এবং করার নির্দেশ দেয়, তারা কোনো দিন ক্ষমা পাবেন না। বিধর্মী বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলাম অনুসারীদের কাছে আমানত। ধর্মের কারণে কোনো মানুষ নিগৃহীত হোক, এটা ইসলাম অনুমোদন দেয় না। ধর্ম যার যার, ইচ্ছামতো গ্রহণ-বর্জনের বিষয়, ইসলাম জোর জবরদস্তি মানে না। কোনো মুসলমান শুধু ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে অন্য কোনো মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না। আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, সব লোক বিশ্বাসী হবে না। বেশির ভাগ মানুষ মুমিন হবে না। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। নবীও দারোগা-পুলিশের মতো আচরণ করার অধিকার পাননি। এই বিশ্বাস থেকেই এ জনপদে আবহমানকাল ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি লালনে পাহারা দিচ্ছেন ধর্মপ্রাণ মানুষ ও আলেম সমাজ। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ বারবার সংখ্যালঘু নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। এবারো করল। সাথে যোগ দিলো ভূমিদস্যুরা।

আমাদের দেশে প্রথম এলিট ফোর্স হয়েছে রক্ষীবাহিনী নামে। সেই বাড়াবাড়ির কলঙ্কিত ইতিহাস কখনো মুছে যাবে না। এরপর র‌্যাব। প্রথম দিকে র‌্যাবকে ভাবা হতো শান্তিকামী মানুষের ত্রাণকর্তা। এখন ক্যাডার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত নানা মহল থেকে। কোনো মানুষ মানুষকে বিনা কারণে, শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমত ও বিশ্বাসের কারণে শক্তি, ক্ষমতা ও দম্ভের কারণে অপমান করলে আল্লাহ সেই মানুষটিকে দুনিয়াতেই কিছু নিষ্ঠুর প্রতিদান পাইয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্ব, আত্মীয়তা, পিতা-পুত্রের সম্পর্ক হলেও অভিযুক্ত মানুষ রেহায় পায় না।

 আল্লাহ যে ইজ্জত দেন এবং কেড়ে নেন, তার প্রমাণ খুঁজতে ফেরাউনের দেশ মিসর যেতে হবে না। জার্মান কিংবা ইতালি যেতে হবে না। আমাদের এই উপমহাদেশের তিনটি দেশের দিকে তাকালেও কিছু অনিবার্য ট্র্যাজেডি ও নিষ্ঠুর ইতিহাস সামনে এসে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির কারণে বঙ্গবন্ধু, ভুট্টো, জিয়া, জিয়াউল হক, বেনজির, ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীরা মর্মান্তিক ঘটনার নজির হয়ে আছেন। রাজনৈতিক বাড়াবাড়ির খেসারত কেউ না দিয়ে পার পেয়ে যাননি। এখনো অনেক শাসক বেইজ্জতির লাগাম পরে অভিশপ্ত জীবনের গ্লানি বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রকৃতির এই নিয়ম পাল্টাবে না। যতক্ষণ মানুষ পাল্টাবে না।

আমাদের দেশে কমপক্ষে চারজন দাম্ভিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানি, যারা ক্ষমতার বাড়াবাড়ির খেসারত রাজপথে পেয়ে গেছেন। যে পুলিশ তাদের নির্দেশে অন্যদের ঠেঙ্গাতো, সুযোগমতো তাদের ঠেঙ্গিয়েছে, চ্যাংদোলা করেছে সেই পুলিশ, শুধু সময়টা পাল্টে ছিল বলে। অঙ্কশাস্ত্রের পণ্ডিত কিন্তু বুজর্গ খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত আলী রা:-এর জানার ভাণ্ডার জ্ঞান রাজ্যের দরওয়াজার মতো। মানুষের মর্যাদা, মানবতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার অসংখ্য অভিজ্ঞতালব্ধ উপদেশ আছে। আমাদের শাসকেরা, লাঠি হাতে ক্ষমতা চর্চাকারীরা, বন্ধুক হাতে আইন প্রয়োগকারীরা, ন্যায় দণ্ড হাতে বিচারকেরা কষ্ট করে হজরত আলী রা:-এর জীবন ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতালব্ধ ইতিহাস খতিয়ে দেখতে পারেন। জাতি না হোক নিজেরা উপকৃত হবেন। 

এ জাতির কপাল কত মন্দ তার একটা উপমা বর্তমান ইসি। নির্বাচন কমিশন আমাদের অঙ্ক শিখাচ্ছেন, যে অঙ্ক কতটা মিথ্যা ও বানোয়াট তাদের বিবেকই হয়তো সবচেয়ে ভালো জানে। বিবেকের সাথে এ ধরনের প্রবঞ্চনার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। তাদের প্রতি সবিনয়ে আরজ বোকাকেও বোকা ভাবলে বিপদ। যেমন পাগলকে পাগল বলা যায় না। সুস্থ একটি জাতিকে বোকা ভাবা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। যে জাতি হাতের আঙুলে কিংবা ঠোঁটে ঠোঁটে হিসাব মিলাতে জানে তাদেরকে তাদেরই দেখা চাুষ ঘটনা নিয়ে ইসির এমন রসিকতা বড্ড বেমানান। নিষ্ঠুর পরিহাস! একই সাথে তাদের চিন্তার সতীত্বও প্রশ্নবিদ্ধ।

যারা ক্ষমতাকে সহজে পাওয়া পণ্য ভেবে পদতলে রেখে পিশাচের মতো হাসছেন, হায়েনার মতো হিংসার লালা ছিটাচ্ছেন, তারা নমরুদের প্রতিপক্ষে মশা, আবরাহার প্রতিপক্ষে আবাবিল পাখির কথা মাথায় রাখতে পারেন। যিনি যে ব্যাপারে ক্ষমতাবান, তিনি সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। যিনি যে বিষয়ে আমানতদার, তাকে তার আমানতদারির হিসাব দিতে হবে। যিনি যে বিষয়ে শপথ নিয়েছেন, আজ হোক কাল হোক তাকে তার জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে।

যত ক্ষমতাধর হোন তাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, কোনটা রহমত কোনটা গজব এমন অজানা ভাগ্যের দায় বুঝাও মানুষের জন্য কঠিন। যে বৃষ্টি রহমত হয়ে বর্ষিত হয়, সেই বৃষ্টি গজবও নামায়। যে হাসি খুশির বন্যা বইয়ে দেয়, সেই হাসি দম বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কারণও ঘটায়। যে সম্পদ সমৃদ্ধি আনে, সেই সম্পদ প্রাণঘাতীও হতে পারে। যে ক্ষমতা শক্তি জোগায়, সেই ক্ষমতা অসহায়ও করে। যে প্রাণ প্রাচুর্য সমৃদ্ধি আনে, সেই ক্ষমতার প্রাচুর্য কাঁদায়ও।

এবার আমরা যে নিষ্ঠুর ও অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হলাম, তার ফিরতি প্রয়োগটা দেখতে মন চায়। যদিও প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা কামনা করি না, তবুও একটা গল্প দিয়ে লেখার এই অংশটা শেষ করতে চাই। গ্রামের বুড়ো শাশুড়ি জোয়ান পুত্রবধূকে বললেন, মা পিঠটা চুলকাচ্ছে। একটু হাত লাগাও। বউ বার কয়েক হাত দিয়ে চুলকিয়ে পা দিয়ে চুলকাতে লাগল। শাশুড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই টের পেলেন, বললেন মা তুই যে পা দিয়ে চুলকাচ্ছিস তা টের পাচ্ছি, দে তোর পা দিয়েই দে, ভালোই লাগছে। তোর কি দোষ, জোয়ান কালে আমার শাশুড়িকে আমিও এমনটিই করেছিলাম। সময়টা এমন, এককাল শাশুড়ির আরেককাল বউয়ের। 

খ. যৌথ অভিযানের নামে বাড়াবাড়িটা এবার একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। এবারকার অভিযানটায় হানাদার বাহিনীর মতো আচরণ লক্ষ করা যায়। এতে অপরাধীচক্র সুবিধা পেয়েছে। সাধারণ শান্তিকামী মানুষ হয়রানির মুখে পড়েছেন। গ্রেফতারবাণিজ্য বেড়েছে হাজার গুণ। সরকারি দলের আসকারাই এর মূল কারণ।

যৌথবাহিনীর প্রশ্নবিদ্ধ অভিযান নিয়ে অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও কোথাও এই অভিযানের নামে এতটাই বাড়াবাড়ি হচ্ছে যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নামান্তর হিসেবে দেখছে দেশের মানুষ। যৌথবাহিনীর অভিযান আগেও হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুট ও বেপরোয়া আচরণ অতীতে হয়নি। অনেকেই এটাকে রাষ্ট্রের পোশাকি শ্বেত সন্ত্রাস বলে অভিহিত করেছেন।

সাধারণত জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালিত হয়। এটা রেওয়াজও বটে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, বৈধ অস্ত্রের অনভিপ্রেত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং পেশাদার অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করার টার্গেট নিয়েই এই অভিযান চালানো হয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার অন্তরায়গুলো দূর করাই এই অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য। তা ছাড়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে জননিরাপত্তা অধিকতর নিশ্চিত করার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। আইনের শাসন নিশ্চিত করে জনমনে ভীতি দূর করে স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এ ধরনের স্বল্প সময়ের তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনার আসল লক্ষ্য।

এবার এর ব্যতিক্রমই শুধু লক্ষ করছি না, অনেক ক্ষেত্রে পেটোয়া বাহিনীর মতো সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ি জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তার বোধের বদলে ভীতির সঞ্চার করেছে। এবার পুরো অভিযান পরিচালিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে বিরোধী দলের কর্মসূচি ঠেকানোর জন্য। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি, গ্রেফতার, নির্যাতন ও গুলির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বাসাবাড়ি, মেস ও আবাসস্থলে হামলা হচ্ছে। দুর্ভাগ্য যে এই অভিযানে গৃহিণী ও কর্মজীবী মহিলারাও হয়রানির শিকার হয়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের পারিবারিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দোকান-পাটও আক্রান্ত হচ্ছে। বিরোধী দল দমনে যৌথবাহিনীর সাহায্যকারী সেজেছে স্থানীয় রাজনৈতিক মস্তান, দাগি আসামি, অস্ত্রবাজ রাজনৈতিক ক্যাডার ও সরকারি দলের লোকজন, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। অস্ত্রবাজ ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের সাথে নিয়ে অভিযান চালানোার দৃশ্য, বিরোধী দলের কর্মসূচি ভণ্ডুল করার চিত্র প্রায় জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু ঘটনা বিদেশী মিডিয়ায়ও ঠাঁই পেয়েছে।

যৌথবাহিনীর অভিযানের ভেতর জালভোট, ব্যালট ছিনতাই, ভোট গ্রহণে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভীতি প্রদর্শন করে জিম্মি করার ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটতে দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় নাশকতার ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ তাও যৌথ অভিযানের ভেতর কিভাবে ঘটেছে তার কোনো সদোত্তর নেই। আওয়ামী লীগ পন্থী একজন শিক্ষকের স্কুল ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনা সবাইকে বিস্মিত করলেও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হামলা লুটপাট যেন গাসহা বিষয়।

বিশেষ অভিযানের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঠেকানোর এই সময়টিতে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। জননিরাপত্তা আরো বেশি বিঘিœত হয়েছে। এই সময়টিতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুধু রাজনৈতিক কারণে বিঘিœত হয়নি, পুলিশি বাড়াবাড়ি, বিভিন্ন ধরনের তল্লাশির নামে হয়রানি এবং যৌথবাহিনীর অভিযানের কারণেই মানুষ বেশি মাত্রায় নিরাপত্তাহীনতায়ও পড়েছে। অনেক গ্রামে মানুষ স্বস্তিতে রাত যাপন করতে পারছেন না।

অতীতে কখনো বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঠেকানোর জন্য বিশেষ অভিযান চলেনি। অধিকার হারা মানুষের গণরোষ দমনে কোনো সরকার যৌথ অভিযান চালায়নি। এবার এই অভিযান পরিচালনার সময় যৌথবাহিনীর সদস্যরা নিরপেক্ষ ভূমিকায় নেই। নির্বাচনী সহিংসতায় দেড় শতাধিক নিহতের ঘটনাটি অভিযানের ভেতরই ঘটেছে। যে অভিযান হয়রানি বাড়ায়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস গ্রামের জনপদ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়, মানুষের ভেতর ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা জাগায় তা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না। একদিকে দাগি অপরাধী, সন্ত্রাসীচক্র ও অস্ত্রবাজেরা সরকারি ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, অন্য দিকে রাজনৈতিক হয়রানির কারণে বিরোধী দলের কর্মীরা পালিয়ে বেড়ায়, সে অভিযান যৌথ হোক আর পুলিশি কিংবা র‌্যাব বিজিপির নামেই হোক তা শুধু তাৎপর্যহীনই নয়, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গত কটা বছরে পুলিশি বাড়াবাড়ি, বিরোধী দলের অফিসে হামলা। দেখামাত্র গুলির যে দৃশ্য, মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে তা নজিরবিহীন। পুলিশি পাহারায় হাইকোর্ট ও প্রেস কাবে হামলার পরই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ ন্যূনতম নৈতিকতার দাবি ছিল।

জনগণ প্রশ্নবিদ্ধ যৌথবাহিনীর অভিযান চায় না। চায় আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার কার্যকর ব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোও আইন ও নীতিবহির্ভূত কাজ।

গ. বিএনপি নেতারা রাজপথে নেই কেন এর কোনো জবাব জনগণ চায় না। কারণ, জনগণ দেখতে পাচ্ছে বিরোধী দলের কোনো রাজনীতিবিদকেই সরকার সহ্য করতে চাচ্ছে না। দুদিন আগেও একজন আওয়ামী লীগ নেতা হুঙ্কার দিলেন, তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাদেরই সংজ্ঞায়িত শান্তি স্থিতির দোহাইতে সব বিরোধীদলীয় নেতাকে জেলে পাঠানো হবে। এরপর আর কোনো কথাও থাকে না, রাজনীতিও থাকে না। গণতন্ত্র এমনিতেই মূর্ছা গেছে। একসময় আবুল মনসুর আহমদ, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, এম এ জি ওসমানী, জাসদ নেতৃত্বসহ অল্প কজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বাকশাল ও গণতন্ত্রের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবার নব্য বাকশাল, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র হত্যা, সংবিধান লুণ্ঠন, আধিপত্যবাদের স্বরূপ উন্মোচন, ও নির্বাচনের প্রহসন বুঝাতে একা লড়ে খালেদা জিয়া জাতির কাছে অম্লান হয়ে থাকলেন।

ইতোমধ্যে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীসহ সাত নেতাকে রিমান্ড ও জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এক সময় এক মন্ত্রী বলেছিলেন, সমঝোতা হলে সবাই মুক্তি পাবেন। এসব গ্রেফতারের মাজেজা ও মর্তবা এতেই স্পষ্ট। ব্যারিস্টার মওদুদ, ব্যারিস্টার রফিক, এম কে আনোয়ার, সাদেক হোসেন খোকা, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও আইনজীবী শামছুল আলম শিমুল বিশ্বাস এ তালিকায় রয়েছেন। অন্য নেতারা অগণিত মামলার আসামি হয়ে কারাগারে রয়েছেন। যারা বাইরে আছেন তাদেরও দেখামাত্র গ্রেফতার করা হবে। কর্মসূচি ঘোষণা করলে গ্রেফতার, রাজপথে হাঁটলে গ্রেফতার, নেত্রীর বাসায় গেলে গ্রেফতার। গ্রেফতার ও মামলাবাজির এ নজির বিরল ঘটনা। সিনিয়র নেতা, আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এবার বেশি টার্গেট হলেন। তারপর সংগঠকদের পাকড়াও করা হয়েছে। যারা কর্মী পরিচালনা করেন তারাও আক্রোশে পড়েছেন। ছাত্র ও যুব নেতারাও টার্গেট হয়েছেন। খালেদা জিয়ার চারপাশে যারা থাকেন তারাও কারাগারে। এ ধরনের গ্রেফতারের কারণ সহজ। খালেদা জিয়াকে ভয় পাইয়ে, নিঃসঙ্গ করে চিন্তাভাবনায় দেউলে করে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। স্বজন প্রিয়জন থেকে দূরে থাকা এই নেত্রীর চার পাশের লোকদেরও গ্রেফতার করে মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। শিমুল বিশ্বাসকে গ্রেফতারের পর আমার মতো অনেকেই তাজ্জব হয়েছেন। খালেদা জিয়ার যাবতীয় অ্যাসাইনমেন্ট দেখভাল করতেন শিমুল বিশ্বাস। তার তৎপরতা ছিল নেত্রীর অফিস ও বাসা পর্যন্ত। তার অনেক রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও গ্রেফতার পর্যন্ত এটাই ছিল তার কাজ। প্রশ্নটা এখানেই তাকে গ্রেফতার করে সরকার কী অর্জন করতে চেয়েছে। আবদুল আউয়াল মিন্টু ও শিমুল বিশ্বাসের গ্রেফতারের পর মনে জাগা শত প্রশ্ন নিয়ে একটা কলামও প্রস্তুত করেছিলাম। মিন্টু ভাইকে নিয়ে লেখার অংশটা প্রকাশ করতে সক্ষম হলেও শিমুল বিশ্বাস ভাইকে নিয়ে লেখার অংশটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ার আগেই গ্রেফতার তালিকায় আরো অনেক শীর্ষ নেতা যোগ হলেন। প্রস্তুত করা লেখায় তার ছবিটাও পেস্টিং হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম, এতসব নিষ্ঠুরতা ও প্রতিহিংসাপরায়নতার জবাব কার কাছে চাইব, কে দেবে উত্তর। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপতি যেখানে নির্বাক, সংবিধান যেখানে অকার্যকর, বিচারের বাণী যেখানে নিভৃতে কাঁদে সেখানে গুমরে কাঁদা যায় আর কিছু করা যায় না। এখন একটাই প্রশ্ন, সরকার যেখানে রাজনীতি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, সংবিধান, সংসদ নির্বাচন সব কিছু গ্রেফতার করে বসে আছে। সেখানে আরশের প্রভু ছাড়া আর কার কাছে অনুযোগ করব। এরপর পথ খোলা একটাই নিজেদের আত্মহননের রাজনীতির জন্য প্রস্তুত করার পরামর্শ দেয়া। কারণ নিশ্চিত করে জানি, ১৬ কোটি মানুষকে এভাবে কারাগারে কিংবা গুলি করে ঠেকিয়ে রাখা কিছু দিন সম্ভব, সম্ভব নয় অনন্তকাল। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি পচে গেছে। অর্থনীতি খাদের কূলে। পররাষ্ট্রনীতি একঘরে। রাজনীতিবিদেরা অসুস্থ। অনেকেই বিকারগ্রস্ত। কেউ কেউ নানা ধরনের সিনড্রোমে আক্রান্ত। তার ওপর সংবিধান অকার্যকর। নির্বাচনব্যবস্থা নিঃশেষ হয়ে গেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন। সার্বভৌমত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিদেশে আমাদের জন্য প্রস্তব পাস হচ্ছে। তাই সব কিছুর আগে আমাদের 

আরোগ্য কামনা করার কোনো বিকল্প নেই। অতএব সমস্ত সত্তা দিয়ে বলতে চাই হে বাংলাদেশ তুমি নিরাময় হও। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads