রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৪

প্রহসনের নির্বাচন এবং অতঃপর


একটি নির্বাচন। ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচন। এরই মধ্যে এ নির্বাচন বিভিন্ন মহলে নানা অভিধায় অভিহিত হচ্ছে একতরফা নির্বাচন, প্রহসনের নির্বাচন, অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন, অগণতান্ত্রিক অনৈতিক নির্বাচন, আওয়ামী লীগের কপালে কলঙ্ক তিলকএঁকে দেয়ার নির্বাচন। তবে সরকার বলছে, সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। যদিও অনেকেই সরকারি এ ভাষ্য মানতে নারাজ। তাদের কথা হচ্ছে বিভিন্ন জরিপ ও সর্বশেষ পাঁচ সিটি করপোরেশনের ফলাফল দেখে সরকারপক্ষ নিশ্চিত ধরে নেয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিজয়ী হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। এর আগেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তা টের পেয়েছিলেন। অতএব এ উপলব্ধির ওপর দাঁড়িয়েই আওয়ামী লীগ তখন পথ খুঁজতে থাকে কী করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। শেষ পর্যন্ত আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে সংবিধান থেকে সেই ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয়। চালু করা হয় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা। অথচ এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগের এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মুখে। তখন সব দল একমত ছিল এ ব্যাপারে। আওয়ামী লীগ বলেছিল এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট চুরির পথ চিরতরে বন্ধ হলো। আর আজ সে ব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করে সেই আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক। প্রশ্ন হচ্ছে আগে যা ছিল গণতান্ত্রিক, এখন তা অগণতান্ত্রিক হলো কী করে? এ ধরনের বক্তব্য থেকে মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের নতুন করে আক্কেলদাঁত গজিয়েছে। তাই তাদের মুখে নতুন এ উপলব্ধির কথা।
এই কদিন আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বেগম খালেদা নির্বাচন বর্জন করছেন জনমতের বিপরীতে গিয়ে। জনগণ যে দিকে যায়, বেগম জিয়া যান বিপরীত দিকে। বেগম জিয়ার মধ্যে বিন্দুমাত্র গণতন্ত্র নেই। প্রশ্ন হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি ঠিক বললেন? গত শনিবারের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখলাম দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের বিপক্ষে। ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এই জরিপ মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় দেশের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষ এ নির্বাচনের বিপক্ষে অংশ নিয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৭৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্যমনে করেন। এরা এ-ও বলেছেন, এবারের ভোটে বিএনপিরই জয়ের সম্ভাবনা ছিল বেশি। তা ছাড়া আমরা বিভিন্ন সময় লক্ষ করেছি, আওয়ামী লীগের নীতি-সমর্থক পত্রিকাগুলোর জনমত জরিপ মতে, দেশের ৭০-৯০ শতাংশ মানুষ চান জাতীয় সংসদের নির্বাচন হোক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কিন্তু আমরা দেখছি, ব্যাপক সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনই শেষ পর্যন্ত যেনতেনভাবে সম্পন্ন করল। তাহলে প্রশ্ন, কে জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া?
এ নির্বাচনে আমরা আর কী দেখলাম? ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ আসনের ১৫৩ আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এসব আসনের বিজয়ীরা ১৪ দলীয় জোটের কেউ-না-কেউ। নির্বাচন হয়েছে বাকি ১৪৭ আসনে। এর ফলে দেশের মোট ভোটারের ৫৫.২২ শতাংশই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। যে নির্বাচনে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগ পেলেন না, সে নির্বাচনকে সাংবিধানিকভাবে বৈধ বা অন্য যা-ই কিছু বলা হোক না কেন, তা কখনোই নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ১৪৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা যে নির্বাচন করেন সেখানে হয় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে কিংবা জোটের শরিক দলের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এ যেন এক নতুন তামাশা। এ ধরনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলান্ধ সমর্থক ছাড়া সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকতে পারে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী র‌্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী নামিয়ে জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন নির্বাচনই সম্পন্ন করলেন যেনতেনভাবে। তাহলে প্রশ্ন জাগেÑ কে হাঁটছেন জনমতের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা, না খালেদা জিয়া? এ লেখা তৈরি করছি ৫ জানুয়ারি দুপুরের দিকে। অতএব এ নির্বাচনের ফলাফল কী দাঁড়াল, সে সম্পর্কে বলার কোনো সুযোগ এখানে নেই।
এ্র প্রসঙ্গে আরেকটি বিবেচ্য হচ্ছে এ নির্বাচন তো বর্জন করল বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন আঠারোদলীয় জোট। আর নির্বাচনে গেছে চৌদ্দদলীয় জোট। সেখানে আবার মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির খণ্ডিত একটি অংশকে নির্বাচনে নেয়া হলো এরশাদকে র‌্যাব দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে হাস্যকর এক রাজনৈতিক নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে। সে নাটকের নানা অঙ্ক এরই মধ্যে মঞ্চস্থহয়েছে। আরো কিছু অঙ্ক মঞ্চায়নের অপেক্ষায়। যা-ই হোক, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০টি। এর মধ্যে মহাজোটের ১৪টি দল এই একতরফা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বাকি ২৬টি দলই এ নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি অর্থাৎ এ নির্বাচন বর্জন করেছে। এ বিষয় বিবেচনায় নিলেও বলা যায়, দেশের বেশির ভাগ দল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে। তাহলে সরকারের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনমতের বিরুদ্ধে সরকারের একটি পদক্ষেপ বই কিছু নয়। অতএব ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়াটা জনমতের পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট। 
এ তো গেল আমাদের দেশের ভেতরের কথা। বাইরের দেশগুলোও কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিপক্ষে। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও অন্য অনেক দেশ বারবার তাগিদ দিয়েছে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের। কিন্তু এর বদলে সরকার যখন একদলীয়, একতরফা নির্বাচনে অনড়, তখন এরা সবাই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়; যা এর আগে বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রেই ঘটেনি। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতাকে জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কমনওয়েলথসহ এসব দেশের ওপর বিষোদগার করতে শোনা গেছে। আসলে দেশের ভেতরের ও দেশের বাইরের বিভিন্ন মহল ৫ জানুয়ারির একতরফা প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে। বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থানও তাই। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি বলেনÑ খালেদা যা-ই বলেন, জনমতের বিরুদ্ধে, তবে তা কতটুকু যৌক্তিক, কতটুকু গ্রহণযোগ্য? আসলে এ ধরনের অর্থহীন ও অগ্রহণযোগ্য আওয়ামী লীগের অনেক নেতার মুখ থেকেই শোনা যায়। যখন আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বলেন, ২৯ ডিসেম্বরের মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসিতে সরকার কোনো বাধা দেয়নি। যখন বলেন বেগম জিয়াকে অবরুদ্ধ বা গৃহবন্দী রাখা হয়নি, তিনি মুক্ত, পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে; এসব কথা কেউ বিশ্বাস করেন না। কারণ বেগম জিয়াকে নিয়ে যা ঘটছে, তা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যাণে ঘটছে, জনগণের চোখের সামনেই।
এ দিকে জাতিসঙ্ঘ, ইইউ, কমনওয়েলথসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও আরো অনেক দেশ যখন অর্থহীন ও অগ্রহণযোগ্য প্রহসনের এ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে; তখন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতাকে বলতে শোনা যায়, প্রয়োজন নেই বিদেশী পর্যবেক্ষকদের; নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আমাদের গণমাধ্যমগুলোই যথেষ্ট। গণমাধ্যমই বলবে এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু কতটুকু হয়েছে। এর বিপরীতে আবার দেখছি নির্বাচন কমিশনের গাঁটের পয়সা খরচ করে ভারত থেকে দুজন ও ভুটান থেকে দুজন মোট চারজন বিদেশী পর্যবেক্ষক এনে নির্ধারণের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা চলছে। এ আরেক প্রহসন।
যেনতেনভাবে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন তো হলো। এরপর কী? এরপর কী, তা আল্লাহ মালুম। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখ থেকে অনেক কথাই বের হচ্ছে। কেউ বলছেন বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা করে সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ সংসদের নির্বাচন করা হবে। এটি যেকোনো সময় হতে পারে। কালকেও হতে পারে। আবার কোনো কোনো নেতা বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ দশম সংসদ নির্বাচনী ট্রেন বিএনপি ফেল করেছে। আবার কোনো কোনো আওয়ামী নেতা বলছেন, আগামী মার্চ পর্যন্ত চলবে বিরোধীদলীয় সন্ত্রাসীদের সমূলে উৎপাটনের কাজ। জানি না, ৫ জানুয়ারির যেনতেন নির্বাচনের পর আসা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নয়া মহাজোট সরকারের বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক দমনপীড়নের তীব্রতা এবার কোন মাত্রায় নিয়ে তুলবে? কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখ থেকে সমূলে উৎপাটনেরকথা উচ্চারিত হচ্ছে, তবে আন্দাজ-অনুমান হয় এবারের দমনপীড়নের তীব্রতা রেকর্ড ছুঁতে পারে। যদি তেমনটি সত্যি সত্যিই ঘটে, তবে রাজনৈতিক সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের পারদমাত্রা যে আরো কয়েক ডিগ্রি ওপরে উঠবে, তেমন সম্ভাবনা প্রবল।
এ ছাড়া আমরা জানি না বিখ্যাত ব্রিটিশ সামরিকী দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত মান্তব্যিক নিবন্ধ অনুযায়ী নতুন সরকার মাইনাস ওয়ানপরিকল্পনা মাথায় নিয়ে মাঠে নামছে কি না। বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রহসন, মাইনাস ওয়ান সমাধান’ (Electoral farce in Bengladesh, the minus-one solution) শিরোনামে এ প্রবন্ধে বলা হয়েছে দুবারের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফের শপথ না নেয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী রাখা হবে। গৃহবন্দী খালেদা জিয়ার সাথে দলের নেতাকর্মীরা দেখা করতে গেলেই তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ইকোনমিস্ট আরো লিখেছেÑ বিএনপি ও তাদের জোটের ১৭টি দল নির্বাচন বর্জন করেছে। (আসলে ৪০টি দলের মধ্যে মোট ২৬টি, অন্য হিসাবে ২৮টি দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে)। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে হাসপাতালে বন্দী রাখা হয়েছে। এরপর জামায়াতে ইসলামীর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সাথে খাপ না খাওয়ায় নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। মোট ৩০০ আসনের ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন। এ কারণে ৯ কোটি ২০ লাখ ভোটারের চার কোটি ৮৩ লাখ ভোটার ভোট দিতে পারবেন না। এ নিবন্ধে আরো উল্লেখ করা হয়েছেÑ শেখ হাসিনার এক পরামর্শদাতা বলেছেন, এ নির্বাচন একটি স্বল্পকালীন ব্যবস্থা। সংবিধান অনুযায়ী এ নির্বাচন ছাড়া সরকারের আর কিছুই করার ছিল না। তবে এটিই একমাত্র ব্যাখ্যা নয়, এটি আওয়ামী লীগের সুবিধাজনক ব্যাখ্যা। ইকোনমিস্ট আরো উল্লেখ করেছেÑ খালেদা জিয়া জানেন, যে বালুভর্তি ট্রাকগুলো দিয়ে তার বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলোই একসময় তার ক্ষমতায় ফিরে যেতে সাহায্য করবে। তবে এ নিবন্ধের শিরোনাম থেকে এটুকু স্পষ্ট, ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের একটি লক্ষ্য হচ্ছে মাইনাস ওয়ান, অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করা।
আবার গণমাধ্যমে দেখছি, নানা বিতর্ক ও নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়া ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করার চিন্তাভাবনা করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। যে সরকারে ঠাঁই পেতে পারেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। সরকারের গঠনপ্রক্রিয়া কী হবে, কিভাবে আগামী দিনে নির্বিঘেœ ক্ষমতায় থাকা যায় তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা আর চিন্তাভাবনা চলছে যেমন দলটির শীর্ষপর্যায়ে, তেমনি ১৪ দলীয় জোটের ভেতরেও। এসব আলোচনায় জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টিও তাদের মাথায় আছে বলে দায়িত্বশীল নেতাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব দিতে পারেন, যা আরেকটি চমক হতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেনÑ এ-জাতীয় সরকারে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত সব দলের অংশ নেয়া নিশ্চিত করতে পারলে নতুন সরকারের পাঁচ বছর পাড়ি দেয়ার পথ সুগম হবে। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারেও শেখ হাসিনা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের ইঙ্গিত দেন। ইশতেহারে ঘোষণা দেয়া হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখা এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সিভিল সমাজসহ দল-মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হবে। অপর দিকে গত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবসে এক আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা পরবর্তী সরকার কিভাবে গঠন হবে, এর ইঙ্গিত দেন। সেখানেও জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সূত্র মতে, সম্ভাব্য জাতীয় সরকারে টেকনোক্র্যাট কোটায় নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীদের কয়েকজন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।
বিরোধী দলবিহীন প্রহসনের নির্বাচন বর্জনের পক্ষে যখন দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চলে গেল, তখন সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের একটি ব্যর্থ চেষ্টা চলতে আমরা দেখেছি। ১৪ দলীয় জোটের ও জাতীয় পার্টির কয়েকজনকে নিয়ে গঠিত হয় এই তথাকথিত সর্বদলীয় সরকার। নিবন্ধিত ৪০টি দলের ২৮ই এ দলে যোগ না দিলে জাতীয় পার্টির কয়েকজনকে নিয়ে এ নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়; যাকে পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদেরই সর্বদলীয়সরকার বলা যাবে না বলে মন্তব্য করতে দেখা গেছে। এরা তখন বললেন, বরং এ সরকারকে নির্বাচনকালীন বহুদলীয় সরকারবলা যেতে পারে। আসলে শেখ হাসিনা সেই নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারগঠন উদ্যোগও ছিল কার্যত একটি প্রহসন। প্রহসনের তথাকথিত সর্বদলীয় বা বহুদলীয় সরকার ৫ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন, প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন যে প্রহসনের নির্বাচন যেনতেনভাবে সম্পন্ন করল, সে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত অটো-এমপিদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন হবে আওয়ামী লীগের আরেকটি প্রহসন। কারণ যে নির্বাচন দেশের বেশির ভাগ দল বর্জন করল, যে নির্বাচনে দেশের অর্ধেকের বেশি ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগ পেল না, সে নির্বাচনে নির্বাচিত নিয়ে সরকারে বর্জনকারী কোনো দল অংশ নেবে, তা কল্পনা করাও পাপ। আর সরকারি মহাজোটের বশংবদ নাগরিক কজনকে টেকনোক্র্যাট দেখিয়ে কোনো সরকার গঠন করে যদি তাকে জাতীয় সরকারবলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে, তবে সেটি হবে আরেকটি বিস্ময়কর প্রহসন। যেমনটি ঘটেছে নির্বাচনকালীন তথাকথিত সর্বদলীয় সরকার গঠনের নামে।
এ ধরনের জাতীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ যে হবে হাস্যকর তা আওয়ামী লীগের অনেক নেতারই বোধে আছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘জাতীয় সরকার হতে বাধা নেই। তবে জাতীয় সরকার হতে হলে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন।তার এ উপলব্ধি যথার্থ। কারণ বিরোধী দলকে বাইরে রেখে জাতীয় সরকার গঠনের চিন্তা অর্থহীন। যেখানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সব বিরোধী দল বর্জন করেছে, আর সে নির্বাচনে জয়ী হওয়া এমপিদের নিয়ে গঠিত হতে যাওয়া বিরোধী দল অংশ নেবে, এমনটি কল্পনা করা ভুল। অতএব জাতীয় সরকার গঠনের ভাবনাচিন্তা অর্থহীন। অপর দিকে পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, ‘দেশের ক্রান্তিকালে জাতীয় সরকার গঠন করা হয়। এখন দেশে ক্রান্তিকাল নেই। তাই আমি মনে করি না ৫ জানুয়ারির ভোটের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সর্বদলীয় বা বহুদলীয় সরকার গঠিত হবে।
বিরোধী দলবিহীন একতরফা এ নির্বাচন আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে? অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আমরা আজ যে এক অস্থিতিশীল পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তা দেশ-জাতিকে এক খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে। অথচ সরকার প্রহসনের এই নির্বাচন সম্পন্ন করে ভাবছে কী করে আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, কী করে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে দেয়া যায়। ৫ জানুয়ারি যেনতেনভাবে পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা হলো। এখানেই কি সব শেষ হয়ে গেল? বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা করে দ্রুত দেশে-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারলে রাজনৈতিক সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ যে থামবে না, অর্থনৈতিকভাবে আমরা যে দেউলিয়া হয়ে যাবো, সে ভাবনা কি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মাথায় আছে? একতরফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক লোক নিহত হয়েছেন। আহত কয়েক হাজার। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী মামলা-হামলা-গ্রেফতারের শিকার। এ সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ অবসান ঘটাতে না পারলে দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এর উত্তর কে দেবেন? আমরা আজ দেখছি, যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি সাময়িকী ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি দেশ ও অঞ্চলের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। নতুন বছরে এসব দেশ ও অঞ্চলের সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে বলে ওই সাময়িকী উল্লেখ করেছে। এ বছরের তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি দেশের নাম যোগ হয়েছে। বাংলাদেশ এর একটি। বাংলাদেশ বিষয়ে পত্রিকাটি এর প্রতিবেদনে বলেছেÑ ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন বছর শুরু করল দেশটি। জানুয়ারিতে নির্বাচনের আগে সেখানে নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ দিয়ে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্তৃত্ববাজি শাসন চালাচ্ছে এবং নির্বাচন বর্জন করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের ফলে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। এতে বাড়বে ভয়াবহ সঙ্ঘাত। সাময়িকীর মতে, এ সঙ্কট সমাধানে একমাত্র উপায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ৩০ ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফরেন পলিসি এসব মন্তব্য করে। অপর দিকে এই সাময়িকীতে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আবার তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হতে পারে। এর কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের ২০১১ সালের একপক্ষীয়ভাবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে নেয়াকে দায়ী করা হয়।
প্রশ্ন অনেক। সরকারের কি বোধোদয় ঘটবে? ‘একলা চলোএকরোখা নীতি পরিহার করে সরকার কি গণতান্ত্রিক পথে ফিরে আসবে, না একগুঁয়েমি প্রদর্শন আরো দমন-পীড়ন জোরালো করবে?


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads