মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৪

সুন্দরগঞ্জ : নিপীড়িত মানুষের আহাজারি


আলফাজ আনাম

বাংলাদেশের গ্রামের অভাবী মানুষকে রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য যে কতটা চড়া মূল্য দিতে হয় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ তার একটি উদাহরণ। দেশের উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনপদ সুন্দরগঞ্জ। এ উপজেলার বড় অংশ চরাঞ্চল। বেশির ভাগ মানুষের আবাদি কৃষিজমি না থাকায় হাঁস-মুরগির খামার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ এলাকার গরিব সহজ-সরল মানুষের জীবনে এখন অন্ধকার নেমে এসেছে। যৌথবাহিনী নামের এক আতঙ্ক হাজার হাজার মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে স্ত্রী-সন্তান ছাড়া দিনের পর দিন চরে শীতের রাত পার করতে হয় গ্রামের পুরুষদের। পুলিশের ভয়ে অনেক আগেই কয়েকটি গ্রাম পুরুষশূন্য। ৫ জানুয়ারির ভোটের পর এ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে চলছে যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। গ্রামের পর গ্রামজুড়ে চলছে তাণ্ডব। বিরোধী দলের ভোট বর্জনের ডাক দেয়ার পর সুন্দরগঞ্জের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স পৌঁছেনি। ফলে নির্ধারিত দিনে ভোট হয়নি। পরের তারিখের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একজন হাইব্রিড নেতা ডিজিটাল পদ্ধতিতে লাখ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এরপর ভোট না দেয়ার অপরাধে এসব গ্রামে আসামি ধরার নামে চলছে অভিযান। যৌথবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছেন নবনির্বাচিত এমপির ক্যাডার বাহিনী। রাতের আঁধারে গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কাপড়-চোপড়, অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। এমনকি রান্নাঘরের চুলা, হাঁড়ি-পাতিল ভেঙে চুরমার করে দেয়া হচ্ছে। যৌথবাহিনীর অভিযানের পর বহু পরিবার শুধু মাথা গোঁজার জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন নারী ও শিশুরা।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে যে বিক্ষোভ হয়, তার মধ্যে বড় আকারের বিক্ষোভ হয়েছিল সুন্দরগঞ্জে। এখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে চার পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ ৬০ হাজার লোককে আসামি করে ৩২টি মামলা দায়ের করে। এর পর থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় চলছে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ত্রাসের রাজত্ব। হাজার হাজার মানুষের নামে মামলা দেয়ায় যখন যাকে পাওয়া যাচ্ছে, তাকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতারবাণিজ্য আর পুলিশি অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পুলিশ আসছে এমন খবরে পুরুষেরা গ্রাম থেকে পালাতে শুরু করেন। এক বছরের বেশি ধরে এ অবস্থা চলছে। ১৯ তারিখ রাতে যখন এভাবে আসামি ধরার নামে পাশের এলাকার সরকার সমর্থকদের নিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর ও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়, তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তারা। তারা গাছের গুঁড়ি, বালু, মুরগির বিষ্ঠা আর গোবর দিয়ে সব রাস্তা বন্ধ করে দেন। তাদের উদ্ধারের জন্য রাতে অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি পাঠানো হয়। চলে আরেক দফা ধ্বংসযজ্ঞ। গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মোফাজ্জেল হোসেন তথ্য দিয়েছেন যৌথবাহিনী ১২ শরাবার বুলেট ও চায়নিজ রাইফেলের গুলি ছুড়েছে। ৩০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে নারীরাও রয়েছেন। অষ্টম শ্রেণী পড়য়া গুলিবিদ্ধ এক কিশোর মারা গেছে। সুন্দরগঞ্জের ১১টি গ্রামে বিভিন্ন সময়ে যে অভিযান চালানো হয়েছে, তাতে টার্গেট ছিল সাধারণ মানুষ। শুধু বিএনপি-জামায়াত সমর্থকেরা হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমন নয়। ভাঙচুর করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে। এমনকি প্রতিবন্ধীরাও বাদ যাননি। সাধারণভাবে গ্রামগুলোকে টার্গেট করে অভিযান চালানো হয়েছে। স্থানীয়রা ঘটনার যে বর্ণনা দিচ্ছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যৌথবাহিনীর সাথে আসা লোকজন একেকটি বাড়িতে পুরুষদের খুঁজছে। না পেয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করছে। নারীদের অকথ্য গালাগাল করা হচ্ছে। ১৯ জানুয়ারি রাতে চালানো অভিযানে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া একজন শ্রেষ্ঠ খামারির খামার ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। এর আগে তারেক জিয়ার কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ খামারির পুরস্কার পাওয়া একজনের বাড়ি ও খামার ভাঙচুর করা হয়েছে। তার বাড়ি ভাঙচুরের কারণ তিনি তারেক রহমানের কাছ থেকে একটি ফ্রিজ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
পুুলিশি নিপীড়নের শিকার গ্রামের হাজার হাজার মানুষ এখন মিডিয়ার চোখে জামায়াতের সন্ত্রাসী। বিভিন্ন মামলার আসামি ৬৫ হাজার। একটি এলাকায় যদি অর্ধলক্ষাধিক সন্ত্রাসী থাকে, তাহলে সেই এলাকা বা দেশ চলছে কিভাবে? ১৯ তারিখ রাতের ঘটনার পর মামলার আসামি করা হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষকে। কিভাবে এত আসামিকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে? সুন্দরগঞ্জের এসব গ্রামে আরেক দফা গণগ্রেফতার আর গ্রেফতারবাণিজ্যের পথ খুলে গেল। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন গ্রামের মানুষের কাছে শূন্যের কোঠায়। সাংবাদিকের পরিচয় এখন সাঙ্ঘাতিক মিথ্যাবাদী। স্থানীয়রা টেলিভিশন আর খবরের কাগজে ঘটনার উল্টো বিবরণ দেখছেন। যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস বা নির্যাতনের খবর না থাকলেও খুব সহজেই গ্রামের মানুষকে বানানো হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার। তবে এতে মিডিয়া কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করছে জানি না, তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে জামায়াত। ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দলটি এখন গণসংগঠনে রূপ নিচ্ছে।
সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অভিযানের রূপ আমরা দেখি ভারতের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গের অরণ্য এলাকায়। সেখানেও ভারতীয় বাহিনীর নাম যৌথবাহিনী। এ বাহিনীকে সহায়তার জন্য সালওয়া জুদুম নামে সরকার সমর্থক এক মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়েছে। যাদের কাজ হচ্ছে যৌথবাহিনীর সাথে থেকে আদিবাসীদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে লুটপাট চালানো। কারণ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তারা মাওবাদীদের আশ্রয় দিয়ে থাকেন। আদিবাসী আর মাওবাদীদের সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন যৌথবাহিনীর সাথে সালওয়া জুদুম বাহিনীর মতো ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা সাধারণ মানুষের ওপর এভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের মাওবাদী বানিয়ে যেভাবে ভারতের যৌথবাহিনী অত্যাচার চালানোর পথ নিয়েছে, একই কায়দায় এ দেশের যৌথবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম সাধারণ মানুষকে জামায়াত-শিবির বানিয়ে অত্যাচার চালাচ্ছে।
মাওবাদী দমনের স্টাইলে সরকারের এ জামায়াত-শিবির দমনের অভিযান সাধারণ মানুষকে সরকারের ওপর আরো বেশি ক্ষুব্ধ করে তুলছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে জামায়াত-শিবির কোনো সশস্ত্র গোপন সংগঠন নয়। প্রতিদিন এ দলের লোকদের সাথে সাধারণ মানুষের দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে। তাদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান। তারা সন্ত্রাসী না রাজনৈতিক কর্মী, তা বোঝার জন্য ঢাকার টেলিভিশন দেখে সিদ্ধান্ত নেন না। তাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পুলিশি নির্যাতন ও গণমাধ্যমে প্রচারণা চালালেই তাদের সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসী ভাববেÑ এটি হাস্যকর প্রচেষ্টামাত্র। এ ধরনের অভিযান কিংবা ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাধারণ মানুষের ওপর এ ধরনের অত্যাচারের ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চপর্যায় যেমন নির্লিপ্ত রয়েছে, তেমনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বেগম খালেদা জিয়া যৌথবাহিনীর এসব অভিযানের সমালোচনা করলেও স্থানীয় বা জাতীয়পর্যায় থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার এসব মানুষের পাশে কেউ দাঁড়াননি। যৌথবাহিনী যেসব এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে, সাধারণভাবে এসব এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একসময়ের বামপন্থী বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কিছু দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে মনে হচ্ছে কান্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তিনি যেন ভুলে না যান সুন্দরগঞ্জ কিংবা নীলফামারীর তার দলের হাজারো সমর্থক মাসের পর মাস ফেরারি জীবনযাপন করছেন। শুধু জনসভায় নিন্দা করলে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ ভোট বর্জন করেন। সংগ্রাম কমিটি করে ভোট প্রতিহত করেন। দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, একতরফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার অন্তর্নিহিত যে তাৎপর্য, সেটি অনুধাবন করতেও বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। আদর্শবিচ্যুত বাম নেতারা এ আন্দোলনকে রেডিক্যাল আন্দোলন বলে দূরে থাকার চেষ্টা করছেন। পুলিশের রোষানল, বিলাসী জীবন আর নিজেদের সহায়সম্পদ রক্ষার জন্য আপসের পথে চলেছেন; কিন্তু সাধারণ মানুষ আর নেতাকর্মীদের এখন জীবন আর সহায়সম্পদ দিয়ে খেসারত দিতে হচ্ছে। এ রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য যে মূল্য দিতে হচ্ছে, তার জন্য যদি সামান্যতম সহানুভূতি না দেখানো হয় তাহলে এসব নেতার প্রতি তারা ভবিষ্যতে আস্থা রাখতে পারবেন না। এর ফলে নিপীড়নমূলক শাসন আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে। বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হবেন। নীলফামারীর মতো আরো বহু লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাবে। সাধারণ মানুষের এ লাশের দায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিতে হবে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads